শব্দকুঞ্জ ঈদসংখ্যা
মাহফুজ আল-হোসেন এর
গুচ্ছ কবিতা
শব্দকুঞ্জ ঈদসংখ্যা-২০২৪
মাহফুজ আল-হোসেন এর গুচ্ছ কবিতা
শব্দ-শিকারী
বৈদগ্ধের ভাতঘুমে আচ্ছন্ন চাকচিক্যময় এই প্রসাধিত শহরের উপকণ্ঠে পরিযায়ী বৈকাল হাঁসের ধবল ডানায় ভর করে দুর্বিনীত দলছুট কতিপয় শব্দ উড়ে এসে বসেছিল বোধের দানাপানি আর নান্দনিক আশ্রয়ের সন্ধানে ;
প্রশান্ত মহাসাগরর ওপরে টানা কুড়ি সপ্তাহের দীর্ঘ ক্লন্তিকর উড়ানে ওরা পেরিয়ে এসেছে টকটকে লাল টমেটোর মতো যুদ্ধভয় এবং প্রবল ক্ষুধায় ভিসুভিয়াসের উদরে দাউদাউ করে যেভাবে জ্বলতে থাকে হাবিয়াহ্ হুতাশন;
আর সেটাই কি সব, ওদের অলক্ষ্যে হয়তো কোথাও ওঁৎপেতে বসে আছে সুচতুর কোনো শব্দ-শিকারী –সুতীক্ষ্ণ বল পয়েন্টের বিষাক্ত তীর জ্যা-মুক্ত করবে বলে কবিতার খাতায় তাক করে বসে আছে মাছরাঙার অভ্রভেদী চোখে !!
লাল নীল হলুদ ইশতেহার
ফ্লাশব্যাক:
দুঃস্বপ্ন এবং জাগরণের ঠিক আইল বরাবর
সাময়িক সুখদুঃখের যে সড়কদ্বীপ,
ইমিটেশনের গয়নাগাটি ছাড়া
একদম খালিখালি লাগছিল
দূর থেকে।
দৃশ্যপট – এক :
বুঝে না বুঝে এক মায়াবৃক্ষের চারা লাগালাম ওখানটায়,
কুসুম কুসুম প্রেম যেভাবে প্রশ্রয়ের হুতাশনে হয়ে ওঠে মেঘশিল্প ।
দৃশ্যপট – দুই :
হঠাৎ দেখি বিস্মৃতির বিস্তীর্ণ প্রশাখা জুড়ে লাল- নীল -হলুদ ফুল ফুটেছে একসাথে ।
দৃশ্যপট – তিন:
যেন না চাইতেই ত্রৈত সন্তান, এ কী ওরা সাতসকালে নক্ষত্রের ইশকুল ফাঁকি দিয়ে গোল্লাছুট খেলছে অভিপ্রায়ের উঠোনে !!!
দৃশ্যপট – চার :
হায়ারোগ্লিফিক্সে লেখা বাজারের ফর্দে কাঁচামিঠে ঘুমের ঢেউ ভেঙে গেলে লাল নীল হলুদ ইশতেহারে লেখা নতুন কবিতাই পারে বালখিল্য স্নায়ুযুদ্ধের ঘড়ির কাঁটা বছর বিশেক পিছিয়ে দিতে <<<
কোনো রোদ্দুরের অভিমান
নামগোত্রহীন রৌদ্রেরও অভিমান থাকতে পারে-
এই ভেবে যে কনরাড কিংবা অস্টেনের শ্যুটিংয়ে কেন পুব দিকের আলো পরিদৃষ্ট হয়নি
অথবা থাকতে পারে ঋতুমতী ফোটনিক খায়েশ-
যেন গৌরী রাজমহিষীর কোল আলো করে ভূমিষ্ঠ হতে পারে অনাকাঙ্ক্ষিত কৃষ্ণকুমারী
কিংবা নির্বাসনের শর্তানুসারে বৃহন্নলা হওয়ার ছদ্মবেশ এখনো ঘোচাতে পারেনি বলে…
অন্ধকারের যাত্রী
‘Theatre is the art of looking at ourselves. ‘
Augusto Boal
স্থিতিস্থাপক এক পাইপের মধ্যে অভাবিত মঞ্চসজ্জা
