You are currently viewing শব্দকুঞ্জ ঈদসংখ্যা। গল্প: চোখের নিচে হাতের তালুর দূরত্ব-রাজিয়া নাজমী

শব্দকুঞ্জ ঈদসংখ্যা। গল্প: চোখের নিচে হাতের তালুর দূরত্ব-রাজিয়া নাজমী

শব্দকুঞ্জ ঈদসংখ্যা

গল্প
চোখের নিচে হাতের তালুর দূরত্ব
রাজিয়া নাজমী

গল্প

চোখের নিচে হাতের তালুর দূরত্ব

রাজিয়া নাজমী

 এ কেমন যোগ বিয়োগ কিছুতেই মিলছে না। সকাল থেকে অসকাল- একটি অংক করেই যাচ্ছে। মিলছে না।

সারাদিন ধরে হিসাবের পাতায় নিভুর্ল অংক মিলালেও এই  হিসাবের খাতা দিনরাত নানাভাবেই  চেষ্টা করেও যে মিলাতে পারে না। মিলাবে কেমন করে বেমিল কিছু ধরা না পড়লে? এখনও রোজ সকালে বাড়ি থেকে বের হবার সময়ে তার লক্ষ্মী বউ দরজা পর্যন্ত ব্যাগ, টিফিনবক্স নিয়ে আসে। ভালোভাবে অফিসে যেও বলে হাতের ব্যাগ যত্ন করে কাঁধে ঝুলিয়ে দেয়। বিকেলে  ঘড়ির কাঁটা  ধরে  রোজ সেই আগের মত দরজায় দাঁড়িয়ে থাকে তার বাড়ি ফেরার অপেক্ষায়। দরজায় পা রাখতেই মিষ্টি হাসি। 

নিক্তি মেপে মেপে দেখলে কিছুই বদলে যায়নি। সারাদিনের যুক্তি ঊলোট পালট হয়ে যায়। গনিতের সার্থক সংখ্যা এক থেকে নয়ের কাছে সহকারী শূন্য এসে এদিক সেদিক বসে যায়। মিলে না কিচ্ছু মিলে না। কেবল থেকে থেকে মনে হয় –  জীবনের গোঁজামিল অংক সব কাটাই যাক। ও আর না মেলানো ভালো। তারপরেও মনের ভিতর হুহু করে ওঠে হতাশার যন্ত্রনায় – জানার অধিকারে। অন্তত একটি প্রশ্ন, কেন এতসব এখনও?     

এই যে আজকাল এত রাত করে বউটা ঘুমায় তারপরেও  ঠিক সকালে উঠে চা বানিয়ে বিছানায় নিয়ে আসে। বিয়ের এক সপ্তাহ পর থেকে গত দশ বছরে এর কোন হেরফের হয়নি।  বউয়ের এমন নরম নরম আদর পাবার বাসনা থাকলেও মুখ ফুটে  বলে নাই। প্রথমদিন যখন চায়ের ট্রে নিয়ে বিছানায় রাখলো তখন সে অবাক চোখে তাকাতেই বউ হেসে  বলেছিলো – আমার এই ইচ্ছায় বাধা দিও না। 

দেয়নি তো  কোন চাওয়াতে তো বাধা। কী করেই বা  দেবে। চেয়েছেই তো অনেক কম। ভাবতে ভাবতে বুকের ভিতর চিনচিন ব্যথা করে। পুরুষমানুষের কাঁদতে নাই। তার যে ভীষণ কাঁদতে ইচ্ছা করে –অনেক জোরে চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছা করে। বউকে ধরে চিৎকার করে জানতে ইচ্ছা করে কেন? কিসের অভাব হয়ে গেলো তোমার? কেন জানতে দিলা না আমার কাছে তুমি কী পাইলা না! ভাড়া বাড়িতে  সামান্য আসবাব দিয়ে নিখুঁত করে সাজাইলা। হাতে গোনা কাপড়চোপড় – সুন্দর করে গুছায় রাখো । কাজের লোক রাখার কথা বললেই বল, কী এমন কাজ যে আমার বিলাসিতা করতে হবে। 

