শব্দকুঞ্জ ঈদসংখ্যা-২০২৪
মাজেদুল হক এর গুচ্ছ কবিতা
শব্দকুঞ্জ ঈদসংখ্যা-২০২৪
মাজেদুল হক -এর একগুচ্ছ কবিতা
প্রেতাত্মাদের ধ্রুপদী নৃত্য
সহসাই এক অদ্ভুত তাড়না প্রতিনিয়ত বিভ্রমের দিকে
ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে…
বন্ধনহীন, মমতাহীন এই নিশ্ছিদ্র লৌকিকতার
অন্তপুরে শুধুই দেখছি জৈবিক উল্লাস
করোটির ভেতর জন্ম নেওয়া
অনুষঙ্গ একত্রিত হয়ে স্বপ্নের ভেতর
ভাঙতে থাকে কালের নীরবতা
ভাঙতে থাকে জীবনের উপাখ্যান
ভাঙতে থাকে জীবনের সমস্ত জৌলুস
ভাঙতে থাকে কৃষাণের আলবাঁধা মেঠোপথ
ভাঙতে থাকে জোছনাময় রাতের মহেন্দ্রক্ষণ
ভাঙতে থাকে রৌদ্রজ্জ্বল দিনের সূচিশুদ্ধ চিত্রপট।
মেতে উঠা ইচ্ছা-অনিচ্ছার অদৃশ্য আলোর বিচ্ছুরণে সমাদৃত
প্রেতাত্মাদের ধ্রুপদী নগ্ননৃত্য…
অনাস্বাদিত সমীকরণ
ভুল হিসেবের নামতা পড়ে আর্তকে উঠি বারবার
তারপরও মস্তিষ্কের ভেতরে তাড়া খাওয়া
বেসুরো ভায়োলিন মগজের ভিতর-বাহির, হলি-গলিতে
জমায় বিবর্ণতা, পাপ ও প্রহেলিকা।
এক সময়Ñ
ভুলে যাওয়া অতীত কিংবা স্বপ্নে থাকা স্বপ্নেরা
বধির ভগ্নস্তুপ থেকে উঁকি দেয়…
জীবনের যাদুঘর ভরে উঠে এবড়ো থ্যাবড়ো, ভাঙাচোরা
অনাস্বাদিত সমীকরণে।
মুছে যাক– ধুয়ে যাক যতো আত্মপ্রতারিত কামাতুর
রাত্রির উদ্ধত বুক
অগ্নি নরক দীর্ঘস্বাস…
নৈবেদ্যের সারৎসার
যৌবনাবর্তী বেলুনের নিজস্ব যশ, খ্যাতি, প্রতিভা
ফেটে ধীরে ধীরে শেষ হয়ে যাচ্ছে যাযাবরী ভগ্নাংশের রাত।
প্রলম্বিত এই দীর্ঘ নৈঃসঙ্গের রাত শেষে
অবাধ্য, অনাবৃত উন্মুক্ত মনে একাকী আঁকছি
শূন্যতার নৈবেদ্য…।
অবরুদ্ধ–
জীবনটা যেন আটকে আছে চিকন রোগাগ্রস্থ মার্জিনে।
করুণ সুর তুলে সুরের মূর্ছনায় রেওয়াজ করে যায়–
উৎকর্ষের রন্ধ্রে রন্ধ্রে বসবাস করা নৃত্যরত ঘুনপোকা।
বিবর্ণ স্বপ্নের বিশাল পৃথিবী জুড়ে নির্মাণ করে
ধ্বংসের সাম্রাজ্য।
প্রতিদিন একটু একটু করে–
জাগতিক সুখ খুজি অসমাপ্ত কবিতার পৃষ্ঠায়…
অবরুদ্ধসময়ের ব্যাকরণ
কংক্রিটের বিবর্ণ দেয়ালে পেরেকবিদ্ধ মানবতার
বিলবোর্ডে ঝুলে আছে বিমূর্ত ভাবনা।
ভাবনার নৈতিকতার বাঁধন ছিঁড়ে বেদনার্ত হয়ে উঠে মন
ঝরনা ধারার মতো অবিরাম ঝড়তে থাকে বেদনাশ্রু।
বেদনায় সিক্ত হয়ে দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকে নিদাঘ চিতায়
অবরুদ্ধ সময়ের ব্যাকরণ।
অবসাদ, সংবেদনশীলতা অস্তিত্বের মধ্যে জিঁইয়ে থাকলেও
