শব্দকুঞ্জ ঈদসংখ্যা
ওবায়েদ আকাশ এর গুচ্ছ কবিতা
শব্দকুঞ্জ ঈদসংখ্যা
ওবায়েদ আকাশ এর গুচ্ছ কবিতা
গোরখোদক
আলাউদ্দিন, গোরখোদক
একটি একটি কবর খোঁড়ার পর
সারারাত নিজের জন্য স্বনির্মিত কবরেই ঘুমিয়ে থাকে
তার দেহখানা আলনায় ঝুলিয়ে দেয় আর
আত্মাটাকে খুলে রেখে কবরের দরজা ভেজিয়ে দেয়
গোরস্থানে আলাউদ্দিন এক স্বনামখ্যাত ডাক
তার মুখভর্তি ছোটবড় কাচের আসবাব
বুকভর্তি রাজপথ এবং
চোখভর্তি হরপ্পা-মহেঞ্জোদারো সভ্যতার বিস্মৃতি
সকলের চোখ ফাঁকি দিয়ে আলাউদ্দিন যা করে :
কখনো কাকতাড়ুয়া আবার কখনো
বাঘের চামড়ায় ঢেকে নিজেকেই দাঁড় করিয়ে দেয়
গোরস্থানের মূর্তিমান মনুষ্য-আতঙ্ক করে
আর ভাবে মনে মনে, পৃথিবীতে যে কোনো মিথ্যাকে সত্য আর
সত্যকে মিথ্যা বানানো গেলে
এই প্রকার মনুষ্য-আতঙ্ক একদিন
মানুষের মৃত্যুকেও প্রতিরোধ করার শক্তি যোগাবে!
অভিধান থেকে ইতিহাস— গোরখোদক শব্দটি
আর কোথাও থাকবে না
হঠাৎ চিৎকার করে কবরের ভেজানো দরজায় লাথি মেরে দেখে
কে যেন তার খুলে-রাখা পুরনো আত্মাটি
হাতিয়ে নিয়ে গেছে
এবং নিজেকে আবিষ্কার করে একটি নতুন আত্মার মুখোমুখি
আলাউদ্দিন, গোরখোদক
অভিধাটি আজকাল কেউ ব্যবহার করে না আর
কৃষককন্যার কাব্যচর্চা
এক কৃষকের— কিশোরী সে— স্কুলে যায়— লোকজন বলে— প্রতিটি সকালে— না যদি সূর্য ওঠে— একমুঠো কাঠের আগুনে— পৃথিবী কি আলোকিত হয়?
প্রতিবেশী আমি— এমনই কিশোরী সে— রাত করে ছড়া-পদ্য লেখে— কেবলই আমাকে চেনে— আর ভাবে মনে মনে— একদিন তুমিও কিশোর— প্রেমপদ্য লিখে শেষে— ছুড়েছ আগুনে— আমি তার পদ্য ঘেঁটে পাই— রূপের আগুনে তার— পতঙ্গেরা পুড়ে পুড়ে— কত হলো ছাই— আরো লেখে মেয়ে— অন্যত্র তুষের আগুন— কৃষক পিতাকে তার— আজন্ম জ্বালিয়েছে— তারো চে’ দ্বিগুণ— আমি তাকে বলি— রূপের সীমানা যদি— খেয়ে যায় ঘুণে— ছড়া-পদ্য লিখে মেয়ে— তুমিও ছুড়বে আগুনে—
আমার রচনাবলি— চারিদিকে বারুদের ঘ্রাণে— একদিন জেনো তারা— গড়াবে ধুলায়— আর তুমি কৃষককন্যা— একমুঠো কাঠের আগুন— প্রতিদিন দেখা হবে— তারায় তারায়
প্রশ্ন
কিংকর্তব্যবিমূঢ় তোমার দেখালেপনা
এখন শহরজুড়ে একটিও নদীর সন্ধান দিতে পারছে না
অথচ শহরের স্তনবৃন্ত
ভরা মৌসুমের আঙুরের বোঁটার মতো ঝরে পড়তে পারে
এমন আসন্ন বেলা—
তখন দুধের নহরে শহর ভেসে গেলে কী জবাব দেবে
বলো?
প্রতিদিন ট্রাকভর্তি ফুলকপি-ঢেড়সের দুধ
ঝিঙে-পটলের লালা এবং
পুঁইশাক-পাটশাকের লাবণ্য এসে
পুরো শহর মেকআপ করে দিচ্ছে
আর পরনারী পরপুরুষেরা তাতে
মোহিত হয়ে বিবিসি সিএনএন
আল জাজিরায় প্রচার করে দিচ্ছে—
তোমার দুয়ারে এখন আজন্তর্জাতিক নন্দনতাত্ত্বিক
আর
গণমাধ্যমের বিশ্বখ্যাত কূটনৈতিক বার্তা পরিবেশক
এবার তাদের চোখা চোখা প্রশ্নের কী জবাব দেবে
বলো?
