You are currently viewing শব্দকুঞ্জ ঈদসংখ্যা। গল্প: মাকিয়াভেলি- হাসান মুস্তাফিজ

শব্দকুঞ্জ ঈদসংখ্যা। গল্প: মাকিয়াভেলি- হাসান মুস্তাফিজ

শব্দকুঞ্জ ঈদসংখ্যা

গল্প
মাকিয়াভেলি
হাসান মুস্তাফিজ

গল্প

মাকিয়াভেলি

হাসান মুস্তাফিজ 

কবি ডায়ান সোইজ পুলিৎজার প্রাইজ জেতার তিনমাস পরে হান্নান আর নানন বারান্দায় বসে ছিল আর তখন মোটামুটি রাত তিনটা বাজে। হান্নান সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে বললআমার উপর এটা অবিচার। আমিও তো চাই ওকে। আমি কেন একা এভাবে দেখব যখন আমি ওর থেকে সেরা।

নানন চুপচাপ, বারান্দার মেঝেতে পা ঠিক করে বললকালকে ঝড় হবে বোধহয়।

হান্নান শুনে হাই তুললো, বিষাদ লাগতেসে, ওপর সাইডের বিল্ডিং থেকে হাসির শব্দ আসতেসে, সেটাও বিষাদ।

সরকারি চাকরি সুবাদে চারমাসের ট্রেনিংয়ে থাকা লাগবে কারভিতে, যদিও এই টাইমটায় এই ধরনের ট্রেনিং যেন একটা বিলাসিতা। 

হান্নান বলেই ফেললধর পাশের দেশটা আসলেই আমাদের এটাক করলো, মেইন শহরে পৌঁছায় গেসে, কাকতালীয়ভাবে ওরা এশাকে রেপ করতে গেল। তোর মনে হয় আরিফ ওর জন্যে কিছু করবে?

নানন হেসে ফেললভাই, চরম ফাউ উদাহরণ হইসে। আরিফকে যদি এর আগে মেরে ফেলে তাইলে আর বাঁচাবে কেমনে? আর যুদ্ধ যদি লাগেও সবকিছু ফালায় কেন সে এমন এক মেয়েকে বাঁচাতে যাবে যার সাথে ওর সম্পর্ক এখনও গজায় নাই? অতিরিক্ত একটা ম্যাটাফিজিকাল প্রশ্ন হয়ে গেসে রে। তবে তোর আত্মার শান্তির জন্য বলতে পারি যে না করবে না। তবে তুই এটা করতে গেলে দুইটা ঘটনা ঘটতে পারে। দেখা যাবে তোকে আগে মেরে ফেলে তারপর এশাকে রেপ করসে নাইলে তোকে দেখায় দেখায় আগে গণধর্ষণ করবে এরপরে দুইজনকে একইসাথে মারবে। আচ্ছা, এক হিসেবে এটাও হ্যাপি এন্ডিং। , হয়।

হান্নানহাল ছেড়ে দিসেএরকম একটা পোজে দেওয়ালে হেলান দিয়ে বললআমি জাস্ট ক্লান্ত, আমি এই দরদামে বারবার হারতেসি যেটা আমার সহ্য হচ্ছে না। সৌন্দর্য বৃথা গেসে দেখে কুৎসিত দিয়ে চর্চা শুরু করসি, সেখানেও আমি ব্যর্থ। ভাবটা এমন শয়তানও আমাকে তার দলে নিতে চায় না।

নানন সিগারেটে শেষ একটা টান দিয়ে উঠে গেল। হান্নান রাগী গলায় বললমৃত্যুই সব আর শালার জীবন একটা বাইনচোদ।কিন্তু পরক্ষণেই বুঝলো লাইনটা মিডিয়া প্রস্টিটিউটশন শ্রেণির হয়ে গেসে। 

হান্নান ঘুমাতে যাওয়ার টাইমে শুনলো আরেক কলিগের কাছ থেকে যে প্রতিবেশি রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রী বলে আমেরিকার প্রেসিডেন্টকে বলসেনবাহডু, শ্রীদেশ কোনো দেশ না, ওটা আমাদেরই অঞ্চল।

