শব্দকুঞ্জ বর্ষা কদম্ব সংখ্যা
গল্প: বৃষ্টি ও লাল সাইকেল
সুমাইয়া আলম
শব্দকুঞ্জ বর্ষা কদম্ব সংখ্যা
গল্প:
বৃষ্টি ও লাল সাইকেল
সুমাইয়া আলম
-শিমু, ওই শিমু! ওঠ! ঘুমাচ্ছিস নাকি, এ শিমুর বাচ্চা ওঠ!
কেউ কি আমায় ডাকছে নাকি, উহুমমম কাঁথাটা আরও মুড়িয়ে নিয়ে কাচুমাচু হয়ে ঘুমোতে লাগলাম।
আমার শরীর কেউ জোরে ঝাকাতে শুরু করলো। এবার ভালো করে চোখ মেলে দেখি ভাইয়া আমাকে ডাকছে।
আমি ওঠে বসে চোখ কচলাতে কচলাতে বললাম, সকাল হয়ে গেছে?
-হ, ওঠ ফাজিল। তাত্তারি ওঠ। আমায় ডেকে ভাইয়া পাশের ঘরে গেলো নিজের রেকেট নিতে।
আমি টলতে টলতে আবার শুয়ে পরলাম। ভাইয়া রেকেট হাতে নিয়ে ঘরে এসে দেখে আমি আবার ঘুমিয়ে গেছি। জোরে হুঙ্কার, কই!!!?
আমি হুড়মুড়িয়ে এক লাফে উঠে বিছানায় দাঁড়িয়ে বলি, হে রেডি রেডি রেডি। বিছানা থেকে নেমে দৌড়ে গায়ে জামা পরে নিয়ে চুলগুলো দুইটা ঝুটি করে বেড়িয়ে পরলাম ভাইয়ার সাথে। শীতকালে বড় বড় টূর্ণামেন্ট থাকে ওর। তাই সারাবছরই ভাইয়া ব্যাডমিন্টন খেলে মাঠে। সে সারাবছর প্র্যাকটিসের ওপরই থাকে। আমাকে সাথে নিয়ে যায়। আমি বসে খেলা দেখি। ৯টায় বাড়ি ফিরে এসে আমি গোসল করে খেয়ে স্কুলে যাই। ২য় শ্রেণীতে পড়ি আমি।
সারারাত বৃষ্টি হয়েছে বোঝাই যাচ্ছে। হালকা শীত শীত অনুভব হচ্ছে। আমি ভাইয়ার হাত ধরে হাঁটতে থাকি।
-“আর মাত্র ৪ দিন পরেই আমার সাইকেল আসবে” খুব আনন্দ নিয়ে বললো ভাইয়া।
-কি বলো! তাই! আর ৪ দিন পর সাইকেল কিনবা?
-হো। কি রঙের সাইকেল ভাল্লাগে তোর?
-লাল!! লাফিয়ে বললাম।
-ধুর এইডা কোনও কালার? আমি চুপসে গেলাম। মাঠে আসতেই ভাইয়ার বন্ধুরা তার সাথে কথা বলতে লাগলো।
আমার গাল টেনে আদর দিলো। ঝুটি টেনে দুষ্টুমি করে। হিহি।
ভাইয়া এবার জেএসসি দেবে।
ভাইয়ার রেকেট টা অনেক ভালো। কি সুন্দর। আমার অনেক ভালো লাগে। কিন্তু আমার হাত ছোট, এত বড় রেকেট আমার অনেক ভার লাগে।
বিকেলে পাশের বাসার একটা ছেলে আছে আমার বন্ধু, কাসেম। ওর কাছে দুইটা ব্যাট আছে। ওর ব্যাটগুলা ছোট ছোট। কিন্তু ওর ফ্লাওয়ার নেই। ভাইয়ার কাছে অনেকগুলা ফ্লাওয়ার আছে। আমি বিকালে তার থেকে একটা নিয়ে কাসেমের সাথে খেলতে যাই। ও ব্যাট দেয়, আমি ফ্লাওয়ার। এই লেনাদেনায় আমাদের খেলা চলে বিকেলে।
ভাইয়া সিঁড়িতে বসে আমাদের খেলা দেখে।
আজ কাসেম খেলায় চিটিং করলো। আমি প্রতিবাদ করতেই ও রাগে আমার হাত থেকে নিজের ব্যাটটা নিয়ে বললো, দাও আমার ব্যাট দাও। আমি দিয়ে দিলাম। সে ব্যাট নিয়ে চলে গেলো। আমি কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে, মাটিতে পরে থাকা ফ্লাওয়ার নিয়ে ঘরে চলে এলাম। আমার ব্যাট নাই, ওর ব্যাট সে নিয়ে চলে যেতেই পারে কি আর করার আছে।
সন্ধ্যার পর পড়তে বসেছি। ভাইয়া দরজার ফাঁক দিয়ে উঁকি দিয়ে ফিসফিস গলায় আমাকে ডাকলো, ওই শিমু এদিক আয়। ভাইয়া প্রায়ই এমন করে। লুকিয়ে লুকিয়ে সিঙারা, কখনও পুরি, কখনও চকোলেট, কখনও বা মিরান্ডা অর্ধেক খেয়ে অর্ধেক আমার জন্যে রাখে। লুকিয়ে অন্ধকারের মধ্যে ডেকে নিয়ে বলে, তাড়াতাড়ি খা। আর যদি আম্মুরে কইছোস মাইরা ঠ্যাঙ ভাইঙ্গা দিমু।
আমি যত তাড়াতাড়ি পারি গিলি। তারপর আবার পড়তে বসি যেন কিছুই হয়নি। আজও ভাইয়া ডাকছে। মনে হয় কিছু আনছে। আমি দৌড়ে গেলাম। ভাইয়া পেছন থেকে একটা ব্যাট বের করলো।
-দেখতো ভাল্লাগে?
আমি দেখলাম একটা ছোট সাইজের রেকেট। লাফাতে লাফাতে বললাম, — এটা আমার!!!! এটা আমার???
-আরে আস্তে আস্তে। কাল থেকে বিকালে তোরে খেলা শিখাবো আমি।
-সত্যি!!! ব্যাট হাতে নিয়ে লাফাতে লাফাতে ঘরে এলাম।
বাবা ব্যাটটা দেখে খুব পছন্দ করলো। মা বললো, হুদাই টাকা খরচ করতে গেলি ক্যান। ও ছোট ও কি খেলার কিছু বোঝে।
ভাইয়া কিছু বললো না।
আমি ব্যাটটা একহাতে নিয়ে আরেক হাতে হোমওয়ার্ক করছি।
পরদিন বিকালে আমি আর ভাইয়া খেলছি। ভাইয়া আমাকে শিখিয়ে দিচ্ছে, কাসেম সে সময় এসে আমার ব্যাট দেখে বলে, এটা তোমার?
আমি বুক ফুলিয়ে বললাম, হে! সুন্দর না?
কাসেম একটু চুপসে গেলো। অসহায়ের মতো বললো, আমাকে খেলায় নিবা?
-অন্যদিন নিবো, ভাইয়ার সাথে খেলব আমি এখন।
ভাইয়া কিছু না বলে শুধু মুচকি হাসে।
চারদিন পর, সকালবেলা আমার মাথায় টোকা মারলো কেউ। আমি চোখ খুলে দেখি ভাইয়া খুব হাসিমুখ নিয়ে আমার দিক তাকিয়ে আছে।
আমি ঘুম ঘুম চোখ কচলে বললাম, ভাইয়া কাল রাতে কখন আসছো? তুমি আর বাবা সাইকেল কিনতে শহরে গেছিলা না? আমি অনেক রাত পর্যন্ত জেগে থেকে থেকে পরে ঘুমিয়ে গেছিলাম।
-হিহি আয় তোরে সাইকেল দেখাই।
আমি লাফিয়ে ওঠে বললাম, সাইকেল কিনছো!!