বোধের পাঁজরে এঁটে থাকে মিহি ধূলোর আস্তরণ।
ক্লান্তিহীন, ঘুমহীন রাত্রির চৈতন্যে টোকা দিয়ে
ঘেটে যাই ভগ্নাকৃত হৃদয়ের গভীরতা।
প্রচ্ছন্ন নীরবতার রকমারী পসরা সাজিয়ে বানের জলের মতো
ভেসে যাই অজানা গন্তব্যে…।
বিস্ময়সূচক যতিচিহ্ন
প্রাণচ্ছল আত্মবোধের পাশেই যমের কাফন পেঁচিয়ে
নিশ্চুপ শুয়ে আছে বিস্ময়সূচক যতিচিহ্ন।
আশ-পাশ, ভিতর-বাহির নেই কোন আনুগত্য
নেই কোন পরিপূর্ণ প্রশান্ত উৎসব, নেই কোন প্রখর রৌদ্র
নেই কোন উন্মুখ সূর্যাস্ত, নেই কোন গুমোটবাঁধা অন্ধকার
নেই কোন বৈপরীত্যের সাতকাহন,
নেই কোন উচ্ছল তরঙ্গের জল
নেই কোন চৈতন্যের বিলাপ…
ঐন্দ্রজালিক কৃষ্ণপক্ষের এয়েদশী চাঁদ কোন দিক নির্দেশনা
ছাড়াই উদোম উঠোনে ঘুরপাক খায়।
এক সময় থেমে যায় কষ্টের গোঙানি
বদলে যায় সমুদ্রের নৈঃশব্দের বাঁক
¤øান হয়ে যায় ভোরের আচ্ছাদিত কুয়াশা
থেমে যায় উষ্ণ নিঃশ্বাসের দুরন্ত ঝড়, আষাঢ়ের নূপুর ধ্বনি
মুছে যায় শিশিরের ছাউনিতে সদ্য ফোঁটা ফুলের গন্ধ
নিভে যায় আকাক্সক্ষার দীপ্ত প্রদীপ।
স্বপ্নের শিথানে বিপন্নতা
স্বপ্ন এখন দুঃস্বপ্নের বেড়াজালে আবদ্ধ-
থমকে গেছে সময়, ঠাস ঠাস করে ভেঙে গেছে বিবেকের দেয়াল।
আগুনের ফুলকিতে ভস্ম হয়ে যাওয়া উদ্যমী উচ্চাশাকে দমিয়ে রেখেছি
করাতকলের সানে কেটে যাওয়া নিশ্চিদ্র ভাবনাগুলোকে জিঁইয়ে রেখেছি
পাড় ভাঙা খেয়া খাটে স্বপ্নতরীদের নোঙর ফেলতে দেখেছি
ভোরের পোয়াতি সূর্যের ভ্রণগুলোর স্বতঃস্ফূর্ত হাসি দেখেছি।
কিছু সুখ, কিছু অনুভূতি, কিছু স্বপ্ন খুঁজে পাবো এই বিশ্বাসে–
অথচ, অথচ– সব কেমন যেন এলোমেলো, অগোছালো
বেঁচে থাকতে চেয়েছিলাম অ নে-ক কাল; অনেক বছর
যেমন বেঁচে থাকে সহস্র বছরের পুরোনো চাঁদ
যেমন বেঁচে থাকে জনপথ, আততায়ী বিকেল
যেমন বেঁচে থাকে অদম্য ইচ্ছের কুচকাওয়াজ
যেমন বেঁচে থাকে এক ঝাঁক রোদ্রের ঝিলিক
যেমন বেঁচে থাকে নিভৃতে, নিঃশব্দে ঘুনপোকা
যেমন বেঁচে থাকে জনহীন, নির্জন পথের ছায়া।
তারপরও দেখি চেনা জানা মানুষগুলো কেমন যেন বদলে যায়–
বদলে গেছে বারান্দায় সাজানো টবের বনসাই
বদলে গেছে ধূলি ওড়া অপরাহ্ন
বদলে গেছে শিস দেয়া গার্হস্থ্য সকাল
বদলে গেছে ভরা ভাদ্রের জ্যোৎস্নারাত
বদলে গেছে নুয়ে পড়া হেমন্তের হাওয়া
বদলে গেছে জীবনের নান্দনিক প্রচ্ছদ
বদলে গেছে কবিতা লেখার পঙক্তি।
নব যৌবনা কিশোরীর আক্ষেপ
