শব্দকুঞ্জ ঈদসংখ্যা
গল্প:
ঢোল কলমির জীবন
স্বপঞ্জয় চৌধুরী
ঢোল কলমির জীবন
স্বপঞ্জয় চৌধুরী
শীতের সকাল। পাতাগুলো কুয়াশায় ভিজে আছে। এই ভোরবেলায় সরকারি মৃত্তিকা ইনস্টিটিউটের ডাকবাংলোটি পাখিদের কিচির মিচিরে মুখোরিত হয়ে উঠছে। বারান্দার রেলিংয়ে ঝুলছে কুয়াশার বিন্দু। কয়েকগুচ্ছ শিউলিফুল ঝরে পড়ে আছে বাংলোর পেছনটায়। বাংলোর বাইরে একটা টিনসেড ঘর রয়েছে। ওই ঘরে অরিতন বিবি থাকে তার বৃদ্ধ মাকে নিয়ে। অরিতনের বাবাও এই বাংলোর রাঁধুনি কাম ঝাড়–দার ছিলেন। তার মৃত্যুর পর অরিতন তার পোস্টে যোগদান করেন । কোনমতে বৃদ্ধ মাকে নিয়ে সংসার চলে যায়। এই সরকারি চাকরির বেতন খুব একটা বেশি নয়। তাই নুন কিনলে পান্তা ফুরিয়ে যায়, আবার পান্তা জোগালে নুন ফুরিয়ে যায়। এভাবেই চলতে থাকে তাদের জীবন। অরিতনের বিয়ের বয়স যাই যাই। এই বয়সে স্বামী সংসার নিয়ে সুখে থাকার কথা কিন্তু সংসারের বোঝা তাকে বইতে হচ্ছে। কারণ ভাগ্যের নির্মম পরিহাস। বিয়ের বয়স এই বসন্ত সেই বসন্ত করে চলে যাচ্ছে। তার জীবনের কতগুলো বসন্ত এমনি এমনি চলে যাচ্ছে। কোন প্রাণভোমরা তার জীবনে কি ধরা দিবে? ওদিকে তার মা তার চিন্তায় নাওয়া খাওয়া ছেড়ে দিয়েছে তার জীবন আজ আছে তো কাল নেই। সে চোখ বুজে গেলে তার মেয়ে অথৈ সাগরে ভাসবে। তাই তিনি সবসময় মনমরা হয়ে থাকেন। একটা সুপাত্রের হাতে মেয়েকে তুলে দিয়ে চোখ বন্ধ করতে চান। কিন্তু কে করবে মেয়েকে বিয়ে। নব্বই দশকের সরকারি চাকরির বেতন আজকের মত নয়। একেতো চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারি তার ওপর বাবা নেই, বাড়তি কোনো সম্পত্তি নেই। এই যুগে মেয়েদের যতটুকু পড়াশোনা লাগে সেটুকু নেই। এই বড়জোর কোন ড্রাইভার গোছের পাত্রের সাথে বিয়ে হতে পারে।
ডাকবাংলোর কেয়ারটেকার করিম শেখ হাকডাক দিচ্ছেন ওই অরিতন হাতচালা বড়বাবু আসলে বলে। শুনেছি সকাল আটটায় তার গাড়ি ঢুকবে বাজারে। আর তুই এখনো এখানে বসে শিউলি ফুল তুলছিস। অরিতন তার চিন্তার পৃষ্ঠা ভাঁজ করে হাতে ঝাড়– তুলে নেয়। পাতাগুলো খসখস শব্দ ঝাড়ু দিতে থাকে। একটু পরেই হয়তো বড়বাবু আসবে। বড়বাবু আসবে তাই গত এক সপ্তাহ ধরে ডাকবাংলো চলছে সাজ সাজ রব। তিনি কোন মাছ পছন্দ করেন, কোন ডিম খান- হাঁসের ডিম নাকি মুরগির ডিম, গরুর মাংস নাকি মুরগির মাংস সবকিছু তালিকা তৈরি হয়ে গেছে এখন শুধু ফরমায়েশ অনুযায়ী মুখের কাছে তুলে ধরবার পালা। অরিতনের রান্নার হাতও খুব পাকা।
