You are currently viewing শব্দকুঞ্জ ঈদসংখ্যা। গল্প: ভালোবাসার রঙিন ঘুড়ি-আশরাফ উদদীন আহমদ

শব্দকুঞ্জ ঈদসংখ্যা। গল্প: ভালোবাসার রঙিন ঘুড়ি-আশরাফ উদদীন আহমদ

শব্দকুঞ্জ ঈদসংখ্যা

গল্প
ভলোবাসার রঙিন ঘুড়ি
আশরাফ উদদীন আহমদ

গল্প

ভালোবাসার রঙিন ঘুড়ি

আশরাফ উদদীন আহমদ

 

হাট গোদাগাড়ীর ভাঙাপুল তার নীচ বরাবর সুতোর মতো চিকন খাল। খালের ওপারে মহিষতলী গ্রামের ভেতর দিয়ে যেতে গিয়ে খানিক থামে ময়জান বেওয়া। চালের বস্তা কাঁখ থেকে নামায়। আঁচল টেনে মুখঘাড় গলা মোছে সে। রোদের তীব্র ঝাঁঝ আগুন ধরায় সর্বাঙ্গে। ম্যাঁড়ম্যাঁড়ে পানসে জীবন নিয়ে মাজা ভাঙা ঢোঁড়া সাপ যেন। শরীর আর পারে না এতো ধকল নিতে। তবুও ভূতগ্রস্ত মাতাল সে আজ। মহাফাঁপড়ের মধ্যে দিবানিশি ফানুষের মতো উড়ে বেড়াচ্ছে এবং কঠিন সময়ের কাছে নির্বাসিত ডিঙ্গি যেন। ঔজ্জ্বল্যহীন ওই বিশাল আকাশের শুকতারা কি না তাও ভাবতে পারে না। বেঁটে ঝাঁকড়া আমগাছের নীচে বসে পড়ে একসময়। বড় ভালো লাগে ছায়াছায়া জায়গা। কতো দূরের পথ তাকে পাড়ি দিতে হবে এখন।  আকাশের দিকে তাকানো যায় না কিছুতেই। একটা নেড়ি কুত্তা ছুটে যায় ময়জান চালওয়ালীর পাশ দিয়ে। কিছু দূরে গিয়ে কি মনে করে একবার থামে, তারপর ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে আবার চোঁচাদৌঁড় দেয় কুত্তাটা। ময়জান এক মুহূর্ত তাকিয়ে আবার হাঁটতে থাকে।

 

ফাজু শেখের লোকেরা বড় দেরি করলো আজ। ময়জানের মুখ দিয়ে বিয়ের প্রথম রাত্রের গল্প শোনার কি আগ্রহ ওদের। ফাজিলনাছোরবান্দা সব শুনবে বাসর রাত্রের রসাত্মক গালগল্প হাসি তামাশার বৃত্তান্ত। ওদের কারণে এখন মাথার ওপর কড়া রোদের অত্যাচার। কাঁখে বস্তা নিয়ে হাঁটতে হচ্ছে তারপরও। নয়তো কোন সকালে কাঁকনহাটে পৌঁছে যেতো সে। হাটবারের দিন একটু সকালসকাল না গেলে সুবিধামত জায়গা পাওয়া যায় না। কতোরকমের মানুষের কতো রকম ফন্দিফিকির। সবই বোঝে ময়জান, এই তো দুনিয়ার হালচাল। দিনে দিন মানুষ বাড়ছে তো বাড়ছেই আর মানুষের চাহিদাও ধেঁইধেঁই করে মাথার ওপর উঠছে। সবাই শুনতে চায়—  জায়গা দাওভাত দাওভালোবাসা দাওবেঁচে থাকার নগদ রুপিয়া পেতেই ব্যস্ত।

ফাজু শেখের লোকেরা বড় বেশি খচ্চর। খসলতই ওদের ওমন, মেয়ে মানুষের  মুখ থেকে রসরঙ্গের কথা শোনার আগ্রহ দেখে ময়জান হাসি সংবরণ করতে আর পারে না। তারপর কতোক ছোড়া বিয়েথাও করেনি। অবিবাহিত হলেও মেয়ে মানুষের শরীর সম্পর্কে অজানা নেই ওদের। আজকালকার ছেলেছোকরাগুলো কতো সহজে শুধুমাত্র টাকার বিনিময়ে মেয়ে মানুষের তাবৎ শরীরখানা অবলোকন করতে পারে। রহস্যময়ী জিনিসটা আর রাখঢাক নেই কোথাও তেমন। তবুও নতুন মুখে একটু রসটসের কথা শোনার আগ্রহ খায়েস ঢেকে রাখে কি করে! চলতি পথে বাড়তি আর্কষণ দুটোই প্রবল টানটান উত্তেজনা ছড়ায়। ময়জান সবই বোঝে। ওদের চোখ মুখের ভাষা বড় পরিস্কার, কি চায় তাও আন্দাজ করতে বিলম্ব হয় না। প্রকৃতির এই কারসাজি সবই জানা।

