শব্দকুঞ্জ ঈদসংখ্যা
আহমেদ শিপলু’র একগুচ্ছ কবিতা
আহমেদ শিপলু’র একগুচ্ছ কবিতা
চাবি। মহান খুট অথবা খটাস!
তাহলে চাবিকেই ভেবে নিতে পারি অবতার; যতক্ষণ সে দৃশ্যমান, ততক্ষণ কেবলি একটি নাম। যদিও অনেক নির্ভরতা সংরক্ষণ করে সে। অতোটা নির্ভরতা মানুষ কিংবা ইশ্বরে করেছিলাম বলে তেমন কোনো স্মৃতি নেই। সারাদিন পথে ঘুরে জিজ্ঞাসা শেষে ওই একই উত্তর। তাহলে চাবি সত্যিই নিশ্চয়তা বহন করে! এবং চাবি যখন অদৃশ্য আমারই হাতে, তখনো কি ভীষণ নিশ্চয়তায় মাত্র দুই আঙুল! এমন কি কব্জিও জানে! একটু মোচড়! সামান্য চাপ! খুলবেই, খুলে যায়, খুলে যাচ্ছে প্রতিদিন… এভাবে আমরা
এড়িয়ে গেছি চাবির শক্তি ও তাৎপর্য! কারণ সে কোনো বলিদান চায়নি, কোনো প্রার্থনাও না। না হলে কি করে এমন নিশ্চয়তাকে এড়িয়ে তালাকে ইশ্বর ভেবে বেরিয়ে যাই প্রতিদিন। আর থানাপুলিশ হয়রান! তালা ভাঙা মামলায় দখল পুরো টেবিল! এত এত ফাইল, অথচ তালাকেই ভরসা ভেবে নেয়া! চাবি, যখন ঢুকে যায়, তখন আমাদের শ্রবণে একটিই প্রত্যাশা থাকে, একটিই শব্দ, ক্লিক কিংবা খটাস! অথবা আরও মোলায়েম প্রত্যাশিত খুট! পৃথিবীর সকল ভাষা এখানে আত্মীয়ের মতো।
১৪ নভেম্বর ২০২২
দি লাস্ট ম্যাসেজ অথবা শেষ চিৎকার
পাতা খসে গেলো ডাল থেকে, বাতাস পিঠে করে বয়ে নিল, তবু ঠেকানো গেলো না পতন। মানুষের পিঠ বাঁকা হয়ে গেলে পৃথিবীও ঝুকে যায় কি না! নতমুখী হলে সামনের মানুষের দেমাগ বেড়ে যায়! উত্তপ্ত চেয়ার। কারো কারো পশ্চাৎদেশ এমন তন্দুরি! পা পড়ে না মাটিতে। সেসব ঠেলেঠুলে জাদুঘরে ঢুকে গেলে, দেখি কতো স্থির সেইসব অতীত। আমাকে তুমি ক্ষমা ক‘রো না, কেননা সে ক্ষমতা তোমার তোমাদের দেয়া হয় নি। যে রকম পুরস্কৃত করার। রূগ্ন বিচক্ষণতা শিরোধার্য হলে আদেখলাপনায় মঞ্চে হেলদোল।
ওসবে সত্যিই পোষায় না। ফুল বিক্রি করা মেয়েটির মতো স্বাধীন নও তোমরা। সুতরাং— ছবির হাটে এসো, চা খেতে কোনো চেয়ার লাগে না; একটা বিকেল লাগে শুধু। ঘনানো সন্ধ্যায় এলোমেলো কথামালা স্ল্যাং হয়ে উঠলে কেবল বুঝবে আড্ডার সার্থকতা।
৮ নভেম্বর ২০২২
বিবিধ বিরোধ ||
