You are currently viewing শব্দকুঞ্জ বর্ষা কদম্ব সংখ্যা। গল্প: গল্পটি কাকতালীয়-পলাশ মজুমদার

শব্দকুঞ্জ বর্ষা কদম্ব সংখ্যা। গল্প: গল্পটি কাকতালীয়-পলাশ মজুমদার

শব্দকুঞ্জ বর্ষা কদম্ব সংখ্যা

গল্প
গল্পটি কাকতালীয়
পলাশ মজুমদার

গল্পটি কাকতালীয়

পলাশ মজুমদার

 

তিন মাস হলো নন্দিনীর পিরিয়ড বন্ধ। রজঃস্ত্রাব শেষবার হয়েছিল জানুয়ারির ৭ তারিখে। আজ এপ্রিলের ১৫। অথচ কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। তবে কি অনাকাঙ্ক্ষিত অঘটন ঘটেছে? প্রতি মাসের ওই দিনগুলোতে সে আশায় থাকত, এই বুঝি ব্যথা শুরু হয়ে গেল।

একটা অস্বস্তি ভাব কুরে কুরে খাচ্ছে নন্দিনীকে। কিছুতেই শান্তি পাচ্ছে না সে। শরীর মন দুটোই যেন তার সঙ্গে দিনের পর দিন বিশ্বাসঘাতকতা করে চলেছে। মাথা ঘুরছে। ঘুম হচ্ছে না ঠিকমতো। ঘুম এলেও ভেঙে যাচ্ছে যখন-তখন। সারা শরীরে একধরনের ব্যথা। পা যেন চলছে না। কাজ করার জন্য শক্তি পাচ্ছে না দুই হাতে। সেই সঙ্গে মানসিক অবসাদ একদম কাবু করে ফেলেছে তাকে। এমন হচ্ছে কেন সে বুঝতে পারছে না। তবে কি কোনো জটিল রোগ তার শরীরে বাসা বেঁধেছে?

কারও সঙ্গে আলাপ করতে পারলে হয়তো পাওয়া যেত কোনো সমাধান। অথচ আলাপ যে করবে, সেই উপায় তার নেই। একধরনের লজ্জাবোধ আঁকড়ে ধরেছে তাকে। স্বামীকে এই কথা বলা কি সম্ভব? কী মনে করবে ধ্রুব? সে জানে, কিছুতেই তার কথা ধ্রুব বিশ্বাস করবে না। বিশ্বাস করার কথাও নয়। কারণ, অনেক দিন ধরে সে স্বামীসঙ্গ থেকে বঞ্চিত। কম করে হলেও প্রায় এক বছর। তাহলে কীভাবে ঘটল ঘটনা?

এই কথা শুনলে হয়তো ধ্রুব মুহূর্ত মাত্র বিলম্ব না করে ডিভোর্স লেটার পাঠিয়ে দেবে। সে হবে পরিবার ও সমাজ পরিত্যক্তা। কী উপায় হবে তার। সে যে কোনো কাজ জানে না। চাকরি করবে, সে রকম যোগ্যতার ঘাটতি আছে তার; ব্যবসায় করার মতো বুদ্ধিও নেই।

ধ্রুব দেশের বাইরে থাকে। ফ্রান্সে। ছুটি নিয়ে তিন মাসের জন্য এলেও বিয়ের কারণে প্রায় ছয় মাস কাটিয়ে গেছে। ধ্রুব বলত সে ফ্রান্সে চলে গেলে যদি নন্দিনীকে আর ফিরে না পায়; তাই তার মন বিদেশে যেতে সায় দিচ্ছিল না। এমনই ভালোবাসা নন্দিনীর জন্য জন্ম নিয়েছিল তার মনের মধ্যে। তার প্রতি ধ্রুবর এই আবেগের বহিঃপ্রকাশ নন্দিনীকে মাঝে মাঝে বিস্মিত করত।

একবার ধ্রুব কথা প্রসঙ্গে নন্দিনীকে বলেছিল, আর বিদেশ না গিয়ে দেশে ব্যবসা করলে কেমন হয়; তাহলে তোমার কাছে কাছে থাকা যেত। নন্দিনী হেসে বলেছিল, তুমি যা ভালো মনে করো তা করো। আমার কিছুতে আপত্তি নেই। আমি তোমারই থাকব।