সত্যিই তো তাই  বিলাসিতা করার কথা ভাবাই যে  বিলাসিতা তার মত কেরানী গোছের চাকুরীদের। নামেই বুককিপার। ক্লাস তো সেই  কেরানী। মাস শেষে মায়নার টাকা মানিব্যাগ ফুলে ওঠে না। তবু তার নরম মনের বউটার জন্য নিজেরে ধনী মনে হইতো। তিনমাস অন্তর অন্তর বাচ্চাদের নিয়ে একটু পার্কে যাওয়া, ছোট কোন রেস্তোরায়  খাওয়া এইটুকু ওদের বিলাসী জীবন।

সব কিছু হারিয়ে ফেললো সে?  হারিয়ে ফেললো অণুক্ষণ ভালবাসার অহংকার – কবে? কবে! ভাবতে ভাবতে শ্বাসে টান লাগে।  মাথার উপর বনবন করে ঘুরে চলা পাখার নিচে তার গরম লাগে, কপাল থেকে জলপ্রপাতের মত ঘাম বেয়ে নামে।

অফিসের জ্বলজলে  লাইটগুলোর দিকে তাকায়। কেবল তার মাথার উপরের বাল্বগুলো এত নিভু নিভু আলো ছড়ায়ে। টেবিলের উপরে খোলা ফাইলের লেখাগুলো গুলিয়ে যায়। চোখ ঘষে ঘষে আবার মন দিতে চায়। পারে না। মনটা বড় কাঁদে। চোখে তেঝহীন জ্বালা  –  পানি গড়ায় না।

কদিন আগে ম্যানেজার তাকে প্রমোশনের ঈশারা দিয়েছে । বউ শুনে নফল নামাজ পড়ল। মাঝে মাঝে মনে হয় এই কী তার বউ? নাকি আজগুবি কিছু ঘটে গেলো? জিন ভুত?

রোজ অফিস থেকে ফেরার পথে মন ঠিক করে, আজ ঠিক জিজ্ঞাসা করবে কেন রোজ  রাতে বিছানা  ছেড়ে উঠে গিয়ে পাশের রুমে চলে যায়?  কিন্তু আজ আজ করে দিন যায় । রাত হলেই সেই একই দৃশ্য। বউ অন্য ঘরে আর সে ঘুমের ভানে পড়ে থাকে।

কবে থেকে এইসব শুরু করেছে কে জানে। মাঝরাতে একদিন ঘুম ভাঙ্গতেই, বউকে টানতে গিয়ে দেখে বালিশের উপরে কাঁথাটানা। মানুষটা নাই।  ঘড়িতে তখন রাত বারোটা।  কই, তার তো  সন্দেহ হলো না তখন। সে তো ধরেই নিলো বাথরুমে গেছে। তাই আবার ঘুমিয়ে গেলো।  শরীরে ইচ্ছারা থেকে থেকে জাগায় । কিছুক্ষণ পরে ঘুম আবার ভাঙল।  পাশ ফিরে দেখে – বিছানা খালি। চোখের পাতা আর এক হলো না।

পা টিপে টিপে বউ যখন আসলো তখন রাত তিনটা। বিছানায় শোবার আগে একবার ঝুঁকে দেখে নিশ্চিত হয়ে বালিশে মাথা রেখে কিছুক্ষণ পরে ঘুমিয়ে গেলো। টেরই পেলো না পাশের মানুষটা চোখ বন্ধ করে  জেগে আছে।

সেই থেকেই  শুরু। গত একমাস ধরে প্রতিরাতে একই দৃশ্য।  আর তার ভিতরে ধস নেমে আসছে। তার সাধের সংসার এখন নাটকের  নিয়মে চলছে।

রাত এগারোটায় রোজকার নিয়ম মত বউ তার সাথে বিছানায় আসে। বারোটার দিকে আস্তে করে উঠে একবার ঝুঁকে দেখে। ভাবে গভীর ঘুমে আছে। এক পা এক পা করে ঘর থেকে বের হয়ে পাশের রুমে যায় । আস্তে করে দরজা বন্ধ করে দেয়। মাঝ রাতে বউয়ের দিন শুরু হয় কার জন্য?

