You are currently viewing আলী সিদ্দিকী’র একগুচ্ছ কবিতা

আলী সিদ্দিকী’র একগুচ্ছ কবিতা

আলী সিদ্দিকী’র একগুচ্ছ কবিতা

আলী সিদ্দিকীর একগুচ্ছ কবিতা

 

টানগুলো টান টান নেই

 

এক সময় ইশতেহার পড়ার নেশা ছিলো

বেশ, চমৎকার ছন্দে লেখা দেয়াল লিখন

টানতো খুব

গ্রাফিতির রহস্য ভেদ করতে করতে রিক্সা

দ্রæ মোড় নিয়ে নিলে আফসোস হতো

রাস্তায় মিছিল দেখলে রক্তে ঝুনঝুনি

বাজতো, হাতপা দিশেহারা হয়ে যেতো

প্রভাতফেরির মোলায়েম ভোরে শহীদী

আতরে ভরপুর হতো বুক

পিকেটিংয়ে পুলিশী হামলা দেখলে

গুলতির কথা মনে হতো খুবসে ছিলো

সারা কৈশোরের একান্ত সঙ্গী

জলপাই ট্রাক পুড়লে আবর্জনা পোড়ার

উল্লাসে হা হা করে উঠতাম

এক সময় কবিতার প্রতিটি শব্দ গায়ে

আগুন ধরিয়ে দিতোস্পন্দিত হতো বিপ্লব

এক সময় আড্ডার টেবিলে তাবৎ পশ্চিমা

মনীষীদের উদগীরণ ঘটে যেতো

আঙুলের ফাঁকে জ্বলা সিগারেট কখনোই

শেষ হতো না

এক সময় মনে হতো আজই বলশেভিক

বিপ¬ ঘটে যাবে দেশেশুরু হবে মাওয়ের

লংমার্চ মাটি কাঁপিয়ে

এক সময় মনে হতো আজ তোমাকে

একবার না দেখলেএকবার না ছুঁলে

কাল আর বেঁচে থাকবো না

কিছুই হয় নি কোথাওবদলায়নি কিছুই

এখন কিছুতেই বুকে রক্ত কলবল করে না

টানে না কোনো দেয়াল লিখনইশতেহার

সুবোধের হারিয়ে যাওয়া সূর্যের গ্রাফিতি

এখন টানগুলো আর টান টান নেই

বদলেছে আমার বেঁচে থাকার আদল

তোমাকে না দেখেনা ছুঁয়ে

বেঁচে আছি পুরো এক শতাব্দীকাল।

 

 

ভাঙচুর, জলের বুদবুদ

 

কিছু কিছু ভাঙচুর খেলা হয়ে ওঠে

ক্ষরণের জবাকুসুম নোনাসমুদ্রের শ্বাস

 মাতাল কুয়াসায় হারায় চেনা পথরেখা

শূন্যময় লগ্নতায়

        বিভোর সময়

                    পাহারায়;

ভাঙনের হৃদপিন্ডে দানা বাধে সুর

কবিতাময় হয় সকল অনুচ্চারিত শব্দ

ভাঙন বিলাপে বনমর্মর চাপা পড়ে যায়।

 

কোথাও কোনো এক অচেনা অন্তর্লোকের

ক্রন্দন

জমাট বরফের নিচে নিরব এক রক্তস্রোত

মৃত্যুহিম বেদনায় মূঢ় হৃদপিন্ড

অজেয় দুঃখের বিষক্রিয়ায় থাকে ম্রিয়মান

গহন কোন অন্ধকারের গ্রাস হবে একদিন।

 

কিছু কিছু ভাঙচুর একেবারে নিয়ন্ত্রণহীন

সময় তার ক্রীড়নক

            জীবন শুধুই জলের বুদবুদ

      এই আছে মোহময় নিমেষে বিলীন।

 

 

স্বপ্ন সজীব করি

 

