শব্দকুঞ্জ ঈদসংখ্যা
গোলাম কিবরিয়া পিনু’র
একগুচ্ছ কবিতা
গোলাম কিবরিয়া পিনু’র একগুচ্ছ কবিতা
বরফকাল
সাম্রারাজ্য ও শাসনে–কত রক্তের দাগ। ভূখণ্ড
দখল ও আত্মস্থ করার জন্য কত হীন–কৌশল,
কত অভিনয়, কত পোশাক বদল, কত বেদনামিশ্রিত
বিকার–শিকার শিকার খেলা! তাল ও খেজুরের
রস গেঁজিয়ে মাদক তৈরি ও গ্রহণ, উন্নাসিক হয়ে
ওঠে শাসকেরা, বার বার মানবিকতা নিয়ে যায়
হিমাঙ্কের নিচে, বাবুই পাখিও তখন খেজুর
গাছে বাসা বাঁধতে পারে না, বরফের নিচে আটকা
পড়ে পিঁপড়েরাও! এমন পরিবেশে–বসন্ত তো
দূরের কথা, বর্ষাকালও আসে না, সব ঋতু চাপা
পড়ে, আসে শুধু বরফকাল!
শিলাখণ্ড
মৃত্যুকে পরাজিত করতে পারি না বলেই—তোমরা
মৃত্যু ও মৃত্যু পরবর্তী কত রকমের কল্পকাহিনির
মধ্যে আমাদের অন্তর পুঁতে রেখে—জল ঢালো,
কত রকমের ঝোপজঙ্গল তৈরি করো, কখনো
বাঘের ভয়—কখনো সাপের ভয় দেখিয়ে
দেখিয়ে নিজেরা কত রকমের ইচ্ছে মত পোশাক
পরো! আমরা তখন কোনো প্রশ্ন উত্থাপন করতে
পারি না, প্রশ্নেরও উত্তর খুঁজে পাই না!
স্তব্ধ–শিলাখ– হয়ে থাকি একেকজন, জানিনে–
সেইসব শিলাখণ্ডের ঘর্ষণে ঘর্ষণে কবে আগুন
জ্বলবে ও কবে গুহা আলোকিত হবে?
শালিধান
কারো পায়ের কাছে কেউ কাঁপতে কাঁপতে
লুটিয়ে পড়ুক, তা তো চাই না! প্রত্যেকটা
মানুষই একই মর্যাদা নিয়ে সূর্যের তাপ নিক,
ফুলের নির্যাস নেওয়ার অধিকারী হয়ে উঠুক।
পার্থক্য ও বিভাজনে হেস্তনেস্ত করার দিন কমিয়ে
আনার নামই তো সভ্যতা, শালিধান কেন
থাকবে শুধু অভিজাতবর্গের গোলায়!
আত্মবেদ থাকা ভালো–আত্মভেদ নিয়ে বিভোর
হলেই—ভোর দোর পর্যন্ত আসবে না!
বিভাজন
না নিরপেক্ষ, না ন্যায্য—ব্যবধান ও বিভাজনে টেনে
নেয় মহাজন! তুমি ভোগ করো আয়েশ ও ক্ষমতা,
আমি তো তলানিতে পড়ে থাকা নিচুশ্রেণি, গিরিখাদ
থেকে পড়ে যাই, বৈষম্য ও নিপীড়ন সহ্য করতে
করতে কপালের দোষ মনে করি, আর সে–কারণে
এক মোষ তার শিঙ দিয়ে গুঁতোতে গুঁতোতে গর্তে
ফেলে দেয়, আইন ও সংবিধানের সমতা কোনো
কাজে লাগে না!
দুষ্টচক্র
পেশির জোরই শেষ কথা, না হলে ইরাক চুরমার
হলো কেন, আফগানিস্তান বা লিবিয়া! এখন হয়তো
আমেরিকার প্রেসিডেন্টের মাথায় পালকসমেত শিরস্ত্রাণ
না থাকলেও, সেই মহারাজ পৃথিবীর! সেই সশস্ত্র
বাহিনীর প্রধান হয়ে দখল নিতে পারে—ইচ্ছেমত
যে–কোনো ভূখণ্ড! মতামত, জনমত ও পরিশীলিত
জাতিসংঘ–তারই দৈবশক্তির কাছে পরাজিত! সেই
দুষ্ট দমনের নামে দুষ্টচক্রের প্রধান, হিরে–জহরতে
ঠাসা পোশাক না পরলেও—পরচুলা, মোজা ও উঁচু
হিলের জুতো পরে–পৃথিবীটাই কোণঠাসা করে রাখে!
