শব্দকুঞ্জ ঈদসংখ্যা
বদরুজ্জামান আলমগীর এর
গুচ্ছ কবিতা
বদরুজ্জামান আলমগীর এর গুচ্ছ কবিতা
বাংলাদেশ হয়ে ফুটি
বয়স বাড়ে ধীরে, মায়া কিংখাবের অজানায়
পরে নিই ধূসরের সাদা ধানের কুড়া ও ক্ষমায়,
কথার গুটিবসন্ত হাতে ফিরে যাই একা নিরবধি
আমি প্রতিদিন এক নতমুখ বাংলাদেশ হয়ে ফুটি।
বাংলার অগণিত বিল ময়ালের পয়ার আমার
ফাটাফাটা কাদা কর্দমের শরীরে ওঠে প্রতিবার।
নদীর অন্তরে ঝিনুকের দাগকাটা নীরবতায় বাঁধি
মুখ বুজে পাতালের নীলে বাংলা ভাষা হয়ে কাঁদি।
হেমন্ত কী বর্ষায় আদিবাসী অন্তর নিত্য আমাকে
ডাহুকের মায়া রক্তে রুয়ে নিঙরে নিঙরে ডাকে
মায়ারাত্রির সুই-সুতোয় বোনা দিগন্ত পানে চাহি
মৃত্যুর গোলাপজল ছিটিয়ে অপার ঘূর্ণি হয়ে বহি।
মাধবী শস্যের ছায়ারা একা হাওয়া ভাঙার দুপুরে
ঘোলা চোখে কেবলি আকুল শিশুরা খেলা করে
ইশকুলের হঠাৎ কাঁপা ঘন্টাধ্বনির মুখে যে ছুটি
আমি প্রতিদিন এক নতমুখ বাংলাদেশ হয়ে ফুটি।।
গ্লেসিয়ার
পুরো মোড়টিই জেনট্রিফিকেশনের আওতায় ছিল-
ব্যাঙ্ক ছিল, ফার্মেসি, এক ডলারের দোকান,
তার সাথেই মিসরীয় আবানৌব যে দেখা হলেই বলে হাবিবি,
হাবিবি- গিফটের একটা দোকান চালাতো এই শপিং কমপ্লেক্সে,
ইটালিয়ান এন্থোনির পিজ্জার ডেরায় পাওয়া যায় খানিক বাফোলো সস মিশানো ঝাল ঝাল পিজ্জা-
পার্কিং লটের মাঝ বরাবর আড়াআড়ি হেঁটে যায় অশীতিপর
নাওমি- সেলার রোড পার হয়ে একটি ছড়ি হাতে ডার্বি ক্রিক পার্কে যায় সে প্রতিদিন-
বরফ ভেঙে যায়, ঠাঠা রোদ মাড়িয়ে যেতেও ভোলে না নাওমি-
পার্কে লাঠিতে টকটক করে খোঁজে হীরা বসানো
চুলের ক্লিপ।
চোখের সামনে ছোট কমপ্লেক্সটি উঠে গেল- একবছরে বারবার গ্যাছি ওখানে- কারো সাথে আর দেখা হয়নি ওখানে, ওরা আত্মীয় নয় কেউ- পথের ধারের দোকানী, অন্তর্গত মসলার গৃহস্থ তারা,
এমনিই পড়শী যারা রাস্তা পারাপার করে, বাসস্ট্যান্ডের বেঞ্চিতে বসে দূরের দিকে চায়।
গত একবছরে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে বেশ কিছু সুমসৃণ প্রাসাদ, টানা বহুতল গুদামঘর- ওখানে দূরদূরান্ত থেকে এমাজন সাপ্লাইয়ের মাল এসে জমে- বড় বড় ক্রেন ট্রাক থেকে মালগুলো নামায়,
থরে থরে গুদামে সাজিয়ে রাখে, দুদিন পরেই ওরা সব নাই হয়ে যায়। বিশাল জায়গা নিয়ে ওখানে একটা সুপারমার্কেট হয়েছে এখন, যারা কাজ করে ওরা সবাই একরকম ইউনিফর্ম পরা- হলুদের উপর নীলের ছোপ বসানো- ওরা কেউ আর ট্রাইবাল নয়- তাদের কারো পিছুটান নেই,
নেই দূরে তাকিয়ে থাকার বেহুদা আনস্মার্টনেস। সবকিছু
ভীষণ ঝকমকে, আলো টিকরানো চোস্ত।
এতোবড় সুপারমার্কেটের এতোগুলো রেজিস্ট্রারে সব ইস্কুলের বাচ্চা বাচ্চা ছেলেমেয়েরা কাজ করে, ওরা সব মনোযোগী প্রত্যয়ী; কিন্তু ওদের কোনভাবেই যে কিশোর কিশোরী মনে হচ্ছে না, ওরা যেন সেই পথের মোড়, ওরাই সেই ছোটখাটো দোকানগুলো যারা এখানে নেই আর!