সকালে কুরাইশি ব্রেকফাস্ট শেষ করে হান্নান আর নাননকে বের হতে হল। এলাকার বিভিন্ন ধরনের ফেইক নিউজ, কুসংস্কার বা যাই হোক এসব নিয়ে তাদেরকে একটা কলাম লিখতে হবে এবং যার লেখা সবচেয়ে ভালো হবে সেটা মিনিস্ট্রির অফিশিয়াল ওয়েবসাইট থেকে প্রকাশ করা হবে। হান্নান কাঁচাবাজার বা ইন্ডিভিজুয়ালি লোকাল মানুষদের বাসাবাড়িতে না গিয়ে সোজা ফুটপাত আর বাজারি বইয়ের দোকানগুলাতে ঢুকে গেল। কিন্তু এখানেও কুরাইশি অবস্থা কারণ অথেনটিক কিছু নাই। বেশিরভাগই একাডেমিক বই কিংবা ধারিয়া ধর্মের বই।জ্বীনকে কীভাবে বউ বানানো যায় নিয়েই বলতে গেলে শত শত বই। কারভি শহরটার ব্যাপার হল প্রচুর নগরায়ন ঘটছে কিন্তু বেশিরভাগই অবৈধ, অনৈতিক এবং অনিয়ন্ত্রিতভাবে, গত ছয়মাসে লাইসেন্স ছাড়া কী পরিমাণে যে ফ্যাক্টরি এই শহরে বানানো হইসে হিসাব নাই। কাজে চারপাশে এত বালু আর বৃক্ষরাজির বলতে গেলে ডিভোর্স ডিভোর্স অবস্থা। তাই প্রচন্ড গরম। হান্নান ঠিক করল ফুটপাত থেকে একটা বই কুড়িয়ে নিয়ে সেটার উপরেই কোনোরকম রিভিউ লিখে দিবে, চাকরি তো পেয়েই গেসে। সে রাস্তার এক হকারের সামনে ছড়িয়ে বসা বইয়ের স্তূপীকৃত জঞ্জালের মধ্যে একটা বই পেল, লেখকের নাম কড়াকিয়া, ছদ্মনাম আর নামটাতে হিউমিলিয়েশনের সেন্ট আছে। কিন্তু হকার বললভাই, অনেকেই এটা খুঁজতেসিল দেই নাই, আপনাকে ভদ্রলোক লাগে, আপনিই নেন।

হান্নান ভাবল এবার হকার এই বাহানায় বেশি দাম চাইবে কাজে ওরমধ্যে অলরেডি বলতে গেলে বইটা আবার স্তূপে রেখে দেওয়ার একটা মানসিকতা তৈরি হচ্ছিল, কিন্তু হকার বিড়ির দামে বইটা ওর কাছে বিক্রি করে দিল।

কোয়াটারে ফিরে আসতেই ওর পড়শির সাথে দেখা হয়ে গেল এবং ভালোও লাগল যে একা, আসেপাশে কোনো পপুলিস্ট, লবিস্ট নাই। পড়শি কয়েকবার হান্নানকে জিজ্ঞাসাও করসিলঅন্যান্য মানুষ থাকলে কী অসুবিধা? আমরা সবাই তো বন্ধু।

হান্নানের এই কথায় জরজেট আপত্তি আছে। মোটেও সবাই সবার বন্ধু না, যতদিন দুনিয়ায় খারাপ এবং ভালোর মধ্যকার প্যারালাল ডিভাইস আছে ততদিন কেউই কারোর বন্ধু হতে পারে না। এই সেইম কারণে হান্নানপড়শিনামটা সহ্য করতে পারে না৷ একবার প্রায় বলেই ফেলসিলতোমার নাম এরচেয়ে বড়শি রাখলে ভালো হইত। যেই গণহারে তাল মিলায় মানুষের সাথে চলো, মনেহয় তোমার কোনো ব্যক্তিত্ব নাই, তুমি দূষিত পানি, খাওয়া যায় না কিন্তু দেখতে সুন্দর লাগে। 

হান্নানের খুব ইচ্ছা করে ওর নাম দিবেমারইয়ামএবং সেখান থেকে সে আদর করে ডাকবেমরি কিন্তু এইযে আদর বা নামের মাধ্যমে ওকে ভাসানী মানুষ বানানোর যে প্রচেষ্টা, সেটাও হান্নানের কাছে চরম পর্যায়ের মেকি লাগে। পড়শির প্রতি ওর বিন্দুমাত্র দৈহিক আকর্ষণ নাই, মাঝে মাঝে যা জেগে উঠার সে তো অবশ্যই জেগে উঠে কিন্তু সেটা তো নরমাল, ওর মধ্যে ফিজিকাল কোনো ধর্ষণ আছে বলে হান্নানের মনে হয় না। পড়শির চেহারাও হান্নান ঠিকভাবে খেয়াল করে নি, কয়দিন আগে লাঞ্চে সে খেয়াল করেছে যে পড়শির সামনের দাঁত সামান্য উঁচা যদিও সেটা ব্যাপার না কারণ হান্নানের আবার সামনের দাঁত টোলগেটের তুল্য ফাঁকা। তাইলে এসব আকর্ষণের প্রেক্ষাপটটা কী? যেমন এখানে আরেকটা মেয়ে আছে বর্ণ। বর্ণের উচ্চতা বলতে গেলেড্রাইভিং লাইসেন্সের ছবিতে পা দেখা যায়এমন।

