শব্দকুঞ্জ ঈদসংখ্যা-২০২৪
গল্প: জীবন ভজঘট
সৌমেন দেবনাথ
শব্দকুঞ্জ ঈদসংখ্যা-২০২৪
জীবন ভজঘট
সৌমেন দেবনাথ
রানিকে দেখতে গিয়ে মহারানি দেখবো ভাবতেই পারিনি। উচ্ছলসুখ পেয়ে বসেছিলো আমায়। রানি মুখার্জীর মুখমণ্ডলের মতো মুখশ্রী সম্মুখ থেকে দেখবো এ এক সুতীব্র আনন্দ। স্নিগ্ধ অনিন্দ্যশ্রী রানি তামাটে জীবনে আনন্দের ফল্গুধারা বইয়ে দিলো, যার কাজল আঁকা চোখে চেয়ে পেয়েছি অপূর্ব বিস্ময়।
স্রষ্টার সুনিপুণ তুলির আঁচড়ে আঁকা রানির মতো এক উজ্জ্বল আলোকলতা জীবনের সুখ তালিকায় যুক্ত হবে কল্পনাতেও ছিলো না। অন্তহীন বিষাদ জীবনে এমন স্বপ্নশিখা হঠাৎ দিলো আলোকোজ্জ্বলতা। কষ্টজর্জর, নিঃসঙ্গপ্রবল জীবনে পুষ্পরেণু কণার সঙ্গতায় সুখের বারতা বয়ে যায়। রানির অগ্নিআঁখিতে চেয়ে চেয়ে হয়ে থাকি সুখবিলাসী। এমন হাসির কোকিল জীবনে এত বেশি হাসির ঝিলিক দেবে, নিজস্ব তেজদীপ্ততা দিয়ে অলংকৃত করবে মনোভূমি যা অকল্পনীয় ছিলো। সাঝের ধূসরতা রেঙে গিয়েছে তার মিষ্টি মধুর চোখশাসনে। মনসমুদ্র উদ্বেল হয় তার থেকে প্রাপ্ত কোমল সংঘাতে। জীবনপথ আলোর প্রপাতে স্বর্ণময় হয়ে উঠে। তার খুঁনসুটি আলাপনে হৃদয়ের দেউড়ি কাব্যিক পৃথিবী হয়ে উঠে। সুখস্বপ্নের খেয়ায় ভাসি হাতে হাত রেখে, তার চোখের দীঘিতে চেয়ে চড়ুইমন আবেশী হাওয়ায় পায় আনন্দ হিল্লোল। নিবিড় আদর দিলে বলে, মধ্যাকর্ষণ শক্তিও হার মানে এমন অনাবিল আদরের কাছে।
এমন কথা শুনলে কূলপ্লাবীস্রোত হৃদয়ের পাড়ে ঘাই মারে। আবেগ তরির শুভ্রপালে বহমান সমীরণ দোলা দেয়। ভাবনা বৃত্তবন্দি সীমানা ছেড়ে সুনীল আকাশে উড়ে চলে। সঞ্জিবনী ভাবনার ঝিরিঝিরি জলে ধূলোমাখা স্বপ্নও সুনির্মল হয়ে উঠে। বলে, তোমার দেহঘামগন্ধ নেশাক্রান্ত সৌরভ।
তার হঠাৎ উচ্চারিত এমন উচ্চারণে হুট করে মুগ্ধ হই। চোখ পাপড়ি নেশাগ্রস্ত। শৈল্পিক কথায় অবিন্যস্ত জীবন হয়ে উঠে বিন্যস্ত। আনাড়ি সাজও যেন ময়ূর সাজ। প্রাণের পড়শির ফুটন্ত রূপসিঁড়ি স্বপ্নাক্রান্ত করে ছাড়ে। বলি, তুমি জীবনের সুখপ্রদীপ, সুইয়ে গাঁথা স্বপ্ন। ভাবনার মগডাল থেকে এসেছো মন সৈকতে।
এই কথা শুনে নিষ্পলকে চেয়ে থাকে রানি। বাকপটু নিশ্চুপ। লোভাতুর দৃষ্টি। চার চোখের চোখাচোখি চলে এভাবেই অবিরাম। বিভোরতা আসে, কাটে না ঘোর। অজানা আনন্দ চেনা দৃশ্যে ধরা দেয়। অজানা সুখ চেনা পটে আছড়ে পড়ে। একটু-আধটু সুখ জ্যামিতিক সুখে রূপান্তরিত হয়। একটু রংচ্ছটা বর্ণিলতায় বিচ্ছুরিত হয়। একরঙা আলো সাতরঙা আলোয় উজ্জ্বলিত হয়। বলে, তুমি সুখের সূর্যোদয়, যৌবনের মধ্যাহ্ন, জীবনের শান্তিপর্ব।