জিভ কাটার সঞ্চারি
কাঁচালঙ্কা মেশানো একটি মধুশ্রী গ্রুপে
তুমি আছো দেখে আমিও যুক্ত হলাম।
জানি নতুন এক আঁটি দুঃখ নিতে
তোমার তেমন সমস্যা হবে না।
চুল খোলা রেখে যেই তুমি
ঝাউবন মাড়িয়ে হেঁটে যাও
বাতাস তোমাকে দিব্যি সই ও দোপাট্টা বলে ডাকে
আমি দেখি তুমি বাতাসকে ফিরে
যেতে বলো না, তুমি বলো না যে-
বাতাস তুমি ধাড়ি কাক,
ধূলা ভেঙে ভেঙে আর ডেকো না।
সেই ভরসায় আমিও নিজেকে
তোমার সাথে এক সমিতির সভ্য করে নিয়েছি
আমার এ জিভ কাটার সঞ্চারি তোমার পায়ের
ঘুঙুরের পাশে রাখামাত্র
তুমি বললে- সিন্দুকের উপর মুখ রেখে
একবাটি দুধ দিয়ে মুখ ধুয়ে এসো যাও-
কাঁটার দাগগুলো দেখা যাক।।
মধুচূর্ণা
আমরা তোমার হৃদপথে শরিক, প্রত্যাখ্যানে শরিক
তুমি জীবনে খাড়া দুপুরের সমান নির্ঘুম চুমুক।
সে একসময় এসেছিল আমাদের জীবনে
সব তরুণ হয়ে উঠেছিল পতঙ্গের নজির।
আগুনে হাত রাখা-ই প্রকৃত ফুলে হাত রাখা- এই আজব বিদ্যা আমরা শিখেছিলাম গেরিলা ইয়াকুবের কাছে।
আমার কাজের মধ্যেই অকস্মাৎ নার্গিস ফোন করে,
ফোনের ওপাশে ওকে খুব বিচলিত লাগে;
কাঁপা কাঁপা গলায় বলে- ইয়াকুব স্যার মারা গ্যাছে,
বলেই গলার স্বর কান্নার নিচু গ্রামে আটকে যায়।
আমরা কম্পনরেখায় যে অঞ্চল থেকে আসি
ওখানে বিল আর ছানিপড়া চোখের বড় মিল পড়ে।
আমরা যে দুধগ্রাম থেকে আসি ওখানে নিজেরই ঘূর্ণাবর্তে
আলোর চিক্কন রেখা ভাঙা নক্ষত্রের মধুচূর্ণে পাষাণ।
উইপিং উইলো
টাওয়ারের ভিতরেই উড়ে যাচ্ছে পূর্বপুরুষের লাটিম
খেলার পোশাকে ছেলেরা মেয়েরা দলে দলে আলাদা,
দল বেঁধে লাফায়, হল্লা করে বেনামি প্রমাদ একসাথে।
পাকা সড়কের হাতের নিচে নিস্তরঙ্গ শুয়ে আছে পুকুর
মাথা উঁচু আকাশের ডাকঘরের ঠিকানায় অট্টালিকা
স্প্রিংফিল্ড শপিং মলের নীল কোণায় হুকার দোকান।
মোটেলের পাশে গাড়ি ধোয় আমিগো মেহিকান ছেলেরা
কাস্টোমার চলে যাবার পর জলের ধারায় বলে কুলেরো,
কিছুদিন পরেই কুলেরোর বদলে বলবে নিগা এসহোল!
ফুটবল খেলার মাঠের দিকে যাচ্ছে যে উৎফুল্ল যুবারা
একবারের জন্যও দেখে উঠছে না- একান্ত পরিপাটি উইলো গাছটি
মোড়ের দখিনেই একাকী কাঁদছে বড়!
বদরুজ্জামান আলমগীর
নাট্যকার, কবি, অনুবাদক। জন্ম কিশোরগঞ্জ জেলার বাজিতপুর উপজেলায়। পড়াশোনা– সরিষাপুর প্রাথমিক
বিদ্যালয়, সরারচর শিবনাথ বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়, বাজিতপুর কলেজ, ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। নানা পর্যায়ে পথনাটক, সাংস্কৃতিক আন্দোলন, রাজনৈতিক মুক্তিসংগ্রামে ঘনিষ্ঠাভাবে যুক্ত থেকেছেন; বিভিন্ন সময় সম্পাদনা করেছেন: নাট্যপত্র, সমাজ ও রাজনীতি, দ্বিতীয়বার, সাংস্কৃতিক আন্দোলন, পূর্ণপথিক, মর্মের বাণী শুনি, অখণ্ডিত। প্যানসিলভেনিয়ায় কবিতার আসর সংবেদের বাগান–এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য, বাংলাদেশে গল্প থিয়েটার যাত্রা শুরু করে তারই উদ্যোগে।
প্রকাশিত বই: নননপুরের মেলায় একজন কমলাসুন্দরী ও একটি বাঘ আসে। পিছুটানে টলটলায়মান হাওয়াগুলির ভিতর। আবের পাঙখা লৈয়া। হৃদপেয়ারার সুবাস। নদীও পাশ ফেরে যদি বা হংসী বলো।
বর্তমানে বসবাস করেন ফিলাডেলফিয়া, যুক্তরাষ্ট্রে।