হান্নানের মেয়েটাকে দেখতে একদমই ভালো লাগত না। কিন্তু ট্রেনিংয়ে এসে জারিফ নামের এক ছেলের সাথে ওর শুরু হয়ে গেছে স্পাইনোজা প্রেম। এখন জারিফ আর বর্ণের বাদরামি কিংবা জারিফ যখন হাত ধরে তখন বর্ণ যেভাবে হাসে বা ফরমাল ডেতে শাড়ি পরা অবস্থায় বর্ণকে দেখতে এখন হান্নানের মনেহয় সে আব্বাসি আমলের খলিফাদের স্ত্রীদের দেখতে পারছে। অথচ এই আর্কষণের স্পেসটাইমেও ওর কিছু জাগে না। ওদিকে আবার সে এশার জন্য আরেক ছেলেকে নিয়ে জেলাস হয়ে আছে। কিন্তু ব্যাপার হল, এইযে ওর এসব আকর্ষণের এমন কনফিউশান, এরজন্যেও ওর নিজেকে নিয়ে গর্ব হয়। বর্তমান সমাজ একটা স্যাডিস্ট সমাজ, আর যাই হোক সে এসবের অংশ না আর এর শাস্তি একাকীত্ব। 

হান্নান পড়শির পথ আটকায় বললকেমন আছো, মরি?”

পড়শি বাপ্পা ভাবে বললআমার যা নাম তাতে ডাকো।

ব্যস্ত? না হলে চলো একটু বসি, চা খেতে ইচ্ছা করছে।

এখন পারছি না, ফ্রেন্ডরা অপেক্ষায় আছে।

হান্নান মাটির দিকে তাকিয়ে বললওদের সাথে এত ঘনঘন মেলামেশা কি জরুরি?

তুমিও আসো।

আমি ওদের সহ্য করতে পারি না।

আমরা সবাই…”

দয়া করে এই কথা বলবা না আমাকে। আমরা মোটেও সবাই সবার ফ্রেন্ড না। ওদের দেখলে মনেহয় এরা জন্মাইসে জীবনটা নিয়ে জাগলিং করার জন্য, ওদের হয়ত সেইভাবে ব্যাকআপও আছে। ব্যাকআপ না থাকলে তখন দেখতাম ওদের এসব ফ্রেন্ডশিপগিরি কতদিন টিকে।

পড়শি এবার কঠিন হয়ে ওর বাম পায়ের নিচের মাটিকে সম্ভ্রান্ত ঘষা দিয়ে বললতুমি এরকম নার্সিসিস্ট কেন?”

কমন সেন্স আছে মানে এই না সে নার্সিসিস্ট। সেইমভাবে যুক্তি তোমাকে অফেন্ডেড করসে তার মানে এই না যে ফ্যাক্ট চেঞ্জ হয়ে গেল।

পড়শি এবার ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললযাই আমি, দেরি হয়ে যাচ্ছে, বিকালে মিটিং আছে।

প্লিজ, আমার সাথে চা খেয়ে যাও অন্তত।

সময় নেই।

হ্যাঁ, ডায়লগগুলায় পুরা জিরো অ্যারোমা।



কড়াকিয়ার বইটা মেইনলি কমন সেন্স বেইজড লেখালেখি, যেই দুদৈর্ব অবস্থা তার মধ্যে এসব মাগ্না ফিলোসোফি ভালো লাগে না। পার্লামেন্টে যেখানে কালো অর্থ সাদা করা নিয়ে এমপিদের মধ্যে মতবিরোধ চলছে এর মধ্যে আত্মা বা স্বাধীনতা জানা কি খুব দরকারি? ওদিকে তারা আরও ঠিক করতে পারতেসে না ডিফেন্স বাজেট বাড়ানো দরকার কীনা। কিন্তু একটা ডিসিশন তারা ঠিকই নিসে যে জরুরিভাবে আরেকখানা সরকারি মিউজিয়াম খোলা দরকার।

কিন্তু কড়াকিয়া যেটা অবশ্যই ওর ছদ্মনাম ভালোই কিছু কথাবার্তা লিখসে বলতে গেলে। প্রথমেই টেক্সটে সে শপথ করে নিসে সুপারন্যাচারাল বা ধাচের কিছু সে টানবে না। তার দ্বৈততা পুরাপুরি প্র্যাকটিকাল সেন্সের দিকে।

হান্নান আরও বইটা পড়বে কিন্তু দরজায় টোকা। হান্নান বারান্দার দিকে ওর কণ্ঠ তাক করে নাননকে বললদেখ না, কে?

নানন আসবে না, হান্নান শিওর নানন ওর কথাও সেভাবে পাত্তা দিবে না, ট্রেনিংয়ের তিনমাস পরেই ব্যাটা বিয়ে করবে, সে পীরিত চলতেসে এখন।

হান্নান দরজা খুলে দেখে কেয়ারটেকার দাঁড়ানো। ভদ্রলোক হাসিমুখে বললেনএকটা বিড়ি দেন দেখি।

মানুষটা কীরকম জর্জর স্টাইলে আপন হবার চেষ্টা করছে। কিছু না, হান্নান মোটে ভদ্রলোকের ফোনে ওয়াইফাই কানেকশন এনে দিসিল কিন্তু এখন মনে হয় হান্নান যেন ভদ্রলোকের চাকর।

একটা সিগারেট কুরবানি দিয়ে হান্নান ভাবলো সেও না হয় এই ঘাওড়া ইকোসিস্টেমে একটা সিগারেট খেয়ে আসুক।

করিডোরের স্মোকিং জোনে সিগারেট ধরাতে যাবে এরমধ্যেই মুরাদ এসে বললশুনসোস? দোতলার ইলেকট্রিসিটি বন্ধ করে দিসে।

হান্নান কী বলবে বুঝতে পারছে না। 

মুরাদ বললকাম করসে বুঝলি, মানে পুরা পাবলিসিটির কাজ।

হান্নান ওর ডান হাতের আঙ্গুলগুলা চক্রান্ত চক্রাকার ভারিক্কে ঘুরায় ইশারায় জানতে চাইল হইসে কী।

আরে, আমরা ঐযে পরিদর্শনে গেলাম না? কোন চোদনা একটা সেটানিক বাইবেল খুঁজে পাইসে। ঐখান থেকে কয়েকটা প্যাসেজ পড়ে আর নেট ঘেটে তার শখ জাগসে যে সে ব্ল্যাকম্যাজিক করবে। বুঝোস না, কার থেকে জানি জোগাড় করসে স্যানিটারি প্যাডের রক্ত…”

হান্নান সিগারেট ধরালো। ফেইক নিউজের সহোদরা ভাব থাকে একটা। বাংলাদেশের ফেইক নিউজ একটা প্যাটার্নে যায় যেখানে খালি ব্যক্তি না, এমনকি বস্তুও স্ত্রীলিঙ্গ ধারণ করে, মাঝে মাঝে সেটা ক্লীবলিঙ্গও ধারণ করে পরে আচমকা সেই স্ত্রীতেই চলে আসে। 

হান্নান স্বাভাবিকভাবেই বললআমার বিশ্বাস হয় নাই এই কাহিনি।

মুরাদ চোখ গোল করে ডান পকেটে একটা হাত রেখে বললছবি আছে আমার কাছে।

আর আমিও জানি দুনিয়ায় বহু ধরনের রোগ আছে, জাস্ট ভোগ করি নাই দেখে যে আমি বলতে পারব সব রোগ মারাত্মক না, এমন অধিকার দেওয়া হয় নাই আমাকে।

এরমধ্যেই খবর আসল, প্রতিবেশি নিউক্লিয়ার অস্ত্রধারী রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রী ১৮ পাতার একটা প্রবন্ধ লিখে সে দেশের ন্যাশনাল টেলিভিশনে নিজে লেখাটা পাঠ করেছেন। শ্রীদেশের সাথে ওনার দেশের সাংস্কৃতি এবং ভাষা এসব বহু জিনিস তিনি তুলে আনলেন। সাথে অভিযোগও করলেন বর্ডারের দিকে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের উপর নাকি শ্রীদেশের সরকার অত্যাচার করছে বলেই তারা সশস্ত্র প্রতিবাদ শুরু করছে আর এরজন্য ওনার দেশ দায়ী না কারণ উনি বলে কোনো অস্ত্র সহায়তা দেননি। ওদিকে জাতিসংঘের রিপোর্টের ভিন্ন তথ্য সম্বন্ধে তিনি জাস্ট বললেনজাতিসংঘ পশ্চিমাদের দালাল।