একথা শুনে নিস্তরঙ্গ অন্তরাত্মা অসময়ে উচ্ছ্বসিত হয়। সুখস্মৃতি স্মৃতিপটে সুস্পষ্টভাবে প্রতিবিম্বিত হয়। হৃদয়াবেগের মন্দতা আনন্দতায় রূপ নেয়। মনের বদ্ধ কপাট খুলে যায় এ প্রেমোচ্ছ্বাসে। প্রেমসুখ স্বর্গসুখ, প্রেমানন্দ প্রাপ্তি স্বর্গানন্দ প্রাপ্তিসমান। সুখপাখির বর্ণনানন্দে অদৃশ্য বিচ্ছেদবাঁশির সুর নিপাত যায়। পাশে থাকা সুকণ্ঠি সুহাসিনীর দায়িত্বদীপ্ত আচরণে হয়ে উঠি সুখশিল্পী। আত্মার সান্নিধ্যে থাকা প্রিয়াত্মা সুখের প্রারম্ভ দৃশ্য, সুখের সমাপ্তি দৃশ্যও। বলি, তুমি আমার উপলব্ধির চূড়ান্ত ও অনন্য সাথি, ভাবনার পলি, জীবনে নামা ঐশ্বরিক দেবী লক্ষ্মী।
শুনে সে হেসে নিয়ে বলে, লক্ষ্মীর পাশে নারায়ণকেই মানায়; নারায়ণের পাশে লক্ষ্মীকেই মানায়। লক্ষ্মী নারায়ণকে চিনলে, নারায়ণ লক্ষ্মীকে চিনলে লক্ষ্মী নারায়ণ, নারায়ণ লক্ষ্মীর সাক্ষাৎ হয়।
অমূল্য রত্নের অমূল্য বাক্যে আনন্দ না পেয়ে উপায় নেই। হীরকসুখ পেতে হিরা পেতে হয় না, এমন হিরন্ময় রানির দেখা পেলেই চলে। অস্তিত্বের ভূ-ভাগে এমন অনিন্দ্য সাথি থাকলে সর্বচিন্তা শৈল্পিক হয়ে উঠে। হৃদয় কোণে এমন স্বপ্নবাজ সাথি বিরাজ করলে মনের সৌন্দর্য বাড়ে, পাওয়া যায় পূর্ণতার স্বাদ। অপেক্ষার সিঁড়ি হয়ে যায় রঙিন, প্রতিক্ষার সিঁড়ি হয়ে যায় বর্ণিল, ধৈর্যের সিঁড়ি হয়ে যায় প্রজ্জ্বলিত, প্রাপ্তির সিঁড়ি হয়ে উঠে সোনালী রোদে অপূর্ব। বলি, স্তব্ধ জীবনে তুমি প্রশান্তির ঝড়। অসীম অন্তরীক্ষ থেকে এসে জীবনগহনে দিয়েছো মুঠোমুঠো সুখ-শান্তি। ঘাতক দুঃখ নেই আমার। জীবনের কালোপ্রহর কেটে গিয়েছে। শান্ত-স্নিগ্ধ জীবন এখন আমার। রূপালী জ্যোৎস্না লুটোপুটি খেলে আমার আঙিনা জুড়ে। ভাবনার স্তূপ জুড়ে শুধু তুমি আর তুমি।
আমার কথা শুনে বিমুগ্ধ নেত্রে আমার পানে চেয়ে থাকে রানি। অনুরাগঘন মুখমণ্ডল। বসন্ত উল্লাস চোখে-মুখে। সুখদর্শনে সাত সমুদ্র দেখতে যেতে হয় না আমার। সোনারং মাখা সাথি আমার রানি সুখধারা; জীবন মোহনা জুড়ে জ্যোৎস্নার টুকরো ছড়িয়ে দিতে থাকে। অফুরন্ত সুখের অন্য নাম রানি, সুখের অণু-পরমাণু। নব নব আশার অঙ্কুরোদগম হয় তার আশাদীপ্ত কথা কারুকার্যে। জল্পনার শাখা-প্রশাখা বাড়ে প্রিয় সব বাক্যালাপে। বলে, ডাল-ভাতে বাঁচবো, তবু অন্যের বৈভবে হবো না কাতর। আত্মসুখের চেয়ে বড়ো সুখ নেই। স্বীয় ধনে সুখী থাকবো, স্বর্ণগহনার চেয়ে বড়ো গহনা তুমি আমার স্বপ্নগহনা।