 

আবার চালের বস্তা মাথায় নিয়ে ছোটে ময়জান। পিরিজপুরপ্রেমতলী পার হলেই তবে কাঁকনহাটের সড়ক পাওয়া যাবে, সেই ভাঙাচোরা মাটির এবড়ো থেবড়ো যাচ্ছেতাই পায়ে চলা সড়ক। নছিমন রিক্সাভ্যান গরুগাড়ি যাওয়া মাটির সড়ক ভেঙে আরো বেহাল দশা। এবড়োথেবড়ো গর্তটর্ত আর আগাছা পরগাছা পরিপূর্ণ সড়ক ধরেই মানুষ ছুটছে ধান্ধায় নিজের প্রয়োজনে। এভাবেই মানুষকে যেতে হয়, বেঁচে থাকার জন্য তার এই চলা।

মাথায় চালের বস্তা নিয়ে হাঁটতে বড় কষ্ট হয় ময়জানের। কিন্তু এছাড়া আর কি বা করবে। তাকে তো এভাবেই পথ চলতে হবে চিরকাল। পথের সাথে এই তো তার ভালোবাসা! সমস্ত উচুঁনীচু পথ মাড়িয়ে জীবন সংগ্রামের সঠিক গন্তব্যে পৌঁছাতে হবে।  জীবন তাকে মুক্তি দেবে না কখনো। এদিকে বেশ চড়চড়িয়ে বাড়ছে বেলা। যতোই বেলা বাড়ছে ততই দুঃচিন্তা ধেঁইধেঁই করে বেড়ে যাচ্ছে মাথার মধ্যে। বুকের ভেতর ধুঁকপুক করছে এখন তার। অকস্মাৎ লক্ষ্য করলো ময়জান, ওপাশের নোতুন নির্মিত সাঁকোটা পার হয়ে জমির আলপথ ধরে সাইকেল ঠেলে আসছে কেরামত গাজি। সাইকেলের পেছনে মুরগীর ঝাঁকা, মুরগীগুলো কক কক করছে ভাঙা মাটির সড়কের ধাক্কা খেয়ে। ঝাঁকার জায়গার তুলনায় মুরগী অনেক বেশি নেওয়ার কারণে ওদের বড় কষ্ট হচ্ছে অনুমান করে ময়জান। একসময় ময়জানকে সামনাসামনি দেখে একটু থামে। ঈষাৎ হাসিটুকু ঠোঁটের আগায় রেখে কি একটা কথার রেশে টেনে মুহূর্তে নির্বাক হয়ে যায়। মাটির ঢেলার ওপর তখন একটা ফিঙে কি যেন খুঁজে যাচ্ছে, হয়তো পোকা মাকড় হবে। দূরে কয়েকটা গরু ঘাসে মুখ ডুবিয়ে গোগ্রাসে গিলছে অনবরত,কোনোদিকে ওর খেয়াল নেই। একটা কালো গরুর পিঠে এবং শিংয়ের ওপর দুটো কাক, ওপাশে খালের জলে মুখ চুবিয়ে মাছরাঙা ছুটে উড়ে যায়। অনেকক্ষণ পর ময়জান শুকনো হাসি ফেলে বলে, কেমন আছো কেরামত ভাই ?

ঠোঁট উলটে উত্তর দিলো, আর থাকা না থাকা, ওই আছি একরকম!

 

ময়জান মৃদু রশিকতা ঝরিয়ে জানাই, কি হলো এতো শিগগির চৈতন্যদেবে পেলো যে তোমাকে

কাঁখের চালের বস্তা ঘাসের ওপর নামায় একসময়। আর কেরামত আলী সাইকেল ষ্টান্ড করে একপাশে।

দূরের আকাশে কতোগুলো পাখি উড়ে বেড়াচ্ছে। অনেকটা সময় পরে কেরামত একটা নিশ^াস ফেলে, তোমাকে দেখলে বড় কষ্ট হয়, কি করবো আমি বা, তোমার বাপভায়েরা জেনে শুনে কি না

