বদরুজ্জামান আলমগীর এর
একগুচ্ছ কবিতা

বদরুজ্জামান আলমগীর এর একগুচ্ছ কবিতা
ক্ষমাসিঞ্চন
আমায় বধ করো– তীক্ষ্ণ নিশানায় অনড় ফলক
বুক পেতে দাঁড়িয়েছি শঙখচিল ভুলের কোরক।
স্থির করো অবিচল চতুর বক্র রাজাদেশ নীতি
অঙ্গে মেখেছি নিমফল ফলবান চাষীর রীতি।
পদতলে দ্বিধা কেন জলপাই রঙ ত্রস্ত নাবিক,
মেঘ ঘষেছে পাথরে মুখ পরিসংখ্যান গ্রাফিক।
নতজানু দেখো মৃত্তিকাদিক তৃণকল্যাণ রোখ
তুমি থাকো অহংকার রূপিনী মৌল অভিমুখ।
বর্শা এবার ছিন্ন করুক চোখে যে আশা আছে
ক্ষমা না করো দেবী আমায় রক্ত ফলার নিচে।।
স্মৃতির রক্তাভা
অচেনা এক যাজক আসে আমার ঘাটে
নোঙর করে মাঠের ওপারে অন্য কারো বাড়ি।
এতোদিন এক স্থবির মঠ ছিল যা
হিলচিয়া বাজারের ঢালুর মোড়ে– রাঙা ঠোঁট
মরিচ গুল্মের পাড়ায়, আজ তা উড়ে এসে
আসন পাতে সরিষার হলুদ ঢেউয়ের পাড়ায়।
ঘুম ঘুম হাডসন জেগে রও ট্রেনের ভিতর
ধুম ধুম এস্রাজে তোলো সুর বুড়িগঙ্গার সতর
তোমার খয়েরি ধূলা এ কেমন রুয়ে দেয় দ্বিধার স্বনন
ডুবসাঁতারে ভাসে কুমার, কুমার এক অন্ধ হোমার।
কার নামে কাটা গাছ এতোটা নুয়ে নুয়ে পড়ে
কার নামে নদী কাতরায় এমন ব্যাকুল
মাছের চোখ কতো ঝুম ঝুম কাঁপে নির্ঘুম
আগস্ট মাসের তীব্র রোদ রূপালি সীসার দিন
কপালে স্মৃতির রক্তাভা বালু খোঁটে পদ্মাগাঙের মীন।
সুরাইয়া কণা
কথা পেড়ে ময়না পাখি, আগুন পুড়ে কথা–
শুকিয়ে যাচ্ছি কথার ত্রাহিতে পড়ে বড়
যে গরম পড়েছে– শুনছি ১০৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের
উপরে উঠবে তাপমাত্রা;
একটা পর্যায়ে গরম আর ঠাণ্ডার পার্থক্য লোপ
পেয়ে যাবে, তাকেই বোধকরি সুফিরা
ফানাফিল্লাহকে বাকাবিল্লায় লুপ্ত হওয়া বলে,
বিপ্লবীরা একেই একটি একনায়কতন্ত্র গুঁড়িয়ে
আরেক নামের ডিক্টেটরশিপে উন্নয়ন বলে।
আমরা ধরে নিয়েছি– মোরগের ঝুঁটির মত
কেঁপে ওঠে একটি দিনের অঙ্কুরোদগম হয়,
যাকে আমরা সকাল বলে ডাকি
নিজের ছায়া ছোট হতে হতে ছায়াটি যেই নাই হয়ে যায়
তাকে আমরা ভর দুপুর বলি–
বটগাছের, তেঁতুলগাছের আগডালে ভুত বসে থাকে
সোমত্ত মেয়েদের বলি– যেও না, ঘরের বাইরে
যেও না এখন– আছর পড়বে, তোমার লুকানো হাসিটি
মটকে দেবে ওরা।
আসলে তো সকাল দুপুর বলে কিছু নেই
স্টিফেন হকিঙের বরাতে বুঝি– সকাল সন্ধ্যা দুপুর
বলে কিছু নেই– একটি প্রবাহ, কাল নিরবধি।
দুনিয়ার কেন্দ্রে চৌকাঠে দোরগোড়ায় কণা
কণাদের সমিতিই দাহ্য গ্রাহ্য দুনিয়া সংসার
এমনও কণা আছে আলবার্ট আইনস্টাইন বোঝেননি,
বোঝেননি সত্যেন্দ্রনাথ বসু–