দেশে কিছু করার জন্য কিছুদিন ঘোরাঘুরি করে মনঃপূত ব্যবসা খুঁজে পেল না ধ্রুব। অগত্যা চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। যাওয়ার মাস তিনেক আগে থেকে সন্তান নেওয়ার জন্য ধ্রুব উঠেপড়ে লাগে। একটা ভয়ের কথা সে প্রকাশ করেছিল—নন্দিনী, আমার সঙ্গে যদি আর কখনো দেখা না হয়, আমার সন্তান নিয়ে তুমি বাকি জীবন পার করে দেবে। আমি সব সহ্য করতে পারলেও তোমাকে অন্য কোনো পুরুষের পাশে মেনে নিতে পারব না। তুমি শুধু আমার থাকবে।

ধ্রুবর এমন আবেগ-মিশ্রিত সংলাপ শুনে নন্দিনীর বুক কেঁপে ওঠে। হাহাকার জাগে মনে। হায়রে নারী-পুরুষের ভালোবাসা। সম্পর্কের প্রথম পর্যায়ে এমন আবেগ উছলে উঠলেও ধীরে ধীরে তা কমতে থাকে। সে যে পক্ষেরই হোক না কেন। জীবনে সে কম দেখেনি। কষ্টে কষ্টে বুক ঝাঁঝরা হয়ে গিয়েছিল তার। এমনি এমনি তো ধ্রুবকে বিয়ের সিদ্ধান্ত সে নেয়নি। প্রত্যেক মানুষ কী ভীষণ অভিনেতা! পরিস্থিতির খাতিরে মানুষ আবেগে আপ্লুত হয়; পরিস্থিতির কারণেই আবার ছিটকে পড়ে পরস্পরের কাছ থেকে।

এত চেষ্টার পরও কিছুতে নন্দিনী কনসিভ করছিল না। এ জন্য ভেতরে ভেতরে ধ্রুবর কষ্ট ছিল। মুখ ফুটে সে কথা একবার মাত্র বলেছিল। নন্দিনী ভয় পায়। সে আবার বন্ধ্যা নয় তো? ধ্রুবর চাপাচাপিতে ডাক্তারের কাছে গেলে তারা জানতে পারে, সমস্যা নন্দিনীর নয়, ধ্রুবর। তবে চিকিৎসা করলে ঠিক হয়ে যেতে পারে।

বিদায়কালে ধ্রুব বলেছিল, কিছুদিনের মধ্যে নিয়ে যাব তোমাকে। আমার চিকিৎসাও ওখানে গিয়ে করাব। প্যারিসে গিয়েই তোমার জন্য কাগজপত্র জমা দেব।

নন্দিনীকে নেওয়ার বিষয়টা কাগজপত্রের কিছু ঝামেলার কারণে সম্ভব হচ্ছিল না বলে কয়েকদিন আগে ধ্রুব জানিয়েছে; তবে তার চেষ্টার কোনো ত্রুটি নেই।

নন্দিনী ধ্রুবর কথা বিশ্বাস করে। অবিশ্বাসের কোনো কিছু সে আজ পর্যন্ত অনুভব করেনি। ধ্রুবর মতো এমন বউ-পাগল পুরুষ চেনাজানা মানুষের মধ্যে সে দেখেনি। প্রতিদিন তার সঙ্গে অন্তত এক ঘণ্টা কথা না বললে ধ্রুবর ভাত হজম হয় না। সে কথা ধ্রুব জানায় অকপটে। কোনো ধরনের কুণ্ঠাবোধ ছাড়াই। নন্দিনী মনে মনে হাসে।

স্বামীর এই মাত্রাতিরিক্ত ভালোবাসার কথা ভেবে নন্দিনী চমকে ওঠে। বিবাহিত পুরুষের এমন ভালোবাসা যেকোনো স্ত্রীর জন্য অহংকারের বিষয়। অথচ কত নারী স্বামীর ভালোবাসাকে পায়ে দলে চলে যাচ্ছে অন্য পুরুষের হাত ধরে। সেসব নারীর জন্য নন্দিনীর ওই মুহূর্তে করুণা হলো। কখনো পুরুষ স্ত্রীর ভালোবাসা ছেড়ে চলে যাচ্ছে অন্য আকর্ষণে। এ ধরনের পুরুষদের মনে মনে ধিক্কার দিল সে।

নন্দিনী ভাবে পরিস্থিতির কারণে সে সম্পর্ক ছিন্ন করলে ধ্রুব কি থাকতে পারবে! পরক্ষণে মনে হয়, অপরের জন্য কারও জীবন কখনো আটকে থাকে না। ধ্রুব কিংবা নন্দিনীও তার ব্যতিক্রম নয়। সময়ই মানুষের সব করণীয় ঠিক করে দেয়।

নন্দিনী কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছে না যে সে প্রেগন্যান্ট। অন্য কোনো বিষয় এর মধ্যে নেই তো? প্রেগন্যান্ট হওয়ার মতো কোনো ঘটনা এই কয় দিনে ঘটেনি। সে তো দ্বিচারিণী নয়। অসম্ভব। তবে এটা কীভাবে সম্ভব হলো। ভেবে কোনো কূলকিনারা পাচ্ছে না সে।

নন্দিনীর বাসায় স্থায়ীভাবে আরও তিনজন মানুষ থাকে। শ্বশুর-শাশুড়ি আর দেবর। শ্বশুরের বয়স পঞ্চান্ন। ছাত্রজীবনে তিনি ক্রিকেট খেলতেন। তাই শরীর বেশ ফিট; বয়স বোঝা যায় না। অসুস্থতার কারণে শ্বশুরের তুলনায় শাশুড়িকে বয়স্ক দেখায়। সাতাশ বছর বয়সী ছেলে ধ্রুব বাপের সঙ্গে বের হলে চেহারার সাদৃশ্যের কারণে অনেকে তাদের সহোদর মনে করে। এই নিয়ে ধ্রুব মাঝে মাঝে মজা করত।

দেবর শুভর বয়স উনিশ। উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছে এবার। বয়সের তুলনায় শুভ বেশ পাকা। শরীরের গঠন চমৎকার। আকর্ষণীয়ও। সে চোখে-মুখে কথা বলে। যেমন চতুর তেমন সাহসী। মেয়েদের প্রতি শুভর প্রচণ্ড দুর্বলতা। গল্প করায় ভীষণ আগ্রহ। চ্যাটাং চ্যাটাং কথা বলে। বেশির ভাগ মেয়েদের নিয়ে। অন্য বিষয়ে যেন কথা নেই। কখনো বান্ধবী নিয়ে আসে বাসায়। ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় কাটায়। দরজা বন্ধ করে গল্প করে। তার মা-বাবা কিছু মনে করে না। প্রথম দিকে নন্দিনী অবাক হলেও পরে এটাকে স্বাভাবিক বলে ধরে নেয়।

শুভর কথাবার্তার ধরন নন্দিনীর কখনো ভালো লাগেনি। গা ঘেঁষে কথা বলতে চাইত বিয়ের পর। চুল ধরে টানত। মুখ টিপে দিত অকারণে। সে দূরে সরে আসত। একদিন কথা প্রসঙ্গে বলেছিল, দাদা পারে তো ঠিকমতো। না পারলে আমি আছি। তোমার কোনো চিন্তা করতে হবে না। প্রয়োজনে ডেকো।

শুভর এমন কথায় নন্দিনী ভয় পেয়েছিল। এত অল্পবয়সী ছেলে এমন চতুর হয় কীভাবে।

শুভ এরকম মাঝে মাঝে তার সঙ্গে ইয়ার্কি করতে চাইত, যা সে মোটেও পছন্দ করত না। তবে স্পষ্ট প্রতিবাদ করতে তার বাধত। ভদ্রতাবোধের কোথায় যেন আটকে যেত। শত হোক, সে তার দেবর এবং বয়সে তার চেয়ে প্রায় চার বছরের ছোট।

নন্দিনী কৌশলে জানিয়ে দিয়েছিল যে শুভর এসব কর্মকাণ্ড তার পছন্দ নয়। কিন্তু শুভ তা কানে নিত না। সামান্যও পাল্টায়নি তার আচার-আচরণ। শুভর চাহনি, স্পর্শ করার মনোভাব, কথা বলার ভঙ্গি তার মধ্যে অস্বস্তি ভাব তৈরি করত। সে গুটিয়ে রাখত নিজেকে। একবার ধ্রুবকে শুভর বিষয়ে জানানোর কথা ভাবলেও পরক্ষণে সিদ্ধান্ত পাল্টায়। তা শুনে হয়তো ধ্রুব হেসে বলত, সে ছোট মানুষ। তুমি এত সিরিয়াসলি নিচ্ছ কেন। তখন লজ্জায় নন্দিনীর মাথা কাটা যেত আরকি।

ননদ প্রীতির বিয়ে হয়েছে বছর দুই আগে। প্রীতির বয়স নন্দিনীর কাছাকাছি। বন্ধুর মতো সম্পর্ক তার সঙ্গে। বিয়ের পর থেকেই প্রীতি থাকে চট্টগ্রামে। অফিসারদের সরকারি কোয়ার্টারে। তার স্বামী অপু কাস্টমসের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা।

প্রীতির এক বছর বয়সী একটি মেয়ে আছে; তাদের বাসায় এলে প্রীতি থাকে পনেরো থেকে বিশ দিন। সাপ্তাহিক ছুটিতে তখন অপুও আসত ঢাকায়। থাকত কয়েক দিন।