Ñনা না ওরা তো কিছুই জানতো না, কেউ কি জেনে শুনে ওমন কালব্যাধি রোগীর সঙ্গে বিয়ে দেয়

Ñতোমাকে আমার আর পাওয়া হলো না। তাতেও কষ্ট নেই, কিন্তু দুঃখ হয় তোমাকে দেখলে, সোনার প্রতিমার মতো ময়জান আজ কেমন পাঁকাঠির মতো জীর্ণশীর্ণ শরীর নিয়ে কেন্নো যেন। সব কেমন গুলিয়ে যায়।

Ñভাগ্য বলে তো একটা ব্যাপার আছে কেরামত ভাই। আমার ভাগ্যটাই হয়তো এমন। আমি হয়তো হতভাগী সাতকালের

Ñনা না ওমন কথা বলো না, শুনতে ভালো লাগে না।

Ñভালো না লাগলেও সত্য যেটা, সেটা সত্যই।

Ñকিসে সত্য আর কি যে অসত্য বুঝি না বাপু!

Ñতা ভাবী কেমন আছে

Ñওর আর থাকা, এবারের বাচ্চাটাও তো রাখতে পারলো না। বিধির কি খেলা দেখো, রোগে শোকে একেবারে বিছানাগত।

Ñভালো ডাক্তার দেখাও, শহরে নিয়ে গাইনি

Ñতা হবে, কিন্তু তুমি তো আজ বেশি দেরি করে ফেলেছো, রিক্সাভ্যান দেখো।

হাসি মুখে ময়জান বলে, সে কথা আর বলো না।

হাসিটুকু কেরামত আলী ধরার চেষ্টা করলেও পরক্ষণে মিলিয়ে যায়। Ñনা ভাই আজ আর কথা নয়

ময়জান চার সড়কের বাঁকটা ধরে কিছুসময় দাঁড়িয়ে থাকে। তারপর আবার হাঁটতে থাকে ধূঁসর ধুলো উড়িয়ে। রোদটা মাথার ওপর মিচকি হাসছে অনবরত।

কেরামত আলী তন্ময় হয়ে তাকিয়ে থাকে ময়জানের চলে যাওয়ার পথের দিকে।  কতো বড় বংশের মেয়ে আজ পেটের দায়ে অভাবে পড়ে চালের বস্তা মাজায়কাঁধে বয়ে হাটে বাজারে যায়। খুনকার বংশের গরমে একদিন ময়জানের বাপভায়েরা কেরামতের বাপমাকে অপমান করে তাড়িয়ে দিয়েছিলো বাড়ি থেকে, তার জন্য ময়জানের কোনো দোষ দেয় না। ময়জান তো প্রাণ দিয়ে ভালোবাসতো, পালিয়েও যেতে চেয়েছিলো অথচ কেরামত রাজি হয়নি। বলেছিলো, বিয়ে করবো দু পরিবারের সম্মতি নিয়েই জানিয়ে শুনিয়েই করবো

ফল হলো তার উল্টো। খুনকার বংশ রাজ বংশ। তাদের মান ইজ্জত নাকি আকাশছোঁয়া। খুনকারেরা নাকি সাচ্চা মুসলমান। তাদের মধ্যে ইমানের কোনো খাদ নেই। অর্থাৎ কেরামতের সঙ্গে ময়জানের বিয়েটা হয়নি বংশমর্যাদার  গর্বের কারণে। কেউ কারো অপরাধ না খুঁজলেও সবই নিয়তির ওপর সঁপে দিয়েছে, তবে কেরামত বোঝে যথেষ্ট অভিমান আছে ময়জানের। বুকের মধ্যে অনেক কথার বিষ, দংর্শন করে দিবানিশি। অথচ কথারা গুমরেগুমরে মরে, ঠোঁট পর্যন্ত কোনোদিন অনুরণিত হলো না তার আর। এখন ওসবে তেমন আর পাত্তাও দেয় না ময়জান। নিজের কষ্ট নিয়ে নিজেই আছে ভেজা মাটির মতো। এভাবেই হয়তো মানুষ বসবাস করে নিজের সঙ্গে, নিজের ভেতর।

 