গেল টার্মের বড়বাবু তো অরিতনের রান্নার মারাত্মক ভক্ত ছিলেন। তিনি চিঠি মারফত অরিতনের রান্না খাবার জন্য তাগাদা দিতেন। তার ড্রাইভার এসে টিফিন ক্যারিয়ারে করে নানা পদের রান্না বড়বাবুর জন্য নিয়ে যেতেন। তার পোস্টিং হয়েছে খাগড়াছড়ি । মৃত্তিকা ইনস্টিটিউটের ডাকবাংলোটি হবিগঞ্জের একটি পাহাড়ি টিলার উপর অবস্থিত। ছিমছাম একটি টিলা। না খুব একটা বড়, না খুব একটা ছোট। কিন্তু একটা অ্যাডভেঞ্চার কাজ করে যখন বাংলোর ছাদে গিয়ে দু হাত দুদিকে থেকে প্রসারিত করে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকা যায়। অরিতন মাঝে মাঝেই ছাদে গিয়ে দূর আকাশের দিকে তাকিয়ে দুহাত দুদিকে প্রসারিত করে দাঁড়িয়ে থাকেন আর ভাবেন ঐ আকাশের মেঘের ভেতর যদি পাখি হয়ে উড়ে যাওয়া যেত তাহলে কতই না ভালো হতো। মেঘের উপরে কি আছে তার দেখার খুব ইচ্ছা। এই বাংলোর চার দেয়াল থেকে সে আরও অনেক দূরে যেতে চায়। যেখানে সে শুধু তার স্বপ্নের মানুষকে নিয়ে আজন্মকাল ধরে বেঁচে থাকবে কিন্তু তার এ স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যায়। কখনও বাস্তব হবে কিনা সেটাও তিনি জানেন না। অরিতনের মা হাক ডাক দেয় কীরে অরিতন কি করছিস রে মা এদিকে আয়। আমার যে ওষুধ খাবার টাইম হলো অরিতন হাত থেকে ঝাড়ু রেখে বলে- “আসছিরে মা একটু সবুর কর।”
দুই
বেলা ১০ টায় বড়বাবুর গাড়ি আসলো ডাকবাংলোর সামনে। বড়বাবু মানে এই ইনস্টিটিউটের বড় কর্তা। যিনি এখানে মৃত্তিকা ইন্সটিটিউটের এর চিফ অফিসার পদে নতুন জয়েন করেছেন। এই পদের কর্মকর্তাকে ওরা বড়বাবু বলে ডাকেন। অরিতন গাড়ির শব্দ শুনে দৌড়ে বাংলোর গেটের কাছে যায়। তার সাথে সাথে বাংলোর কেয়ারটেকার করিম শেখও যায়। করিম শেখ গাড়ির পেছন থেকে বড়বাবুর বড় বড় দুটো সুটকেস নামায়। অরিতন অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকে কারণ এর আগে এত কম বয়সি বড়বাবু এই অঞ্চলে আসেনি। সরকারি চাকরিতে হয়তো বছর খানিক হলো জয়েন করেছেন। তার পোস্টিং হয়েছে হবিগঞ্জের মৃত্তিকা ইন্সটিটিউটে। পাহাড়ি মাটির ভূ-ত্বক ও পাহাড় ধ্বস নিয়ে কাজ করে এই প্রতিষ্ঠান। অরিতন অবাক চোখে তাকিয়ে আছে বড়বাবুর দিকে। বড়বাবু তার দিকে তাকিয়ে আছে মায়া হরিণির মত। মনে হচ্ছে যেন দুজন দুজনকে অনেক আগে থেকেই চিনেন কিন্তু বড়বাবুর চাহনিতে কি যেন একটা মায়াবি ভাব লুকিয়ে আছে। কি সেই মায়া তা অরিতন ঠাহর করতে পারছে না। যাক সে কথা বড় বাবু গাড়ি থেকে নেমেই ডাকবাংলোর দোতলায় চলে গেলেন। তার চোখে মুখে ক্লান্তির ছাপ। বেশ একটা জার্নি হয়েছে।