ভোরের সাথে বিরাট গণ্ডগোল! কারণ সে পরদেশী। পরদেশী বলেই যে গণ্ডগোল, তা ঠিক ঠাহর করতে পারে না সুবেহ–সাদিক। তাহলেতো বিয়ান বেলার সাথে সকালেরও ঝগড়া হতো। এদিকে দুপুরের সাথে সন্ধ্যার ছাড়াছাড়ি। কাঁটাবনে বসে বদনামে ভাসিয়ে দিচ্ছে! যদিও ভাসানোয় পটু বৃষ্টি‘র সাথে শিলার যতটা ভাব, ততটাই বিরোধ রোদ্দুরের সাথে। রোদ্দুর যদিও কবিতায় মশগুল। সব শুনে লাল চায়ে চুমুক দিয়ে কার্তিক বললো সন্ধ্যার সাথে কুয়াশার যেমন ভাব, তা কিন্তু ভোরের সাথেও। সেদিক থেকে কুয়াশা কিন্তু দ্বিচারিণী! অবশ্য তৃচারিণীও বলতে পারো, যেহেতু রাতের সাথেও সমান ভাব। তা‘বলে বহুগামী বলা একদম অনুচিত হবে। সাকুরায় ঢুকে গেছে বিকেল, সে নাকি খুব একা! তাইতো চিরকাল উদাস। ম্লান হতে চায় চুমুকে চুমুকে। ভাসমান জ্যোৎস্নার সাথে অনেকেরই নষ্টি; স্বীকার করে না কেউ। কেবল কবিতায় তাকে নিয়ে তুমুল…
ভরা যৌবনা পূর্ণিমার চোখে যারা চোখ রেখেছিলো, তাদের অনেকেই হয়তো অন্ধ হতে
পারতো। অমন আলিঙ্গন থেকে ছুটে পালায় যারা, তারা শুধু রাতকেই দেখেছিলো। তুফানের সাথে যখন বিজলির প্রেম হয়, মানুষের তখন রাত জাগার পালা। রাস্তাঘাট ভেসে গেলে মেঘের সাথে সূর্যের দূরত্ব বাড়ে খুব। এসব নিয়ে কালবৈশাখীর কোনো ভাবনা নেই, সে আসে মঙ্গল শোভাযাত্রায়, পান্তা ইলিশের সাথে মরিচপোড়ার মতো একাই মচমচে ভাংচুর!
২ নভেম্বর ২০২২
ছক ||
তোমার যাবার কোনো যায়গা নেই, আমারও না। সুতরাং দেখা হয়ে যাচ্ছে। আমরা বলছি না কিছুই। বার বার এবং বারবার কেবল দেখা হয়ে যাচ্ছে। এই যে ঘটছে, এটা নিছক মাত্র। ছকের বাইরে গেলে তুমি আগন্তুক, আমিও। ধরো তুমি চৌধুরী পাড়া, আমি বেইলি রোড। যায় আসে না। ছকটাই আসল, সেটা কারওয়ান বাজার হোক অথবা কাঁটাবন। সবাই যেমন ছক মোতাবেক গোলাপ ফুলের প্রেমিক, তেমনি প্রেমিকাও হতে হয় কেশবতী। ছকের বাইরে গেলেই ভাঁটফুলের দুনিয়া। ওইসব বুনো ঘ্রাণে মন যাদের মজে গেছে, তাঁরা সাধারণত দাঁড়ায় না।
দাঁড়ালেই ছক কাটার কোদাল কাস্তে হজির হয়ে যায়। আমাদের আসলে যাবার কোনো যায়গা ছিলো না, তাই দেখা হয়ে যাচ্ছিলো। অথচ সেসব আলাপের বাইরে রেখে মনরো–সোফিয়ার দুঃখের সন্ধান অথবা সিলভিয়া প্লাথের মৃত্যু রহস্য ঘিরে ফেলেছিলো আড্ডার টেবিল। আমরা কেবল ছক কাটতে ভালোবাসি। ছকের বাইরে গেলেই পাগল অথবা খ্যাপা।
২০ জানুয়ারি ২০২৩
নিখোঁজ সংবাদ ||
ভাইসব! ভাইসব! একটি জিনিস হারাইয়াছে। ভীষণ কোমল ও কঠিন। তাহার রঙ লাল। হারানোর সময় সে একাই ছিলো!