যে কণা বুঝি না তাকে বসু–আইনস্টাইন কণা বলি,
ব্যাকুলতা মিশিয়ে বলি গডস পার্টিকল– ঈশ্বর কণা;
যে কণা নদীর সাথে নগরের দেখা করিয়ে দেয়
আগুন ও জলের বিভেদ ভুলিয়ে দেয়,
যে কণা বলে আমরা আদতে বুঝি না কিছু
আমরা নিজেদের রোপন করি কংক্রিটে জন্মান্ধ, কানা
বাতাসে পাতারা কাঁপে
সুরাইয়া কণা সময় হিমাঙ্কে ফোটে বিজ্ঞানে, ভাবে, সন্তাপে।
প্রথম বৃক্ষরোপণ
মাছ বাজারে সরল তাজা জিয়ল মাছ খুঁজি
কিন্তু কী আশ্চর্য, নুয়ে দেখি ছুঁয়ে দেখি
কোন মাছটির কানকোর নিচে রক্ত জমে আছে
কে পরে আছে রক্তের নোলক
বড়শির কাঁটাও যে বাঁকা, হাঁপরে নোলক আঁকা।
হাসপাতাল আশা নিরাশার ডেন্ডিলায়ন
একজনমের মায়া মায়া ভুল,
হাতের রাঙা উত্তাপ আর কপালে জমে থাকা ঘাম
মন বাড়িয়ে কোদালে নিজেকে মাটিতে রুই
প্রণমি তোমায় বিরহে আমায় করো না নির্মূল।
স্টেশনে এলে দেখি, বারবার দেখি
সব যাত্রীর মুখে লেগে থাকে বিদায় বলার মেঘ
কারো চোখে জমা আছে রঙের হাওয়াই
মিলনের ফুটে থাকা আবীর, সুস্বাগতম।
সবার ভিতরে দূরাভিলাষী মানুষের ভিড়ে আমি
হোমলেস ভিখারি লোকটিকে খুঁজি–
যে এখনও এই নির্দয় প্রতিষ্ঠা কালে আমাকে
মনে করিয়ে দেয়–
আমারও বুকের ভিতর একমুঠো লেবুপাতা আছে,
পাখির পালকের উষ্ণ কুশিকাঁটায় তোলা আছে প্রাণ
ওখানে এস এম সুলতানের প্রথম মানুষ
একটি শস্যের চারা রুয়ে প্রতিদিন নাই হয়ে যায়।
আল্লাহর মনোহারি দোকান
হেঁটে ইশকুলে যাই– পায়ে জুতা সেন্ডেল নাই; বেশ খানিকটা পথ– মাইল তিনেক তো হবেই। কোনদিন দেওচান্দির ভিতর দিয়ে, কোন কোনদিন বারৈগ্রাম ডিঙিয়ে খনাচ্চর ভেঙে পুরান বাজার পেরুলেই সরারচর শিবনাথ হাই ইস্কুলের হলুদাভ দালান। সিরাজ স্যার সবার পুবদিকের নিচের কক্ষে সিক্সের ক্লাসে তারস্বরে নাম ডাকেন : শরীফউদ্দিন, আকবর আলী, তাজুল, আরিফ, মাখন, সারোয়ার, শামসু, আক্কাস, জয়দেব, পরিমল, আলমগীর, এভাবে আরও কিছু নাম।
আমার ফিলাডেলফিয়ার ছোট ঢ্যাঁড়া থেকে বেরিয়ে খানিক ড্রাইভ করলেই সিটি লাইন এভেনিউ, সিটি লাইনে কয়েক মাইল হাঁকালেই ল্যাঙ্কেশটার সড়ক, সেখান থেকে দুই মিনিট পরে একটু বামে মোচড় দিলেই ল্যাঙ্কেনেউ হাসপাতাল। এখানে সুপরিসর ল্যাবরেটরি লবি– বসে আছি, নার্স নাম ডাকে ম্যাকাফি, স্টাডম্যান, রেকারেম, ওয়াকাবায়াশি, এবিমবোলা, সেমিনভ, আলমগীর, এভাবে আরও নাম, আরও নাম।