অরিতন ও করিম শেখ টেবিলে খাবার সাজিয়ে রেখেছে। বড়বাবু টাওয়াল দিয়ে হাত মুছতে মুছতে খাবার টেবিলের সামনে আসেন। তিনি খাবার দেখে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইল বললেন ওরে বাবা! এত আয়োজন! সব কী একদিনে খাইয়ে ফেলবেন নাকি আমিতো আছি আরো কিছুদিন নাকি। দেখুন এখানে থেকে যেতে হয় কিনা আজীবন। অরিতন মুখে আঁচল টিপে হাসতে থাকে বড়বাবু জামার হাতা গোছাতে গোছাতে হাত ধুয়ে খাবার শুরু করেন প্রথমেই রুই মাছের মাথা প্লেটে তুলে দেন করিম শেখ। বলেন – “বাবু আমাদের অরিতন রান্নায় খুব পাকা ওর খাবার যে একবার খেয়েছে আজীবন ওকে মনে রেখেছে। বড়বাবু কয়েক লোকমা মুখে দেয়ার পর বললেন- ‘আসলেই তো অনেক মজা। এরকম খাবার আমার মা রান্না করতেন। তিনি আজ নেই।’ মায়ের কথা বলতেই বড়বাবু আবেগপ্রবণ হয়ে গেলেন। অরিতন একটু মন খারাপ করলেন। মনে মনে ভাবলেন আহারে বেচারা তোমার মা নেই আর আমার বাবা আমরা দুজনে এতিম। বড়বাবু কয়েকটি তরকারি চেখে দেখলেন। বাকি তরকারি গুলো করিম শেখ নিয়ে গেলেন এরপর বড়বাবু বললেন আমি একটু ঘুমাবো দুপুর পড়লে আপনাকে নিয়ে বের হবো এইখানকার টিলাগুলো ঘুরে দেখবো, স্যাম্পল কালেকশন করে ঢাকা পাঠাতে হবে।
তিন
বিকেলবেলা করিম শেখ ও বড়বাবু দুজনে বের হন। তারা বিভিন্ন টিলা ঘুরতে থাকেন। তাদের সাথে আছে অরিতন। সেও কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করে বড়বাবুর জিপে করে শহরে যাবে মায়ের ওষুধ আনতে। বড়বাবু পাহাড়ে ঘুরতে ঘুরতে বুনো ফুল দেখতে পায়। তিনি বুনো ফুলের দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে থাকেন। বলেন কি সুন্দর ফুলগুলো কি নাম ওগুলোর। অরিতন অঙ্গুলি নির্দেশ করে বলেন- “এগুলো ভাঁটফুল আর ওই যে দূরে দেখছেন ওগুলো হচ্ছে ঢোল কলমি ফুল।” বড়বাবু একটু মুচকি হেসে বললেন- ‘ঢোলকলমি’ ইন্টারেস্টিং নাম। এগুলো তো আগেও দেখেছি কিন্তু নামটা জানতাম না। আজ জানা হয়ে গেল। আসলে পৃথিবীতে সবার কাছেই শেখার আছে অনেক কিছু। হয়তো এই জায়গায় না আসলে জানতেই পারতাম না এখানে কত সুন্দর সুন্দর ফুল আছে। এই যে যেমন অরিতন, তোমার রান্নাটা যে এত সুস্বাদু। তুমি যে দেখতে এত সুন্দর এখানে না এলে হয়তো দেখা হতো না, জানা হতো না এমন দক্ষ একজন রাঁধুনি লুকিয়ে আছে এই নির্জন টিলায়। হয়তো শহরের চার দেয়ালে আটকে থাকতাম আর যন্ত্রের মত কাজ করে যেতাম। তবুও ভাল হল এখানে এসে কিছুটা হলেও মনের শান্তি নিয়ে কাজ করতে পারব। অরিতন তুমি আরো বেশি পড়শোনা করলে না কেন? অরিতনের মুখে যেন পড়াশোনার কথা শুনেই কালো ছায়া নেমে আসলো। বলল- গরিবের বেশি পড়াশোনা করতে হয় না যতটুকু পড়েছি তা-ই যথেষ্ট ঝাড় ঝাঁট দিয়ে বেঁচে আছি এইতো বেশি।
বড় বাবু একটি ঝোপের দিকে যেতে থাকে। অরিতন চিৎকার করে বলে ওদিকে যাস নি বড়বাবু। ওখানে সাপ আছে এই কটা দিন আগেই একজনকে দংশন করল বেচারা মরতে মরতে বেঁচে গেছে। বড় বাবু বললো সুন্দর প্রকৃতিতে মরেও শান্তি। করিম শেখ একটু হাক ডাক দিল। তিনি বড়বাবুর দৃষ্টি অন্যদিকে ঘোরাতে বলল- বড়বাবু ওদিকে একটা টিলা আছে । চলুন ওখানটায় যাই শুনেছি এটি হাজার বছরের পুরনো। এখানে এক সময় পুজো হত অনেক বড় বড় মূর্তি ছিল। বড় বাবু বললো চলো যাই। অরিতন বড় বাবুকে বলছে কেমন লাগছেরে বড় বাবু। বড় বাবু বললো মোটেও ভালো না। আচ্ছা একটা ব্যাপার বুঝতে পারছিনা আমি আসার পর থেকেই তোমরা আমাকে শুধু বড় বাবু বড় বাবু করছো কেন? আমার তো একটা নাম আছে নাকি বাবা-মা এত সুন্দর একটা নাম রেখেছে আর সেই ব্রিটিশ আমলের মতো আমাকে তোমরা বড়বাবু-বড়বাবু বলে যপছো। আমাকে তোমরা তোমাদের নিজের মানুষ মনে করতে পারো। আমি কারো বড় টড়ো বাবু নই। একথা শুনে অরিতন মুচকি মুচকি হাসলো করিম শেখ বলল বাবু এর আগেও অনেকে এসেছে আপন করে নিয়েছে। বেশি আপন করলে কষ্ট পেতে হয়। আপনার আগেও আরো অনেক এসেছে তারা চলে যাবার সময় চোখের জল ফেলেছ। আপনিও কদিন থাকেন দেখেন। মানুষ আসে মানুষ যায় কিন্তু আমরা এই টিলা ছেড়ে কোথাও যেতে পারিনি। এখানেই জন্ম- এখানেই মৃত্যু। এই সরকার দু-চার পয়সা দেয়। তাই দিয়ে খেয়ে পড়ে বেঁচে আছি আরকি।
চার
এভাবে ফুল, পাখি, লতা, পাতা দেখে ভালোই দিন কাটছিল তাদের। কোন এক ভরা পূর্ণিমার রাতে বারান্দায় বসে ছিল বড়বাবু হাবিব আহমেদ। তিনি আকাশের দিকে তাকিয়ে ঝলমলে তারাদের নাচন দেখছিলেন যেন। অবাক বিষ্ময়ে ভাবছিলেন। এত বড় মহাবিশ্বের কত ক্ষুদ্র এই পৃথিবী কত ক্ষুদ্র এই মানুষ কিন্তু কতই না বিচিত্র মানুষের জীবন। এই যে অরিতন নামের মেয়েটির প্রেমে পড়ে আছেন হাবিব। অথচ অরিতনকে আঁকড়ে ধরতে ভয় হচ্ছে। সমাজ, আভিজাত্য আর চাকুরি এই তিন মিলে যেন বড় একটা বাধার দেয়াল তুলে দিয়েছে তাদের সামনে। তাই ইচ্ছা থাকলেও যেন উপায় নেই। কয়েকদলা মেঘ পূর্ণিমার চাঁদকে ঢেকে দিচ্ছে। হাবিব ছাদে গিয়ে অরিতনকে দেখে চমকে ওঠে। অরিতন খোলা চুলে দু হাত দু দিকে প্রসারিত করে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছেন। হয়তো আকাশ থেকে কোন স্বপ্ন পুরুষ এসে তাকে আঁকড়ে ধরবে নিজের মতো করে কাছে পাবে। হাবিব কাঁপা কাঁপা হাতে অরিতনের চোখ ধরে ফেলে পেছন থেকে। অরিতন শিহরিত হয়ে আঁকড়ে ধরে হাবিবকে। অনেক দিনের বাসনার ঢেউ আছড়ে আছড়ে পড়ছে যেন মনসমুদ্রে। আজ রাতে দু’জন দু’জনায় যেন এক হয়ে যাচ্ছে। তাদের মাঝখানে কেউ নেই। তারা সমাজের শ্রেণি বৈষম্যের দেয়াল ভেঙে একে অপরকে কাছে টেনে নেয়। এই প্রকৃতি , সুবিশাল আকাশ তাদের এই মিলনের সাক্ষী হয়ে থাকে। অরিতনের মা কোঁকানি দিয়ে ওঠে কিরে অরিতন কইরে মা। কই গেলি এত রাইতে। মায়ের গলা শুনে অরিতন। ছাদ থেকে নিচে নেমে আসে। তার সমস্ত শরীর জুড়ে ঘাম, চুলগুলো এলোমেলো। বঙ্গোপসাগর থেকে একটা ঝড়ো হাওয়া এসে যেন আল্পস পর্বতমালায় গিয়ে শান্ত হয়েছে। মা অরিতনের এই রূপ কখনো দেখেনি। নদীর ভাঙনের মতো ক্ষয়িঞ্চু রূপ। সে নিজের পাড়কে ভেঙে নদীর আয়তনকে বড় করার প্রয়াস হাতে নিয়েছে যেন। মা শিহরিত হয়, আঁতকে ওঠে এক অজানা ভয়ে।
পাঁচ
সপ্তাহখানেক পরে। পিয়ন এসে একটা চিঠি ফেলে যায় লেটার বক্সে। অরিতনের বুকটা চিঠির খাম দেখে ধক করে ওঠে। কেমন যেন একটা অজানা ভয়ে কাতরে ওঠে অরিতন। করিম শেখ এসে লেটার বক্স থেকে চিঠিটা বের করে বড়বাবুকে দেয়। করিম শেখ হাবিবকে চিঠির খামটি দেয়। হাবিব খাম খুলতেই তার মুখটা মলিন হয়ে ওঠে। অরিতন বাবুর মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারে এ চিঠি কিসের। তার চোখের কোনায় অশ্রæ ভিড় করে। সে হাউ মাউ করে কাঁদতে চাইছে কিন্তু পারছে না। হাবিব করিম শেখের দিকে তাকিয়ে বলে- চাচা আমার ট্রান্সফার নোটিশ। আমাকে কাল চলে যেতে হবে ঢাকায়। করিম শেখও আবেগে কান্নারত হয়ে ওঠে। যাবেনইতো বাবু। কর্তার ইচ্ছায় কর্ম। মাঝখানে শুধু মায়াখেলা। হাবিব আলমারির ভেতর থেকে কাপড় চোপড় বের করতে করতে বলে- তোমাদের সাথে আমার সবসময় যোগাযোগ থাকবে। আমি কখনই তোমাদের ভুলবোনা- ভুলতে পারবো না। এই পাহাড়, এই টিলা, তোমাকে, অরিতনকে কীভাবে ভুলি বলো। অরিতন কান্নায় ভেঙে পড়ে। সে কান্না থামাতে পারেন। দৌড়ে চলে যায় ছাদে।
করিম শেখ হাবিবের ব্যাগ গোছাতে থাকে। হাবিব ছাদের ওপরে গিয়ে দেখে অরিতন দূর আকাশের দিকে দুহাত প্রসারিত করে দাঁড়িয়ে আছেন। খুব বেশি আনন্দ হলে অথবা খুব কষ্ট পেলে অরিতন এভাবে দু’হাত দুদিকে প্রসারিত করে দাঁড়িয়ে থাকেন। মানুষের মধ্যে যে দ্বৈত সত্তা বাস করে সে সত্তাকে মানুষ মূলত কখনো এড়িয়ে থাকতে পারেনা। নিজের অসহায়ত্বে তা খোলস ছেড়ে বেড়োয়। হাবিব অরিতনের কাঁধে হাত রাখে।
-“ জানিনা কি থেকে কী হয়ে গেল। কেন যে এ মায়ায় জড়ালাম। তোমাদের ছেড়ে যেতে অনেক কষ্ট হচ্ছে। তবু যেতে হচ্ছে। কাল ভোরে রওয়ানা দিব।”
অরিতন কিছু একটা বলতে চায় কিন্তু বলতে পারেনা। তার কণ্ঠ আটকে আসে পরম আবেগে। তার ভেতরে বেড়ে উঠছে অঙ্কুরিত এক ঢোল কলমি ফুল।”
পরদিন খুব ভোরে জিপ আসে। বড়বাবু হাবিব আহমেদ তার আবেগকে দমন করে চলে যাচ্ছে। সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে জিপ পাহাড়ি আঁকা বাঁকা রাস্তা ভেঙে ভেঙে দূরে চলে যায়। অরিতন ছাদের ওপরে দাঁড়িয়ে দূরে চলে যাওয়া জিপটার দিকে তাকিয়ে থাকে। তার বুকের ভেতর শূন্যতা অনুভূত হয়।
ছয়
এরপর বহুবছর কেটে যায়। পাহাড়ি টিলা এখন আর আগের মতো নেই। পাহাড় ধ্বসে একদম ছোট হয়ে গেছে। আগের স্থাপনা ভেঙে নতুন ভবন গড়া হয়েছে। কোন এক বিকেলে একটা জিপ বাংলোর সামনে এসে ভিড়ে। জিপ থেকে নেমে আসেন বড়বাবু হাবিব আহমেদ। তার হাতে সুটকেস। করিম এগিয়ে যায়। তার চোখে মুখে খুশির ঝলক।
-আরে বড়বাবু যে।
-আমি কি ভুল দেখছি?
– না ভুল দেখছো না। আর সবাই কোথায়? অরিতন? কাকিমা?
অরিতনের কথা বলতেই করিম শেখের মুখে কালো মেঘ নেমে আসে যেন। সে কোনো কথা বলেনা।
একটা আট ন বছরের ছোট্ট মেয়ে দৌড়ে আসে করিম শেখের কাছে। দাদু দাদু চলনা ঘুরে আসি। ও পাহাড়টোর গায়ে কত সুন্দর সুন্দর ফুল ফুটেছে । দেখে আসি চলো।
ছোট্ট শিশুটির আহবানে করিম সাড়া না দিলেও হাবিব ঠিকই সাড়া দেয়। খানিকটা তার বুকের ভেতর ধক করে ওঠে। অবকল অরিতনের মতো দেখতে।
হাবিব হাসিমুখে বলে- ‘চাচা এ বুঝি অরিতনের মেয়ে।”
করিম শেখ কোনো কথা না বলে সুটকেস নিয়ে ওপরের ঘরটায় যায়।
হাবিব তার পকেট থেকে একটা চকলেট বের করে বলে- কি নাম তোমার মামুনি।
চকলেট হাতে নিয়ে বলে- কলমি। পাহাড় ঘুরতে যাবে?
হাবিব কলমির গাল টেনে বলে আলবৎ যাবো।
পাহাড়ের ওপরে ছোট ছোট ঝোপ অনেক ভাঁটফুল ফুটেছে। খানিক বাদে বাদেই ঢোল কলমি ফুল। একটু উঁচু টিলায় একটা মাটির ঢিবি দেখা যাচ্ছে। কলমি ওখানে গিয়ে দু’হাত তুলে মোনাজাত করতে থাকে। আর কাঁদতে থাকে। ‘মা, আমি ভালো আছি, তুমি ভালো আছো তো। এই দেখো এক বড়বাবু আমায় চকলেট দিয়েছে।”
করিম শেখ কান্না মুছতে মুছতে সামনে আসে। হতভাগি পাহাড় ধসে মরেছে। সেই আপনি যে গেলেন। তার কদিন বাদেই পোয়াতি হলো। মানুষের কটুকথা আর লোকলজ্জায় বহুবার মরতে গিয়েছিল। মরতে দেইনি। শেষমেষ ওই ওপর ওয়ালাই ব্যবস্থা করে দিলেন। মরার সময় এই মেয়েটাকে রেখে গেছেন। এতো তোমারই মেয়ে বাবু।
