শব্দকুঞ্জ ঈদসংখ্যা
গল্প
আহ্লাদ
পিনাকী দত্ত
গল্প
আহ্লাদ
পিনাকী দত্ত
গ্রামের নাম নূরপুর । তবে এই নূর সমাজের সর্বস্তরে ছড়িয়ে পড়েনি।তাই শিক্ষিত-অশিক্ষিত, চাষাভূষো ,গরীব-ধনী-ফকির-মিসকিন সবধরণের মানুষের বাস এই গ্রামে । সম্প্রতি তামাকের ব্যবসাকে কেন্দ্র করে এখানে বহু দোকান গড়ে ওঠায় অনেকটা গঞ্জের চেহারা নিয়েছে ।ভাগ্যান্বেষণে বহু মানুষ এখানে এসে দোকান দিয়েছে।কেউ কাপড়ের, কেউবা মনোহারি, কেউবা গালামাল ,কেউবা পান-বিড়ি-সিগারেটের দোকান । এরকমই এক ভাগ্যান্বেষী জামাল হুসেনের ভাগ্যতরী এসে ভিড়ল নূরপুরে।
নূরপুর বাজারে তার ছোট্ট একটি মনোহারী দোকান রয়েছে । সপ্তাহে পাঁচদিন সেখানেই সে দোকান করে । আর সোম ও শুক্রবার মাইল চারেক দূরে মুর্গাটোনা হাটে হাট করতে যায়।বিক্রি বাট্টা ভালোই হয়।তার সাথে কিছু মরসুমী ফসল একটু একটু মজুত রাখে।
এভাবে ভালোই চলছে ।বেশ কয়েক বছর হল বিয়ে করেছে । আল্লাহ্’র রহমতে ঘর আলো করে দুটো মেয়েও এসেছে- টগর ও গোলাপ (যমজ দুই মেয়ে)। এমাসে ওরা এগারোয় পড়ল।এখন ওদের চোখ ফুটেছে।ওরা বায়না ধরেছে এবারের ঈদে “ফ্যাশন পার্ক”থেকে জামা কিনে দিতে হবে।নইলে ওদের জামা বরাবর কালামের “ফ্যান্সি স্টোর্স” থেকেই আসে।মেয়ে দুটি জামাল হুসেনের কলিজার টুকরা ।তাই জামাল কথাটা ফেলতে পারলো না।
মেয়েদের কথামত জামাল হোসেন একদিন বুটভাজা,মুড়ি ,পিঁয়াজু ,ঝুরিভাজা, বুন্দিয়া,কাগজি লেবুর সরবত দিয়ে ইফতার সেরে দুরু-দুরু বুকে “ফ্যাশন পার্কে”র সামনে গিয়ে দাঁড়াল ।ভিতরে তখন মেলা ভীড় ।পয়সাওয়ালা ঘরের ছেলে মেয়েরা রঙিন প্রজাপতির মত টুল আলো করে বসে আছে ।
জামাল হোসেনকে জড়সড়ভাবে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে দোকানের কর্মচারী ভিতরে ঢুকতে বলল
○আরে আপনে বাইরে খাড়াইয়া আছেন ক্যান?ভিতরে আইয়েন।
● জামাল কাঁপতে -কাঁপতে ভিতরে গিয়ে দাঁড়াল ।
○কর্মচারী হাইস্যা কইল-পোলা না মাইয়া?বয়স কত কন? আর অত ডরানের কি আছে?
●জামাল ঢোক গিইল্যা কোন রকমে বলল- মাইয়া। তয় দুইডা।বয়স-এগারো ।
○ চক্ষের নিমিষে কর্মচারীটা বাণ্ডিল-বাণ্ডিল জামা নামিয়ে দেখাতে লাগল ।
●জামালের তো টাসকি লাইগ্যা যাওনের মত অবস্থা।এত সোন্দর -সোন্দর জামা ।মনডা কয় সবগুলান লইয়া যাই টগর-গোলাপের জন্য ।যা সোন্দর লাইগব না মাইয়া দুইডারে।কিন্তু আল্লাহ্ তো তারে অত খেমতা দেয় নাই।তাই অতি কষ্টে লোভ সামলাইয়া সে দুইখান জামা বাছল।
একখান জামা উপরের দিকটা ক্রিম কালার আর নীচের দিকটা পার্পল ।আর গলার কাছে পিছন দিক থেইক্যা দুইডা ফিতা আইস্যা বুকের কাছে একটা কদমফুল ঝুলছে।এইডা তার মাইয়া গোলাপকে যা লাগব না !ঝ্যান পরী।
আর টগরের জন্য বাছলো একই ডিজাইনের জামা, শুধু নীচটা সবুজ ।
●আহা! জামাল কল্পনায় দেখতে পেলো-ঈদের দিন টগর -গোলাপ জামা দুইখান পইরা বন্ধুদের লগে ঘুরতে যাইত্যাছে।মাইয়া না,ঝ্যান দুইডা প্রজাপতি ।
○মিঞাভাই !কথা কন না ক্যান?পছন্দ হয় নাই?