রানির পরিপুষ্ট কথা শুনে সুখচিহ্ন দেখি। তার কারণে ঘর আমার আনন্দের সুতিকাগার। যার অন্তর জলসা ঘর এত বেশি উন্নত তার ভেতর নেই অভাববোধ, অহমিকা কণা। এমন বুঝ ভালোবাসার মানুষ থাকলে বক্ষপিঞ্জরে, জীবন হয়ে যায় সুন্দরের বাগিচা। যার অফুরন্ত প্রত্যাশা জুড়ে আমি, আমি থাকি কী করে খারাপ! এমন সুচেতনা বক্ষখাঁচায় বিরাজ করলে বুকে বিরহ পাবে না ঠাঁই। বিষণ্ন উৎসবও বিদায় নেবে এক পাক্ষিকেই। ব্যথার নদীও শুকিয়ে যাবে ভরা ভাদরে। বলি, সুনিপুণ কর্মা তুমি, কাজ তোমার মৌনধ্যান। তোমার দায়িত্বনিষ্ঠ কর্মে রাঙে আমার ভোর সোনারোদে, রাঙে আমার দুপুর আগুন ঝরা বীণায়, রাঙে আমার বিকাল প্রণয়ী ঘ্রাণে, রাঙে আমার রাত ধবল জ্যোৎস্নায়, তারার প্রদীপে।
শুনে হাসে হাসির রানি। কাজলমাখা চোখে তার বর্ণিল তারা। বর্ণিল তারায় স্নিগ্ধ আলো। স্বর্ণলতার মতো জড়িয়ে ধরে। সুতীব্র আলিঙ্গন। চেনা ঘ্রাণ, দুরন্ত নিঃশ্বাস। নেই দ্বিধার সাঁকো। বিম্বৌষ্ঠ ফণাসদৃশ। রানি আগুনফুল, বহ্নিশিখা হয়ে আছে। বিবেক নাশ, বোধ টালমাটাল। মন উচাটন। চঞ্চু উদগ্রীব, তৃষ্ণা প্রকট; তৃষ্ণার্ত। আকাঙ্ক্ষার এক ছোবল মেরে বলে, তুমি আমার ভালোবাসার গোসাই।
প্রেমসুখে মন স্বপ্নবিভোর। সঙ্গতা; এ এক মহাসুখ। কষ্টমাছি উড়ে যায়, আনন্দাশ্রু আক্রান্ত হই, আত্মতৃপ্তি এতই প্রবল যে ঘোলাটে ইচ্ছাগুলো ছুটি পায়। প্রতীক্ষার জানালা দিয়ে এত সুখবারতা ঘরে ঢুকবে অকল্পনীয় ছিলো। অধীর চোখে ছিলো কেবল শূন্যতা, আজ সেই চোখে স্বপ্ন আবির। কান্না উৎসব ম্লান হয়ে গিয়েছে আজ প্রত্যাশার সূর্যোদয়ে। তাই বলি, জলতেষ্টায় জল তুমি, হৃদয়ক্ষরণে হৃদয়েশ্বরী, ধূসর যাত্রায় সঞ্জিবনী সহযাত্রিনী, কান্নার কলহে হাসির দ্রোহ, নির্মম বাস্তবতায় চরম সুখবার্তা, অপেক্ষার বদ্ধতায় মেঘভাঙা রোদ।
ভীষণ আনন্দে রানির চোখে জল আসে। সোহাগীর চোখের জল অসহনীয় আমার জন্য। যে চোখে রোদ ভেলা করবে খেলা, সে চোখের অশ্রুকণা বিদ্ধ করে। যদিও আনন্দাশ্রুপাত। বলি, এ অশ্রুকণা অনুভবের সুখফোঁটা। অশ্রুসজল আঁখির ভাষা আমাকে স্তব্ধ করার জন্য যথেষ্ঠ মারণাস্ত্র। কাঁদবে না নীরবে বা সরবে।
এরপর উষ্ণতার আলিঙ্গনে নিই তাকে। নির্ভরতার হাত মাথায় পেলে শান্ত নদীর মতো শান্ত থাকে সে, শান্ত খরগোশের মতো শান্ত থাকে সে। স্পর্শ পেলে স্পর্শসুখে নিস্তব্ধ রাতের শান্ত-স্নিগ্ধ পরিবেশের মতো শান্ত-স্নিগ্ধ থাকে সে। তার ঘনশ্বাসে মহাপ্রলয় বয়ে যায় মনের মাঝে। রানি আমার যৌবনের গৌরব, অফুরন্ত বিশ্বাসের সৌরভ, অনুভূতির জলকণা, স্বস্তির নিঃশ্বাস।