মিশেল ফুকো ও মামুন হুসাইনের চিকিৎসাপদ্ধতি
মিশেল ফুকো পাগলাগারদের বৃত্তান্ত বোঝেন
তার প্রতিটি অস্থিসন্ধির প্রলাপ— ভিসুভিয়াসের উত্তপ্ততায়
মুহূর্তে ছড়িয়ে পড়ে অকৃত্রিম অনুরাগীকুলে
পাশ্চাত্য-যৌনতার উন্মুক্ততা ও অবদমন বিষয়ক তর্ক কিংবা
স্বভাব মনোবিকলনকালে, যখন তিনি হেঁটে হেঁটে
আমাদের মধ্যরাত্রিক চেতনার উদ্যানজুড়ে বসিয়ে দেন মীমাংসা;—
আমরা কি তখন ততটাই প্রলাপমুখর গভীর তন্দ্রায়?
কিংবা আমাদের প্রতিদিনের কারাগারের অবিশ্বাস্য বোঝাপড়ায়
যখন মিশেল ফুকো দাম্পত্যে, প্রেমে, রান্নাঘরে, বাথরুমে
অফিসে, বক্তৃতায়, সংগ্রামে, সৈকতে— ঘরে ঘরে পাঠ্য হয়ে ওঠেন—
আমরা তখন ফুকোর চকচকে টাক উঠোনের আমগাছের ছায়ায়
বিছিয়ে নিয়ে দল বেঁধে দিবানিদ্রায় যাই—
আজ প্রাচ্য কিংবা পাশ্চাত্যে দর্শন ও শল্যচিকিৎসার
করুণ পরিণতিজুড়ে একদিন আমাদেরও খোয়াবনামায়
জুড়ে বসেছিল মিশেল ফুকোর আসমান-সমান প্রকাণ্ড ছায়া
তবু ফুকো আমাদের প্রতিদিনের আসবাবপত্র ঝাড়মোছ
ঘষামাজায় কতটা কি যোগান না যোগান, তার চেয়ে বড়
তিনি আমাদের অগণিত প্রধান সড়কের পাশে পদ্মপাতার
অসংখ্য শুশ্রূষালয় ফেরি করে ফেরেন ফরাসি ভাষায়—
তখন আমি আমাদের অসামান্য কথাকার, মনোচিকিৎসক
মামুন হুসাইনের শরণাপন্ন হলে— তিনি আমাকে তার উপন্যাস
ও গল্পের বিভাষায় একটি টাকা আটকানোর রাবার বাঁহাতে লাগিয়ে
চলতেফিরতে ও সময়মতো টেনে আবার শরীরে ছুড়ে মারতে বলেন!
তাতে আমি যেমন চিৎকার করে সুস্থ হয়ে উঠি;
তেমনি দিনদিন মামুন হুসাইনের অন্ধ ভক্ত হয়ে— প্রতিদিন তার
কোলেপিঠে চড়ে মিশেল ফুকোর বেবাক গল্প শুনি
হাসপাতাল থেকে ফিরে
আমি যখন পাগল হয়ে ফিরে এলাম
দেখি, কেউ আমার চেনা নয় আর
স্ত্রীকে বলি— ভাবি, তোমার মতো মেয়ে, যারা
সারারাত্রি স্বাস্থ্যসেবা করে
তারা কেউ নয় আমার স্ত্রীর মতো পরিচর্যারত
আমি তাদের চুমু খেয়ে, গন্ধ শুঁকে
মুখ ভরে ঢেলে দিই বাংলা মদের ঝাঁঝ
তারা বলে— তাদের ঘরে রাত্রিযাপন
নির্ হরিণ শিকারই
ভাবি বলে বাপু— ‘তোমার সন্তানগুলো
তারা তো ঘুমিয়ে পড়েছে
আমাকে খুঁজতে এসেছে মধ্যরাতের মাঝি’
আমি দারোয়ান সমেত কাউকে বেরিয়ে যেতে দেখি
দেখি, ডাক্তার এসে আমার পালস দেখছে, গাল টিপছে
আমার হাড় কব্জি ঘষে-ছেনে তার দীর্ঘ কালো চুলে
ঢেকে দিচ্ছে মুখ
আমার নিঃশ্বাস বাড়ছে, আর
সে তার কম্পিত ঠোঁটে রাক্ষস হয়ে চেটে খাচ্ছে রোগ
সময়
ঘড়ির দিকে তাকালে
কোন কাঁটাটি কখন ঠিক বুকের মধ্যে বিঁধে যায়
এই ভয়ে ঘড়িকে বর্জন করেছি
অথচ রাত্রি হলে হৃৎপিণ্ডের উচ্চারণের চেয়ে
অধিক আপন হয়ে ওঠে ঘড়ির টিকটিক
তখন ব্যবহৃত বাসনকোসন ঘড়ির নিচে পেতে দিয়ে
ডায়াল থেকে টুপ টুপ করে ঝরে-পড়া সময় সংগ্রহ করি
ভোর অবধি এত এত সময় আমার সমস্ত ঘর উপচে
জানালা দরজা দিয়ে গড়িয়ে ছড়িয়ে যায়
আর সন্ধে নামার আগেই