গোলাম কিবরিয়া পিনু , মূলত কবি। প্রবন্ধ, ছড়া ও অন্যান্য লেখাও লিখে থাকেন। গবেষণামূলক কাজেও যুক্ত। গোলাম কিবরিয়া পিনু–এর জন্ম ১৬ চৈত্র ১৩৬২ : ৩০মার্চ ১৯৫৬ গাইবান্ধায়। গাইবান্ধা শহরে মূলত শৈশব–কৈশোর কেটেছে। পড়েছেন গাইবান্ধা শহরের মধ্যপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে, এর পর মাধ্যমিকগাইবান্ধা সরকারি উচ্চ বালক বিদ্যালয়ে, এর পর গাইবান্ধা সরকারি কলেজ হয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাগত যোগ্যতা : স্নাতক সম্মান (বাংলা ভাষা ও সাহিত্য) এবং স্নাতকোত্তর; পিএইচ.ডি. । ১৯৮৩ থেকে ধারাবাহিকভাবে ঢাকায় বসবাস করেন। লিখছেন তিন দশকের অধিককাল। এর মধ্যে কবিতা–ছড়া–প্রবন্ধ ও গবেষণা মিলে ২৬টি গ্রন্থ বের হয়েছে—বাংলা একাডেমি, বাংলাদেশ শিশু একাডেমিসহ বিভিন্ন প্রকাশনী থেকে। বিশ্ববাংলা কবিতা, উত্তম দাশ, মহাদিগন্ত, কলকাতা, ২০১৩, পৃষ্ঠা–১৪৩ কবিতার বই ছাড়াও তাঁর ছড়ার কটি বই আছে। আছে বাংলা নারীলেখকদের নিয়ে গবেষণা গ্রন্থ, যা বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত হয়েছে। এই গ্রন্থে নারীর আত্মপ্রতিষ্ঠা থেকে নারী লেখকদের সৃজনশীলতা ও বাংলা সাহিত্যে তাঁদের অবদান বিশেষভাবে এসেছে। নারী লেখকদের সাহিত্য–ভূমিকা, সৃজনশীলতা, জীবনচেতনা, আত্মপ্রতিষ্ঠার সংগ্রাম ও ভূমিকার বিবর্তন তাৎপর্যপূর্ণভাবে এই গ্রন্থে ধরা পড়েছে । এছাড়া অন্যান্য বিষয়ে প্রবন্ধের বইও রয়েছে। শিশু–কিশোর সংগঠন খেলাঘর–সহ ছাত্র ও রাজনৈতিক সংগঠনের সাথে যুক্ত ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধেও তাঁর রয়েছে ভূমিকা। পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পরবর্তী প্রতিবাদ–কর্মকাণ্ডে যুক্ত ছিলেন, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে গাইবান্ধায় অনুষ্ঠিত প্রথম ছাত্র মিছিলে নেতৃত্ব দান, ১৯৭৫–৭৭ পর্যন্ত হুলিয়া ও গ্রেফতারি পরোয়ানা নিয়ে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত ছিলেন। সে–সময়ে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে কবিতা লেখা ও তা ‘সাপ্তাহিক মুক্তিবাণীসহ অন্যান্য সংকলনে ছাপা। নব্বইয়ের স্বৈরাচার বিরোধী ও ধর্মান্ধ–মৌলবাদ বিরোধী আন্দোলনে ধারাবাহিক ভূমিকা পালন করেছেন। বর্তমানে বাংলা একাডেমির জীবনসদস্য ও এশিয়াটিক সোসাইটি অফ বাংলাদেশ–এর সদস্য। এখনো কটি সংগঠনের সাথে যুক্ত আছেন। জাতীয় কবিতা পরিষদের সাবেক সাধারণ সম্পাদক। বর্তমানে বাংলাদেশ প্রগতি লেখক সংঘের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। দেশ ও দেশের বাইরের বিভিন্ন সংগঠন থেকে পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়েছেন। পেশাগত প্রশিক্ষণ ও অন্যান্য প্রয়োজনে ভারত, নেপাল, শ্রীলংকা, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, আমেরিকা, বলিভিয়া, নেদারল্যান্ডসসহ কয়েকটি দেশ ভ্রমণ করেছেন। ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ পর্যন্ত একটি আর্ন্তজাতিক মিডিয়া বিষয়ক সংস্থা ‘ফ্রি প্রেস আনলিমিটেড’-এর সাথে যুক্ত হয়ে কাজ করেছেন। এর আগে এফপিএবিতে উপপরিচালক (এডভোকেসি), ফোকাল পয়েন্ট ও বিভাগীয় প্রধান হিসেবে কর্মরত ছিলেন। এছাড়া এফপিএবি থেকে প্রকাশিত মাসিক ‘সুখী পরিবার’-এর সম্পাদক হিসেবে ১৯৮৩ থেকে ২০১৪ পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। বিসিসিপি ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানেও যুক্ত ছিলেন। পেশাগতভাবে বিভিন্ন সময়ে সাংবাদিকতা, কলামলেখা, সম্পাদনা ও এডভোকেসি বিষয়ক কর্মকাণ্ডে যুক্ত থেকেছেন।