দোকানের কর্মচারীর কথায় সম্বিৎ ফিরে জামালের।
● সে জানায় খুব পছন্দ হইছে।
সে জিগায়, ‘ভাইছাব, দাম কত?’
○ দোকানের কর্মচারী জামার ভিতরে একটা সাদা কাপড়ের টুকরোয় কি জানি লেখা আছে তা দেখে বলল-“দুইডার দাম দুইহাজার পড়ব”।
●দু—ই-ই হাজার।আর একটু হলেই জামাল মাথা ঘুইরা পইড়া যাইত।সে কোনমতে নিজেরে সামলাইয়া লইল।
○কর্মচারী-“কোন সমস্যা?
●সমস্যা–মানে
○বাজেট ফেল কইরা গ্যাছে ?তাই তো ? ফ্যাশন পার্কে আইবেন আর একটু টাকা খরচ না করলে চলব ক্যামনে ?
●জামাল কিন্তু কিন্তু কইরা কইল –“জামা দুইডা কি রাইখ্যা দ্যাওন যাইব?যদি পরে আইস্যা নিয়া যাই।
○কর্মচারীটি বলল ,সমস্যা নাই।অনেক জামা আছে।তবে এইগুলান রাখন যাইব কিনা হেইডা কইতে পারি না।বোঝেন-ই তো সব।আমরা হইলাম বেতনভূক কর্মচারী ।তবে আপনে যখন কইত্যাছেন তখন আমি রাইখ্যা দিতাছি।ঈদের তো সপ্তাহখানেক বাকী।দ্যাখেন।
●কৃতজ্ঞতায় কর্মচারীটির হাত দুইডা জড়াইয়া ধরলো জামাল ।
○করেন কি !করেন কি চাচা!আপনি হইলেন মুরুব্বি মানুষ ।আর আপনে মনে হয় আমারে চিনতে পারেন নাই ।আমি কামাল ,কলিমুদ্দিনের পোলা।আপনের দোকান থেইক্যাই তো মাল নেয় আব্বা ।
●“ও আইচ্ছা! আইচ্ছা!” বলে মুখটা কালো করে বের হয়ে এলো জামাল ।
দুই।
‘তারাবি’নমাজ শেষ কইরা রহিমা বিবি ভাবলেন, অনেক রাইত হইছে।যাই রান্ধনের যোগাড় করি গিয়া।আইজ স্বামীর পছন্দমত টাকি মাছের (ল্যাঠা) নাড়া ,আর বাইগন ফালি -ফালি কইরা কাইট্যা পেঁয়াজ কুঁচি দিয়া ট্যাংরা মাছ রান্ধুম।
পেঁয়াজ কুঁচি, রসুন থেতো কইরা, হলুদ,নুন,কাঁচা মরিচ, তেল দিয়া ভালো কইরা টাকি মাছগুলানরে মাইখ্যা রহিমা বিবি চুলায় বসাইয়া দিল।লকড়িগুলান একটু পিছনে নিয়া আইস্যা আচটারে একটু ঢিমা কইরা দিয়া ঢাকা দিয়া দিল।কিছুক্ষণ পর ঢাকনা খুলতেই সুবাসে জিভে পানি চইল্যা আইলো। এরপর এট্টু বিলাতি ধইন্যা পাতা ছিটাইয়া দিলো।
হঠাৎ কইরা রহিমা বিবির খেয়াল হইল, আরে,মাইনষেটা তো অনেকক্ষণ আইছে ।রা কাড়ে না ক্যান? অন্যদিন তো টাকি মাছ হইলে রান্ধনের ঘরে ঘুরঘুর করে ।মাইয়া দুইডাও ঘুমাইয়া পড়সে। তয় শরীলডা কি খারাপ করছে?