সোহাগী আদর খায়, সোহাগীর আদর খাই, সোহাগীর আনন্দোচ্ছ্বাসে উল্লসিত হই, সোহাগীর বলা গল্পে বুনি গল্প। নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে সে লিপ্ত হয় নিত্যদিনের কাজে। আটপৌরে জীবনের চিত্রকল্প কুলীন শ্রেণির মতো নয়। ক্ষোভস্রোত নায়াগ্রা জলপ্রপাত না হলেও বোঝা যায় কিছু অপ্রাপ্তি তাকে বিদগ্ধ করে। কল্লোলিত হাসির আড়ালে বিমূর্ত হাসি থাকে, উপলব্ধি দিয়ে বুঝে নিতে হয়। শত আত্মতৃপ্তির আড়ালেও কিছু বিমূর্ত প্রার্থনা থাকে। জীবনস্রোতে যাতে অমানিশা বিচ্ছুরণ না আসে তাই কিছু নিখাদ কথাও রানি বলে না। অনুসন্ধানী চোখে ধরা পড়ে বলে বলি, জীবনে না পাওয়া থাকবেই। যাকে দেখে ভাবছো তার অফুরন্ত পাওয়া, সেও আমাদের দেখে ভাবছে আমাদের অফুরন্ত পাওয়া। অন্তর্জ্বালা সবার ভেতরই, এই অন্তর্জ্বালাই সর্বনাশের বাঁশি। বিষাদের রংতুলিতেই আঁকা জীবন; বিজয় উল্লাস বলে কিছু নেই। প্রতিটি দিন নিরাপদে যাপন আর সুস্থ থাকায় আসল কথা।
আমার কথা শুনে রানি স্তম্ভিত হয়ে যায়। বলে, আমার ভাবনা সরল যোগ-বিয়োগ মতো সহজ-সরল। পরশ্রীকাতর নই আমি। অপ্রত্যাশার আগুনে পুড়ি না আমি। অপ্রাপ্তির সাথে আমার কোনো কানাকানি নেই। পর আনন্দে দুঃখ পুষি না, আনন্দিত হই। পর দুঃখে আনন্দ পাই না, দুঃখিত হই। আমার ভাবনার সারসংক্ষেপ তুমি। আমার সুখের সারসংক্ষেপ তুমি। আমার ভাবনার সারসংক্ষেপে অন্যের বিলাসিতা নয়। আমার কষ্টের সারসংক্ষেপে অন্যের আলংকারিক মোড়ক নয়; আমার কষ্টের সারসংক্ষেপ তোমার এই ছাইপাঁশ ভাবনা।
রানির শৈল্পিক ভাবনার বিন্যাসে আমার কপালে ভাঁজ পড়ে। এমন উন্নত চিন্তাশক্তির মানবীর সান্নিধ্যে স্বর্গীয় সুখ পাওয়া সহজলভ্য। তবুও বলি, এ তোমার দুঃখবিলাস, কষ্টবিলাস, ক্ষোভবিলাস। অপ্রাপ্তির স্মৃতি রোমন্থন করা যায়, অপ্রাপ্তি নিয়ে বাস করা যায় না।
আমার কথা শুনে রানি নীরব হয়ে গেলো। কথা না বলে চলে গেলো। তমসাচ্ছন্ন হয়ে গেলো আমার মন-অরণ্য। একটা প্রচ্ছন্ন কষ্ট বিকট শব্দে সুতীব্র আঘাত করলো। মেঘ সামিয়ানা ঢেকে দিলো আমার আলোকোজ্জ্বল সরল পথকে। তার মন ভাঙার দায় কাঁধে নিয়ে গেলাম তার কাছে। বললাম, অপুষ্ট চিন্তা থেকে আমার অপক্ব কথা বের হয়েছিলো। কষ্ট পেও না, জীবন বারান্দায় এনো না ভুলের ধারাপাত। অবিন্যস্ত চিন্তা থেকে বের হয়ে এসেছি আমি। চোখের সামনে থেকে ভুলের মিনার সরে গিয়েছে। পেও না কষ্ট, থেকো না চেয়ে নির্বাক দিকবলয়ে।