সযত্নে দূরত্বে রাখি স্বপ্নগুলো

তোমার মতো

থাকি দূরত্বে হতে সকল বর্ণালি উজান,

ভেঙে ভেঙে আপন ইমারত

তোমার আদলে

আমার ভেতরে চলে অনিত্যের নির্মাণ।

 

একান্তই থাকি কোলাহলময়

সুরের নেপথ্যে

আগলে রাখি সমুদয় কিংবদন্তি কথন,

তোমার মাস্তুলেই তো নির্ণয় করি

গহীন গন্তব্য

উন্মূল শ্রাবণে ভাসে উন্মত্ততা চিরন্তন।

 

তোমার মতো সযত্নে দূরে রাখি

জ্যান্ত স্বপ্নগুলো

আত্মজাগরণের সম্পূর্ণ বিপরীতে,

তুমি লেলিহান স্বপ্ন শোকে খোঁড়ো

হৃদয়ের গোর

জাদুময়তায় আচ্ছন্ন মিথ্যের মিথে।

 

নিমজ্জনের কালস্রোত নিরন্তর

বয়ে যায়

তোমার পথ রচনার মৌল প্রয়াসে,

তোমার হৃৎকমলে ফোটে

অনন্তের সুবাস

সৃষ্টি সুখের মহান সজীব উল্লাসে।

 

সযত্নে দূরে রাখা স্বপ্নগুলো সজীব করি

জাগৃতির প্রাক্কালে

লোক সমাজের প্রাণময়তায়,

জেগে আছি এই এক ধোঁয়াচ্ছন্ন প্রহরে

সমতার সুরে লেখা হবে গান

জনপদ উদ্বেল হবে নতুন স্বপ্নময়তায়।

 

 

বিস্মরণের বিবর্ণ এপিটাফ

 

ফিকে হতে হতে সেই কবে মুছে গেছে প্রিয় সব মুখচ্ছবি

হাসির আলো আর আনন্দের সব মাতাল রঙ;

ঘুংঘুরের মিলিয়ে যাওয়া মূর্ছনার মতো

দূরগামী ট্রেনের নৈঃশব্দ্যে মিলিয়ে যাওয়া হাহাকারের মতো

বসন্ত শেষে পাতাদের মূক হয়ে যাওয়া কোলাহলের মতো

সকল মুখরতা অন্ধকার গহীনে নিভৃতে হারিয়ে যাবার মতো;

কবে মুছে গেছে সরব স্মৃতি

আগুনে রচিত পঙতিমালা ছাইয়ের মতো গেছে উড়ে।

 

জমজমাট আর আলোকময় ছিলো কোলাহল মগ্ন

গল্পগাঁথার অপরূপ দিনরাত;

ছিলো প্রেম আর দ্রোহে স্বপ্নময় উড্ডয়নশীল উত্তাল বন্ধনহীন

ছিলো অকুতোভয় দীপ্রতায় নিমজ্জিত উদ্বেলিত প্রাণ

ছিলো বুলেট ছুঁয়ে যাওয়া মৃত্যুহীন শপথের দৃঢ় হৃদয় প্রাচীর

ছিলো হার না মানা অগ্নিময় রাজপথের হিমশীতল বিভীষিকা

ছিলো র্ণ করা দুর্দম ব্যারিকেড ভেঙে গড়া নতুন অধ্যায়;

যে শৌর্য ফিকে হতে হতে আজ বিস্মরণের এপিটাফ

যে গৌরব গ্লানি হয়ে মুছে দিয়েছে সকল অর্জন।

 

আমাদের ছিলো নিগূঢ় বন্ধন শেকড়ে আর রক্তরেখায়

ছিলো চুম্বনে আলিঙ্গনে জোছনা আর সূর্যের সমীকরণ

ছিলো নিঃশ্বাসে আর বিশ্বাসে বারুদমোড়া স্বপ্নের নেশা

ছিলো অন্তহীন উজ্জীবনে মোহগ্রস্ত স্পর্ধিত আহবান

ছিলো তো কিছু সময়োত্তীর্ণ  স্পর্শাতীত রক্তের জোয়ার

ছিলো সমস্ত সীমারেখা মুছে ফেলার স্ফুলিঙ্গের অদম্য উচ্ছ্বাস;