মাইয়া মানুষ হইয়া জন্ম নেওয়াটাই পাপ। তানা হলি এমন হবে ক্যান। সেই ছোট্ট বেলায় বাবা মারা যাবার পর থন আমার জীবনে নাইমা আইলো এক কালবৈশাখীর ঝড়। যতদূর মনে পড়ে কইলাটিলায় আমাগো বাড়ী ছিলো। কতবড় উঠান, দরদালান বারান্দা। উঠানে বান্ধবীরা মিলে কানামাছি, ছিবুড়ি, গোল্লাছুট খেলতাম। বাবা যখন বাড়ীতে আইতো মা মা বলে ডাকতো। বাবা যেদিনই বাড়ীতে আইতো আমার জন্য হরেক রকম খেলনা, মজার মজার ছড়ার বই লইয়া আইতো। বাবা কইতো মা’ তুই বড় হইলে তোরে আমি ডাক্তার বানামু, ইঞ্জিনিয়ার বানামু। বাবার সখ আর পুরোন হইলো না।
সামনের মাসে ঈদ। বাবা বললো– আমি গঞ্জে যাইমু। তোমার জন্য কি আনুম মা? আমি বললাম– বাবা আমার জন্য লাল রঙের একটা জামা লইয়া আইসো। ঐ যে বাবা গেল আর ফিরে আইলো না। রাতদিন অপেক্ষায় রইলাম। ঈদের সপ্তাহ খানিক আগে খবর পেলাম বাবা লঞ্চ ডুবে মারা গেছে। বাবার জন্য অনেক কান্না করছিলাম। কান্তি কান্তি চোখের জল শুকাইয়া গেল। বাবা মইরা যাওনে এতো কষ্ট পাইছিলাম তা বইলা বুঝাইতে পারুম না। মাও আমার কষ্ট বুঝলো না। তার সুখের জন্য আমাকে ফেলাইয়া রাইখা আরেক জনের হাত ধইরা চইলা গেল। যার কাছে দিয়া গেছিলো সে আমাকে বিক্রি করে দিলো এক মাসীর কাছে। সেটা নাকি খারাপ জায়গা। ঐ অন্ধকার গলি থেকে কেউ নাকি বের হতে পারে না। আলতা, স্নো, পাউডার দিয়া আমাকে সবসময় সাজাইয়া রাখতো। মাসীর কথায় রাজি না হইলে মাসি আমাকে ভীষণ মারধর করতো। গরম খুনতি দিয়ে ছ্যাকা দিতো। যন্ত্রণায় ছটফট করতাম। একদিন রুমের এক কোনায় বসে কান্না করতে ছিলাম। আমার কান্নার আওয়াজ পেয়ে এক আনটি এসে বললো– কান্না করছো ক্যান? কান্না করো না। আমি বুঝতে পারছি তোমার কী হয়েছে? আমি যেভাবেই হোক তোমাকে আমি এখান থেকে বের করবোই। অন্ধকার এই গলিটায় সন্ধ্যা নামলেই ভোর অবধি রঙ তামাশা চলে। পাগলা পানির নেশায় সবাই যখন মাতাল হয়ে ঘুমাবে ঠিক তখন তোমাকে লইয়া এখান থেকে বের হবো। তুমি রাত্রে ঘুমাবে না। জেগে থাকবে। রাত ভর ঘুমাইলাম না। জেগে রইলাম।
সারারাত এখানকার মানুষগুলান আর কুকুরগুলো চিৎকার করে ক্লান্ত হয়ে বিভোর ঘুমে। তখন আমার কানে ভাইসা আইলো আজানের ধ্বনি। ‘আস্সালাতু খাইরুম মিনান নাউম।’ আন্টি আমার রুমের কাছে এসে আস্তে আস্তে ডাক দিল। আমি আন্টির হাত ধরে গুটি গুটি পা ফেইলা গলির পাশ কাইটা বড় রাস্তায় বের হলাম। বের হয়ে এক অফিসের বারান্দায় ঘুমিয়ে পড়লাম। চোখে অনেক ঘুম ছিলো। ঘুম ভেঙে যাওয়ায় ভীষণ খিদা লাগছিলো। খিদায় যখন কান্না করছিলাম এক ভদ্রলোক আইয়া বললো– এই মেয়ে কান্না করছো কেন? বললাম খুব খিদা লাগছে। দুইদিন ধরে কিছুই খাই নাই। আমাকে তাদের বাসায় লইয়া আইলো। পেট পুরে খাবার দিলো। বললো– এখন থাইক্কা এখানেই থাকবা, কাম করবা। মাথা নেড়ে সম্মতি জানালাম। অনেকদিন ধরে এই বাড়ীতেই থাকতাম। সুযোগ পেলে বড় সাহেব হাত-পা, শরীর টেপাতো। আদর কইরা কাছে টানতে চাইতো। মেম সাহেব আমাকে দিয়ে খাটাতো আবার চুলের মুঠি ধইরা মাগি-ছাগি বলে গালিগালাজ করতো। অত্যাচারে টিকতে না পেরে ওহান থাইক্যা আইয়া মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুইরা বেড়াইতাম। মাইনষে কয়– ঐ ছ্যামরি, তোর লজ্জা সরম নাই, মাইনষের সামনে হাত পাতোস? তোর শরীরেইতো ম্যালা রূপ। ঘরে বইয়াইতো ট্যাহা কামাইতে পারস? লাগলে…। ঐ শুয়োরের বাচ্চা– ঘরে তোর মা-বোন নাই। মাইয়া মানুষ দেখলেই খালি খারাপ কথা কইতে মন চায় -না?
অনেকদিন পর তিন বেলা খাবার, পাঁচশো ট্যাহা বেতনে কাম নিলাম হোটেলে। মালিক ভালোই খাবার দিত। তেলে ঝোলে ভালোই ছিলাম। শরীরেরও রঙ বদলাল। মালিক কয় আমার কিচ্ছুর অভাব নাই। খালি একটা মাইয়া মানষির। তোরে দেখলি পরাণের ভেতর উথাল-পাতাল করে। -আয়, এদিকে -আয়। -না, না আমার গতর ধরেন ক্যান? তুই বুঝোছ না…। অতো বুঝার দরকার নাই। হ্যাচকা টান দিয়া দৌঁড়ে পালাইলাম। ইজ্জত বিক্রি কইরা ট্যাহা কামাইতে চাই না। পরে এদিক-ওদিক ঘুইরা বেড়াই কেউ দুই ট্যাহা দিয়া সাহায্য করে না। কু-দৃষ্টি থেকে রেহাই পেতে ছেঁড়া জামার ভেতর দিয়ে বেড়ে উঠা আবরণটুকু ঢেকে রাখার চেষ্টা করি। তারপরও মানুষগুলান হা কইরা চাইয়া থাহে।
–কি দ্যাহেন? আমার কি রূপ জ্বলাইছে?
–সত্যিই কইছোস। দেহে তোর যৌবনের রস চুয়াই চুয়াইয়া পরতাছে। যাবি আমার লগে? কড়কড়া ট্যাহা দিমুনে? হ.. যামু। কামুক মানুষগুলান ইচ্ছামত আমারে খাবলায় খাবলায় খায়। বেশ ট্যাহাও কামাই। আমি এ্যাহন দেহ বেইচ্চা খাই।
মাজেদুল হক
জন্ম ঃ ১৬-১২-৭১ ইং, প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ : ৬ টি,
লিটল ম্যাগাজিন : সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চা ও চর্যার ছোট কাগজ ‘শব্দকাহন’
২০০৮ সাল থেকে যাত্রা শুরু। এ পযর্ন্ত ১৪ টি সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছে।