You are currently viewing শব্দকুঞ্জ ঈদসংখ্যা। গল্প: কাগজ- নাসের ওয়াদেন

শব্দকুঞ্জ ঈদসংখ্যা। গল্প: কাগজ- নাসের ওয়াদেন

শব্দকুঞ্জ ঈদসংখ্যা

শব্দকুঞ্জ ঈদসংখ্যা-২০২৪

 

গল্প:                

কাগজ

 না সি র ও য়া দে ন

           রাগে গজগজ করতে করতে ফিরে যাচ্ছে আনিস। রাতের গন্ধ গায়ে লাগিয়ে ভোরের কুয়াশা মেখে পাঁচ কিলোমিটার পথ ধাওয়া করে সাইকেল বেয়ে এসে লাইন দিতে হয়েছে । বেলা গড়িয়ে দুপুর পার, মাথার সূর্য তখন বাইশ দিনের ওম দেওয়া ঘোলাটে ডিম, একটা পোক্ত ছানার রূপ পেয়ে যাবে যেন । একরোখা রোদ বারবার মুখ লুকোচ্ছে মেঘের বুকে, মেঘকে তার বড্ড হিংসে করে । উত্তুরে শীতল হাওয়া ভাসিয়ে নিয়ে যায় ইলশেগুঁড়ির ছানাপোলাদের। বৃষ্টির হালকা মেজাজ, দোতলার মেয়েটির মুখে রবীন্দ্র সংগীতের সুর জানালার শিক ভেদ করে ভেসে আসে পিচরাস্তার বুকে ।
   ‘ যদি নাই হবে, খামোখা হয়রানি কেন ভাই ?
দীর্ঘ লাইনের মাথা যখন ছুঁল পোস্টাপিসের বাবুর কাছে, বাবু বলে দিল,’ তিনমাসের পর এসো। মগের মুলুক পেয়েছে । আমরা সব ভেড়ারদল! ‘
      বাড়িতে ফিরতে ফিরতে সেই সন্ধ্যা এসে যাবে তাদের।

‘ভুল!  ভুল করবে ওরা, আর তাপ সইব আমরা, কী আজব দেশ রে ভাই ।’
রাগে ততক্ষণে তার রক্তচাপ বেড়ে গেছে । তার পাশে সাইকেল চড়ে যাচ্ছে আবির । দীর্ঘদিনের সম্পর্ক, পাশাপাশি বসবাস ,
  আনিসের দাদু আর আবিরের দাদু দেশ ছেড়েছে সেই  সাতচল্লিশ সালে । আজ ওরা দুজনেই গত। ওপারের জল, হাওয়া তাদের ভাল লাগেনি, তাই পাড়ি দেওয়া । কোথায় যেন বেসুরো আওয়াজ ভেসে আসছে আজ , কালিমালিপ্ত হচ্ছে ভোরের ভালবাসার বাতাস, নিশ্বাস প্রশ্বাসে বিষের গন্ধ । কে ছড়ায় —

  তখন অখন্ড একটা ভারত নামে দেশ ছিল। একে অপরের সাথে মিলেমিশে কাজ করতে হয়েছে তাদের। এর বাড়িতে অতিথি এলে তার ব্যস্ততা।যেন আপন ভাইয়ের বাড়ির কাজ। হাতে হাত লাগিয়ে একসাথে মিলে কাজ তুলে নিত। শুধু কি পুরুষেরাই, তা নয়, মেয়েদের মধ্যেও ছিল অসম্ভব ভাব, ভালবাসা।

 ছোট্ট আনিসের মনে পড়ে সেদিনের তার বাপের সেই কথা।  বারো মাস উৎসব লেগেই থাকত। পালা পার্বণে  একসাথে মিলে পিঠে বানানো হোত। আষাঢ়-শ্রাবণ মাসে বৃষ্টির ছাট এসে দাওয়ায় পড়লেই কদম্ব ফুলের গন্ধে বাসি উঠোন ভরে যেত, সুগন্ধে ভরপুর। চারিদিকে মিষ্টি স্বাদ বাতাসে ভুরভুর করছে। শ্রাবণ ভাদ্র মাসে তাল গাছ থেকে টুপটাপ করে পাকা তাল খসে পড়ত দিঘির জলে। ছোট ছেলেরা উলঙ্গ হয়ে ঝাঁপ দিত সেই জলে, তুলে আনত পাকা তাল। এই নিয়ে ছেলেদের মধ্যে চলত লড়াই,কে কতটা সংগ্রহ করতে পারল তারই প্রতিদ্বন্দ্বিতা।

    সেই কুড়িয়ে পাওয়া তাল দিয়ে  বানানো হোত পিঠে। মেয়েরা দল বেঁধে একসাথে বসে পিঠা বানিয়ে পাড়াপড়শির মধ্যে বিতরণ করত।

 

 বাংলার বুকে সেসময়ে একটা প্রচলিত প্রবচন ছিল,

পান,পানি,পিঠা, এই তিনই শীতে মিঠা।

 

  হাজার হাজার বছর ধরে বাঙালি সমাজ বিভিন্ন প্রথা,রীতি পরম্পরা নিয়ে নানান খাদ্য বিভিন্ন উপাদানে তৈরি করে বন্টন করত পরস্পরের বাড়িতে। দক্ষিণ পাড়ার ক্ষেপা গোবিন্দর মুখে প্রায়ই শোনা যেত গান, লোকজ সঙ্গীত, আপন মনের খেয়ালি সুর,

 

   পৌষ পার্বণে পিঠে পুলি মহা ধুমধাম 

   ঘরে ঘরে পিঠে করে ধন্য হয় পল্লিগ্রাম ।

 

সেই গানের সুর ভেসে বেড়াতো সারা গ্রামময়। পাড়ার বৌ-ঠাকরুন বিন্তি দিদি ছিল বদমেজাজি স্বভাবের মেয়েলোক। গোবিন্দের গান শুনে মুখ ভেংচিয়ে বলত, আ মলো, ওলোটার হয়েছে কি? ওমুন বেসুরো গান শুন্যা পিত্তি জ্বলি যায়।

   হর কাকা দাওয়াই বসে শন দিয়ে দড়ি পাকাতো। দড়িকে ঢেড়ায় জড়তে জড়তে বিন্তি পিসির দিকে তাকিয়ে বলত,

‘ কি হয়্যাছে গো বিনি পিসি? অমুন কোরা গাল দিচ্ছ কারে? বলি, গোবিন্দা কি কারো পাকা ধানে মই দিয়্যাছে নাকি?

 — তা কেনে দিতে যাবে মুড়ল ভাই? ওর গলায় কি সুর আহে? সুর না আহলে শুধু শুধু গান গেইলে কি শুনতে ভালো লাগে ? তাই, সেই কথা টুকু কহিছি।

–ক্ষ্যাপা, পাগল মানুষ মুন ভালো করার লেগে যদি একটু সুর ভাজে তো খারাপটা কি শুনি? গাহিছে যখুন, গাহিতে দাও না বাপু।

 

রাগে কচ কচ করতে করতে বিন্তি পিসি চলে যায় মুখটাকে বেঁকিয়ে।

        অঘ্রান মাসে বাঙালির ঘরে ঘরে আরও একটা উৎসব হয়, নতুন ধানের গন্ধ, ও আকাশ বাতাস ম ম করে। গরিব ধনী নির্বিশেষে সকলের ঘরে নবান্নের আনন্দ উপচে পড়ত বাংলার ভূমিতে, বাঙালির হৃদয়ে।‌‌ আতপ চালের গুঁড়ো, চিনি ও পাকা কলা দিয়ে রহম তৈরি হত, অতিথি আপ্যায়ন করা হত। সেটাই ছিল সবার আগে মানব ধর্ম। ধর্মের কোন বাধা ছিল না। কোন বাঁছ-বিচার ছিল না কোনো কাজে। আর দেখো এখন ধম্মে ধম্মে ভাগাভাগি,দলে দলে মারামারি,কত কাণ্ড ।

গেরস্থের ঘরে ঘরে প্রদীপ জ্বেলে ধনলক্ষ্মী দেবীর আরাধনা করা হত। সেই প্রদীপের আলোয় ছিল সম্প্রীতির সুগন্ধ, ভালোবাসার ঘ্রাণ, মনের অন্তরালে বেজে উঠত মিলন বাঁশির সুর।

  বিদেশী লালমুখোরা যেদিন দ্যাশ ছেড়ি চলি গেলো, দেশটোকে দু’টুকরা করল,সেদিন থেকেই ওদের ভাগ্যও দু ফাঁক হয়ে গেল। ভাইয়া ভাইয়া লড়াই। লুটপাট করে যে যা পারল কেড়ে নিল।