মানুষ হিসেবে অপু খারাপ নয়; তবে অপুর ভাবভঙ্গি অন্য রকম। তার সঙ্গে রসিকতা করতে চাইত। কথার মধ্যে থাকত বিভিন্ন ধরনের ইঙ্গিত; কিন্তু নন্দিনী সেসব পাত্তা দিত না। বিয়ের পর ধ্রুবর সঙ্গে নন্দিনীও একবার বেড়াতে গেছে প্রীতির বাসায়। ছিল এক সস্তাহ। তখন সবাইকে নিয়ে কক্সবাজার বেড়াতেও গিয়েছিল। ছিল তিন দিন। ভীষণ মজা হয়েছিল। অপু জানে কীভাবে জীবনকে উপভোগ করতে হয়।

এই পরিবারের সবাই মোটামুটি ভালো মানুষ। তার জন্য সবার আন্তরিকতায় কোনো ঘাটতি নেই। সে তার প্রমাণ একবার পেয়েছিল। মাস তিনেক আগে। রান্না করার সময় হঠাৎ মাথা ঘুরে পড়ে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল নন্দিনী। প্রায় বারো ঘণ্টা পর জ্ঞান ফেরে। তখন হাসপাতালে তার শুশ্রƒষার জন্য শ্বশুর, দেবর ও শাশুড়ি পালাক্রমে কেবিনে ছিল। খবর পেয়ে পরদিন চট্টগ্রাম থেকে হাসপাতালে ছুটে এসেছিল প্রীতি ও অপু। সেবার প্রায় তিন দিন হাসপাতালে থাকতে হয়েছিল তাকে।

আজ সকালবেলা ফার্মেসি থেকে প্রেগনেন্সি টেস্টের স্টিচ এনে যখন নন্দিনী নিশ্চিত হলো, তখন তার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। এটা কিছুতেই হতে পারে না। অসম্ভব।

 

দুই.

ধ্রুবকে নন্দিনী ভালোবেসে বিয়ে করেনি। বিয়ে হয়েছে তার বাবার ইচ্ছেতে। তার মায়েরও ভীষণ পছন্দ ছিল ধ্রুবকে। ধ্রুব অমায়িক ব্যবহার দিয়ে জয় করে নিয়েছিল তাদের মন।

ওই সময় নন্দিনী মানসিকভাবে বিধ্বস্ত। অর্ণবের সঙ্গে ব্রেক-আপের পর সে একদম ভেঙে পড়েছিল। চোখে দেখছিল অন্ধকার। কোনোভাবে ওই দুঃসময় থেকে সে বের হতে পারছিল না। তখনই বিয়ের প্রস্তাব আসে। ওই নিদারুণ অবস্থা থেকে মুক্তি পেতেই সে বিয়েতে সম্মতি দিয়েছিল। মা-বাবাকে সাফ জানিয়ে দিয়েছিল, তোমাদের পছন্দই আমার পছন্দ। আমার ব্যক্তিগত কোনো পছন্দ নেই।

নন্দিনীর জীবনে ভালোবাসা অভিশাপ। যতবার সে ভালোবেসেছে, ততবারই আঘাত পেয়েছে। কেন জানি, কোনো ছেলের সঙ্গে তার সম্পর্ক বেশি দিন স্থায়ী হতো না। হয়তো সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার কৌশল তার অজানা ছিল। অথবা ছেলেরা যা চায়, তা তার মধ্যে ছিল না। কিংবা সে তা দিতে পারত না। সে অন্য সব মেয়ের চেয়ে ব্যতিক্রম। যারা সম্পর্ক করে বিয়ে করত তাদের প্রতি তার ঈর্ষা ছিল।

নন্দিনীর জীবনে প্রথম প্রেম এসেছিল সেভেনে পড়ার সময়। নাইনে পড়–য়া পাশের বাড়ির ছেলে রতন তাকে প্রেম নিবেদন করেছিল। তখনো তার বুঝে ওঠার মতো অনুভতি জাগেনি। সে হ্যাঁ বা না জানায়নি কিছুই। কিছুদিন তার পিছে ঘুরে হয়তো হতাশ হয়ে রতন জড়িয়ে পড়ে তাদের প্রতিবেশি আরেকটি মেয়ের সঙ্গে। আরো কয়েকদিন পর সে বিষয়টি বুঝতে পারে। টের পায় ভালোবাসা কী জিনিস। তত দিনে রতন হাতছাড়া। তখন রতনের ওপর অভিমান হয়েছিল তার; মনে জেগেছিল ঘৃণা।

নাইনে পড়ার সময় তাদেরই এক সহপাঠী সুমন নন্দিনীকে প্রেম নিবেদন করে। তখন ছেলে-মেয়ে সম্পর্কের বিষয়ে সে অনেকটা বুঝতে শিখেছে। ইতিবাচক মনোভাব দেখালেও সে কোথাও ঘুরতে যেতে চাইত না। ভয় ছিল, মা-বাবার কানে যদি এই খবর আসে, তবে তারা তাকে মেরে ফেলবে। তবু একবার সুমনের চাপে তাদের বাসায় যায়। তার পরদিন থেকে সুমন তার সঙ্গে মেশা বন্ধ করে দেয়। বিষয়টি তাকে অবাক করে। সে ভীষণ কষ্ট পায় সে।

মাঝে বিচ্ছিন্ন আরও কিছু ঘটনা ঘটলেও সেসব নন্দিনী আমলে নেয়নি। কখনো আর সিরিয়াস হয়নি। চলছে, চলুক—এই ছিল তার মনোভাব। কলেজে ওঠার পর প্রস্তাব আসে এক সিনিয়র ভাই অর্পণের কাছ থেকে। সেই প্রেমও শেষ পর্যন্ত স্থায়িত্ব পায়নি। এভাবে ঘটনা ঘটতে ঘটতে একসময় সে কলেজ পেরিয়ে চলে আসে বিশ্ববিদ্যালয়ে।

শেষ সম্পর্ক হয়েছিল একই বিভাগের বন্ধু অর্ণবের সঙ্গে। মাস তিনেকের মতো সম্পর্ক ছিল। নন্দিনীর ইচ্ছে ছিল অর্ণবকেই বিয়ে করবে। কথাবার্তাও একরকম চড়ান্ত ছিল। হয়তো হয়ে যেত। সেখানে বাদ সাধে অর্ণবের প্রাক্তন প্রেমিকা জুঁই। অর্ণবও যেন জুঁইয়ের ফিরে আসার প্রতীক্ষায় ছিল। জুঁই ঝড়ের বেগে এসে অর্ণবকে তার কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয়। ভেঙে চুরমার হয়ে যায় তার স্বপ্ন। গুমরে গুমরে মরে মনে মনে।

অবসন্নতার ওই সময়ে বিয়ের প্রস্তাব আসে নন্দিনীর এক দূর সম্পর্কের মামার মাধ্যমে। পাত্রপক্ষের হাতে বেশি সময় ছিল না। কারণ পাত্র ফ্রান্সপ্রবাসী।

 

তিন.

বিয়ের পর ধ্রুব ছয় মাস মাত্র দেশে থাকে। এই ছয় মাসে প্রায় প্রতিটি দিন ধ্রুব তার সঙ্গে মিলিত হয়েছে। শুধু পিরিয়ডের কয়েকটা দিন বাদে। এক রাতও ধ্রুব মিস করার পক্ষে ছিল না। যৌনমিলন না হলেও একান্তে কিছু সময় তার কাটাতেই হবে। নন্দিনী মাঝে মাঝে বিরক্ত হলেও মুখে প্রকাশ করত না, যদি ধ্রুব কষ্ট পায়।

শেষ দিকে সন্তান নেওয়ার জন্য ধ্রুবর খুব ইচ্ছে জাগে। নন্দিনী চেয়েছিল আরও কিছু সময় নিতে। ধ্রুব এমনভাবে তাকে কনভিন্স করে যে নন্দিনী রাজি হয়ে যায়। কিন্তু অনেক চেষ্টার পরও নন্দিনী প্রেগন্যান্ট হলো না। এটা নন্দিনীর মধ্যে অপরাধবোধের জন্ম দেয়।

দেশের চিকিৎসায় ধ্রুবর বিশ্বাস ছিল না বলে সে প্যারিসেই ডাক্তার দেখাবে বলে চলে যায়। যদি ওই সময় নন্দিনী প্রেগন্যান্ট হতো, এতদিনে সে মা হয়ে যেত। সন্তানের বয়স হতো ছয় মাস। নন্দিনী ভাবে যদি তা হতো তাহলে এই অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে হতো না।

ধ্রুব চলে যাওয়ার প্রায় এক বছর পর সে নিশ্চিত হলো যে সে মা হতে চলেছে। ধ্রুব যদি এই কথা জানতে পারে, স্পষ্ট জানিয়ে দেবে তার সঙ্গে সংসার করা সম্ভব নয়। হয়তো কার বাচ্চা সে পেটে ধরেছে বলে নষ্টা মাগী বলে গালি দেবে। ধ্রুবর মা-বাবাই বা বিষয়টা কীভাবে নেবে। সমাজই-বা বিষয়টাকে কীভাবে দেখবে।