চোখ তুলে চায় সে আমার পানে। চোখে সরল দৃষ্টি। বিবর্ণ মুখ। বিষণ্নতার রঙে বিমলিন মুখশ্রী। মনপুকুর ঢেউহীন। অধরে নেই স্ফুরণ। বলি, অভিমান করে থেকো না। ম্লান মুখ দেখলে ঘূর্ণিবাতাস তছনছ করে হৃদয় পাটাতন। বোবা কষ্ট বুক অরণ্য নীলাক্ত করে। সুখবাড়িতে আর চাই না দুঃখ আবর্জনার জট। বনসাই মন আমার, তাই বলেছি নিন্দনীয় কথা। ভুল সমুদ্র থেকে আমার উত্থান হয়েছে, ক্ষমা করো স্বপ্নকন্যা।
আবার চোখ তুলে চায় সে। ব্যঞ্জনাপূর্ণ চোখ, পাথর মনে প্রস্রবণ বইতে শুরু করেছে। হৃদয়পালিত আমার হৃদয়নন্দিনী। কিছু বলবে বলে মনে হচ্ছে। বিনা সুতোয় বাঁধা এই জীবনে কতই মানভঞ্জন, দুঃখপীড়ন, সুখপীড়ন। রঙরঙা মন কখনো বা রঙহীন রঙচটা হয়ে যায়। হৃদয় সীমানায় হতাশার রূপ এসে কীর্তন করে। সুতীব্র দুঃখ প্রান্তসীমায় উৎসবে মাতে। হৃদয়ের অদৃশ্য বাঁধন মজবুত হলে ভুল ক্রীড়ানক হতে পারে না। বোঝাপড়ার জীবনে ভুলের বিন্দুকণা প্রকাণ্ড রূপ পায় না। শখের পিছু লেগে থাকা মানুষ জানে জীবনের গূঢ় রহস্য। ইচ্ছার বিসর্জন দেয় না তাই শত ঘূর্ণাবর্তেও। ক্ষমার আবিরে অশ্রুনদীও হয়ে উঠে বর্ণে বর্ণিল। মন ভ্রমরা চোখ বরাবর চেয়ে বলে, দুটি মায়াপ্রবল হৃদয় নিকষ আঁধারেও প্রণয়ের চাষাবাদ করতে জানে। দুটি মায়াচ্ছিন্ন হৃদয় ভরা পূর্ণিমাতেও বিরহ চাবুকে ক্ষত হতে থাকে। সুখঘামে লেপ্টে থাকা আনন্দের প্লাবনস্রোত। আর মনে নীরব আহাজারি নিয়ে বৈভব প্রদর্শন জীবনের অপরাহ্ণ।
রানির কথা শুনে নিজেকে ভাগ্যবান মনে হয়। নিজেকে বোঝে, আমাকে বোঝে যে মানুষটি এত সুন্দর করে তার হৃদয় অনেক বিকশিত। এত পরিপুষ্ট জীবনমুখী কথা শুনলে কষ্টকণা মনে বাজে না। তার সুনীল ভাবনা মনরাজ্য থেকে তমসার মেঘ বিতাড়িত করে দেয়। বিরহ পারদ কর্পূরের মতো উবে যায়। যন্ত্রণার নদী শুকিয়ে যায়, জেগে উঠে প্রেম জলোচ্ছ্বাস। সর্বহারা মনও পেয়ে যায় সর্বস্ব। দ্বিধার দরজা ভেঙে প্রবেশ করি নতুন দিগন্তে। নতুন দিগন্তে নতুন এক প্রেম-ভালোবাসার নিকেতন। সেখানে নেই ষড়যন্ত্রের কানাকানি; আছে সবুজের সমারোহ, জোনাকির ঝাঁক, আলোর লুকোচুরি। তার হাতটি ধরি শক্ত হাতে। সে লুকায় পাজরের ভাঁজে। উদোম বুকের মায়ায় লেপ্টে থাকে। ছিনতাইকৃত শব্দ এনে সাজাই তাকে। ফুটন্ত আদরে ভরিয়ে দিই। কপালে এঁকে দিই জোনাকির টিপ। আর বলি, আমি বিকলাঙ্গ চিন্তা থেকে বের হতে পেরেছি কিনা জানি না। কিন্তু আমি বর্ণিল সুখ পেয়েছি তোমার সুখোচ্ছ্বাস থেকে। তোমার সঙ্গতায় হৃদয়ের উচ্ছ্বাস বেড়েছে চতুর্গুণ। স্বপ্নের কারুকাজে জীবন সাজাবো, প্রণয়ের পলিমাটি মেখে মেখে বাঁচবো৷ করবো প্রণয়ের চাষ হৃদয়চাষী হয়ে।