সময়ের সাথে পৃথিবীর সম্পর্কের চিতায়
দাউ দাউ আগুন জ্বলে ওঠে
ওবায়েদ আকাশের জন্ম : ১৩ জুন ১৯৭৩; সুলতানপুর, রাজবাড়ী। একাডেমিক
পড়াশোনা : বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতকোত্তর।
পেশা : গণমাধ্যমে চাকরি। বর্তমান কর্মস্থল : দৈনিক সংবাদ। প্রকাশিত গ্রন্থসংখ্যা :
কবিতা, অনুবাদ, গল্প, প্রবন্ধ, সম্পাদনা মিলিয়ে ৩৭টি।
কাব্যগ্রন্থ:
পতন গুঞ্জনে ভাসে খরস্রোতা চাঁদ (২০০১), নাশতার টেবিলে প্রজাপতিগণ (২০০৩), দুরারোগ্য বাড়ি (২০০৪), কুয়াশা উড়ালো যারা (২০০৫), পাতাল নির্মাণের প্রণালী (২০০৬), তারপরে, তারকার হাসি (২০০৭), শীতের প্রকার (২০০৮), বিড়ালনৃত্য, প্রেতের মস্করা (২০০৯), যা কিছু সবুজ, সঙ্কেতময় (২০১০), প্রিয় কবিদের রন্ধনশালায় (২০১১), শুশ্রূষার বিপরীতে (২০১১), রঙ করা দুঃখের তাঁবু (২০১২), বিবিধ জন্মের মাছরাঙা (একটি দীর্ঘ কবিতা, ২০১৩), তৃতীয় লিঙ্গ (কয়েকটি দীর্ঘ কবিতা, ২০১৩), হাসপাতাল থেকে ফিরে (২০১৪, কলকাতা), ৯৯ নতুন কবিতা (২০১৪), পাতাগুলি আলো (২০১৬), তথ্যসূত্র পেরুলেই সরোবর (২০১৮), সর্বনামের সুখদুঃখ (২০১৯) এবং পৃষ্ঠাজুড়ে সুলতানপুর (২০২০)
কাব্য সংকলন:
ঋতুভেদে, পালকের মনোবৃত্তিগুলি (কাব্য সংকলন, ২০০৯), স্বতন্ত্র ৬০টি কবিতা
(কাব্য সংকলন, ২০১০), ওবায়েদ আকাশের কবিতা ॥ আদি পর্ব (কাব্য সংকলন, ২০১১), উদ্ধারকৃত মুখমণ্ডল (বাংলা একাডেমি প্রকাশিত নির্বাচিত কাব্য সংকলন, ২০১৩), মৌলিক পৃষ্ঠায় হেঁয়ালি (কাব্য সংকলন, ২০১৭, কলকাতা), বাছাই কবিতা
(২০১১থেকে২০১৮ পর্যন্ত নির্বাচিত কাব্য সংকলন, ২০১৮), স্বতন্ত্র কবিতা (স্বতন্ত্র
কাব্যসংকলন, ২০১৮), শ্রেষ্ঠ কবিতা (কলকাতা, ২০১৯)।
Translated Book (Poetry Collection)
Faux Assassin
Translated by : Ashoke Kar, Haikal Hashmi, Mahfuz Al-Hossain, Razia Sultana and
Kamrul Hasan. (2019)
শিশুতোষ গ্রন্থ : ভূতের বাপের শ্রাদ্ধ, ২০১৯
অনুবাদ:
ফরাসি কবিতার একাল / কথারা কোনোই প্রতিশ্রুতি বহন করে না’ (২০০৯)
‘জাপানি প্রেমের কবিতা / এমন কাউকে ভালোবাসো যে তোমাকে বাসে না’ (২০১৪)
গদ্যগ্রন্থ :
‘ঘাসের রেস্তরাঁ’ (২০০৮),
‘লতাপাতার শৃঙ্খলা’ (২০১২)
সম্পাদনা গ্রন্থ :
‘দুই বাংলার নব্বইয়ের দশকের নির্বাচিত কবিতা’ (২০১২),
পাঁচ দশকে বাংলাদেশ : সাহিত্য সংস্কৃতি সমাজভাবনা (বিশিষ্ট কবি লেখক বুদ্ধিজীবীর সাক্ষাৎকার সংকলন, ২০১৮),
সম্পাদিত লিটল ম্যাগাজিন :
শালুক (১৯৯৯–)
পুরস্কার :
এইচএসবিসি–কালি ও কলম তরুণ কবি ও লেখক পুরস্কার ২০০৮
কলকাতা লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরি ও গবেষণা কেন্দ্র পুরস্কার ২০০৯
লন্ডন থেকে প্রাপ্ত সংহতি লিটারারি সোসাইটি বিশেষ সম্মাননা ২০১২
কলকাতা থেকে ঐহিক মৈত্রী সম্মাননা পদক ২০১৬
যোগাযোগ:
email : oakash1971@gmail.com