আলোহীন সুড়ঙ্গ পথ ধরেই ক্রমাগত সম্মুখের পানে এগিয়ে চলা
ওড়নায় পেঁচানো চাঁদ জোৎস্নাকে সামলে রেখেছে দূর্বল আশ্বাসে
শৈশবে স্নেহবঞ্চিত বামুন বেয়াড়া বাঁ হাতটা বাড়িয়েই রেখেছে –বেহায়া হাওয়ায় অশুচি স্পর্শানুভব থেকেথেকেই লাগছে
কিছু পলাশের রঙ কিন্তু কালোই থাকে
জন্মান্ধ কবিতার পঙক্তিগুলো ক্রমশ গান হয়ে যাচ্ছে
প্রথম অন্তরায় বিষাদ সিন্ধু: ‘রে পথিক, রে পাষাণ হৃদয় পথিক…’
হায়, এই কী সেই রবীবাবুর দেখানো পথ-
ঘুটঘুটে আঁধারে সব বুঝি হলো বেভুল :
‘পথিক পরাণ চল সে পথে তুই…’
ছেঁড়া তারের একতারায় বাধা সন্ধ্যা মেঘের ছায়া :
‘মিলন হবে কত দিনে…’
শনিবার আসবেই -পাইপের ওপাশে–
(একটু খালি)
একটা দুটো করে বাতি জ্বলে উঠছে– (হাততালি)
শিল্পপ্রয়াসী পানতুম
(শার্ল বোদলেয়ার -কে নিবেদিত)
বেড়ে চলেছে শৈল্পিক জনস্রোত দিনকানা
ভাবনার পানসিতে কী নেই আগের মতো
ছানিপড়া ব্রাত্যজনের উৎসুক আনাগোনা
প্রশান্তি মলমের প্রতীক্ষায় কতোশত ক্ষত
ভাবনার পানসিতে কী নেই আগের মতো.
মুখবইয়ের অলিগলিতে অগণ্য অষ্টপ্রহর
শিল্পপ্রয়াসী ভিন্ন চোখ দিবাঘুমে অবিরত
ঝলমলে নিয়ন শাড়িতে নাচছে নষ্ট শহর
মুখবইয়ের অলিগলিতে অগণ্য অষ্টপ্রহর
উইপোকার উদরে মুদ্রিত শিল্পের বসবাস
অনুবাদহীনতায় কূলচ্যুত নিজস্ব লটবহর
নগরে দেদার বিকোয় পরিযায়ী হাঁসফাঁস
উইপোকার উদরে মুদ্রিত শিল্পের বসবাস
তোমার ঘুঙুরে নাচবে কী মেম ব্যালেরিনা
নগরে দেদার বিকোয় পরিযায়ী হাঁসফাঁস
বেড়ে চলেছে শৈল্পিক জনস্রোত দিনকানা
নতুন নন্দনের নকশাদার দরোজা
পঙক্তিগুলোর অপ্সরী অভিধার সাথে
গান্ধর্ব্য মতে থাকতেই পারে
অল্পবিস্তর মিশ্র -কলাবৃত্তের করণিক মতপার্থক্য ;
আবার মর্ত্যলোকের শ্রেয়সী বললে
সোনালু রোদ্দুরের স্বয়ংবরা অভিমান পলানুপলে গলে গলে হতে পারে
প্রগলভ হিমবাহ !
এলায়িত কুন্তল মধ্য প্রশান্তের
মতিচ্ছন্ন লঘুচাপের নির্ঘন্ট লিখছে
ঘন্টায় ঘন্টায়
মনোযোগী বিদ্যার্থীর ক্লাসনোটে ;
আর কাজলবিরহিত স্ফটিক দৃষ্টির অচ্ছোদপটলে লেপ্টে আছে
শতসহস্র মহাকালিক জিজ্ঞাসা;
সেসবের সমাধানসূত্র নিয়ে
কিংকর্তব্যবিমুঢ়
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার উপাত্তিক জলাশয়;
শেষাবধি সিন্ধুলিপির সংকেতায়িত
পাঠকৃতিই কি তবে খুলে দেবে
হৃদিশব্দের নকশাদার দরোজা ??