প্রবন্ধ পাঠ শেষ।



বিপত্তি ঘটার বাকি আছে? শ্রীদেশের প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে একটা কমপ্লেইনই আছে যে সে বেশি ইমোশনাল, আসলেই তো তাই। আবেগের চোটে সে নৌবাহিনীতে বরাদ্দকৃত অর্থের চেয়েও আরও বেশি ফান্ডিং দিসে এখন বলে ডিফেন্স বাজেটে ব্যালেন্স আসতেসে না, শিক্ষার থেকে কমায় সেটা ঠিক করা লাগবে। ভদ্রলোক আরেক বিরাট ভুল করলেন। প্রতিবেশি রাষ্ট্রের নিওহিটলার লিডারকে খুশি করতে উনি দেশে গণভোটের আয়োজন করলেন, কারণ একটাই উনি বহির্বিশ্বকে দেখাতে চান শ্রীদেশ স্বাধীনই থাকতে চায়, আবার প্রতিবেশি রাষ্ট্রের স্যাটেলাইট রাষ্ট্র বা প্রদেশ হতে চায় না। ভুল হইসে এখানেই কারণ বর্ডারের দিকের মানুষগুলা ঠিকই হ্যাঁ ভোট দিসে ফলে গণভোটে সর্বমোটনাভোট বেশি হলেও বর্ডার দিকের শহরগুলারহ্যাঁভোট বেশি। এইবার নিওহিটলার একদম সরাসরি অস্ত্র সাপ্লাই শুরু করে দিল আর এটা ঠেকানোর কিছুও নাই কারণ ওখানকার মানুষ এটাই চায়। প্রমাণস্বরূপ কয়দিন পর তারা শ্রীদেশ আর প্রতিবেশী রাষ্ট্রের মধ্যকার বর্ডার ওয়ালও ভেঙে ফেললো।

মজার ব্যাপার, হান্নান এসব জানলেও অন্যান্য কলিগদের তালে ওত রাজনৈতিক বিভীষিকাচারণ আলাপে না যেয়ে আরামে কড়াকিয়ার বইটা পড়া শেষ করলো সাতদিনের মাথায়। বর্ডার অঞ্চলের মানুষজন যখন বর্ডার ওয়াল ভাঙছিল, হান্নান সেদিন রাতের গুডনাইটে ঘুমে দেখল একটা স্বপ্ন।

কিন্তু স্বপ্নে বিলকুল ছাইয়া ছাইয়া সাঁতারের পূর্বে হান্নানের একটা ফ্ল্যাশব্যাক ঘটে যার মধ্যে শুধুমাত্রই আফসোস আর জন্মসূত্রে পাওয়া লোয়ারমিডল ক্লাস নিয়ে ছিল ঘিন্না। মেয়েটা ছিল সুজানা। সুজানা ছিল সেই ধরনের মেয়ে যারা আসলে প্রদত্ত গ্রিকমূর্তি যা দেখলে নীৎশে গালি দেবার আগেই প্যারালাইজড হয়ে যায়, সমস্ত ছোটলোকরা জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট চাটে, দেশবিদেশের ব্যবসা হয়ে উঠে সৌভিক, সোভিয়েত হয় মুক্ত তবে দেশ ভাঙে, চরমভাবে দুর্দান্ত দুর্দশা আঙ্গিকের সন্নিকটে থোবড়া কুচকে যায়, সুজানা এমন এক স্বরবর্ণব্যঞ্জনবর্ণ মেয়ে।

কথাবার্তাও ওর মনে আছে।

আমার কিচ্ছু ভালো লাগছে না। নিজের সাথে যেন আমি প্রতারণা করছি, অথচ আমার খুশি হবার কথাহান্নান বলেছিল।

সুজানা ঠাণ্ডা গলায় বলেছিলমেয়েটা যদি তোমাকে পছন্দ করেই থাকে তাহলে এত ভাবার দরকার কী? রাজি হয়ে যাও।

হান্নান দ্রুত বলেছিলকিন্তু আমি তো চাই না। মেয়েটা ডাহা মূর্খ। আমি এমন কাউকে চাই যে লজিকালি ভাবে, তারজন্য আমি সারাজীবন কষ্ট করতে রাজি।

কী চাও তুমি?”

তুমি আমাকে রেসপেক্ট করো?”

অধিকাংশ দিক থেকে করি না, তবে বেশ কিছু দরকারি জায়গার থেকে করি।

আই ওয়ান্ট ইউ টু গো আউট ইউথ মি অন ডেট।

সুজানা হেসে ফেলেছিল। হান্না যেন অবুঝ, উৎকণ্ঠায় চিল্লায় বলেছিলহাসছো যে?”

সুজানা হাসতে হাসতে বলেছিলউত্তর কি তুমি বুঝো না?”