নীরবস্রোতা হয়ে শোনে সে আমার কথা। তৃষ্ণাদগ্ধ চোখ। চোখে স্বপ্নের নির্যাস। বাঁচতে তার লাগে না অঢেল। তৃষ্ণা নেই তার অন্য কিছুতে। এক বুক তৃষ্ণা শুধু আমাকে নিয়ে।
এভাবে দিন যায়, দিন আসে। কবিতার তাজমহলে বাহ্যিক পরামর্শ প্রভাব ফেলে। ক্ষণে ক্ষণে বাঁধে স্নায়ুযুদ্ধ। ক্ষণে ক্ষণে বদলায় জীবন-আকাশের রং। ঘরে কেন আসবাবপত্রের লেলিহান তাণ্ডব নেই, ঘরে কেন তৈজসপত্রের সুনামি দাপট নেই, ঘরে কেন ফ্রিজের ভূতুড়ে শব্দ নেই, ঘরে কেন টেলিভিশনের দীপ্তি নেই, ঘরে নেই কেন নিত্য ব্যবহার্য সামগ্রীর উল্কা ছুট, নেই কেন শান্তিনিদ্রার পালঙ্ক!
কানের কাছে নিত্য এসব শব্দ উচ্চারণে হতাশার রঙে রাঙতে থাকে রানির নিত্যদিনের যাপন। এই অত্যুক্তি উচ্চারণ ফোঁড় তোলে মনের ঘরে। কষ্ট বুনন বাড়তে থাকে। অতি প্রত্যাশার নীলবিষ গৃহকোণে অশান্তির বাতাবরণ বাড়ায়। বিবর্ণ হতে থাকে সুখ, বিপন্ন হতে থাকে আপন অস্তিত্ব। আরণ্যক হৃদয়ে বাড়ে দ্বিধার ধারাপাত। এই সব ঘরে নেই কেন শব্দগুলো সুতীব্র দংশন করতে থাকে তাকে। মেঘের মিনার ঘরের কিনারে এসে বসত গড়ে। পুনর্বার শুনতে থাকা শব্দে ধৈর্যের নোঙর ছিঁড়ে যায় রানির। গভীরতার গভীরে প্রবেশ করতে থাকে এসব শব্দ। বাস্তব স্বপ্নকে এখন অলীক স্বপ্ন মনে হয়। আলিঙ্গনের উষ্ণপ্রহর, উত্তাপপ্রহর ফিকে হতে থাকে। স্বপ্ন গিরিখাতে পড়তে থাকে। সবুজ মন বনে মেঘের লুকোচুরি বাড়তে থাকে। উন্মাদ চাওয়া অশান্তির হাওয়া নিয়ে ঘরে প্রবেশ করে। আমার উপর থেকে তার আস্থার সামিয়ানা উড়ে যায়। সমস্যা সংকুল জীবনে সমস্যা থাকবে, বিক্ষুব্ধ জীবনে বিক্ষুব্ধতা থাকবে সেটাই স্বাভাবিক, কিন্তু তার কারণে একান্ত উষ্ণতার নীড়ে কেন এভাবে অশান্তি উৎসব আসবে? একদিনের রঙিন স্বপ্নকে ছেঁড়া স্বপ্ন মনে হয় তার। মন দেয়াল বিধ্বস্ত হতে থাকে। সহ্য হয় না সঙ্গীর সান্নিধ্য। প্রত্যাশার পারদ বাড়ে। কমে স্বপ্নসন্ধির তরের দরদ। চোখে অগ্নিদৃষ্টি, তাচ্ছিল্যের হাসি হাসে ক্ষণে ক্ষণে। পুরুষত্ব নিয়ে করে কটাক্ষ। কখনো বা করে ফেলে বর্বর বচসা। বচাবচ সংসারে শান্তি আনে না কখনো। মন থেকে স্বপ্নের নীলপাখি উড়ে গিয়েছে, ভর করেছে অতীব স্বপ্নের ঝাড়বাতি। বৈরী বাতাসে চিন্তাশক্তি কাজ করে না। স্তব্ধ চৌকাঠে বসে ভাবী, পাই না তল, অথই পাথারে নিমজ্জিত হতে থাকি। অল্পে সুখী একটি সুখোদ্যানে অন্তহীন যাচ্ঞা এসে এলোমেলো করে দিলো সব। মগজের মেঝেতে কেউ বিষ দিলে সুচিন্তার অনিন্দ্য ঘোড়াও খোঁড়া হয়ে যায়। একটি পরিতৃপ্ত হৃদয়ে আকণ্ঠ তৃষ্ণা এলো, আর পল্লবিত ভাবনা বদলে গেলো, সাথে সাথে জীবনচিত্র বদলে গেলো। কাব্যকলার সুন্দর একটি রঙিন ভুবনে এলো দানবীয় অশান্তি। সময়পৃষ্ঠা উল্টে যায়, প্রেম-লাবণ্য ধূসরিত হতেই থাকে। অমৃত প্রশান্তি বিদায় জানায়। শত সুন্দর শব্দ উচ্চারণ করেও আর তার বন্ধ বদ্ধ নীড়ে কড়া মেরে প্রকম্পিত করতে পারি না। কী এক ঘূর্ণাচক্র এলো জীবনে! পারদ কঠিন হয়ে গেলো একটি কোমল সম্পর্ক বাগিচা। অটল বিশ্বাসে সূক্ষ্ম ছিদ্র কোন কালো জাদুর জিয়নকাঠিতে প্রবেশ করলো! দলছুট বলাকার মতো আজ আমি গৃহছুট। একদিন বললাম, প্রত্যাশার পা যত না বুঝে ফেলবে ততই পাঁকের মধ্যেই তলিয়ে যাবে। আর্থিক সচ্ছলতা এক অদেখা সীমান্ত আমার কাছে। তবুও আমরা রচেছিলাম সুখের প্রহর।
আমাকে থামিয়ে দিয়ে রানি বলে, জীবন নোনাস্রোতে দীর্ঘদিন চলে না। তোমার ঘরের দুঃখনহর আমায় ছাড়বে না। কখনো খুলবে না তোমার প্রাপ্তির দরজা। কষ্টের মৃদু আঁচড় আমায় আঁচড়ই দিয়ে যাবে, দেবে না আলোর মুখ, শঙ্কাহীন বর্ণিল বাতায়ন। খরায় খাক জীবনে জড়িয়ে আমার শৈল্পিক চিন্তা করা বোকামি ছিলো।
কথাগুলো বদ বাতাস হয়ে দগ্ধ করলো। দুঃসময়ের কাহন এলো জীবনযাত্রায়। জীবনের রঙিন আকাশ হতে থাকলো ধূসর। ঝঞ্জাট আবর্জনা দুর্গন্ধ ছড়ায় সংসারে। অবচেতন ছিলাম আমি; ঘূণাক্ষরেও বুঝিনি আমার সুখজলসায় এভাবে ক্ষোভের বিস্ফোরণ হবে। বিলাসী ভাবনা ক্ষয় হতে থাকে, সুখের প্রাচীর নষ্ট হতে থাকে। জীবন আজ এক অবিশ্বাসের কাগজ। অতি লোভের রঙিন চোখে আবেগের ছেঁড়া কাঁথার গন্ধ সুখ দেয় না। দেহকষ্ট দেখে যে রানি কান্না করতো আজ আমার মনঃকষ্টেও সে হয় না শান্ত। মানুষ কেন অনন্য ঘ্রাণ না নিয়ে লোভনীয় ঘ্রাণে আকৃষ্ট হয়? তুমুল ঝড় বয়ে যাচ্ছে মন অরণ্যে। স্বপ্নের চোখ আগুন উনুনে লালিমা হয়ে উঠছে। লোভের আগুন ঝড় আমার সংসার স্বর্গটাকে সর্বনাশের ভেলায় ভাসিয়ে দিলো। সবুজে বিমুগ্ধ মানুষটি কেন সম্পত্তি লোভে আকৃষ্ট হয়ে নিকৃষ্ট হতে লাগলো? অটুট শৈলী মালার মতো অটুট বন্ধনে কেন ফাঁটল ধরাতে