অফিসে বসে, বাড়ি ফিরতে ফিরতে, ঠিক করে কিভাবে জানতে চাইবে । কিন্তু ঘরে ঢুকেই বউয়ের ব্যবহারে কিছু মাথায় থাকে না। ভাবে জিজ্ঞাসা করবে না। হাতে নাতে ধরবে। 

একদিন পা টিপে টিপে সেও দরজায় গায়ে কান পাতলো।  নিচু স্বরে তার বউ গান গাইছে। বুকের মাঝে ধুক ধুক শব্দ  গানের সাথে একাকার হয়ে গেলো।

এই  গান যে তারা  দুজনে একসাথে গায়। সেই গান বউ মাঝরাতে কাকে শোনাচ্ছে?  একবার ইচ্ছা হয় দরজা ভেঙে ঘরে ঢোকে আবার মনে হয় সদর দরজা খুলে বের হয়ে যায় – পাশের ঘরে বাচ্চাদুটো ঘুমায়। ছেলেটা ঘুমের ঘোরে কী যেন বলে ওঠে।

সে পায়ে পায়ে বিছানায় এসে পড়ে থাকে – ভাবে কী উপায়ে এর সুত্র বের করবে! 

পরদিন  বাড়ি ফেরার পথে সেলফোনের দোকানে যায়। সেলসম্যানের জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে প্রশ্ন আনে – কোন উপায় আছে কল লিস্ট বের করার?  জানতো এই সিস্টেম বিদেশে থাকলেও বাংলাদেশে নাই।  তবুই ওদের মুখে থেকে শোনা মানে সে একটা সম্ভাবনা থেকে নিজেকে বঞ্চিত করছে না। বাড়ি ফিরতে ফিরতে ভাবল নিজের ফোনে পয়সা শেষ হয়ে গেছে  বলে বউয়ের ফোন দিয়ে ফোন করার বাহানায় সব নাম্বার দেখে নেবে । লাভ হলো না । দশটা চেনা  নাম্বার ছাড়া কোন নাম্বারই যে নাই।  তাইলে কী কেউ তারে অন্য ফোন  দিলো ? মাথার মধ্যে কেন এত জট পাকিয়ে দিচ্ছে বউটা!

রাতের বেলায় কেন সে উঠে যায় কথা বলতে ? সারাদিনে বউ ঘরের কাজ আর বাচ্চাদুটো  নিয়ে ব্যস্ত থাকে তাই সময় হয় না ? না কী সে কোন দূর পাল্লার মানুষ। ঘড়ির কাঁটায় রাত দিনের তফাৎ।

বউ তো বলেছিলো তার কারো প্রতি টান ছিল না তবে একজন চাইছিল তার আশেক হতে। তাদের বিয়ে কয়েকমাস আগে সে বিদেশে পাড়ি  দেয়। তাহলে? তাহলে সেই কী ফিরে …।  তাই যদি হয় তাহলে  হাতে নাতে ধরবে কেমন করে?  তার মাথায় যে আর কোন উপায় আসছে না।  কার পরামর্শ নেবে? সবাই যে তাকে ঈর্ষা করে তার বউ ভাগ্যের কারণে।  যে বউকে নিয়ে তার এত অহংকার, আজ সে সেই বউয়ের চরিত্রের কথা বললে সবাই যে তাকে নিয়েই হাসবে। বলবে ঝাড়ু দিয়ে পিঠিয়ে বের করে দিতে। বলবে তুমি বেশি নরম টাইপের মানুষ বলেই পারছে। ওঁদের  কী করে সে বোঝাবে তাঁর বুক জুড়ে কতটা ভালোবাসা । ঝাড়ু দিয়ে পিঠিয়ে অত সুন্দর শরীরে! এও কী সম্ভব? তাহলে কী ওদের কথাই ঠিক সে নরম মানুষ জানে বলেই…।

নিজের পরিবারের লোক বলবে তালাক দিয়ে দে। কিন্তু বাচ্চা দুটো? চার বছরের  ছেলেটাকে না হয় কোনভাবে বড় করলো। কিন্তু জমজ মেয়েটাকে। মেয়ে মা ছাড়া বড় হতে পারবে?