হ্যাঁ, সেই ছিল সুজানা, অধিকন্তু। 



তো, স্বপ্ন। স্বপ্নটা এমন, হান্নান যদিও খাটে শুয়েছিল কিন্তু স্বপ্নের দুলানির ছলে সে ন্যাচারালি দেখলো সে এক হাতির পিঠে বসে আছে আর হাতি নদীর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে পানি পানের জন্য। নদীর গভীরতা বেশি না, বলতে গেলে এক বামুন উচ্চতার কাছাকাছি। অযৌক্তিকভাবেই বনের পারঙ্গম হেলকির থেকে একটা বন্য হাতি বেড়িয়ে এসে হান্নানের হিপের নিচে জ্যামড হাতিটাকে আক্রমণ করে বসল। হান্নানের হাতির দাঁত ভেঙে গেল আর সেই দাঁতের সাথে সেও মাটিতে পতিত হইল। চমক এখানেই দাঁতটা ঘনীভূতে হয়ে একটা ছুরিতে রূপান্তরিত হয়ে গেল। হান্নান যেই ছুরি ধরতে যাবে সেই মুহূর্তেই বন্য হাতিটা জোরে মাটিতে পা ফেলে মাটি কাঁপায় শুড়ের ফুঁটা দিয়ে বললভাই, মিটিং আছে উঠেন।

হান্নান ঐদিনই অফিসের থেকে বরাদ্দ থেরাপিস্টের কাছে গেল স্বপ্নটা নিয়ে কথা বলার জন্য। থেরাপিস্ট লাল চা পান করতে করতে বললেনকিছু হয় নাই, রেস্ট নেন। অ্যানজাইটির কিছু মেডিসিন দিতেসি, কিছুদিন খান।

কিন্তু হুট করে এইরকম স্বপ্ন কেন দেখব? তাছাড়া ছুরিও কেন দেখলাম? “

খাওয়া দাওয়া বেশি করে করেন। সবজি খান?”

হান্নান সংশয় নিয়ে বললকয়দিন আগে একটা বই পাইসি, লেখকের নাম…”

থেরাপিস্ট ওকে থামায় দিয়ে চায়ের কাপ টেবিলে রেখে বললমিঃ মাহবুব, কিছু কথা বলি আপনাকে, কানের ছ্যাদায় যতখানি পারবেন প্রবেশ করান। এরকম একটা ন্যাশনাল ক্রাইসিসের পরেও আমলা নিয়োগের জন্য পরীক্ষাটা ঠিকই হইসে যাতে দ্রুত লোক নিয়ে ডিপ্লোমেসির কাজে ইউজ করা যায়। আপনি নিজেও জানেন এরমধ্যে নেপোটিজম কতখানি ছিল, তার মধ্যেই এক্সাম দিয়ে চান্স পাইসেন। এই এত শ্রম কি আপনার কাছে দামী না?

হুঁ।

কথা বুঝচ্ছেন?”

হুঁ।

কী বুঝচ্ছেন বলেন।

যা বুঝার তাই বলসি।

থেরাপিস্ট এইবার চেয়ারে হেলান দিয়ে বললেনবেশ, তাইলে যান। মেডিসিন নেন, খাওয়া দাওয়া করেন আর দেশের সেবা করেন সেটা দেশে থেকে হোক বা বিদেশ থেকে হোক।



শক্রধনু শক্তিশালী ভূধর, তাই শুক্রবার থেকেই বৃষ্টি নামা শুরু করলো যেটা অনেক এলাকায় হয়ে উঠলো আযাব। কিন্তু হান্নানের হুট করে ওর মায়ের কথা মনে পড়তে শুরু করলো। চারপাশে ইদানিং খেয়াল করে দেখলো ওর বয়সী কিংবা ওর চেয়ে প্রায় চারপাঁচ বছর বড় এমন ছেলে মেয়েদের মা আস্তে আস্তে অসুস্থ হতে শুরু করছে আর যেহেতু ফ্রি মিডিয়া প্রস্টিটিউশনের যুগ, বিশেষ করে শ্রীদেশে যারা শেকসিপরীয় স্টাইলে ফ্রি মিডিয়া বুঝে না, চারপাশে হাজারো অসুস্থ মাদের ছবি ছড়িয়ে পড়া শুরু করলো যা একরকম বিভীষিকা। হান্নানের ইচ্ছা করে ওর মাকে একবার ফোন দিক কিন্তু সেখানেও আঙ্গুলকাটা হিন্দল ঘুরে। ফোনে মাও কিছু বলেন না, হান্নানও কিছু বলে না, এভাবে নিশ্চুপ। একদিন মা বললেনবাবা, আমার মন খারাপ।

কেন?”