যদি কেহ তাহার সন্ধান দিতে পারেন, তাহলে মঙ্গলবার যে কোনো বিকালে পৃথিবীর যে কোনো বকুলতলায় অপেক্ষা করবেন।
ভাইসব! ভাইসব! মানুষের জীবদ্দশায় সে গড়ে ২৬০০ মিলিয়ন বার স্পন্দিত হয়। কিন্তু এখন সে সাড়াহীন, কেবল একটি কথাই সে শুনতে চেয়েছিলো, একটি জিজ্ঞাসা—’কেমন আছো?’
তার ওজন প্রায় ৩০০ গ্রাম। যদিও স্ত্রীলোকের তাহা পুরুষের চেয়ে এক–
তৃতীয়াংশ কম।
ভাইসব! একটি নিখোঁজ সংবাদ!
মানুষের বক্ষগহ্বরের মধ্যচ্ছদার উপরে ও দুই ফুসফুসের মাঝ বরাবর বাম দিকে সে একটু বেশী বাঁকা হয়ে অবস্থিত। এটি বুকের বাঁমপাশে প্রায় ৬০% অবস্থান দখল করে থাকে। কিন্তু এখন সে ভীষণ অচেনা! তার প্রকোষ্ঠজুড়ে কেবল হাহাকার! কেবল যুদ্ধ! কেবল রাজনীতি!
বাংলার আকাশ বাতাস জানে সে কথা।
ভাইসব! লালচে–খয়েরি রঙের এটি ত্রিকোণা মোচার মত। এর দৈর্ঘ্য ১২ সে. মি.। প্রস্থ ৯ সে. মি.। এটি একটি দ্বিস্তরী পেরিকার্ডিয়াম নামক পাতলা ঝিল্লিতে আবৃত। এর প্রাচীর অনৈচ্ছিক পেশী দ্বারা গঠিত। এসব পেশি হৃদপেশি বা কার্ডিয়াক পেশি নামে পরিচিত। সে এই সেদিনও
একটি সকরুণ চাহনির জন্য অপেক্ষা করেছিলো!
তার চারটি প্রকোষ্ঠ। খালি পড়ে আছে! ভাইসব! সে আজ নিরুদ্দেশ! অথবা মানিয়ে নেয়ার ক্লান্তি ছিলো কোথাও। তার উপরের প্রকোষ্ঠ দুটিকে ডান বা বাম অ্যাক্টিয়াম আর নিচের দুটিকে ডান বা বাম ভেক্টিকল বলে। তার স্বতঃস্ফুর্ত প্রসারণকে ডায়াস্টোল এবং স্বতঃস্ফুর্ত সংকোচনকে সিস্টোল বলে।
ভাইসব! ভাইসব! একটি নিখোঁজ সংবাদ…
১২ জানুয়ারি ২০২৩
আহমেদ শিপলুর জন্ম ১৯৭৬ সালের ১৭ জুন।
তার প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থগুলো হলো: বসন্তের অপেক্ষায় (১৯৯৯), কোথাও তুমি নেই (২০০১), ক্রাচে ভর দেয়া যৌবন (২০০৫), মন পাখিটার ডানা কাটা উড়তে মানা (২০০৯), নির্বাচিত কবিতা (২০১৩), বালিকার আকাশ (২০১৫), প্রজাপতিরা ফিরে গিয়েছিলো (২০১৭), বিষণ্ন ইস্পাত (২০১৮), বিষবৃক্ষের উল্লাস (২০১৮), জিরানো প্যাডেলের রেস্তোরা (২০২১)।
সম্পাদনা: কাব্যকল্প (আবৃত্তির ক্লাসের জন্য সম্পাদিত গ্রন্থ২০১৮), আবৃত্তির শ্রেষ্ঠ কবিতা (২০১৮); নন্দিতা (শিল্প সাহিত্য ও সংস্কৃতির পত্রিকা)