শব্দকুঞ্জ ঈদসংখ্যা
মিলি রায় এর একগুচ্ছ কবিতা
মিলি রায় এর একগুচ্ছ কবিতা
দিনলিপির পাতা থেকে
যৌথ বৈকালিক ভ্রমণ কিংবা চায়ের আড্ডায়
আফিম খাওয়া পুঁজিবাদ নিয়ে
আমিও দু চারটে কথার খই ফুটিয়েই ফেলি
কথার ভেতর কিছুটা সত্যি মিথ্যে মিশিয়ে দিয়ে
রেখে দিই আলগোছে।
সঙ্গী হই ভোগবাদ আর সুবিধাবাদ বিরোধী শাণিত মিছিলে
কণ্ঠ মেলাই সোচ্চারে,
পায়ে পা মেলাই কিছুটা পথ
তারপর,
অন্তস্থ বেদনাবোধ বৃত্তের পরিধিতে আটকে
রেখে আসি সযতনে, সনাতন গলি মোড়ে
নীরবতার প্রাচীর তুলে অধোমুখে সং সেজে
বিনীত মুখ লুকিয়ে নিই নিঃশব্দ অন্ধকারে।
রাত ন‘টা বাজলেই ঘাড় থেকে ঝুলে পড়ে ধড়
উপচে পড়া ক্ষিদেয়
বুকের আগুন, চোখের গরল মাটিতে ফেলে
নিঃশব্দে গিলে যাই জীবিকার খাবার
পতঙ্গ প্রবণ আমি অতঃপর ঠোঁট ডুবাই
সাতপাঁকে বাঁধা একান্ত বাধ্যগত ঠোঁটে
অথবা মিশে যাই
কাগজ কলম কিংবা মোবাইল রিংটোনে।
বাতাসের হাত ধরে নিরুদ্দেশ হওয়া হয় না আর
আটপৌরে, এক চিলতে সেলুলয়েড জীবনে।
প্রতীক্ষার প্রহরে
আমার কবিতায় প্রেমের পদাবলী হও তুমি
ষড়ঋতু হাতে নিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে আছি
অনন্ত পথের ধারে
তুমি আসবে বলে
মাতাল শিশিরে মুখ গুঁজে দিয়ে
ম্যাপল পাতার মতো অলস পড়ে আছি
উৎসর্গীকৃত মহাকাল মাঝে রবিবাসরীয় প্রহরে।
সবুজ আমের মতো ভোরের কাঁচামিঠে নরম আলোয়
নির্জনতা ভেঙে নেমে আসছে আশ্চর্য পাখির দল
তিরতিরে একফালি সুখের হাওয়া
বয়ে যাচ্ছে আ–শরীর জুড়ে চন্দ্রবিন্দু জীবনে
ঝুপ করে ভাঙছে বুকের পাড় মৃন্ময়ী ঘ্রানে।
হিজলের জলে মুদ্রিত নীলে
সান্ধ্য সাধনার সংহিতা‘য়
জুড়ে যাচ্ছে ভালোবাসার রাগীনি সুবর্ণ শব্দবন্ধে
নববধূ মেঘে জলছাপ এঁকে যায় মন্দাক্রান্তার সুর
উজান স্রোত ভাসিয়ে নিয়ে যায় অমোঘ লক্ষ্যে।
ভেসে যাচ্ছে সময় গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে
সন্ধ্যা নামছে ধীরে, সাদা বকের দীঘল ডানায়
একটা বিকেল ক্লান্ত হচ্ছে তরুবীথি ছায়ায়
শরীরের ছায়া পড়ে জানি,
মনের ও কি ছায়া পড়ে
অনুভবের সীমানায়?