আবিরের বাবার মনের এইসব স্মৃতি কথা ভেসে ওঠে আবিরের মনে। গঙ্গা,পদ্মা নদীর জলে কত রক্ত ভেসে যেতে দেখেছ সে। মানুষে মানুষে হানাহানি, মারামারি। মনে পড়ে, কীভাবে সেদিন রাতে বুড়িগঙ্গা নদী পার হয়ে বিবস্ত্র হয়ে, নিরস্ত পথে, শূন্য হাতে এপার বাংলার মাটিতে পা রেখে একটা অনিশ্চিত জীবন যাপন করতে হয়েছে। সেকথা মনে পড়লে আতঙ্কে ঘুম ছেড়ে চলে যায় তার।

  সেই তাড়া যেন এখন আবার ফিরে আসছে। ধর্মে ধর্মে আবার বিভেদের বীজ। পরস্পরের প্রতি অবিশ্বাস। নতুন করে যন্ত্রণা মাথার উপর এসে খাড়া হয়ে দাঁড়াচ্ছে।

    ভুল।

 

আবার ভুল । আধার কার্ড । ভোটার কার্ড । ঠিকঠাক না হলে নাকি সমূহ বিপদ, অসম পরিণতি । আঁতকে ওঠে আনিস,  বলে, ‘ আর বাঁচা যায় ?  আমার বাবা জন্মাল এ দেশে, আমি জন্মালুম, আমার ছেলে, তার ছেলে গত মাসে, এখন নাকি  আমাদের সবাইকে প্রমাণ দিতে হবে।
  ‘ঠিক বলেছিস আনিস,  বলল আবির, আমাদেরও তো ভয় করে ভাই!  আধার কার্ড, ভোটার কার্ড, স্কুল সার্টিফিকেটের কোন দামই নাই। নতুন জন্ম সার্টিফিকেটের প্রয়োজন ।এই পঞ্চাশ পেরোনো মানুষ, কোথায় পাবে বলতো ?’
  — সেটাই তো মোদ্দা কথা ভাই।
  — তাকিয়ে দেখ আসাম।গোটা রাজ্য পুড়ছে, আগুন জ্বলছে, কারো কোন হুশ আছে?
এখানেও কি আগুন জ্বলবে ?
  পাশের বাড়িতে আগুন লাগলে আমার বাড়ি কি সুরক্ষিত থাকবে ?
–তুই ঠিকই বলছিস আবির। জন্মালাম এখানে , আর এখন বলছে, প্রমাণ না দিলে কাম্পে পচে মরতে হবে ।
      ওরা  চলছে পিচরাস্তার উপর দিয়ে সাইকেল চড়ে । দুপাশের সারি সারি গাছ, পাখির কলকাকলি,ছন্দস্বর, মাঝেমাঝে রোদের লুকোচুরি । দূরে সবুজ প্রান্তর, রবিফসলের ঢেউ, শরীরের অঙ্গে সোনার গহনা, সোনালি ধানের শীষ ।
    পিচরাস্তার শেষ, এখন কংক্রিটের রাস্তা । রাস্তার চেহারা পাল্টে গেছে, জীর্ণশীর্ণ রাস্তা হাড়মাস পেয়ে উল্লসিত । সৌহার্দ্য আর ভালবাসা মুড়ে আছে সোনার বাংলা । সেই সকালবেলায় সূর্য ওঠা, রাখালিয়া সুরে সুরে সূর্যের অস্তাচল গমণ, পাখিদের ঘরে ফেরা, কোন বাধা নেই, কোন বেড়া নেই, আছে শুধু সুন্দরের ঘ্রাণ, অনন্ত ভালবাসা দিগন্তের ভাঁজে ভাঁজে হরিৎ বাতাসের সুগন্ধি।
       মোবাইল বেজে উঠলো আনিসের। ওপার থেকে কন্ঠস্বর শোনা গেল, ‘চাচা নেই! আক্রাম চাচা গলায় দড়ি দিয়ে মরেছে ।’
    আনিস বিহ্বল হয়ে পড়ে । গত কয়েকদিন ধরে আক্রাম চাচা অস্থির ছিল । দাদুর আমলের বাড়ির দলিল, জমির কাগজপত্র খুঁজে পাচ্ছিল না । দু’হাজারের বন্যায় সব ভেসে গেছে, ভেঙে গেছে আশ্রয়টুকুও। সরকারি সাহায্যে ছোট একটা আস্তানা গড়েছে।ব্যস, এতটুকুই।
    দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে আনিস, আবিরও ,দুজনেই ।এর শেষ কোথায় !
              ——