বেলা গড়ায় । অফিসের সবাই টিফিনবক্স খোলে। সেও খোলে অভ্যাস মত।

আজ টিফিনের বক্স বের করতেই  দেখে একটা ছোট্ট চিরকুট আটকানো। তাঁর হাত ছিটকে উপরে উঠে গেলো।  আস্ত চেয়ার কেঁপে উঠলো।  চলে যাওয়ার কথা লিখেছে নাকি। হাত পা সব ঠাণ্ডা হয়ে আসছে। মাথায় উপর ফ্যান বনবন করে ঘুরছে তবু এত গরম লাগছে কেনো। চিরকুট না খুলেই টিফিন বক্স বন্ধ করে সে বাথরুমে গেলো।  শব্দ না করে কাঁদলো কিছুক্ষণ। পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করে মায়ের কোল ঘেঁসে বসা নিষ্পাপ দুটি সন্তানের মুখের উপর হাত বুলাতেই যেন বজ্রপাত হলো। তার মানে কী বাচ্চাদের সঙ্গে নিয়ে যাবে? এই প্রথম যেন হাতের মুঠি শক্ত হতে শুরু করলো। কমোড থেকে উঠে দাঁড়াতেই দেখে অফিসের কেরানি ফোনে কথা বলতে বলতে পেশাব করতে দাঁড়িয়েছে।

কেরানির শেষ কথা শুনে মনে হলো কথায় আছে  রাখে আল্লাহ্‌ মারে কে! কথাটা তার জীবনেও ফললো। কেরানি কাকে যেন বলছে, ‘ আরে ঘরের ভিতর একটা ছোট টেপরেকর্ডার  লুকিয়ে রেখে দেও।  যা কথা বলবে সব রেকর্ড হয়ে যাবে।

কেরানি লোকটার সবসময় ঘোরপ্যাঁচ বুদ্ধি। সেই কারণে ওকে একবিন্দু পছন্দ হয় না। কিন্তু আজ যেন আল্লায়  ওকে সহায়ক করেই  পেশাব করাতে পাঠাল।

কেরানি ওর দিকে একবার  তেরচা চোখে তাকিয়ে তার বুদ্ধি বেচার কাজে ব্যস্ত হয়ে গেলো। 

সেও ইউরেকা না বললেও পেয়েছি ভরসা নিয়ে  রুমে ঢুকে টিফিনবক্স ব্যাগে রেখে দিয়ে ফাইল টেনে নিলো। ম্যানেজার সকালেই ডেকে বলেছে হিসেবে নাকি গণ্ডগোল হয়েছে। অন্যসময় হলে তখন তখনই হিসাবের ভুল খুঁজতে বসে যেতে। আজকাল আর কেয়ার করে না। নিজের জীবনের হিসেবেই ভুল হয়ে গেছে তো এদের ব্যবসা নিলামে উঠলে তার কী!

হিসাবে গণ্ডগোল খুঁজতে দুচার পাতা দেখার আগেই ঘড়ির কাঁটা পাঁচটায় ঠেকে। 

অফিস থেকে বের হয়ে সোজা ইলেকট্রনিক্সের দোকানে গিয়ে ছোট একটা  রেকর্ডার কিনলো।  সেকেন্ডহ্যান্ড বলে দাম কম পড়লো। কাজ হবে কিনা সেই খুঁতখুঁতানি দেখে সেলসম্যান রেকর্ড করে শোনালো। ব্যাগ নিয়ে বের হয়ে বউটার উপরে একটু রাগ লাগলো। আজকে তাকে এইটার জন্য টাকা ধার করতে হলো।  দুদিন বাদে কোরবানি ঈদ। একটা নামের কোরবানির টাকা, বাচ্চা দুটোর জন্য যেমন তেমন হলেও নতুন কাপড় কেনা। এত হিসাব করে চলে যে বউ তার কারণে আজ বাহুল্য খরচ।

ঘাসের উপরে অনেকক্ষণ ধরে একটা লাল কালো ডানা মেলে প্রজাপতি উড়ছে আর ওর পিছনে  ঘুরঘুর করছে হলুদ সবুজ ডানার  ফড়িং।  সে হাসে। একমুঠো ঘাস নাকের সামনে তুলে নিয়ে গন্ধ শুঁকে। বউ একদিন দেখে হেসে বলেছিলো, ঘাসের গন্ধ আছে নাকি!

