You are currently viewing শব্দকুঞ্জ ঈদসংখ্যা। গল্প: চোখের মাংস-সৌর শাইন

শব্দকুঞ্জ ঈদসংখ্যা। গল্প: চোখের মাংস-সৌর শাইন

শব্দকুঞ্জ ঈদসংখ্যা

গল্প
চোখের মাংস
সৌর শাইন

গল্প

চোখের মাংস

সৌর শাইন

 

বুনোকেয়ার পাপড়ি ছুঁয়ে শপথ করার পর চোখে শরীর সন্ধ্যার ইবাদত ওয়াজিব হয়, তখন চির পবিত্রতার রেশটুকু জমা রয় ফ্লুইড পেনের কালি নির্গত হবার স্রোতে। ধবল জোসনার মতো আজন্ম আঁশটে মায়া, লাউফুলের মতো বর্ষণ জাদু। নিজের ভেতরেই প্রশ্ন জাগে, সৌরেশ তুমি এই পথে কেন যাবে? নিরুত্তর প্রশ্ন কাতরায়, ধূলিতে গড়াগড়ি খায়। চোখ ফেটে জল নামে। ভালোবাসতে চাই, কাছে টানতে চাই, চুমু আলিঙ্গনে এক পৃথিবী সুখ পেতে চাই। কার কাছে আছে সেই সুখ? ভাবনার পৃথিবীতে যাকেই জড়িয়ে ধরি, সে বরফ হয়ে গলে যায়, বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়ে। আর আর্তনাদ হয়ে চারপাশে ঘুরে বেড়ায়, যন্ত্রণার পাণ্ডুলিপি হয়ে বুকের জমিনে অঙ্কুর গজায়। মুক্তির পথ অনুসন্ধান করতে করতে ক্লান্তির নোনা ঘাম আঠালো গন্ধে গোটা শরীরে গড়ে তোলে উইপোকার মতো বসত ঘর।

 

অদৃষ্ট বলে কিছু নেই বলে বেড়ানো সেই আমি শুনতে পাই, তোমার মুক্তি নেই সৌরেশ। তোমার নেই কোনো পথ। মৃত্যু.. মৃত্যু.. নৃত্য এসে আমাকে নিঃশেষ হতে শেখায়।

 

পথ সন্ধানী পথিক, তীরহারা নাবিক হয়ে চলার সময়, এখানে নিশ্বাস নির্গত তপ্ত বাতাস থমকে দাঁড়ায়, সিনার উপর দৈত্য হয়ে চেপে বসে আয়েশি ভঙ্গিতে গলা টিপে ধরে। জং ধরা দাঁতের ফাঁক গলে আলজিহ্বা উঁকি দেয়, মনুষ্য মলের দুর্গন্ধ বেরোয়, আরো বেরোয় কুৎসিত হাসি। দুঃসহ মুহুর্ত অজগর সাপ হয়ে শরীর প্যাঁচিয়ে বিষাক্ত চুমু খায়, আখমাড়াইয়ের মেশিনের মতো কষিয়ে মোচড়ায়, অন্ধকার এসে টোকা দেয় চোখের সামনে। মৃত্যুর ছোঁয়া কি এমনই হয়?

 

শ্বাসরুদ্ধ পৃথিবীর বুকে দেখা যায় একটা খোলা ময়দান। হঠাৎ সারি সারি শাল বৃক্ষের মিছিল জাগে মাটি ফুঁড়ে। বনের ভেতর গন্তব্য হারাই, একি কোথায় এলাম?

লতাগুল্মের ভিড় ঠেলে হেঁটে বেড়াই বন্য শরীরের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত। পা ফেলতে ফেলতে বনের ভেতর স্বচ্ছ মূর্ছনা মাখা বিশাল দিঘি ষোড়শী রমণীর মতো চমকে দেয় গোটা শরীর, মৃত্যুর যন্ত্রণা ভুলে জেগে ওঠে আমার পুরুষত্ব।

 

অদূরে ভিখারির কিশোরী কন্যা শালগাছের পাতা কুড়ানোর খেলায় মশগুল, এক একটা পাতা যেনো জীবন্ত ইতিহাস। সেই কচি পাতার চিত্র চোখে ভাসে, চকচকে দর্পণের মতো রূপ, রোদের হাসিকেও ফিরিয়ে দেয় প্রতিফলন খেলায়, মাঝরাতের মেঘ ঘর্ষণে বিদ্যুৎ উথলে জাগে, সেই আলোর ছটাও ফিরিয়ে দেয় মহাশূন্যের দিকে। কেমন মায়াভরা বিদ্রুপ! কেমন সম্মোহন?