© মাহফুজ আল-হোসেন
আমিনা’স পার্ল, মিরপুর, ঢাকা
মাহফুজ আল-হোসেন বিংশ শতাব্দীর নব্বই দশকের ব্যতিক্রমী কবি , বিগত তিন দশক ধরে তিনি বাংলা এবং ইংরেজি ভাষায় শিল্পোত্তীর্ণ অসংখ্য কবিতা রচনা করে স্বদেশ ও বিশ্বের অগণিত পাঠক- হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছেন। নন্দনতাত্ত্বিক ও অনুবাদক হিসেবেও সুখ্যাত এই কবি অধুনাবাদী চিন্তার লিটল ম্যাগাজিন ‘শালুক’ এর সহযোগী সম্পাদক এবং কোলকাতা থেকে প্রকাশিত আন্তর্জাতিক লিটারারি জার্নাল ‘Litinfinite’ – এর এডিটোরিয়াল বোর্ডের সম্মানিত সদস্য। এ ছাড়াও তিনি বৈশ্বিক অনলাইন লিটারারি পেইজ ‘Poetry and Literature World Vision’ এবং ETERENORAMA-এর এডমিন হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্ৰন্থসমূহ হলো: সুবাসিত শব্দের ঘুমঘোর, প্রতীচ্যের বিউগল, কালকেউটের ট্যাক্সিডার্মি, Probably Poems or May Not, দুঃখবিলাসের পুলিৎজার, সিজোফ্রেনিক রাখালবালিকা ও মনের বাঘ, নিজের হাতে খুন করেছি গতকাল, এক গুচ্ছ কুচিলা ফুলের সমীপে, ভালোবাসলে বুকে বিপ্লব বেঁধে রাখতে হয়, ‘Theory of Love Maximisation’। তাঁর বেশ কিছু কবিতা অনুদিত হয়েছে ইংরেজি, সুইডিশ, ফরাসী ও স্প্যানিশ ভাষায় । বহির্বিশ্বের বেশ কিছু খ্যাতনামা লিটারিরি জার্নাল এবং অ্যান্থোলজিতে তাঁর কবিতা ঠাঁই পেয়েছে। তিনি ২০১৯ সালে তাঁর কাব্যগ্ৰন্থ ‘সুবাসিত শব্দের ঘুমঘোর’ -এর জন্য পেয়েছেন ‘বেহুলাবাংলা বেস্ট সেলার পুরস্কার ‘ । ২০২২ সালে তিনি কিরঘিজস্তানের প্রখ্যাত কবি রহিম করিম করিমভ – এর নামে প্রবর্তিত ‘ Rahim Karim World Prize 2022 ‘ – এর জন্য মনোনীত হয়ে ডিপ্লোমা অর্জন করেছেন। মাহফুজ আল -হোসেন ১৯৬৮ সালের ২২শে নভেম্বর কুষ্টিয়া জেলার নওদাখাঁড়ারা গ্ৰামে মাতুলালয়ে জন্মগ্ৰহণ করেন, শৈশবের কিছুকাল অতিবাহিত হয়েছে পৈত্রিক নিবাস চুয়াডাঙ্গা জেলার গড়চাপড়া গ্ৰামে এবং বেড়ে ওঠা , লেখাপড়া ও বসবাস ঢাকা শহরে। আইনজীবী পিতা এবং সমাজসেবী মাতার দ্বিতীয় সন্তান মাহফুজ পেশাগত জীবনে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার পদে কর্মরত রয়েছেন। উন্নয়ন সংস্থায় কর্মরত ছায়াসঙ্গী মাহবুবা রহমানের সঙ্গে তিনি দীর্ঘ ঊনত্রিশ বছর যাবত প্রেমময় দাম্পত্য জীবন অতিবাহিত করছেন।