রহিমা বিবি লম্ফটা হাতে নিয়া শোয়ার ঘরের দিকে গেল।দেখলো, মানুষটা কেমন উদাসীনভাবে কড়িকাঠের দিকে চাইয়া আছে।কোনদিকে হুঁশ নাই । মুখটা পুরো কালা ছাই।
রহিমা বিবি ভয় পাইলো ।এমনিতে মানুষটা দিলখোলা। হাসি -মস্করায় মাতাইয়া রাখে।ঘরে পয়সা না থাকতে পারে কিন্তু সুখ আছে ষোলো আনা ।হায় আল্লাহ্! তার সংসারে কার কুনজর পড়ল ?ধীরে ধীরে সোয়ামীর কাছে গিয়া কইল,কি হইছে কন?
ধ্যান ভঙ্গ ঋষির মত চমকাইয়া উঠলো জামাল । সংক্ষেপে হগ্গল কথাই কইল বৌকে।
● থোন তো পোলাপানের প্যাচাল।অগো কি আর অত বোধ আছে ? আপনি কালামভাইয়ের দোকান থেইক্যাই জামা কিইন্যা দ্যান।
○ না বউ ,এইডা হয় না।আমি দুইখান জামা বাইছ্যা রাইখ্যা আইছি।
ঈদ তো মঙ্গলবার ।তার মানে রবিবার নূরপুরের হাট আর সোমবার মুর্গাটোনার হাট পামু।তার মানে হাজার দেড়েক হইয়া যাইব। ইনশাল্লাহ্! বাকী রইলো আর পাঁচশো। তবে এইডা পূরণ করার কোন দিশা খুঁইজ্যা পাইল না জামাল।
●ঠিক আছে ।ঠিক আছে ।থোন তো এইসব হিসাব-পত্তর।আল্লাহ্ রে ডাকেন।সব ব্যাবস্থাই উনি কইরা রাখছেন ।আমরা মাইনষেরা শুধু দেখবার পাই না।কথাগুলো একটানা বলে গেল রহিমা বিবি ।
○দীর্ঘশ্বাস ফেলে জামাল হুসেন খাইতে গ্যালেন।
○এর মধ্যে তিনি দুইদিন ফ্যাশন পার্কের সামনে থেইক্যা ঘুইরা আইছেন।জামা দুইখান সামনে ঝুলাইয়া রাখছে দেইখ্যা জামালের বুকটা ধড়াস কইরা উঠল।হায় আল্লাহ্! জামা দুইখান যেন কেউ না কেনে।আর তো মাত্র দুইডা দিন।আল্লাহ্ আমার কথাডা শুইনো।আল্লাহ্ রে ডাকতে লাগল জামাল ।
তিন।
সোমবার সইন্ধ্যা ।ঈদের চান্দ দেখা গ্যাছে। চারিদিকে খুশির আমেজ।মাইনষেরা খুশিতে ফাইট্যা পড়তাছে।শুধু একজনের মনেই চান্দের আলো পড়ে নাই। সে জামাল হুসেন । বিক্রি- বাট্টা ভালা না । মাইয়া গো জামা দুইডা আর কেনা হইল না । অহন কালামের দোকানই ভরসা।
দোকানে হাট ফেরৎ মালপত্তর গুছাইয়া রাইখ্যা ঝাপ ফেলতে যাবে এমন সময় কামাল আইস্যা উপস্থিত ।
● চাচা -এই লন আপনার মাইয়ার জামা দুইডা ।
○ “জা আ মা আ!”
●প্যাচাল পারণের সময় নাই চাচা।দোকানে মেলা কাম—–বইল্যাই, কোন কথা কওনের সুযোগ না দিয়াই ,কামাল চইল্যা গেল।
○কোথা দিয়ে কি হইয়া গ্যাল জামাল কিছুই বুইঝ্যা উইঠতে পারল না।শুধু উপরের দিকে তাকাইয়া আল্লাহ্ ‘র কাছে শুকরিয়া আদায় করল।
○টগ-অ-অর—গো -ল-আ-প এর আম্মা কই গেলা?
