শব্দকুঞ্জ ঈদসংখ্যা
এলিজা খাতুন এর একগুচ্ছ কবিতা
এলিজা খাতুন এর একগুচ্ছ কবিতা
মহাকালের মানুষ
তখনও প্রবল ঝড় দেখেছি মৌসুমে। জালে পাটাতনে
শ্যাওলা শামুক উঠে আসতো তোয়াক্কা ছিল না কোনো
তখনও জনবিরল পথে খাড়া দুপুরে থমথমে মেঘ
ঘুড়ি ওড়া খেলায় লাটাইসুতো ছেঁড়াছিঁড়ি
দূর আকাশে শকুনের উড়াউড়ি ; তোয়াক্কা ছিল না কোনো
তখনও রুপালী জ্যোৎস্নার গায়ে ধুসর অভাব
নিয়ম করে চাঁদের গায়ে টানা–পোড়েনের দাগ
তখনও নিরবচ্ছিন্ন অন্ধকারে বাদুড় ঝুলে থাকতো
চুরি যেতো বাঁশের বাঁশি ; তোয়াক্কা ছিল না কোনো
বেড়েই চলছিল কার্নিসের শাল্মলী তরু
গাঢ় থেকে গাঢ় হচ্ছিল তার অযাচিত সবুজ
তোয়াক্কা না–হতে হতে দেখি অভাবেরা জমাট কঠিন বরফ
তখন থেকে হিম হয়ে আসা হাড়ের ভেতর নিরেট বঞ্চনা
স্নায়ুর আশপাশে বোধের মতো তখনও কেউ কেউ ছিলো
কেউ কেউ থাকেই, অনেকেই থাকে, জমে ওঠে ক্রমশ…
সত্যই কি তবে নগরবিলাসী আস্তাকুঁড় সব একাকার হবে
মানুষ জেগে ওঠা বানে !
লাল হতে থাকলে
কতিপয় দ্রব্যের ঘ্রাণ–এলার্জি স্নায়ুর স্বাভাবিকতাকে
ঘায়েল করতে উঠে পড়ে লেগেছে ! নাকি আমিই অমন
দ্রব্য–দ্রষ্টব্যে অতি অস্বাভাবিক ; এমন আলোচনার–
সমাধান হতে না হতেই, ছিটকে সরে আসি
মশার কয়েল থেকে নির্গত ধোঁয়ার বলয় থেকে
সাম্প্রতিক সৃজনশীল কাজে নিবেদিত কতিপয়
বরেণ্য–দাঁতের বিকৃত হাসি গায়ে মেখে দিব্য বিনয়ী ও
সহনশীলতার তকমা লাভ করে চলেছে কেউ কেউ
কারো কারো গলায় তাদের নিজস্ব ক্রয়ে উত্তরীয়র অদ্ভুত–
রং থেকে সহস্র আলোকবর্ষ দূরত্বে ভ্রমণ করতে করতে
এসে গেছি টমেটো ক্ষেতের পাশে
এদিকে আমার মুঠোফোনের পর্দায় অনবরত নাগরিক রং
উঁকি দিয়ে দিয়ে ব্যর্থ হচ্ছে দেখে
প্রকৃতিমগ্ন আমার আনন্দমুহূর্ত একে একে যোগ হয়ে যাচ্ছে
টমেটোর রঙের সাথে ; পোক্ত আর টকটকে লাল হয়ে উঠলে
অমন রং প্রত্যাখ্যান করা খুব সহজ নয় !
খবর না পাঠানো অভিযোগে
প্রায়শ জানাতে ইচ্ছা হয় আগামী সাধের কথা,
গন্তব্যে পৌঁছে যাবার আশা, শস্যের ভাষা
ভিটে–মাটি–ক্ষেত, বৃক্ষ–শেকড়ের কথা
নাগরিক ভিড়ে মানুষের অবয়বে কী বিচিত্র রং
কারো কারো আলাপে ক্রোধ মিশেল, কোন কোন সংলাপ
মৃত্যুর কালো থাবা, কিছু কিছু তত্ত্বে অমঙ্গল–ধ্বনি
তোমাকে লিখিনি এসবের কোনোকিছু
জীবনের দাবি মাখা খবর পাঠিয়েছি কতভাবে !