নাসির ওয়াদেন
মুরারই, বীরভূম
পশ্চিমবঙ্গ, ভারত

 বীরভূমের প্রান্তিক শহর মুরারই থানার রঘুনাথপুর গ্রামে কবি নাসির ওয়াদেন এর জন্ম। ২৩ শে জুলাই ১৯৫৯, গ্রামের স্কুল থেকে প্রাথমিক শিক্ষা । ১৯৮৬ সালে রামপুরহাট কলেজ থেকে স্নাতক হন । তারপর ১৯৯৫ সালে শিক্ষকতার সাথে যুক্ত হন এবং সম্প্রতি অবসর গ্রহণ করেছেন । সামাজিক প্রতিকূলতা উপেক্ষা করে নানান ঘাত-প্রতিঘাত খেয়ে তিনি বড়ো হয়েছেন ।
তাঁর প্রকাশিত কবিতাগ্রন্থ হল ১৷ অন্ধকার কুরুক্ষেত্র খোঁজে,
  ২৷ বিবর্ণ বৃষ্টি ভেজা দাগ, ৩৷ বুক ছুঁয়েছি নগ্ন রাতে,  ৪ ৷ প্রিয় ফুল ও অভিমানী ইচ্ছেরা, ৫৷ কোকিল ডাকলেই বসন্ত আসে ৬। সভ্যতার নামে চাকা ৭। ভোরের কুয়াশা : ডানা গীতিকা। প্রকাশের পথে, শরতের দৈবদৃষ্টি : একটি মেলডি, অদৃশ্য অস্তিত্বের দরোজা। একমাত্র গল্পগ্রন্থ , অথবা অন্য পৃথিবী, ২০১৩ সালে সাহিত্যে বিশেষ অবদানের জন্য “কাঞ্চিদেশ সাহিত্য ” পুরস্কার লাভ করেন । প্রকাশিত হয়েছে তাঁর ” নির্বাচিত প্রবন্ধ ” সংকলন । বীরভূমের প্রথম শিশুদের পত্রিকা হিসেবে ” চমচম  ” পত্রিকা । চমচম পত্রিকাতে অনেক গুণিজন লিখেছেন । চমচম পত্রিকার সম্পাদক । নন্দন, মাসিক কৃত্তিবাস,আর্ষ,গৌতমী,যুগশঙ্খ, কবিতা আশ্রম, অনন্য প্রয়াস, গণশক্তি,হৃদয়ের কথা,সৃজন তৃষা, অভিমুখ সহ শতাধিক পত্রিকাতে লেখা প্রকাশিত হয়েছে ।দেশ বিদেশের পত্রিকাতে লিখেছেন । দেশ সাহিত্য পত্রে চিঠিপত্র বিভাগে  পত্রগুচ্ছ প্রকাশিত হয় ।
  তিনি কাঞ্চীদেশ সাহিত্য পুরস্কার( ২০১৩), “জিরো বাউন্ডারি সম্মান ২০২২”,কৃষ্ণশেখর আচার্য স্মৃতি সম্মান ২০২২’ বঙ্গজন শারদ সম্মান ১৪২৬’ ,নন্দিনী স্মারক সম্মান ২০১৪ “, ময়ূরাক্ষী নন্দিনী স্মারক ২০১২ সহ নানা সম্মাননা লাভ করেছেন।
     কবি সাদামাটা, গ্রামের মানুষ হিসেবে গ্রাম জীবনের চিত্র, হাভাতে মানুষের আর্তনাদ স্বচক্ষে দেখেছেন । তাদের করুণ কাহিনী, আচার-আচরণ, বিহ্বলতা প্রত্যক্ষ করেছেন খুব কাছের থেকে, তাই তাঁর কবিতার মধ্যে প্রেম-অপ্রেম, দ্বন্দ্ব-সংঘাত, বাদ-প্রতিবাদ, সৃজন-সংগ্রাম, ইত্যাদি লক্ষ করা যায় ।

নাসের ওয়াদেন
গল্পকার

Leave a Reply