কেরামত একসময় সাইকেল চালিয়ে চলে যায় মন্থর গতিতে। ঝাঁকাতে মুরগীগুলো কলরব তুলছে এখনো। দূরে যাওয়ার আনন্দে নয়, বেঁচে থাকার প্রয়োজনে। সেদিকে কেরামতের কোনো মাথাব্যথা নেই এখন। সুলতানগঞ্জের মানুষ আর বিদিরপুরের মানুষের মধ্যে ব্যাপক ফারাক আছে। কেউ কাউকে সহৃ করতে পারে না। লোকে বলে দুঅঞ্চল সীমান্তলাগোয়া হলেও সতীনসম। উভয়েই একই পেশায় বলেই ব্যবসার রেশারেশি থেকেই দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে, তারপরও ময়জান তো ভালোবেসেছিলো বিদিরপুরের মানুষকে। পেছনের ছবিগুলো কখনোসখনো কাকতালীয়ভাবে চোখের সামনে ভেসে ওঠে, ভেসেভেসে আবার ডুবে যায়। ডুবেডুবে আবার হয়তো পানকৌড়ির মতো একসময় ভুস করে ওঠে। কি চমৎকার খেলা! যে খেলার কোনো শেষ নেই। জন্ম জন্মান্তর ধরে চলছে। আরো চলবে, চলতেই থাকবে।

বারেকখালি প্রাইমারী স্কুলে যখন ময়জান পড়তো, সেসময় আসতে যেতে দেখা হতো কেরামতের সঙ্গে। সেই থেকেই একটু একটু ভালো লাগা। আজ ঘরে ময়জানের কোনো সুখ নেই। বাপ ভায়ের সংসারে এলেও কেউ ওর দায়িত্ব তুলে নেয়নি। আর সে কারণে রাস্তায় নামতে হয়েছে, তাছাড়া কে বা কাকে স্থান দেয়। তাদেরই টানাপোড়েনের সংসার। নুন আন্তে পান্তা ফুরায় অবস্থা। নাই নাই খাই খাই গুষ্টির মধ্যে ময়জান আরেক গলার কাঁটা। বাধ্য হয়ে চালের বস্তা মাথায় তুলতে হয়েছে। পটল আড়ৎদার লোকটা ভালো। সুলতানগঞ্জের মানুষ বলে কলিজায় একটু দয়া মায়াও আছে। ময়জানের দুঃখদুর্দশা লাঘব হবে আশা দিয়েই সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়, ওর বাপটা মরে যাওয়ার পরপর।

স্বামী গেলো বাপ মরলো, সংসারে সে এখন সত্যিই একেবারে নিঃসঙ্গ। কেউ নেই তার সুখদুঃখের কথা শোনার। জীবন এতো কঠিন কখনো ভাবেনি। মানুষ এভাবেই বাঁচে, এভাবেই সে একটু একটু করে আবার মরে। মরেও হয়তো বাঁচে, জীবনযন্ত্রণা থেকে পালিয়ে যাওয়ার নামই কি মরে যাওয়া। হয়তো এজন্যই মানুষ মরণকে বরণ করে হাসি মুখে।

এমনই এক কঠিন চাকার মধ্যে ঘুরছে সে।  চাকাটা শুধু ঘুরে যায়। চরকার মতো ঘুরে যায়, কোথায় থামবে তার কোনো ষ্টেশান নেই। থামতে হয় কি হয় না তাও হয়তো জানে না। দূরের আকাশের মতো অচেনাঅদৃশ্য ভালোবাসা ঝিলিক দিলেও ময়জানের কোনো সাঁই নেই। কি হবে জীবনে স্বপ্ন দেখে। স্বপ্ন সরে গেছে, ভালোবাসা মরে গেছে, দিনেদিন এটুক বুঝে আজ সে হাঁপিয়ে উঠেছে। মানুষ সরে যাওয়ার সঙ্গেসঙ্গে তার যেমন সবকিছু মিথ্যে হয়ে যায়, তেমনি তার ভালোবাসা মায়া মমতাও মিশে যায় নদীর বালুকার রাশির মতো এক স্রোতেই । সত্যিই জীবন তার স্রোতেই যেন।  স্রোতের মতো কুলেকুলে আছড়ে খেয়ে মরে। কেউ তাকে বুকে নেয় না। নেবে না কখনো জানে। বাপটা গেলো তো গেলো, আর কে আছে তার জন্য। সামনেপেছনে চাপচাপ অন্ধকার। কালো বিদঘুঁটে আবলুশ অন্ধকার। সেই অন্ধকার সাঁতরে কোন কুলে  গিয়ে দাঁড়াবে জানে না।

 