সমাজের কথা ভাবলে গা রি রি করে ওঠে নন্দিনীর। কেন মানুষ সমাজকে তোয়াক্কা করে, সে বুঝতে পারে না। এই সমাজের প্রচলিত বানোয়াট কৃত্রিম আইনকানুন মেনে চলার কোনো মানে হয়। যে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ভণ্ডামি ও দুর্নীতি, মানুষগুলো মুখোশ পরে থাকে, ধিক্ সেই সমাজকে। ধিক্ সমাজের মানুষকে।

প্রাচীনকালে যখন মানুষ গোত্রবদ্ধ হয়ে বাস করত, তখন তো পিতৃপরিচয়ের বিষয়টা আসত না; বরং নারীর পরিচয়টিই সন্তানের জন্য মুখ্য হয়ে উঠত। অথচ সভ্যতার এই যুগে পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীকে কতভাবে অবমাননা করা হচ্ছে। সন্তানের পিতৃপরিচয় দিতে না পারলে শিশুটি হবে সমাজে পরিত্যাজ্য। গর্ভধারিণীর কপালে জুটবে সীমাহীন দুর্ভোগ।

এমন নানা ভাবনায় নন্দিনী অস্থির হয়ে ওঠে। আকাশ-পাতাল কত কিছু ভাবে। বেশির ভাগের মাথামুণ্ডু নেই। গোপনে অ্যাবরশন করিয়ে নিলে কেমন হয়! এই কথা ভাবতেই এক ধরনের পাপবোধ তাকে পিষে মেরে ফেলতে চায়। একটা প্রাণকে হত্যা করা কতটুকু সমীচীন? যে সত্তা পৃথিবীতে আসতে চায়, পৃথিবীর আলো-বাতাসে বেড়ে উঠতে চায়, গর্ভের মধ্যে তাকে হত্যা করা কি মানবহত্যা নয়! জঘন্য অন্যায় হবে এটা।

নন্দিনী ভাবে, কেন একজন পুরুষের পরিচয় লাগবে শিশুর পিতা হিসেবে। বীর্যপাত ছাড়া কী ভূমিকা আছে একজন পুরুষের? গর্ভধারণ থেকে শুরু করে সব কষ্ট যখন নারীকেই করতে হবে, তখন শিশুর জন্য কেন পিতৃপরিচয় প্রয়োজন। পিতা মানে পুরুষ তো আনন্দের সঙ্গে বীর্যপাত করেই লাপাত্তা। সব তো একা নারীকেই সামলাতেই হয়। তবে কার বীর্যে এই সন্তান নারী গর্ভে ধারণ করল, তা কেন গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হয়ে ওঠে।

ধরা যাক, সেদিন যদি ধ্রুবর বীর্যে নন্দিনী গর্ভবতী হতো, তাহলে কি কোনো কষ্ট ধ্রবকে ভোগ করতে হতো। না সব কষ্ট সহ্য করতে হতো তাকেই। হয়তো প্যারিসে ধ্রুব তখন অন্য কোনো আনন্দে মত্ত থাকত। আর যদি অন্য কোনো পুরুষের বীর্যে সে প্রেগন্যান্ট হয়, তাতে তার ভূমিকা তো বিন্দু পরিমাণ বদলে যেত না। তাহলে যার বীর্যেই সে গর্ভবতী হোক না কেন, তা কোনো ব্যাপার নয়। সে মা হতে যাচ্ছে, সেটাই বিবেচ্য। মা হওয়াটাকেই নন্দিনী উপভোগ করবে। তার আর কিছুই চাই না।

 

চার.

অনেক ভেবে নন্দিনী সিদ্ধান্ত নেয় যে, বাপের বাড়ি খুলনায় চলে যাবে। বাপের বাড়িই বরং নিরাপদ। যা হওয়ার সেখানে হোক। তখন ঘন ঘন তার শরীর খারাপ হচ্ছিল। একদিন একা একাই সে ওই ডাক্তারের কাছে যায় যার কাছে ধ্রুব তাকে নিয়ে গিয়েছিল।

ডাক্তারের সঙ্গে তার সমস্যা নিয়ে কথা বলার এক ফাঁকে সে প্রশ্ন করে ধ্রুবর ব্যাপারে। ডাক্তার জানায়, ধ্রুবর বীর্যে কখনো প্রাণের উৎপত্তি হবে না যত চিকিৎসাই হোক না কেন; ওই সময় এই কথা বলতে পারেনি ধ্রুবর মানসিক অবস্থার কথা ভেবে।

পরদিনই মায়ের অসুখের কথা বলে শ্বশুরের অনুমতি নিয়ে খুলনায় চলে যায় নন্দিনী; যাওয়ার সময় সে বলল, কিছুদিন মায়ের কাছে থাকতে হবে।

ধ্রুবর পরিবারের কারও সঙ্গে নন্দিনী আর যোগাযোগ রাখে না। ধ্রুব কল দিলেও ধরে না। বারবার কল দেওয়ায় একপর্যায়ে ধ্রুবর নম্বর ব্লক দিয়ে রাখে। খুদে বার্তা পাঠিয়ে জানিয়ে দেয়, তাকে আর কল না দিতে। সে অসুস্থ; কথা বলতে পারবে না।

এমনকি ধ্রুবর মা-বাবা, শুভ, প্রীতি ও অপুর নম্বরও ব্লক করে রাখে। বন্ধ রাখে সব ধরনের সামাজিক যোগাযোগ। সে চায় না ওই পরিবারের কারও সঙ্গে ন্যূনতম সম্পর্ক রাখতে।

মাকে পুরো ঘটনা খুলে বলে নন্দিনী। মা বলল, অ্যাবরশন করিয়ে নে। ঝামেলা বাড়ানোর কী দরকার।

বিষয়টি নিয়ে মায়ের সঙ্গে নন্দিনীর দ্বদ্ব বাধে। সে চায় বাচ্চাটা বেঁচে থাকুক। একটা সুস্থ সুন্দর শিশু পৃথিবী আলোকিত করে আসুক। শুধু তার জন্য। আর কারও জন্য নয়। শিশুটি তার জন্য প্রকৃতির উপহার। যেভাবে হোক তাকে মা হতেই হবে। শিশুটিকে বাঁচিয়ে রেখে বড় করতে হবে।

এবরশনের কথা ভাবতেই পারে না নন্দিনী। প্রয়োজনে সে বাবার বাসায়ও থাকবে না। আলাদা থাকবে। পুরোনো পরিচয় মুছে দিয়ে সে নতুন জীবন শুরু করবে। চাকরি বা ব্যবসা করবে। কিংবা সব জেনেও যে পুরুষ তাকে বিয়ে করতে চায়, প্রয়োজনে তার সঙ্গে থাকবে।

প্রাথমিক চেকআপের জন্য নিকটবর্তী হাসপাতালে যায় নন্দিনী একা; সেখানে দেখা হয়ে যায় তার প্রথম প্রেমিক রতনের সঙ্গে। হাসপাতালের লবিতে মেয়েকে কোলে নিয়ে বসেছিল রতন। সে গেছে তার দুই বছর বয়সী মেয়েকে ডাক্তার দেখাতে।  

চোখাচোখি হওয়ায় রতন এগিয়ে আসে। কাছে এসে জানতে চায়, কেমন আছো নন্দিনী। এখানে কেন?

নন্দিনী প্রথমে ইতস্তত বোধ করলেও পরক্ষণে স্বাভাবিক হয়ে আসে। উত্তর না দিয়ে পাল্টা জানতে চায়, তুমি কেমন আছো? আর ছোট বাচ্চাকে নিয়ে তুমি একা কেন? তার মা কোথায়?

বিষণœ রতন উত্তর দেয়, কিছুদিন আগে তার স্ত্রী দ্বিতীয় সন্তান প্রসব করতে গিয়ে মারা যায়। তার প্রথম সন্তানটির বয়স দুই বছর। কয়েক দিন ধরে তার জ¦র। কিছুতেই সারছে না।

এই কথা শুনে নন্দিনী সংকুচিত হয়ে আসে। অপরাধী মনে হয় নিজেকে। সান্ত্বনা দিয়ে বলল, ভেবো না। সময়ই সব ঠিক করে দেবে। জীবন আমাদের সঙ্গে এভাবে খেলা করে।

রতন আবারও তার অবস্থা জানতে চাইলে সে বলল, কিছুদিন আগে আমার স্বামী সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছে। আমি তিন মাসের অন্তঃসত্ত্বা। গাইনি ডাক্তার দেখাতে এসেছি।

এই বলে রতনের পুতুলের মতো তুলতুলে মেয়েটাকে নন্দিনী টেনে কোলে তুলে নেয়। মেয়েটার গা পুড়ে যাচ্ছে জ্বরে। মুখে আদর করে সে বলল, ওকে আমার কাছে দিয়ে দাও। বড় করে দেব। আমি ওর মা হবো।

নন্দিনীর কথা শুনে রতন বিস্মিত হয়। এ কেমন কথা। কিছুটা দ্বিধা নিয়ে রতন বলল, সত্যিই ওর মা হতে চাও?

কিছুক্ষণ সময় নিয়ে নন্দিনী ভাবে। অভিব্যক্তিতে প্রকাশ পায় সিরিয়াসনেস। তারপর হ্যাঁ-সূচক সম্মতি জ্ঞাপন করে।

রতন আবারও বিস্মিত হয়। তখনই প্রশ্ন করল, তোমার কোনো সমস্যা হবে না তো?

আমার কী সমস্যা? বরং আমার জন্যই ভালো হবে। বাপের বাসায় ভালো লাগছে না। বিয়ের পর কি মেয়েদের আর বাড়ি থাকে! দেখো, সমাজের কি অদ্ভুত নিয়মকানুন।

নন্দিনী আরও যোগ করল, স্বামীর বাড়িতে আর যাওয়ার ইচ্ছে নেই। ওই বাড়ির লোকজন ভালো নয়। আমার পেছনে ষড়যন্ত্র করবে এবার। চেষ্টা করবে তাড়ানোর।

রতন নন্দিনীর দিকে এক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে। সেই দৃষ্টি বলে দিচ্ছে, নন্দিনীকে তার ভীষণ প্রয়োজন। কিছুক্ষণ পর রতন তাকে বলল, তুমি যদি কিছু মনে না করো, আমরা বিয়ে করে একসঙ্গে থাকতে পারি। আর তুমি চাইলে বিয়ে না করেও পারি। তুমিও একা, আমিও একা। আমার ও তোমার সন্তানকে নিয়ে সুখের নীড় বানাব। কী বলো তুমি?

রতনের কথায় নন্দিনী হতভম্ব হয়ে যায়। রতন এইভাবে ভাবতে পারল! তার বিস্ময়ের সীমা থাকে না। নন্দিনী যেন অতলান্ত সাগরে খড়কুটোর দেখা পায়; কিন্তু তা ভাষায় প্রকাশ করে না।

প্রথম প্রেমের ব্যর্থতার গ্লানি নন্দিনীকে আজও বিহ্বল করে। মনে জেগে ওঠে প্রতিশোধস্পৃহা। সুযোগটিকে কাজে লাগানোর কথা ভাবে সে।

 

অকস্মাৎ নন্দিনী বলল, তোমার প্রস্তাবে আমার আপত্তি নেই। তার আগে আমাকে কিছু কাজ করতে হবে। সেসব শেষ করে তোমার সঙ্গে শিগগির দেখা করব।

পলাশ মজুমদার।

জন্ম ১৯৭৯ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি।

ফেনীর পরশুরাম উপজেলার কোলাপাড়া গ্রামে। বসবাস ঢাকায়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিন্যান্স বিভাগ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর। জীবিকার তাগিদে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত। তবে লেখাই তাঁর ধ্যান-জ্ঞান। বই পড়া ও দেশে-বিদেশে ভ্রমণের মাধ্যমে জ্ঞানার্জনই অভীষ্ট লক্ষ্য। সমাজসচেতন, বিজ্ঞানমনস্ক ও যুক্তিবাদী।

যাপিত জীবনের সবকিছু বিচার করেন প্রজ্ঞা ও যুক্তির নিরপেক্ষ মানদণ্ডে।

সাহিত্যে দর্শন, ভূগোল ও ইতিহাসের সুগভীর সমন্বয় সাধনে ব্রতী।

পৃথিবীর সব মানুষ একদিন বিজ্ঞানভিত্তিক ও মানবতাবাদী দর্শনের পতাকাতলে সমবেত হবে—এই আশাবাদ লালন করেন সব সময়।

‘ফুলের ভাষা যদি বুঝি’ তাঁর দ্বিতীয় প্রকাশিত উপন্যাস। প্রকাশকাল ২০২৩ একুশে বইমেলা।

‘জনৈক বিনিয়োগকারীর আত্মহত্যা প্রসঙ্গে’ তাঁর দ্বিতীয় প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ। প্রকাশকাল ২০২২ একুশে বইমেলা।

‘দিব্যপুরুষ’ তাঁর প্রথম প্রকাশিত উপন্যাস। প্রকাশকাল ২০২১ একুশে বইমেলা।

‘হরিশংকরের বাড়ি’ তাঁর প্রথম প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ। প্রকাশকাল ২০২০ একুশে বইমেলা। প্রকাশক বিদ্যাপ্রকাশ।

প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ : বাংলা দেশে বাঙালির দেশে (ভ্রমণকাহিনি)। ২০১১ একুশে বইমেলা। প্রকাশক শুদ্ধস্বর।

কথাসাহিত্যে পেয়েছেন চর্যাপদ সাহিত্য একাডেমি পুরস্কার ২০২২।

 

প্রধান সম্পাদক : সম্প্রীতি সাহিত্য পত্রিকা।

পলাশ মজুমদার
কথাসাহিত্যিক