 

কিশোরীর আঁধারি চুলে তীর ভাঙা ঢেউ জাগে দখিনা হাওয়ায়, পথহারা আয়ু আবারো পথ খুঁজে পেতে চায়। মুগ্ধতায় বিলীন করতে চায় মানবজীবন। ঢেউ এসে ছোবল দেয় অনবরত, ভাঙে পুরাতন তীর, ভাঙে পুরাতন নীড়। মাটি সরে গেলে নগ্ন শিকড়ের বৃক্ষ কেঁদে জানায় বাঁচার আকুতি, অথচ বিলীন হবার সুখ, সাঁতরে বেড়াবার মৃত্যুক্ষুধাও লুকিয়ে রাখে কয়েনের অপর পিঠে। কয়েন কয়েন খেলায় বার বার পরাজিত সৈনিক একদিন পরাজয়কে বিজয় ভাবতে শেখে, দুঃখকে দুঃখ দিয়ে গুণ করে সমান চিহ্নের ওপান্তে আনন্দ নামক গুণফল পয়দা করতে শেখে।

 

অচেনা ডাহুকের ডাকে সম্বিৎ ফিরে এলে মনে পড়ে, লাঙললাঙল খেলা। জমি কর্ষণের নেশা মাতাল করতে চায়, মহুয়া বনের মদ্য ক্ষুধা এসে ঝাপটে ধরে, মৃত্যু যন্ত্রণা উধাও হয় বিভ্রান্ত পথিকের ভাগ্যবরণে। চিরন্তন সত্য ওহির মতো শুনতে পাই, লিঙ্গ লাঙলের স্বভাব স্বপ্ন ধর্ম অভিন্ন।

বিভোর স্বপ্ন ভেজা চোখে আসি আসি মন্ত্রমুগ্ধ ঘুমের পাখনা গভীর জলে মৎসকন্যার ডানা হয়ে সাঁতরে বেড়ায় সমুদ্র প্রান্তর। এই তলদেশ বিস্ময়ের কামক্ষুধা জাগিয়ে হাত ধরে টেনে নিয়ে যায় দূর বহু দূরে। জলজ পথের দৃশ্যরা টেনে নেয় গভীরে, পাথুরে কাঁদা ধারালো কাঁটার রাজ্যে।

সেখানে কেবলি আর্তনাদের স্বর।

..সৌরেশ বাঁচাও, সৌরেশ বাঁচাও..

 

আমার মন্ত্রমুগ্ধতার ঘুম টুটে যায়। দিগ্বিদিক হাতড়ে কাউকে খুঁজে পাই না। দিঘির মনকাড়া রূপলাবণ্য হঠাৎ উধাও! আমার পুরুষত্ব মিলিয়ে যায় নিমেষে, জমি কর্ষণের ইচ্ছে মরে পড়ে থাকে পায়ের তলায়। শালবন পরিণত হয় খোলা ময়দানে, এক একটা শালবৃক্ষ পরিণত হয় তীর বিদ্ধ ঘুঘুতে। রক্তের হোলি খেলা জাগে জগতের পৃষ্ঠতলে। ঘুঘুরা যন্ত্রণায় কাতরায়, আমার থমকে থাকা মৃত্যু অনুভূতি আবারো জাগে। শ্বাসকষ্টের তীব্র জোয়ারে হৃদপিণ্ড উঠানামা করে।

চোখের সামনে ভেসে ওঠে পত্রিকার হেডলাইন, যেখানে ভরপুর নারী ধর্ষণ, স্তন, যোনি খুবলে খাবার খবরে। এইসব দৃশ্য আমার সহ্য হয় না। নিরুপায় কিশোরের স্বমেহন কাতরতার মতো আমি হাত বাড়াই চোখের দিকে। ছিনিয়ে আনি চোখের মাংস, চিবিয়ে খেতে খেতে ছুটে বেড়াই, পালিয়ে বেড়াই বন জুড়ে।

সেই মুহূর্তের অজগর আবারো মোচড় দেয়, কণ্ঠ ধড়ের হাড় ভেঙেচুড়ে তছনছ হতে হতে দুনিয়া জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে যেতে থাকে। অন্ধকার ভেদ করতে চায় না চোখের মাংস, চির আঁধারের কালিমাতে মরতে চায় আমার পুরুষ পরিচয়।

চিৎকার চিন্তার যুগল রেখা রেললাইনের মতো পাশাপাশি ছুটে আসে বার বার, মুক্তির দরোজা যতবার খুলতে চাই ততবার রুদ্ধ করে দেয় অজগর। মৃত্যু জীবন্ত পথের মাঝখানে বসে থাকি আমি, চোখের মাংস চিবুতে চিবুতে কামক্ষুধা মেটাই। জাবর কাটতে থাকি প্রতিনিয়ত।

 

হঠাৎ একদিন কর্ণ গহ্বরে টোকা দেয় সেই চিরচেনা ভিখারি কিশোরীর কন্ঠস্বর, সৌরেশ বাঁচাও.. সৌরেশ বাঁচাও।

 

নিরুপায় কেন সৌরেশ?

সৌর শাইন
কবি ও গল্পকার

Leave a Reply