হাবিব মেয়েকে জড়িয়ে ধরে হুঁহুঁ কেঁদে ওঠে। মাগো মা, আমাকে মাফ করে দিস মা।
সন্ধ্যা নেমে আসে। আজ পূর্নিমার রাত। ছাদের ওপরে হাবিব মেয়েকে নিয়ে দুহাত দুদিকে প্রসারিত করে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। ওই দেখ, ওই ছোট্ট তারাটি তোর মা। একটা স্নিগ্ধ মিষ্টি বাতাস পুরো ছাদে বিরাজ করছে। রাতের আকাশের সব আলো যেন বাবা মেয়ের চোখের জলে জ্বলজ্বল করে জ্বলছে।
স্বপঞ্জয় চৌধুরী।
কবি, প্রাবন্ধিক, অনুবাদক ও কথাসাহিত্যিক।
জন্ম :১৯৮৪ সালের ৬ জুন।
পড়াশোনা: ঢাকা কলেজ থেকে হিসাববিজ্ঞানে স্নাতোকত্তোর
পেশা ও কর্মস্থল: প্রভাষক, হিসাববিজ্ঞান বিভাগ, সাউথ পয়েন্ট কলেজ।
ইতিপূর্বে কাজ করেছেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে এ্যসিসট্যান্ট কো–অর্ডিনেটর পদে।
এছাড়াও তিনি বিভিন্ন সময় জাতীয় দৈনিকে খন্ডকালীন সাংবাদিকতা ও সাপ্তাহিক
পত্রিকায় সম্পাদনা করেছেন।
লেখালেখির ক্ষেত্র: কবিতা, গল্প, অনুবাদ, প্রবন্ধ, উপন্যাস, ছড়া গান, চিত্রনাট্য ইত্যাদি ।
প্রকাশিত গ্রন্থসমূহ: কাব্য :পতঙ্গ বিলাসী রাষ্ট্রপ্রেম(২০১১, সাহিত্যদেশ প্রকাশনী)
গল্প: জলপিপিদের বসতবাড়ি(২০১৩, পূর্বা প্রকাশনী)
কাব্য : কালযাত্রার স্নিগ্ধ ফসিল(২০১৬, শব্দসাঁকো, কলকাতা)
কাব্য: দ্রোহ কিংবা পোড়ো নদীর স্রোত(২০১৮- চৈতন্য প্রকাশনী)
কিশোর কাব্য: মায়ের মতো পরি( ২০২০,অক্ষরবৃত্ত প্রকাশনী)
কাব্য: গহিনে অরণ্য নদী (২০২১, বেহুলা বাংলা প্রকাশনী)
গল্প: ডুবেছিল চাঁদ নিশিন্দা বনে (২০২১, অণুপ্রাণন প্রকাশনী)
প্রবন্ধ: নিগূঢ় শিল্পের কথাচিত্র (২০২১, অনুপ্রাণন প্রকাশনী)
অনুবাদ( কাব্য): ভিন পাখিদের স্বর (২০২২, বেহুলা বাংলা প্রকাশনী)
গল্প: মৃৎচক্রের দিনগুলো ( ২০২৩, অনুপ্রাণন প্রকাশনী)
কাব্য: জলাঙ্গি ও ভাটপুষ্পসমূহ (২০২৩, বেহুলাবংলা)
লিখেছেন বিভিন্ন দেশী বিদেশী দৈনিক ও সাহিত্য পত্রিকায়।
পুরস্কার: সাহিত্য দিগন্ত লেখক পুরস্কার-২০২০( গল্পগ্রন্থ- জলপিপিদের বসতবাড়ি)
বাঙালির কণ্ঠ সাহিত্য পুরস্কার-২০২০ (কাব্যগ্রন্থ- দ্রোহ কিংবা পোড়ো নদীর স্রোত)
ইন্টারন্যাশনাল পিস এম্বাসেডর সম্মাননা
দাবানল সাহিত্য পুরস্কার-২০০৪ ( কবিতা- রক্তাক্ত রাজপথ)
Rivista Letteraria Lido dell’anima PREMIO(ROME)
সম্পাদনা: শিল্প সাহিত্যের ওয়েব পত্রিকা শব্দকুঞ্জwww.shabdakunja.com