You are currently viewing শব্দকুঞ্জ বর্ষা কদম্ব সংখ্যা। বর্ষার গদ্য। টুং টাং জলপদ্যের শব্দমালা- তৌফিকুল ইসলাম চৌধুরী

শব্দকুঞ্জ বর্ষা কদম্ব সংখ্যা। বর্ষার গদ্য। টুং টাং জলপদ্যের শব্দমালা- তৌফিকুল ইসলাম চৌধুরী

শব্দকুঞ্জ বর্ষা কদম্ব সংখ্যা

বর্ষার গদ্য

টু টাং জলপদ্যের শব্দমালা

তৌফিকুল ইসলাম চৌধুরী


শব্দকুঞ্জ বর্ষা কদম্ব সংখ্যা

বর্ষার গদ্য

টু টাং জলপদ্যের শব্দমালা

তৌফিকুল ইসলাম চৌধুরী

বর্ষায় ঝর ঝর –  অঝোর ধারায় ঝরে বৃষ্টি। টিনের চালে, গাছের ডালে ঝম্ ঝমা ঝম — টুপটাপ বৃষ্টি। এ বৃষ্টির জলধারা ভিজিয়ে দেয় গাছ-পালা, তরু-লতা, মাঠ-ঘাট এমন কি আমাদের দেহ-মনকেও। বৃষ্টিভেজা প্রকৃতির অনাবিল রুপ কার না ভাল লাগে ! আর যদি ভরা বৃষ্টিতে দেখা মেলে কোন বৃষ্টিভেজা ভরা-যৌবনা নারীর এবং তা যদি চোখে পড়ে কোন কবির ; কবির অভিব্যক্তি হয় তখন আল-মাহমুদের মত,
” বৃষ্টির বিধানে সিক্ত এমন কি তোমারও কামিজ /
প্রকৃতি গুছিয়ে দেয় সবুজের সহজ শরম ‘। /
(সনেট–১, বখতিয়ারের ঘোড়া) । /
অথবা ‘ প্রেম-বিরহের কিংবদন্তী-পুরুষ ‘ কবি চণ্ডীদাশের সহজ সরল স্বীকারোক্তি — ” আঙ্গিনার মাঝে বধুয়া ভিজিছে /
দেখিয়া পরান ফাটে “। /
                          বৃষ্টি-স্নাত বধুয়া বা রমণীর শরীরে তখন সাঁতরে বেড়ায় দেবরাজ ইন্দ্র অথবা জিওসের আত্মা। বর্ষণ মুখর দিনে বৃষ্টি-ভেজা রমণীর ভেজা-কাপড়ের ভাঁজে ভাঁজে ফুটে ওঠা নান্দনিক সৌন্দর্যের মতো বৃষ্টি আমাদের অন্তর-মন ভিজিয়ে ভিজিয়ে ভিতরের সুন্দরকে দৃশ্যমান করে, যা বাঙময় হয় আমাদের সৃষ্টিশীলতায়। ‘ ‘আষাঢ় ‘প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ” বর্ষা ঋতুটা বিশেষ ভাবে কবির ঋতু’। এতো গেল কবির কথা। বৃষ্টি আমার কাছে মিষ্টি মধুর, উপভোগ্য এক নান্দনিক সৃষ্টি। বৃষ্টি ঝরছে —আমি বারান্দায় গিয়ে বৃষ্টি দেখি। বর্ষায় ফোটা কদম্ব ফুলের মৌতাতে বিভোর আমি আনমনে একসকী  বৃষ্টির সুঘ্রান নেয়ার চেষ্টা করি। বৃষ্টির জল ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখি। বৃষ্টির একটানা গান আমার অন্তরকে স্পর্শ করে। বৃষ্টি পড়ছে — আমি তার শব্দ শুনতে পাচ্ছি ; বৃষ্টি ঝরছে — আমি তার কণা দেখতে পাচ্ছি। এই শুনা আর এই দেখা — আমার মনোজগতে আলোড়ন তুলে। আমার অন্তর-মন নেচে উঠে সৃষ্টি সুখের উল্লাসে । বর্ষার সজল সরসতায় ভূ-প্রকৃতি হয়ে ওঠে সতেজ-সজীব। বৃষ্টিকে আমার মাঝে-মধ্যে মনে হয়, জন্ম-সূত্র ‘ বীর্য ‘ , মেঘের কামুক রসে সিক্ত করে যে কেবল মাটিকে করে পোয়াতি। বৃষ্টি যেমন বর্ষণের,  তেমনি বৃষ্টি কর্ষণেরও । বৃষ্টি-স্নাত ভূমি কর্ষণ করে যেমন চাষী ফসল ফলায় , তেমনি বৃষ্টি-স্নাত মন কর্ষণ করে লেখক-কবি সৃষ্টির পসরা ফলায়। বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বৃষ্টি-স্নাত বর্ষা নিয়ে ১১৬টি গান রচনা করেছেন। মেঘদূতে তিনি বর্ষাকে অপরুপ বন্দনায় তুলে এনেছেন। বৃষ্টি বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের কথায় —
” যে কথা এ জীবনে রহিয়া গেল মনে , /
সে কথা আজি যেন বলা যায়, /
এমন ঘনঘোর বরিষায় ” । / (বর্ষার দিনে) ।
                       বরিষার রিম-ঝিম ছন্দে আমাদের মগ্ন চেতনার ঘনঘোর আকাশে খেলা করে বৃষ্টি। বৃষ্টি সকলকেই করে অর্ন্তমুখী। তখন কেউ হয়তো কলম ধরেন, কেউ ধরেন না — এই যা পার্থক্য। একটানা বর্ষণের অফুরান অবসর মুহুর্তে যিনি কলম হাতে নিয়ে লিখতে শুরু করেন, বৃষ্টি তার মানস- পটে হাজির হয় সৃষ্টির পসরা নিয়ে। ময়ুখ চৌধুরীর কথায় —-
” মেঘের পোষাক ছেড়ে বৃষ্টি নামে পাহাড়ের স্তনে ; /
পাদদেশে নদী বয়, নৌকাখণ্ড ভাসে দেহ-মনে “। /
                       বৃষ্টি মানেই জল -পতন। বৃষ্টি মানেই জলের অস্তিত্ব-প্রকাশ। রিম-ঝিম, ঝম-ঝম, ঝুম -ঝুমা- ঝুম, ঝর-ঝর, টুপ-টাপ, টাপুর- টুপুর, ইলশে-গুড়ি — যেভাবেই ঝরুক। বৃষ্টির জল-পতনের এই ধারায় একটা ছন্দ আছে, আছে তাল,লয়। জল-পদ্যের এই সম্মোহনী যাদুতে মানুষ মাত্রই মোহিত হয়। এই মাহেন্দ্রক্ষণে মানুষ ঘোর -লাগা একটা সময় পার করে। আর সেই মানুষ যদি হয় কবি -সাহিত্যিক —তাহলে তো কথাই নেই। কালজয়ী অনেক পংতি বা সাহিত্য এ মৌসুমেই লিখেছেন বেশীর ভাগ সৃজনশীল কবি-সাহিত্যিক। এ সময় কবি-লেখকের বর্ণনা কেবল বর্ষণমুখর দৃশ্য রচনায় সীমিত থাকে না, মানুষের একান্ত আবেগ অনুভুতি, নর-নারীর অন্তরলোকের নিভৃত অভিব্যক্তিও সুন্দর বিধুর হয়ে ওঠে। বৃষ্টিতে মন উড়ে যায় দূর পাহাড়ের সেই চূড়ায় — যেখানে মেঘ ধূসর শাড়ি পরে ছুঁয়েছে এ ধরণীকে কিংবা পায়ে চলা মেঠো পথে — যেখানে এখনো সতেজ আমাদের পদস্পর্শ। বৃষ্টি আমাদের সৃষ্টি ও মননে নতুন চিন্তার রুপক, ভাবরস সঞ্চারী কাব্য-প্রতিমা। ভূমির ক্ষয় আছে, প্রকৃতির আছে রুপ-বদল। কিন্তু বৃষ্টির ! বৃষ্টির ছন্দ আছে, বৃষ্টির গন্ধ আছে, আছে রুপ-রস, মিলন-বিরহ-বেদনা। আর আছে নতুন ভাবনার চিন্তন। বৃষ্টি মানুষকে আচ্ছন্ন করে। ‘ আজি ঝরঝর মুখর বাদল দিনে’র বর্ষণে নিসর্গের সান্নিধ্যে , প্রকৃতির একাকীত্বে মানুষের শৈল্পিক ভাবনা মূূর্ত হয়ে ওঠে। এ সময় সৃজনশীল চিত্রশিল্পী সর্বদা একটা সৃজন প্রক্রিয়ার আবর্তে ঘূর্ণমান থাকেন । তখন তিনি প্রকৃতির অনাবিল আবাহনে কখনো আনন্দিত, কখনো বিষাদে হন বিক্ষত। এ সময় প্রকৃতির সাথে শিল্পীর আচরণ অনেকটাই একতরফা — গ্রহীতার। শিল্পী মনে তখন তৈরী হয় প্রকৃতির প্রতি নিখাদ মায়া এবং শন্কার ক্যামোফ্লেক্স। অন্তর্জগতের এই দ্যোদুল্যমানতাকে নানা ভঙ্গি, ফর্ম, টেক্সচার, রেখা -রঙে-চিত্রপটে বুণন করেন নিপুণ পটুয়া।
                        বাঙ্গালির পাললিক মনের সাথে বৃষ্টির নিবিড় সখ্যতা। বৃষ্টির রিম ঝিম ছন্দে মন উড়ে যায় দূরে কোথাও , যেখানে শাল- পিয়ালের বনে নাম না জানা বুনো ফুলের সুবাস, মাটির সোঁদা গন্ধে মন হয়ে যায় পাগলপারা। বাঙ্গালির জীবনে বৃষ্টির কথা এলেই অনিবার্যভাবে এসে যায় কবি কালিদাস ও তার কালজয়ী  ‘মেঘদূত’ এর কথা। মেঘদূতে আছে,
“মেঘলোকে ভবতি সুকিনুহপ্যন্যথাবৃত্তি চেতঃ /
কণ্ঠাশেষ প্রণয়িনী জনে কিং পুর্ণদুরসংস্হ “। /
(মেঘদূত–শ্লোক– ৩) । /
কত শত-সহস্র বছর আগে শেষ হয়ে গেছে সেই কলিদাসের কাল ! খ্রিষ্ট-পূর্ব পঞ্চম শতকের প্রথমার্ধে জীবিত ছিলেন কালিদাস। অথচ আজো “মেঘদূত”এর বিরহ-তাপিত প্রেমরসসিক্ত আবেগ বাংলা কাব্যে সঞ্চারমান। মেঘের গুড় গুড় গর্জন আর অঝোর ধারায় বৃষ্টি শুরু হলেই কালিদাসের মতো বিরহী মন কি যেন খুঁজে ফিরে ইতি-উতি। এ ঘোর-লাগা ক্ষণে সাধু(স্বামী) বিহনে বিরহ-কাতর স্ত্রীর করুন আকুতি লোকজ পদ্যে শুনুন —
” আইলরে শাওন ঘোর বরিষণ, /
গুড়গুড় নাদে করে দেওয়ার গর্জন। /
যার সাধু আছে ঘরে আঞ্জা করে ধরি, /
ফুলের সাধু ঘরে নাই পাছাড়িমু কারে “।/
তখন মনে পড়ে অমিয় চক্রবর্তীর সেই কাব্য পংতি, ” কেঁদেও পাবে না তারে বর্ষার অজস্র জলাধারে……….. “। দয়িতের অনুপস্হিতির মাঝে তখন মৈথিল কবি বিদ্যাপতির মতো বলতে  ইচ্ছে করে —” এ ভরা বাদর মাহ, ভাদর শূণ্য মন্দির মোর “। বৃষ্টি-বাদল বর্ষণে চলে ভাললাগা- মন্দ লাগার কানামাছি খেলা।
                          বর্ষার বর্ষণের সাথে সঙ্গীতের কোথায় যেন নিবিড় সাদৃশ্য বিদ্যমান। উভয়ের সক্রিয়তায় ছন্দের অনুরণন লক্ষণীয়। সঙ্গীতের মতো বৃষ্টিরও শব্দ বা আওয়াজ আছে ; যা ছন্দময়, অনুভূতিপ্রবন। শব্দ ও সঙ্গীতের সুর সমান্তরাল হয়ে নিরন্তর বাজে। কান পাতলেই তা শোনা যায়। আবদুল মান্নান সৈয়দ বৃষ্টির মাঝে সঙ্গীত দেখেছেন–  “মেঘ করে কালো হয় /
মেঘ ফেটে বৃষ্টি নামে অমোঘ সংগীতে “। /
(আষাঢ়স্য প্রথম দিবস) । /
সম্রাট আকবরের নবরত্ন সভার অন্যতম সংগীত গুরু তানসেন নাকি মেঘমল্লার রাগ-সংগীত গেয়ে আকাশে মেঘের সঞ্চার করতেন, বৃষ্টি ঝরাতেন। সংগীতের মতোই বৃষ্টি মানুষকে মাদকতায় বুঁদ করে রাখে। মনকে করে আনচান, প্রাণকে করে উচাটন। বৃষ্টির বাড়ি খুঁজতে গিয়ে মেঘের দেশে মন ছুটে যায়। মেঘকে খুঁজতে গিয়ে দেখি
—” সাগর থেকে জন্ম নিয়ে আকাশে করে বাস , /
মায়ের কোলে ফিরে যেতেই জীবন হয় তার নাশ “। /
অথবা
” সাগরে জন্ম তার আকাশে ওড়ে /
পর্বতের মার খেয়ে কেঁদে ঝরে পরে “। /
                    প্রাকৃতিক নিয়মে বর্ষা আসে শীতল পায়ে। বর্ষার বৃষ্টিতে হৃদ- চলচ্চিত্র সচল হয়ে উঠে। এ সময় স্মৃতির সরোবরে ভিড় করে আনন্দের অনুক্ষণ, মিলন- বিরহের নানা অনুষঙ্গ। রাধা নাকি অভিসারে যেতেন বৃষ্টিতে। আর বলতেন, ” আমার শূণ্য মন্দিরে বৃষ্টি পড়ছে “। বৃষ্টি কামকাতর নর-নারীর কাছে সঙ্গমের মতোই প্রার্থিত, চর্চিত, উপভোগ্য। আকাশের নীলবর্ণ ও কাজলের ছোঁয়ার স্পর্শে  বৃষ্টির অঝোর ধারা, মেঘের গুড় গুড় ডাক বিদ্যুতের আলোর  ঝলকানির মাঝে ময়ূরও পেখম মেলে নৃত্যের তালে তালে বর্ষা অবাহন করে। প্রেমের কবি নজরুল তখন লক্ষ করেন —-
” বন ময়ূর আনন্দে নাচে ধারা প্রপাত ছন্দে “। এ সময় আমাদেরও প্রাণ খুলে গাইতে ইচ্ছে করে —” নাচ ময়ূরী নাচেরে/ রুম ঝুমাঝুম নাচেরে / ঐ এল আকাশ জুড়ে / বর্ষা রাণী সাজেরে “। / বৃষ্টির টাপুর-টুপুর ছন্দে গাছের ডাল-পাতা একে অপরকে জল ছিটিয়ে
জলকেলী করে। তখন কবিগুরু’র কবি মনে ধ্বণিত—-
” বৃষ্টি আসে মুক্তা কেশে আঁচলখানি দোলে, /
নাচন লাগে পাতায় পাতায় আকুল কল্লোলে “। /
আর গ্রীস্ম-দাহে শুস্ক বিমর্স ধান-চারা বৃষ্টির জলে গা ধূয়ে তরতাজা সতেজ হয়ে হেলেদ্যুলে হৃদয় নাড়ায়। ধানকন্যার প্রতি তাই অন্য এক কবির আকুতি —-
” আকাশ জুড়ে মেঘ জমেছে বৃষ্টি থেকে বন্যা, /
গা ধুয়ে নাও দুধেল মাটির বিষন্ন ধান-কন্যা”। /
                      যখন আকাশের সবগুলো দরজা খুলে অঝোর ধারায় বৃষ্টি হয়ে নেমে আসে মেঘেদের দল, তখন ভরা বর্ষণে আমেরিকার দক্ষিণ- পূর্বাঞ্চলের আদিবাসি চেরোকিরা পাখির পালক আর নীল-সবুজ পোষাক পরে এক ধরণের ‘বৃষ্টি- নাচে’ বিভোর হয়। তাদের বিশ্বাস, ভরা বর্ষণে এ ধরণের বৃষ্টি- নাচের ফলে খারাপ আত্নাগুলো পৃথিবী থেকে বিলীন হয়ে যায়। খরার প্রচণ্ড তাপদাহে ধরা যখন জ্বলেপুড়ে অঙ্গার হয়ে যায়, তখন বৃষ্টি ঝরানোর নানা সংস্কারে মেতে উঠে মানুষ। বৃষ্টি কামনায় আমাদের দুই-বাংলায় পূজা-পার্বন, যাদু-টোনা, মানতের আশ্রয় নেয়া হয়। ব্যাঙের বিয়ে, কূলা নামানো, ইন্দ্র পূজা ভাঁদো পূজা, বসুধারা ব্রত ইত্যাদি পালন করা হয়।
                          গ্রামের মেয়েরা গোল হয়ে আকাশের দিকে দু’হাত তুলে নেচে নেচে গায় — ” আল্লা মেঘ দে, পানি দে, ছায়া দেরে তুই ” অথবা ” দেওয়া তুমি অদরে বিদরে নামো………. ” আর চক্রের মাঝখানে কলসি থেকে পানি ঢালে। উদ্দেশ্য, বৃষ্টির ভারী বর্ষণ।এক সময় বৃষ্টি কামনায় ‘চৌদ্দ মাদল ‘ বাজানো হতো। বৈষ্ণব কবি  হরিদাসের মতে —
       ” চৌদ্দ মাদল ধ্বণি যে স্হানে হয়, /
          সেখানে হরির নামে বৃষ্টি সুনিশ্চয় “। /
                    চট্রগ্রামে একসময় পানি মাঙার রেওয়াজ ছিল। লোকজন বিশ্বাস করতো, পানি মাঙলে বৃষ্টি হয়। পানি মাঙার সময় মাথায় কূলা নিয়ে
      তারা গাইতো—– ” মারে মা মেঘ রাণী,/
       ঠেং ধুই ধুই ফেলা পানি।/
       কেলার আগাৎ বেতর বান,/
       ঝর ঝরাইয়া পানি আন “।/
তারা যে ঘরে যেত, সে ঘরের কর্তা বা গিন্নি এক গামলা পানি তাদের মাথায় ঢেলে দিত। অনুরুপ রোমানিয়া ও বুলগেরিয়ায় ” পাপারুদা ” নামে এক ধরণের বৃষ্টি- নাচ প্রচলিত আছে, যেখানে এক যুবতী মেয়ে গাছের সবুজ পাতা আর ডালপালা দিয়ে ‘স্কাট ‘ বানিয়ে তা পরিধান করে গ্রামের পথে নাচতে নাচতে প্রতিটি বাড়িতে ঢুঁ মারে। তখন বাড়ির কর্তা পানি দিয়ে তাকে ভিজিয়ে দেয়। অনেকটা একই ধরণের নাচের প্রচলন আছে দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপের বলকান, শ্লোভাকদের মধ্যে। আর্মেনিয়ায়ও  ‘পিরপিরুনা ‘ নামে একই নাচ প্রচলিত আছে। বৃষ্টির কামনায় পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহার ও জলপাইগুড়ির কিছু কিছু স্হানে এবং বাংলাদেশের পাঁচগড়, দেবীগঞ্জ, বোদা, রাজগঞ্জ এলাকায়  ‘হুদুম চুকা’ বা ‘ হুদুমদেও’ নামে জল-দেবতার পূজাকে ঘিরে এক ধরণের বিশেষ নৃত্য গীত হয়। অমাবস্যার ঘুটঘুটে অন্ধকার রাতে বিশেষ স্হানে শাল বা কলাগাছকে ‘ হুদুম ‘ এর প্রতিভূ গণ্য করে আদিবাসী ও বাঙ্গালি নিম্ন -গোত্রের মেয়েরা সম্পূর্ণ উলঙ্গ- বিবস্ত্র হয়ে টিন বাজিয়ে নানা অঙ্গভঙ্গিতে উদ্দাম ছন্দে নৃত্য করে আর গায় — ” কুদুম দেও হুদুম দেও এক ছলকা পানি দাও, / ছুঁয়ায় পানি নাই, পানি ছুঁয়ায় ছুটি বারা পানি।। /  কাল্যা মেঘ ধওল মেঘ, মেঘ সোদর ভাই,/ এক ঝাঁক পানি দাও , গা ধুবারে যাই “। /
এ অনুষ্টানের ধারে- কাছেও পুরুষরা ঘেঁষতে পারে না। তাদের ধারণা, এ নৃত্যে জলদেবতা হুদুম কামোদীপ্ত হয়ে পৃথিবীতে নেমে আসবে এবং সাথে সাথে নেমে আসবে অঝোর বৃষ্টি। অনা- বৃষ্টিতে বৃষ্টি প্রত্যাশিত ও সঙ্গত। কিন্তু অতিবৃষ্টি ! তাও অনাকঙ্খিত। ছড়ার যাদুকর সুকুমার বড়ুয়ার কথায় —–
” আয় বৃষ্টি আয় / হিসাব করে আয় / ঘরবাড়ি আর ফসল যেন /
রক্ষা পেয়ে যায় “। / বৃষ্টি অঝোরে ঝরলে লোকজ সুরে গাইতে ইচ্ছে করে —- ” নেবুর পাতা করমচা, /
যা বৃষ্টি ধরে যা “। /
                  অতি বৃষ্টিতে বন্যা হলে নিম্ন- বঙ্গের রমণীরা আদিকালে কোন দুগ্ধবতী ভরা-যৌবনা নারীর দুগ্ধ পোড়া-মাটির পাত্রে সংগ্রহ করে বন্যার জলে ভাসিয়ে দিত এই লক্ষে যে, তা পান করে জলদেবতা তুষ্ট হবে এবং অবিরাম বর্ষণ বন্ধ করবে। তখন তারা গাইতো —–
         ” দেবারে দেবা দুধ খা,/
           পিয়ার বুকের দুধ, /
           জলের ধারা বন্ধ হলে/
           পাবি আদর কুত “।/
                       বর্ষায় বৃষ্টির ক্যানভাসে– অনাবৃষ্টি, স্বল্পবৃষ্টি, অতিবৃষ্টি — যাই থাকুক না কেন, বৃষ্টি আসলে বৃষ্টি। বৃষ্টি প্রকৃতির অলন্কার। বৃষ্টিকে নিয়ে যত গল্প, রুপকথা, ছড়া, কবিতা , গান রচনা হয়েছে ; বৃষ্টিকে নিয়ে যত শব্দমালা গাঁথা হয়েছে, অন্য কোন বিষয়ে তা হয়েছে কি-না আমার সন্দেহ। বৃষ্টি নিজেই আসলে শিল্পোত্তীর্ণ পদ্য, রসোত্তীর্ণ গল্প, কালোত্তীর্ণ কথামালা। টুং টাং জলপদ্যের শব্দমালা।

 তৌফিকুল ইসলাম চৌধুরী

প্রাবন্ধিক, গবেষক ও কবি।

জাকির হোসেন রোড, খুলশী,
পূর্ব নাসিরাবাদ, চট্রগ্রাম-৪২২৫।

Leave a Reply