 নাহঃ রেকর্ডার কেনা  বাহুল্য খরচ না। 

ঘরে ঢুকতেই বউ টিফিনের ব্যাগ হাতে নিয়ে অবাক চোখে তাকিয়ে বলে, টিফিন খাও নাই? চিঠিটা  পড় নাই?  অফিসের কাজ বেশি ছিলো বুঝি!  ঠিক আছে হাত মুখ ধুয়ে  কিছু খাও।

সহজ  স্বাভাবিক ভাবে কথা বলে  বক্স থেকে চিরকুট ছিঁড়ে ফেলে দিলো।  চিঠিতে কী ছিলো? সেও জানতে চাইলো না বউ বললো না।

না, আজ রাতে সে কিছু করবে না। কাল শুক্রবার। বউ বাচ্চাদের নিয়ে শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার কথা। একটা অজুহাত দেখিয়ে কাল সে যাবে না। ওদেরকে পাঠিয়ে দেবে। 

শুক্রবার সকাল থেকেই মাথায় আসছে না  যাওয়ার জন্য কী অজুহাত দেখাবে। শরীর খারাপ বললে  যদি না যায়। আগে তো যেতো না। এখনও তো আগের মতই ব্যবহার করে। তাহলে কি করবে?  হঠাৎ করেই মাথা থেকে বুদ্ধি বের হলো।

আজকাল সেও কী চালক হয়ে যাচ্ছে? না হলে এমন চটবুদ্ধি বের হয়ে কী করে?

না যাওয়ার কথা শুনে বউ অবাক হয়ে তাকাতেই বলে, অফিসের একটা ফাইল ব্রিফকেস করে নিয়ে এসেছি। হিসেবে ঝামেলা হয়েছে। আজকের মধ্যে দেখে কাল জমা দিতে হবে এরপরে তো ঈদের ছুটি শুরু হয়ে যাবে। তোমরা যাও।

বউকে দেখে মনে হলো মন খারাপ হয়েছে। কী জানি দেখার ভুল হতে পারে। এতকালের দেখার অভ্যাস। যা দেখায় তাই দেখে।  অথবা ভালো অভিনয় জানে তার বউ যা সে এতদিন টের পায় নাই।

স্কুটার ওদের’কে নিয়ে টান দিতেই সে কাজে লেগে গেলো।  ইদানীং বউয়ের মধ্যরাত পার করার  রুমটা খালিই থাকে।

ঘরটায় ঢুকেই বিরক্তি লাগলো। এই ঘরে কোথায় লুকায়ে জাল পাতবে? আড়াল করার মত কোন কিছুই নাই। এতটুক ঘরে একটা টেবিল চেয়ার আর একপাশে শুধু সিঙ্গেল তোষকের উপরে চাদর বিছানো। রেকর্ডার  তোষকের তলায় রেখে খুব আস্তে  কথা বললো, অনেকটা ফিসফিস করে। তারপর বাজিয়ে দেখে , একটা ফিসফিস আওয়াজ ছাড়া একটা শব্দ রেকর্ড  হয় নাই।  অনেক ভেবে চিন্তে শেষ পর্যন্ত একটা উপায়ের উপর ভরসা করলো। লিভিংরুমে ছোট একটা সেলফ আর গোটা দশেক বই আছে। ওগুলোই এখানে এনে রাখবে। লিভিংরুমে একটু জায়গা বাড়াবার জন্য বউ অনেকদিন বলেছিলো কিন্তু সেই তখন তেমন গরজ করে নাই। 

শার্টের কোণা দিয়ে রেকর্ডার  মুছে বইয়ের আড়ালে রেখে দিলো।

আগামীকাল, সব কিছুর নিষ্পত্তি হবে। বড় হালকা লাগছে হাতে নাতে ধরার উপায় পেয়ে। আবার এক অদ্ভুত আনচান করা মন। বউটাকে কতদিন কাছে টেনে নেয় না।  বউটা মাঝে মাঝে অভ্যাস মত ভোঁররাতে গায়ে হাত দেয় কিন্তু তার যে কিছুতেই সারা জাগে না। এই কিচ্ছুক্ষণ আগে আরেকজনের সাথে কথা বলে আবার তার গায়ে – তাহলে কী আরেকজন মনে রেখে তার সাথে – বড় ঘৃণা করতে ইচ্ছা হয় – পারে না –  চোখ জ্বলে।  এক বিছানায় গায়ে গায়ে থেকেও মনের দূরত্ব কাছে টানে না। 

অনেকক্ষণ ধরে সে গোসল করে। বেড়ে রাখা ভাত খেয়ে নিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়তেই এতদিনের নির্ঘুম চোখ লেগে এলো। ঘুম ভাঙল বাবা বাবা ডাক শুনে। বউ হাসিমুখে দাঁড়িয়ে, হাতে বিকেলের নাস্তা – প্লেট সামনে তুলে ধরে বলে, মুগপুলি তোমার পছন্দের পিঠা, মা বানিয়েছে।  পিঠার পিঠে চায়ে চূমূক দিতেই বউ পাশের ঘর থেকে বলে, সেলফটা সরানো তে দেখেছো বসার ঘরে কত জায়গা বেড়ে গেছে।

পিঠা খেলো না কী খেলো জানে না। শুধু কিছু একটা মুখে তুলে খেলো । বউ বাপের বাড়ির গপশপ তেমন করে না। একটু আধটু যা করে তাও কানে না নিয়েই মাথা ঝোকালো। অভিনয় সে তেমন পারে না। বউ জিজ্ঞসা করলো, তোমার অফিসের কাজ হয়েছে না বাকি আছে ? তুমি এত চুপ করে আছো কেন? শরীর খারাপ লাগছে?

আছে কিছু এখনও  বাকি, কাল অফিসে শেষ করবো। অবেলায় ঘুমিয়েছি তাই মাথা ভারভার লাগছিলো। এখন ঠিক আছি।

বউ  ব্যস্ত হয়ে গেলো বাচ্চাদের নিয়ে। দুটো বাচ্চাই বড় চঞ্চল। অবাক লাগে ওর এত ধৈর্য্য দেখে। সংসারের এতসব কাজ সামাল দেয় কী করে দুইবাচ্চা নিয়ে। কতদিন তো বিকেলে বাড়ি ফিরে দেখেছে নাওয়া খাওয়া কিছুই হয়নি। তবু ওর চোখে কোন অনুযোগ দেখে নাই। নাকি ছিলো সেই দেখে নাই।   

বেলা প্রায় শেষ। রাত বারো বাজতে আর মাত্র কয়েক ঘণ্টা। তারপর সকাল আটটায় রাস্তায় বের হয়েই জেনে যাবে সব। কিন্তু তারপর কী করবে সে? বের করে দেয় কিভাবে! পারবে সে? মাথাটা আবার ঘুরছে। এর চেয়ে কী না জানলেই ভালো হতো? নিজে থেকে যেদিন যাবার চলে যেতো।

রান্নাঘর থেকে পোলাউর গন্ধ ভেসে আসছে। বাবার বাড়ি থেকে রাতের খাবার বয়ে এনেছে। খাওয়া শেষ হয়। বাচ্চারা ঘুমাতে যায়। ওরা দুজন কিছুক্ষণ টিভি দেখে। আজ একটু বাড়তি আলাপ হলো ঈদের দিন নিয়ে। সকালে পায়েস জরদা করবে তারপর সবাই একসাথে হবে বউয়ের বড় ভাইয়ের বাড়ি। বিকেলে বাড়ি ফেরা । প্রতিবারের এই একই নিয়ম। কোরবানির একভাগার কিছু অংশ আসতে বিকেল হবে। বিলি বাট্টার পরে বাকি কিছু থেকে যাবে ভাইয়ের বাড়ির ফ্রিজে। এসব নিয়ে তার কখন ভাবতে হয় না। বউয়ের ব্যবস্থা।