দূরের শহর ডাকে অহনিশি। একবার ভাবে চলেই যাবে দূর শহরে। সেখানে কতো সুখ কতো আনন্দ ছড়িয়ে আছে। তারপর আবার ভাবে কি হবে এতো সুখ আনন্দ নিয়ে। শহর মানেই কিছু রাক্ষুশী মানুষের হাতছানি। ময়জানের অনেক সঙ্গিসাথি শহরে গেছে, অনেকে ভালো আছে, সবাই নয়। মাঝেসাঝে গাঁগ্রামে বেড়াতে আসে। কে কি করে কেউই কিছু বলে না। সবাই মুখ টিপে হাসে শুধু। শহরের শতশত আবাসিক হোটেলগুলো খোলা কেনো, কারা থাকে, কি ভাবে চলে, সবাই জানে। ওপরমহলের মানুষও বখরা নেয় নিয়মিত। সেখানে যারা সারভিস দেয় প্রতি নাইট, রোজগারও ভালো। কাঁচা পয়সা হাতে এলে মানুষ পরিবর্তন হতে বাধ্য। কে কতো আয় করলো তা শুনলে চক্ষু চড়কগাছে উঠবে। টাকাই তো জীবনের সমস্ত, টাকা ছাড়া দুনিয়া অন্ধকার। জন্য কে যেন বলেছিলো টাকা মাটি, মাটি টাকামিল মোহাব্বত বড় কথাকিসের মিল আবার মোহাব্বত! সবখানেই টাকা আর টাকা। মানুষ টাকার পেছনে ছুটছে, টাকা তো মানুষকে চেনে না, তাকে চেনাতে হয় বলেই সে ধুমকেতুর মতো ছুটে আবার নীচে নেমে আসে।

সভ্যতার আলোতে ওরা নিজেকে বিকিয়ে মাছ ধরা জালের মতো টাটকাতরতাজা গলিত সোনা টাকা রোজগার করে। তারপর রাত্রি শেষে দিনের আলোতে হরিণীর মতো ছুটে বেড়ায় নগরীর সভ্য আলোর ঝলকানিতে। ময়জান পারে না। হয়তো কোনোদিন সে পারবে না। এই না পারাকে কি বলবে সে জানে না।  কিন্তু আমরা হয়তো তাকে খারাপ মেয়েই বলে দেবো, কারণ সে তো রাস্তাঘাটেই পড়ে থাকে। ওর চরিত্রের কোনো মূল্য আছে কি। ওর সঙ্গিরা  যা পারে, সে পারে না, হয়তো পারার কোনো বাসনা নেই। লোকমুখে কতো কথা ভেসে আসে ওদের নিয়ে। শুনে কানে হাতচাপা দেয়। কেনো কানে হাতচাপা দেয়, সমাজ তো ওকে খেতে দেয় না, তবে সমাজের প্রতি এতো দরদ কিসের। এই সমাজ শুধু ওপরের মানুষের খেদমত করে নীচের মানুষ চিরকাল নীচেই পরে থাকে। ময়জানকে কেউ দেখে না, দেখার প্রয়োজনবোধ করে না, তবে কিসের এতো দায়বদ্ধতা ! তাছাড়া সে কি বা করতে পারে। সে তো শামুক, নিজের খোলসের ভেতর সিঁধিয়ে রাখতে পারে নিজেকে। কিন্তু কেনো সিঁধিয়ে থাকবে, কার ভয়ে এভাবে গুটিয়ে রাখা!

ময়জানের চোখে তবুও ঘুম নেই। ঘুম যেন চিরকালের জন্য বিদায় নিয়েছে তার। ক্লান্তি তার শরীরের আনাচেকানাচে ভরপুর, এভাবেই সে ছুটে যায় সীমা থেকে সীমাহীন। কেউ তার কথা রাখেনি। কথাগুলো শুধু কথা হয়েই গভীর পানির ভেতর বুঁদবুঁদ কাটে। কেউ দেখে কেউ বা দেখেও দেখে না।

সময় চলে যায় সময়ের মতো। সময় কি কারো জন্য অপেক্ষা করে, হয়তো করলেও করতে পারে কারো কারো জন্য কিন্তু তার জন্য করে না। সে যে শুধু একজন ময়জান,সহায় সম্বলহীন একজন অসহায় মানুষকে কে আর সময় দেয়। সময় পাগলা ঘোড়া। যার হাতে থাকে তারই হয়ে যায়।

অন্ধকার আকাশের মতো নির্মোহ একটা মন নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে একটা সময়, একটা যতিচিহৃ! সবাই দেখতে না পেলেও তার অস্তিত্ব কিন্তু আছে আকাশের খুবই কাছাকাছি অথবা মৃত্তিকা সন্নিকটে।

 

 

আশরাফ উদদীন আহমদ
গল্পকার

Leave a Reply