আমি দৌড়ে বাইরে এসে দেখি লাল রঙের একটা সাইকেল। আমি লাফাতে লাফাতে সাইকেলের চারদিক ঘুরে ঘুরে দেখছি।
ভাইয়া সাইকেলে ওঠে আমায় বললো, ওঠ।
আমি পেছনে ওঠে সাইকেলের ক্যারিয়ারে শক্ত করে ধরে বসলাম।
-দেখিস পা যেনো চাকার ভেতর না যায়।
-ঠিকআছে।
সারা সকাল সাইকেলে করে ঘুরলাম। বৃষ্টির ফোঁটা পরছে হালকা। ঠান্ডায় দাঁতে দাঁত ঠকঠক ঠকঠক করছে আমার।
ভাইয়ার সাথে স্কুলেও গেলাম সাইকেলে চড়ে। স্কুলের সামনে নামতেই দেখলাম, খুব সুন্দর জামরুল, আচার, বড়ই নিয়ে বসা দোকানি। ভাইয়া বললো, কি খাবি?
আমি জামরুল দেখালাম। আমাকে ৫ টাকার জামরুল কিনে দিলো। আমি তা নিয়ে স্কুলে চলে গেলাম।
এখন প্রতিদিন স্কুলে যাই সাইকেলে চড়ে।
আজ স্কুলে ঢোকার আগে ভাইয়া আমায় জামরুল কিনে দিলো।
-এই পানসে ফলে কি মজা পাস তুই?
-হিহি আমার ভাল্লাগে।
-যা ক্লাসে যা।
আমি দৌড়ে ক্লাসে এলাম।
ব্যাগটা রেখে বেন্ঞ্চে বসতেই মিলি আর মিথি আসলো।
কিরে শিমু, তুই দেখি এখনও ছুটো বাচ্চা। হাহাহা। বলে ওরা হাসতে লাগলো।
– কেনো?
– আরে এখনও সাইকেলে চড়ে চড়ে স্কুলে আসছ। তোরে দেখতে যে কি বাজে লাগে! হাহাহা।
পরদিন সকালে ভাইয়া সাইকেল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমি না চড়ে হাঁটতে লাগলাম।
– ওই শিমু ওঠ?
– ভাইয়া আমি কি এখনও বাচ্চা যে সাইকেলে চড়ে স্কুলে যাবো? আমি হাঁটতে পারি। বলে হনহন করে চলে এলাম।
আজ একা একা স্কুলের গেইট দিয়ে ঢোকার সময় একটু দাঁড়ালাম। ভাইয়ার কথা মনে পড়ছে। পড়ুক। আমি তো বড় হইছি এখন। এখন কি আর ছোট আছি নাকি।
ক্লাসে গেলাম। স্কুল ছুটির পর বাসায় ফিরতে নিবো তখনি নামলো ঝুম বৃষ্টি। আমরা সবাই স্কুলের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছি বৃষ্টি কমার অপেক্ষায়। অনেক্ষণ হয়ে গেলেও বৃষ্টি কমছে না, আরও বাড়ছেই। আমি উদাস চোখে বৃষ্টি দেখছি, হঠাৎ দেখি ভাইয়া বৃষ্টিতে ভিজে সাইকেলে করে স্কুলে এসেছে।তার হাতের বগলে একটা ছাতা। আমায় বারান্দায় দেখে ডেকে উঠলো,
-ওই শিমু তুই ওইনেই দাঁড়া, আমি আসছি।
বারান্দা ঘেঁষে সাইকেল নিয়ে এসে দাঁড়ালো, আমি গিয়ে সাইকেলে চড়লাম। সে ছাতা খুলে আমায় দিলো। আমি আর ভাইয়ার উপর ছাতা মেলে ধরলাম।
-আরে গাধা তুই তোর মাথার উপর ধর। আমার মাথায় ধরতে পারবিনা। আস্তে চালাবো ভয় নাই। একহাতে আমারে ধর।
আমি ভাইয়ার কোমর এক হাতে জড়িয়ে ধরে আরেক হাতে ছাতা ধরে আছি। ভাইয়া সাইকেল চালাতে শুরু করলে পেছনে স্কুলের বারান্দায় তাকিয়ে দেখলাম, আমার বান্ধবীরা সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে।
আমি মুচকি হেসে বললাম,
-ভাইয়া কালকেও আমি সাইকেলে চড়ে আসব। আমি বড় হইনাই। হইতে চাইনা।
-হাহাহা, শক্ত করে ধরে বোস আহাম্মক…