রাতের বেলায় নিজেদের জন্য পোলাঊ আর মুরগী রান্না করে রাখবে আগের দিন। চিরকুটে সেদিন কিছু কিসমিস আর বাদাম আনার জন্য লিখেছিলো। মুখেও বলেছিলো যদি ভুলে যাই তাই লিখে দিয়েছিলো। আজ মায়ের কাছে থেকে একমুঠি নিয়ে এসেছে কাজেই আর না আনলেও চলবে।  বাচ্চাদের জন্য এবার কাপড় না কিনলেও চলবে। উপহার পেয়েছে অনেক। এই সব টুকিটাকি বলতে বলতে টিভি বন্ধ করে বিছানায় এলো।

রাত বাড়ল। বিছানার একপাশ শূন্য। আজ আর ফেরার অপেক্ষায় অপেক্ষা করলো না। ঘুমটাকে আসতে দিয়ে ঘুমিয়ে গেলো। মাঝে একবার টের পেলো পাশে একজন শুয়ে আছে।

সকালে বউ রান্না ঘরে যেতেই সে রেকর্ডারটা ব্রিফকেসে রাখে। প্রতিদিনের নিয়মের ব্যতিক্রম নেই । একইভাবে দরজায়, টিফিনের ব্যাগ, দাঁড়িয়ে থাকা। সব এক।

ব্যতিক্রম শুধু – দোরগোড়ায় একমুহূর্তে দাঁড়িয়ে বউকে এক পলক দেখে পা বাড়াল – অজানা রহস্য উদ্ধারের আশংকায়।

গলির মাথা পর্যন্ত হেঁটে আসতে আসতে হোঁচট খেলো কয়েকবার। পিছন ফিরে একবার দেখে নিয়ে ব্রিফকেস খুলে রেকর্ডার অন করে কানে লাগাতেই সেই গুনগুন গান। একটু সময় কোন আওয়াজ নেই। হঠাৎ কাতর স্বরে উহু শব্দ। তারপর আর কোন শব্দ নেই।

রেকর্ড বন্ধ করতেই শোনা গেলো ‘ ফোনটাতে ছবি । আবার চুপ ,তারপরেই বউ হাসছে কেন? কী বললো? রিওয়াইন্ড করে আবার শুনতেই এবার পরিষ্কার ভেসে এলো রেকর্ডারে বউটার মিষ্টি গলা, বলছে, – যাক বাবা এবার শান্তি। দেখো তোমার কত ভাল লাগবে। জানি তুমি  অবাক হবে। তুমি তো ভাবতেই  পারবে না। ইশ আমিও ভাবতে পারছি না তুমি কতটা খুশি হবে। আর মাত্র দুইদিনের অপেক্ষা।

হাত থেকে রেকর্ডার পড়ে গিয়ে দুই ভাগ হয়ে গেলো।  সন্দেহটা  কেন শুধু সন্দেহ হলো না? কেন সত্যিই হতো হলো! সারা শরীরে রক্ত কলকল করে ছুটেছে। যেন বলছে, ধরেছ এবার হাতে নাতে! ঘৃণা কর ঘৃনা ঘৃনা!

ধীরে ধীরে বাসে স্ট্যান্ডে গিয়ে বাস ধরল। অফিসে ঢুকতেই ম্যানেজার ডেকে পাঠাল।  বসতে বলেই সামনে ঠেলে দিলো সাদা এনভেলপ। ভিতরে তার হিসেবের বিশাল ভুলের জন্য  বড় ক্লায়েন্ট’কে হারাবার দায়ে বরখাস্তের কাগজ। 

এত বছর  কাজ করার জন্য ঈদের বোনাসসহ মাসের বেতন দিয়ে দুঃখ প্রকাশ করলো ম্যানেজার। অথচ তার কোন দুঃখ হলো না। ম্যানেজারও স্থির চোখের দিকে তাকিয়ে বলতে ইচ্ছে করছিলো আর কোন অংক মিলাবার ইচ্ছা আমারও নাই।