 

আজ বিহবলতার চোরাবালি গিলে ফেলেছে সব আয়োজন

ফিকে হতে হতে হয়েছে তা বিস্মৃতির বিবর্ণ এপিটাফ।

 

 

 

 অর্গানিক রোদবাগান

 

ভালো করে রোদ চুষে নাও, সূর্যমুখী

শেকড়ে জমেছে তমসা

শস্যগোলায় ট্রয়ের ঘোড়া ভর্তি ইঁদুর

সম্ভ্রমহানি হয়ে গেছে তোমার মাটির

          ঘুমিয়ে গেছে দুর্বিনীত দোঁহা

সূর্যের আগুনে হবে নতুন হাতিয়ার।

 

হাওয়া দাপায় বেদম বড্ড আসুরিক

উড়ে যায় অঙ্গনের মেহেদিকুসুম

ছলেবলে বসন্ত লুটে নেয় তস্কর ত্রাস

কোথাও কোথাও বন্য হয়ে যায় প্রহর

         হামাগুড়ি দিয়ে লুকোয় কুটিল

তোমার স্বনির্বাসনের পতাকা উত্তোলন।

 

নাও চুষে সূর্যের যতো প্রাণরস, সূর্যমুখী

অর্গানিক হোক হননশিল্প

বিভ্রমের দিগন্তে এঁকে দাও প্রজ্জ্বলন শিখা

রকমারি মুখোশের পুতুলনাচ হোক ভন্ডুল

                 হাইব্রিড স্পন্দন যাক চুপসে

 

অর্গানিক চুম্বনে পুষ্পিত হোক রোদবাগান।

আলী সিদ্দিকী

কবি, কথাসাহিত্যিক সম্পাদক, মনমানচিত্র

Email: monmanchitra@gmail.com

                            

চট্টগ্রাম শহরের রামপুর ওয়ার্ডে জন্ম ১৯৬১ সালে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে মাষ্টার্স। যুরাষ্ট্রের ডেভরাই ইউনিভার্সিটি থেকে হিউম্যান রিসোর্সেস ম্যানেজমেন্টের উপর মাষ্টার্স অব বিজনেস এ্যাডমিনিস্ট্রেশন ডিগ্রি অর্জন করেন। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের পেনসেলভেনিয়ায় বসবাস করছেন এবং বেসরকারী সংস্থায় কর্মরত আছেন।

 

নব্বইয়ের দশকে সামরিক শাসনপীড়িত সময়ে এবং গণতান্ত্রিক সংগ্রামের আবহে মূলধারার সম্পৃক্ততায় কবিতা কথাশিল্পের ভুবনে বিচরণ শুরু। শেকড়ঘনিষ্টতা, জাগৃতি, বোধ আর মননের নিগূঢ়তায় গড়ে তোলেন সাহিত্যবোধের জীবনসম্পৃক্ততা। মানবজীবনের বিভিন্ন স্তরের মানুষের বিচিত্র সম্পর্কের গ্রন্থিআন্তব্যক্তিক সম্পর্ক, ব্যক্তি সমাজকেন্দ্রিক মানবিক মূল্যবোধ, প্রাত্যহিক জীবনের দ্বান্ধিকতা তার লেখনীর প্রতিপাদ্য বিষয়। সমাজের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জটিল দুঃখময় জীবন সংগ্রাম তার গদ্যের জীয়নকাঠি। ধর্মীয় কুপমুন্ডকতা, অন্ধত্ব আর অমানবিকতার বিরুদ্ধে এবং প্রগতিশীল মানবিক মুক্তচিন্তারর স্বপক্ষে সোচ্চার তার লেখনী। সুদীর্ঘ সময় মুক্তবুদ্ধির চর্চায় সম্পৃক্ত থাকলেও প্রথাবিরোধী লেখক হিসেবে তিনি বরাবরই প্রচারবিমুখ।

Leave a Reply