বাদ দে।

এইজন্যেই এখন হান্নান ফোন দিতে পারে না কারণ কথোপকথনে কোনো শান্তি নাই, সব কষ্টনীল।

কিন্তু কড়াকিয়ার বইটা ইন্টারেস্টিং। বইটার ইন্ট্রোডাকশন শুরুই হইসে হিটলারকে নিয়ে একটা প্রশংসনীয় ছড়া দিয়ে। খটকা লাগলেও পরে ওর কথা ইগনোর করা যায় না কারণ হান্নান স্কুল থেকে খেয়াল করে আসছে স্কুলের টিচাররাও কেন জানি হিটলারকে ভালোবাসে, ভার্সিটিতে উঠেও সেইম ব্যাপার দেখলো, একেবারে হিটলারবন্দনা, কড়াকিয়ার বইটাতেই লেখাপ্রণাম, হিটলার।

কাড়কিয়া কে হান্নান জানে না, আবার পড়ে মনেও হয় না সে আরজ আলী মাতুব্বর টাইপ কোনো ডেসপারেট চায়নিজ দার্শনিকদের মেকি, কিন্তু ওর কথা ফেলনা না। কাড়কিয়া শুরুই করসে ওরপ্রণাম হিটলারদিয়ে। হিটলারকে সেদুনিয়ার উপপত্নীহিসেবে দাবী করসে। তার মতে, হিটলারের গণহত্যাই অন্যান্য অসভ্য কুকর্মকে কয়েকশ বছরের জন্য পিছায় দিসে এবং সেজন্যেই হিটলারের একটা সিংহাসন প্রাপ্য। এরপরে সে আবার বেশি কিছু লিখে নাই কিন্তু এক লাইনে একটা খোঁচা দিসেএকবার বিচার করেন, আমার এমন জলীয় প্রশংসা যদি আপনাদের অস্বস্তি দেয়, তাইলে ভেবে দেখুন কমন সেন্স দিয়ে কি আপনারা একবারও হিটলারের প্রশংসা করেননি?”

এরপরেই কাড়কিয়া শুরু করসে কেন সমাজে দুর্বলদের আস্তে আস্তে কতল করা উচিত। যদিও তার এই কথাবার্তায় অন্য কোনো দার্শনিকদের কথা নাই, সম্ভবত এইসব কতলবিষয়ে সবাই নীৎশের কথা বলতে পছন্দ করে কিন্তু কাড়কিয়া সূক্ষ্মভাবে এসব এড়িয়ে গেছেন।

এরপরে সে তার এই কতলনীতির কিছু প্রিন্সিপালস দিয়ে বই শেষ করে ফেলল। তার মতে, দুর্বলদের কতল করে ফেলা আসতে হত্যাকান্ড না, এটা আসলে তাদের ভাগ্য। সময়ের বেশি যদি তারা দুনিয়াতে থাকে সেজন্য ইহলোকে এনার্কি সৃষ্টি করতে আসলে একজন দূরন্ত অসৎ মানুষ লাগবে না, স্টুপিডরাই বরং তাদের হয়ে অধিকাংশ কর্ম সফল করে দিবে। কিন্তু কাড়কিয়া বলল এসবের সাথে কোনো আত্মার সম্পৃক্ততা নাই, আত্মার বাণীতে যতই যুদ্ধ, হত্যা কিংবা আত্মত্যাগের কথা বলা হোক, কাড়কিয়ার আছে এগুলা বিশুদ্ধভাবে একটা বায়োলজিকাল সংগ্রাম, এক সময়ে একটা মোমেন্টাম আসে যখন শক্তিশালীদেরকে দিয়ে দুনিয়াতে আবার অর্ডার আনতে হবে, কাড়কিয়ার মতে এখন এই সময়।

লাস্ট তিন পেইজে কাড়কিয়া বর্ণনা দিসে কারা সবচেয়ে দুর্বল। কাড়কিয়ার মতে যারা বেশি স্বার্থপর তারাই বেশি দুর্বল। তাদেরকে কতল করার জন্য একটা নির্দিষ্ট প্রসেস পালন করতে হবে। হান্নানের কাছে ইন্টারেস্টিং যেটা সবচেয়ে ইন্টারেস্টিং লাগল সেটা হচ্ছে কতলের পূর্বে তাদেরকে এক গ্লাস দুধ পান করাতে হবে। কিন্তু কেন?



ওদিকে উপকূলীয় অঞ্চলগুলাতে তীব্রভাবে বৃষ্টির কারণে বন্যা হতে শুরু করলো। দুইটা জেলার মধ্যে বিদ্যুতের কানেকশন চলে গেল, কোনো যোগাযোগ নাই, সেনাবাহিনীও সামাল দিতে পারতেসে না। জেলাগুলার থেকে একটা ঘটনা খুব ছড়াইল সেটা হচ্ছে দুই বছরের এক বাচ্চার বাপমা বন্যায় মারা গেসে। সুন্দর আউটকাম হইল কয়েকদিনে শত শত এপ্লিকেশন পড়লো, তারা বাচ্চাটাকে এডপ্ট করতে যায়। ওদিকে তেল, চাল, ডালের দাম ঊর্ধ্বগামী, বন্দরগুলো প্রতিবেশি রাষ্ট্র আর জঙ্গিরা মিলে বন্ধ করে দিসে ফলে কয়েকদিন পর চরমভাবে সংকট দেখা দিল। ওদিকে তারা বর্ডারে আস্তে আস্তে সৈন্য মোতায়েন করতে লাগল কিন্তু গুরু আমেরিকা কিছু শেয়ার করে না।

ওদিকে এর মধ্যে মানুষগুলা বিশৃঙখলার দিকে চলে গেল। কয়েক জেলার থেকে খবর আসল যে সেখানে 

ইচ্ছাকৃতভাবে অনর্থক খুনখারাপি শুরু হয়েছে। এক মেন্টাল হসপিটালে অভিযান চালিয়ে ১২ জন নার্সকে গ্রেফতার করা হল, ওদের মতে মেন্টালিভাবে অসুস্থ মানুষদের বাঁচার অধিকার নাই। আরেক জেলার কোন জমি খুঁড়ে শত শত মানুষের খুলি পাওয়া গেল, এগুলা গুডলাকের স্যাক্রিফাইস। 

কিন্তু হান্নান খুবই ব্যস্ত। সে ঘুমাতে পারে না কারণ ঘুমাইলেই সেই হাতির স্বপ্ন দেখে, পরে ঘুমের মধ্যেই চোকিং শুরু হয়। সেকোন মানুষগুলা দুর্বলসেটা ইনভেস্টিগেট করা শুরু করে দিল। ফার্স্টেই ভাবল, নাননকে স্যাক্রিফাইস করা যায় কিনা। ব্যাটার শখ ছিল ট্রেনিংয়ের পর মিউজিক করবে কিন্তু সামান্য গিটার বাজাতে জানে বলে যে এত পপুলারিটি পাইসে, এখন সারাদিন গিটার বাজায় যেখানেইকোনমি অফ মোশননাই। কিন্তু নানন স্বার্থপর? পরে ভাবল এশাকে স্যাক্রিফাইস করা যায়?

সেদিন এশার সাথে কেন জানি বেশি আবেগী কথাবার্তা হল। একপর্যায়ে সে প্রশ্ন করলোতোমার কেউ ছিল যার জন্য তুমি এখন দুর্বল?”

হান্নান উত্তর দিয়েছিল  চলে যাওয়ার পর আমি দুর্বল হইসি ঠিক, কিন্তু আমি আসলে দুর্বল স্টালিন হয়ে গেসি

কিন্তুখানকির পোলা একটা পুরাই মাদারচোদএইরাম একজন স্বার্থপর মানুষ খোঁজার আগেই ট্রেনিং শেষ হয়ে গেল। গুরু আমেরিকা তাও কোনো আগামবার্তা দিল না।

ফকফকা রোদের শুক্রবার, বিদায়বেলা। হান্নান বাসে উঠবে দেখে পড়শি স্যুটকেস টানতে টানতে আসতেসে। হান্নান ওর দিয়ে এগিয়ে যেয়ে বললপড়শি, আমি বিয়ে করতে চাই তোমাকে।

 

পড়শির চোখ তখন খুব সুন্দর হয়ে ফুটন্ত শ্রীলেখা হয়ে উঠেছিল, কিন্তু হান্নান সেটা খেয়াল করেনি। কারণ তখন ওর মনে স্বার্থপর ঘূর্ণিতে বেজে উঠলোহায়রে সুজানা, তোমাকে যে আমিকতবার ভেবেছিনুকরেছি।

হাসান মুস্তাফিজ

লেখালেখি শুরু ২০১৯ সাল থেকে।

প্রকাশিত  গ্রন্থঋকউহ্য ইশরা (কবিতা)

গল্প, কবিতা আর প্রবন্ধ লেখার দিকে বেশি ঝোঁক।

কোনো পত্রিকায় আসলে সেভাবে নিয়মিত না তবে শিশুসাহিত্যিক ও কার্টুনিস্ট আহসান হাবীব এর সম্পাদিতউন্মাদম্যাগাজিনের একজন নিয়মিত লেখক।

 

সেখানে বিভিন্ন হাস্যরসাত্মক ফিচার লিখে থাকেন। 

হাসান মুস্তাফিজ
কবি ও গল্পকার

Leave a Reply