অফিস থেকে বের হয়ে অনেকক্ষণ এদিক সেদিক হেটে রমনা পার্কে শুয়ে থাকলো। বিয়ের পরে কয়েকবার এসেছিলো। টিফিনবক্স বের করে রুটি আলুর দম খেলো। কাল বাদে পরশু ঈদ! দুটো রাত। তারপর আর কোন রাত নেই।  বাড়ির ফেরার আগে ফার্মেসিতে থেকে প্যাকেট কিনে পকেটে যত্ন করেই রেখে দিলো। জীবনের শেষ কেনাকাটা।  বাড়ি ফিরে এলো ঠান্ডা এক শরীর নিয়ে। পরদিন আজিমপুর গোরস্থানে গেলো। বাবা মায়ের কবরের চিহ্নের  পাশে বসে থাকে। চারদিকে ভালো করে দেখে। নীরবতার কোলাহলে নিজেকে দেখে। মৃত্যুর পরে কী হয়? যা শুনেছে তাই হয়? অন্য দুটো প্রানের জন্য জবাবদিহিতার জন্য সে কী প্রস্তুত? ভাবতেই বুকের ভিতর শুকিয়ে গেলো। 

পরপর দুইরাত বউ আর  উঠে গেলো না। গায়ের সাথে সেটে একহাত দিয়ে জড়িয়ে রইলো। কিছু কী বলতে চায়? বরাবর যেমন করে আদর করে তেমন করেই- গত একমাসে পরে আজ এতটা কেন? যাবার আগে? এত খারাপ কেউ হতে পারে। ভাবতে ঘেন্না লাগছে। বউয়ের তপ্ত দেহ  তাকে  জাগালো না। তার আড়ষ্ট শরীর আর  কিছুক্ষণ  ধরে থেকে বউ ঘুমিয়ে গেলো। সে উঠে বসে – একবার তাকায় – কী অঘোরে ঘুমাচ্ছে তার ছয় বছরের অচেনা মানুষ!

পায়ে পায়ে বাচ্চা দুটার কাছে গেলো। ইচ্ছা করছে ওঁদের কোলে নিয়ে আদর করতে। পারতো যদি বলতে আমাকে তোমার মাফ করে দিস। আমার সাথেই নিয়ে যাব।  কষ্ট হবে না। ঘুমের মধ্যেই আমার সাথে চলে যাবি। কাল রাতে তোদের মায়ের হাতের কোরমা খেয়ে আমরা ঘুমিয়ে যাবো।

সারারাত বাচ্চাদের পায়ের কাছে বসে থেকে খুব ভোরে বিছানায় গিয়ে  শুয়ে পড়লো।

ঘুম ভাঙলো বাচ্চাদুটির ঈদ মোবারক ঈদ হৈচৈ ডাকে।  চোখ মেলতেই দেখে হাতে একটা ব্যাগ নিয়ে বউ দাঁড়িয়ে। মুচকি হাসিতে বলে, ওঠো গোসল করে এই পাঞ্জাবী পরবে। দেখ তোমাদের তিনজনের জন্য একই রকম নকশিকাঁথা পাঞ্জাবী।

তার হা করা চোখের দিকে তাকিয়ে বউ বলে, তুমি যে  ভাবতেই  পারবে না, অবাক হবে জানতাম।  ঈশ আমিও ভাবতে পারছিলাম না তুমি কতটা খুশি হবে। তোমার মনে আছে বড় ভাইয়ের এমন পাঞ্জাবী দেখে তোমার খুব ভালো লেগেছিলো। দেখ একদম একইরকম করেছি। ফোনে ছবি তুলে এনেছিলাম। 

আরে কি হল অমন ধূম মেরে বসে আছো কেন? পছন্দ হয়নি?  কী হল কাঁদছ কেন?

সারারাত জাগছো …

কী করবো, কাজের ফাঁকে সেলাই করতে পারতাম হয়তো কিন্তু দুষ্ট দুটো তো দিনে ঘুমায় না। ওনাদের বারণ করলেও তোমাকে ঠিক বলে দিতো। 

 

লজ্জায় বউয়ের দিকে চোখ তুলে তাকাতে না পেরে দুইহাত মুখ ঢেকে বলে বউ এত ভালোবাসা কেন …।  বাকি কথা শেষ করতে পেরেই হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো। কিছুটা লজ্জায় বাকীটা আনন্দে!

রাজিয়া নাজমী
কথাসাহিত্যিক

Leave a Reply