শঙ্খ
ফাগুনের বাতাসে ধূপগন্ধী উদোম সন্ধ্যা
বৃষ্টি নামে, লাজুক লতার গায়ে বইছে তুমুল হাওয়া
আহা! স্বপ্ন দেখছিলাম আমি।
যারা পাথর কেটে প্রাগৈতিহাসিক ফসিলে
এঁকে দেয় আমার মুখ
নাক মুখ চিবুকে রক্ত ঝরায় শিল্পিত ছেনি
যন্ত্রণাকাতর পরিশুদ্ধ অবয়ব নিয়ে
আমি তাদের ছায়া কুড়োই, পাশে গিয়ে বসি
দৌড়াতে গেলে হোঁচট খেয়ে পড়ি
কাঁচ বিঁধে যায় পায়ে।
যারা মাটি পুড়িয়ে পুতুল গড়ে
আমায় তারা বাড়ি নিয়ে যায়
ছাঁচে ফেলে দেশজ রঙের ঘোর মিশিয়ে
ফুটিয়ে তোলে আমার ক্লান্ত ম্রিয়মাণ দুচোখ
তেঁতুল বীজের আঠায়।
তপ্ত প্রহরে দিগন্ত ও কেঁপে কেঁপে উঠে
আমার সুচিক্কণ পিঠ পেতে দেয় আগুনে
নিজের পোড়া দাহগন্ধ শুষে নিয়ে
অতঃপর, উদ্ভিন্ন সংহিতা আমি
হাটে গিয়ে নিলামে উঠি
দাঁড়িয়ে থাকি ক্রেতার খোঁজে ধ্রুপদী পসরায়।
সবশেষে শঙ্খ কারিগর আমায় হাতে তুলে নেয়
ফুঁ দেয় সুতীব্র বাতাসের
পাঁজরের হাড়ে বেজে উঠে বিষ্ণুপুরি গান,
প্রতিমা হৃদয় শুধু জানে
সমর্পণের বেদীতে বন্দী ফসিল হৃদয়ের তান।
বিস্মরণের ফাঁদে
মাঝে মাঝে বোধগুলোকে ভিজিয়ে দেয়ার জন্য ও
হিমবাহের মতো আদিগন্ত নির্জনতায়
ডুবে যেতে হয়
পথ হারাতে হয় চেনা পথের বাঁকে।
আত্মনিমগ্ন দু অক্ষর কাব্য
পা রাখছে ধীরে ধীরে
ঘাসের ঠোঁটে জমানো বিন্দু বিন্দু শিশিরে।
সময়কে পেছনে ফেলে
মহুয়া বনে, উচ্ছ্বসিত কুসুমে কুসুমে
কচি পাতাদের নবসংকলনে
প্রকৃতি নেচে উঠেছে নিজস্ব লয়ে
চারিদিকে তারই আগুনে আভাস।
নীলাদ্রির চিবুক বেয়ে
চুঁইয়ে পড়া প্রতিটি রঙের ফোঁটা
নিজেকে সমর্পণ করছে নদীর জলে,
দোল পূর্ণিমার মায়াবী চাঁদে
উচ্ছল মাছেদের খলবলে খুশিতে
প্রাণের জিওন কাঠি।
বুনো ঝোপের নির্বাক ঘ্রাণে
ঝিম ধরানো ভালোলাগায়
ভালোবাসার আঁচড় পড়ছে ক্রমাগত
কিশোরীর উচ্ছল হাসির মতো
বাতাসের আবছায়ায় আজ সমুদ্র গন্ধ।
কথাগুলো না হয় আজ যাক নির্বাসনে
কিছু কিছু নিমন্ত্রণে একাই যেতে হয়
খুলে রেখে দুঃখ পোশাক নিবিড় সন্তর্পণে।
নৈঃশব্দ্যের নেপথ্যে
কপিলাবস্তু অবধি থেমে গেলে সব কোলাহল
রূপ বদলের অপরূপ সন্ধিক্ষণে
চিঠি পড়া ধ্রুপদী প্রহরে
মহুয়ার মাদকতা গিলে খায় ফেরারি ফাগুন।
নরম আলো ঢেলে দেয়া বিদিশা রাতের আলোক ধাঁধায়
দৃশ্যমান তারাদের মুদ্রিত স্বপ্নের কোলাজ
একাকী হেঁটে যাই প্লাবনমগ্ন নক্ষত্রদের ভিড়ে
নির্বিকল্প নিবিড় ছায়াপথ ধরে।
পৃথিবীর সমস্ত সৌন্দর্য থেকে, আকাশ থেকে, পাহাড় সমুদ্র মন্থনে
নৈঃশব্দ্যরা এসে জড়ো হয় সত্তার গভীরে
প্রস্তরীভূত স্মৃতির বেলাভূমি বাজে নীল ধ্রুবতারা মাঝে।
এ–ই তো সেদিন সবুজ আলোর ভেতর
নিমগ্ন বিভোর ডুবে ছিলাম দুজন
প্রাণের সফেদ তরঙ্গ গড়িয়ে নামতো ক্ষুধা তৃষ্ণাহীন
প্রেম নয়,কথা নয়, শব্দ নয়
শুধু,রাতের ব্যুহ ভেদ করে ছেঁড়া আলোর কুচি
খুঁটে নিতো চড়ুইটি অবিরাম নিদ্রাহীন।
ভালোবাসা যেখানে নিখাঁদ, বিশ্বাস সেখানে সমুদ্রসম গভীর
আর
ঘৃণার বাকিটা ঐশ্বর্য।
মিলি রায়।জন্ম ফেনী জেলা শহরে।এস এস সি, ফেনী সরকারি উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়।এইচ এস সি ফেনী সরকারি কলেজ।অনার্স ও মাস্টার্স কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ। প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ: তোমার শহরে আমার প্রেমিকারা(২০২৩)