এখানে কারফিউ তবু জীবনের ঢল
যখন দেখি অযুত চোখ তুষারের মতো স্বপ্নমাখা
সেইসব পাঠিয়েছি বাতাসের খামে
তোমাকে লিখেছি কন্ঠা চুয়ানো বিশ্বাসী ঘাম–কথা
কালিঝুলি মাখা উত্তাল হাতের কথা
তোমাকে লিখেছি দেয়াল ভাঙার পংক্তি । দ্বিধার বাকল–
খসে পড়া শাখায় গজানো নতুন পাতার কথা
লিখতে পারিনি মুমূর্ষু রোগীর শয্যা না পাওয়া তথ্য
শ্বাসকষ্টে অক্সিজেনের তুমুল কাড়াকাড়ি
লিখতে পারিনি লাশ ফেলে আসা গল্প
লিখতে পারিনি শ্বাসের উপর হাঁটু চাপার বিভৎসতা
এসব কথা লিখতে গেলেই কলমের মুখে নেমে আসে
নিদারুণ ক্ষোভ, স্নায়ুর তীরে বাঁধে বিক্ষোভ–দানা
এভাবে কি রোজ খবর লেখা হতে পারে !?
বিড়াল ও আয়না
যেহেতু সে দ্বিধান্বিত
যেহেতু তার নিঃশব্দ পদক্ষেপ
যেহেতু তার গমনের অর্থ গোপন আর ঔদ্ধত্য
আর শিকারে সে তার সুচতুর মেধা দেখাতে পারে
তাই চলাফেরার মধ্যে
কখনও সে আয়নার সামনে এসে গেলে
দেখে নেয় নিজেকে ;
নিজস্ব অবয়বে কতটা ক্রোধ প্রকাশিত হলে
বিড়ালের বিম্বকে বাঘের মতো দেখায়
ভাবতে চেষ্টা করে সে
এমন সময় তার স্বরে উচ্চগ্রাম যোগ হতে হতে
বালখিল্য সংলাপ যদি জমে ওঠে আয়নার সম্পূর্ণ কাঁচে
অথবা
যদি মিউ মিউ শব্দটি হাউমাউ তে পরিণত হয়
দূরের দৃষ্টির কাছে প্রতিষ্ঠিত বিড়াল কি বাঘ হয়ে ওঠে !
এলিজা খাতুন, ১৯৮১ সালের ২রা ফেব্রুয়ারী চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার অরুণবাড়ী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। মহানন্দা নদীতীরে বেহুলা গ্রামে পৈত্রিক বাড়ি, বাবা– মো: মাসদুল হক, মা– মোসা: মাসকুরা বেগম। খুলনা ভিক্টোরিয়া স্কুলে প্রথম লেখাপড়া শুরু। সর্বশেষ জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে এম.এসসি গণিত বিষয়ে পড়াশোনা। সাতক্ষীরা জেলা সদর মেহেদীবাগে বসবাস। একটি মানব–সেবাধর্মী প্রতিষ্ঠান Ôঋশিল্পী’র হস্তশিল্প বিভাগে এক্সিকিউটিভ–এইচ.আর পদে কর্মরত। প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ– নৈঃশব্দ্য ছোঁয়া জল (২০১৭), মধ্যরাতের খামে (২০১৮), ভাঙনকাল (২০২০), শ্রাবণ জানালা (২০২০), আরাধ্য পথের দিকে (২০২০) এবং গল্পগ্রন্থ – বর্গামাটি (২০১৮), ভাটির টানে (২০১৯), আগুন গোঁজা মাটি (২০২০) সম্মাননা : উতল হাওয়া সাহিত্য সম্মাননা(পশ্চিমবঙ্গ)
ইমেইল : alizasat335@gmail.com