স্বামীর তীব্র চিৎকার শুইন্যা রহিমা বিবির বুকটা ধড়াসস্ কইরা উঠল।
হায় আল্লাহ্ ! কাউলকা ঈদ। আর আজ কী আবার সব্বোনাশ হইলো?তার মনে পইড়া গেল আগেকার কথা।সেই দুবারই তো হাট করে ফেরার পথে রাস্তাতেই সব মাল লুঠ করে নিয়েছিল ডাকাইত নিব্বংশীয়ারা ।রাতের বেলা সশস্ত্র ডাকাত দলের সামনে অসহায়ভাবে আত্মসমর্পণ করা ছাড়া আর কোন উপায় ছিল না জামাল হুসেনের । সর্বস্বান্ত হয়ে ফিরে এসে ধপ্ করে বসে পড়েছিল জামাল ।মুখে কোন কথাই সরছিল না । দৃষ্টি ছিল উদ্ভ্রান্ত ।
● হাত -পা কাঁপতে শুরু করেছে রহিমা বিবির।হাতের লম্ফটা আরেকটু হলেই পড়ে যাচ্ছিল ।কোনমতে সামলে নিলো।এমন সময় দেখা গেল টগর-গোলাপের আব্বাকে।ডানহাতে তবিলের ব্যাগ আর বামহাতে একটা কিসের জানি প্যাকেট ।
যাক মানুষটা কাছে আসতেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল রহিমা বিবি ।সে সোয়ামীর উপর রাগ দেখাইয়া কইল—“আপনে কি যে করেন ?দিছিলেন তো ডরাইয়া।আপনের হাতে ওইডা কি?
○জামাল একমুখ হাসি নিয়া কইল -বৌ ঘরে চলো,দেখাইতাছি তোমারে-কি লইয়া আইছি।
●“ইস্ ! আসমানের চান্দ ঝ্যান নিয়া আইছেন”। কপট রাগের সাথে বলল রহিমা বিবি ।
○জামালের যেন তর সইছে না ।সে বউকে তাড়াতাড়ি লন্ঠনের আলোটা বাড়াইতে কইলো।টগর-গোলাপ কই ?অগরে দ্যাখতে পাইত্যাছি না তো?
●ইস্ ঢঙের কথা কইয়েন না তো !টগর – গোলাপ কোনদিন জাইগ্যা থাকে আপনার জন্য ।আপনার আসতে-আসতে তো দশটা বাইজ্যা যায় । ওরা তো নয়ডা বাজতে না বাজতেই ঘুমে ঢুইল্যা পড়ে।কয়ডা বাজে হেইডা খেয়াল আছে? আজ শেষ রোজা রাখছিল । ক্লান্ত হইয়া ঘুমাইয়া পড়সে।
○ জামাল ধীরে ধীরে বিছানার কাছে গিয়া ঘুমন্ত টগর -গোলাপের দিকে তাকালো।আহা! কি নিষ্পাপ মুখ ! সে উপরের দিকে তাকাইয়া আল্লাহ্ -র কাছে শুকরিয়া আদায় করলো।এরম দুইডা ফুলের মত মাইয়া উপহার দ্যাওনের জন্য ।তারপর প্যাকেট খুইল্যা জামা দুইডা বাইর কইরা ঘুমন্ত টগর-গোলাপের উপর আলগোছে রাখল।
○মাশা -আল্লাহ্! কথাটা দুজনের মুখ দিয়া বেরিয়ে এলো ।ঝ্যান জান্নাতের দুইখান হুর নাইম্যা আইছে অগো গরীবখানায়।
তারপরই জামাল আশ্চর্য হইয়া বৌরে কইল –“এইডা কি কইরা সম্ভব হইল কও দেখি?”
●রহিমা বিবি মুচকি হাইস্যা কইল -রাগ কইরেন না।আপনেরে না জিগাইয়া একখান কাম কইরা ফেলছি। ঘরে কয়েক বস্তা যে ধান আছিল কাশেম মিঞার কাছে বিক্রি কইরা দিছি।সেই টাকা কাউলকা দিয়া আইছি ফ্যাশন পার্কের মালিকের কাছে । শুধু বইল্যা দিছি -‘জামা দুইখান ঝ্যান আপনের হাতে দেয় আর কোন কথা ঝ্যান না বলে।
○ জামাল আনন্দে- আবেগে বউরে কাছে টাইন্যা নিলো।
●করেন কি ! করেন কি ! মাইয়ারা আছে।
○ “মাইয়ারা ঘুমাইয়া-ঘুমাইয়া বুঝি দেখত্যাছে।”–
বইল্যাই বউকে জড়াইয়া ধরলো। রহিমাবিবিও আর বাঁধা দিল না। কাঁচা মেহেন্দির রঙ তখন ওদের দুজনের শরীরেই ছড়িয়ে পড়তে লাগল ।