আমাদের ছোটকালে বর্ষার নয়াপানি একটু এঁটে বসলেই আমাদের মুখিয়ে থাকার মুখে বালিগাঁও থেকে একটি ছোট ছৈতোলা নৌকার মধ্যে মুরালি, বিস্কুট, ল্যাবেনচুশ, চুলের ফিতা, জরি, মোয়া, ঝুমঝুমি নিয়ে ভাসমান মনোহারি দোকান সাজিয়ে ঘাটে ঘাটে আসে শফিউল। পুরা বর্ষার শেষে আশ্বিন মাসের গোড়ার দিকে নাইমলা পানি বেয়ে আসে শফিউল, কী কারণে জানি শফিউল এবার তার চোখে সুরমার জরুয়া লাগায়, চোখের উজানে দাঁড়ানো আনতারা বানুকে বলে, বর্ষার পানি টান দিচে, এইবছর আজই শেষ আসা– দোকানের মালসামানও শেষ। আমার আর কী দোকান– আল্লাহর কতবড় দোকান, কত তার বুজরুকি– এই যে দেখো, কত রঙ্গের মানুষ কত ঢঙ্গের ঘুড্ডি ফানুস– এরাই তার সওদা।
সবচেয়ে বড় সিরাজ স্যার তো তিনি– রোল কলের খাতা নিয়া বসচেন– যদি আমার নাম তার হিসাবে না উডে এইবার, তাইলে আগামী বছর আবার দেখা হবে– সবই যে নাম ডাকার খেলা! দেখো, মায়া করে চোখে সুরমা লাগাইচি, জরুয়া লাগাইয়া নৌকায় টান দিবো গো সই।
ময়নাবাজি
জন্মান্ধ শিকল বাউল– কথাটি ভাবা মাত্রই
জালালি কবুতর উড়ন্ত রাত্রিও জন্মান্ধ হয়ে ওঠে।
অন্ধ হলে ধূলা ও জল একাকার হয়
কাঠামোর বাইরে একটি কলবের তাজমহল
নির্মিত হয়ে ওঠে– গন্ধের বৈঠকঘর।
মাইজভান্ডারি গানের পাখায় কবরের ভিতর
উড়তে থাকে শিকল বাউল।
লোকগুলো নাচে, আর নাচে আয়নার ভিতরে ময়না
পুরো মজমায় বিজ্ঞানী নাই, নাই কোন বুদ্ধিজীবী
সবাই যোগালি, একা ও একসঙ্গে দূরের রেললাইন
তারা সকলে মিলে গাঁইতিতে দেহ ভাঙে
বাড়ি চুনকাম করে– অন্ধ নগরে আনে বাঁশঝাড়ের মর্মর
গড়বে বলে তারা গাঁইতিতে ঘর ভাঙে।
বদরুজ্জামান আলমগীর
নাট্যকার, কবি, অনুবাদক। জন্ম কিশোরগঞ্জ জেলার বাজিতপুর উপজেলায়। পড়াশোনা– সরিষাপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়, সরারচর শিবনাথ বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়, বাজিতপুর কলেজ, ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। নানা পর্যায়ে পথনাটক, সাংস্কৃতিক আন্দোলন, রাজনৈতিক মুক্তিসংগ্রামে ঘনিষ্ঠাভাবে যুক্ত থেকেছেন; বিভিন্ন সময় সম্পাদনা করেছেন: নাট্যপত্র, সমাজ ও রাজনীতি, দ্বিতীয়বার, সাংস্কৃতিক আন্দোলন, পূর্ণপথিক, মর্মের বাণী শুনি, অখণ্ডিত। প্যানসিলভেনিয়ায় কবিতার আসর সংবেদের বাগান–এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য, বাংলাদেশে গল্প থিয়েটার যাত্রা শুরু করে তারই উদ্যোগে।
প্রকাশিত বই: নননপুরের মেলায় একজন কমলাসুন্দরী ও একটি বাঘ আসে। পিছুটানে টলটলায়মান হাওয়াগুলির ভিতর। আবের পাঙখা লৈয়া। হৃদপেয়ারার সুবাস। নদীও পাশ ফেরে যদি বা হংসী বলো।
বর্তমানে বসবাস করেন ফিলাডেলফিয়া, যুক্তরাষ্ট্রে।