কাঁপছে না মন? ভাবনার ঘাঁটিতে কখনো এমন অন্ধকার রূপ আসবে কল্পনা করিনি। প্রত্যয়ী চিন্তা কেন দানবীয় চিন্তায় নিপতিত হলো? লোভনীয় চিন্তায় আমার বসন্ত বেলা হারাতে বসেছে। বুনো চিন্তার নির্মম-নির্দয় ছোবল অবিনাশী ঝড় হয়ে দেখাচ্ছে সংসারে বৈশাখী দাপট। স্বপ্নের চাষাবাদক্ষেত্রে এভাবে অসহনীয় আগুন দাউদাউ করবে ভাবতেও পারিনি। সেই আগের অনিন্দ্য সময় আমার নিদারুণ আর্তনাদে কাটে। যুগল বাসের, যুগল পরিভ্রমণের জীবনে এসে গিয়েছে অশনি-দুর্বৃাত্তয়নক্রীড়া। বিশ্বাসের নথিপত্রের নেই দাম, পরসুখত্রাস আজ ঘরের চৌকাঠে। মোলায়েম সুখ হত ও হৃত। মানুষের মন ও মগজ অদ্ভুত, অন্যের অপক্ব চিন্তার পরিপক্ব আঙুলের ধূর্ত হেলনে হেলে পড়ে। কল্পনায় আঁকা সজীব স্বপ্ন কালো ঝুলন্ত মেঘ হয়ে কান্না করে। মনের মন্দির আর পায় না সোনালী রশ্মি। লোভ চক্রাস্রোতে পাক খায় সুখ ভাণ্ডার। স্বপ্নের চিলেকোঠায় এসে ভর করলো অন্ধকারের কর্তৃত্ব। এখন সংসার আগুন ফুলে রাঙা ফুটন্ত লাভা। ক্ষুব্ধ হয়ে বলি, কেন আজ তোমার ভাবনার জগতে অন্তহীন বিষাদ? কেন আজ নও নিজস্বতায় বিমুগ্ধ? কেন চিন্তা জুড়ে এত ধূধূ বালিয়াড়ি ভাবনা? কেন আমার যাপিত জীবন এখন বেদনার বুনন? কেন মনে নেই সেই আগের অদম্য ভালোবাসা? কেন মনে এত অদম্য তৃষ্ণা? উদ্যত তৃষ্ণা?
আমার প্রশ্ন শুনে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলো সে। বীতশ্রদ্ধ হয়ে অপ্রিয় বাক্যবাণে জর্জর করলো আমায়। সরলতার পটে অতৃপ্তির মশাল। সুখমরণে মরে না আর সে, মরে অন্যের সুখে; আমার কথায় তৃপ্ত হয় না আর সে, মাতে অন্যের কুমন্ত্রণায়। চলে না আমার সাথে, চলে উল্টোরথে। সময়ের স্রোতে ভেসে গিয়েছে সে, বদলে গিয়েছে তার বোধের দেয়ালের রং। তাকায় সে চোখে, চোখে যেন বর্শার ফলা; তাকায় সে চোখে, দেখি তার চোখে আমার জন্য বিমূর্ত ধিক্কার। হাসে সে এখনো, হাসির তির্যক রশ্মি কদম শরীর-মনে দগ্ধতা দেয়। চোখের অগ্নিদৃষ্টিতে অগ্নিদগ্ধ হই, ঘর-সংসার অগ্নিগর্ভ। সাজানো জীবন অবাধ্য আর অবিবেচক ইচ্ছায় আজ মরীচিকা প্রলেপে বিনষ্ট। যত আনন্দ সময় তিমিরে বিস্মৃত। সংসার আজ আমার মিথ্যা স্বপ্নের আখড়া। বাস্তবতার নির্মম আঘাতে জর্জর আমি। দ্বন্দ্বের পাহাড় উঁচু হয়, রাগ-সংঘাত বাড়ে; চেনা মানুষের অচেনা আত্মা দুর্গন্ধময় তাচ্ছিল্য করে। সময়ের চলন্ত সিঁড়ি বয়ে যায়, স্মৃতি-বিস্মৃতির প্রান্তরে পড়ে থাকি আমি। নিঃশব্দ করিডোরে নিঃশব্দ আমিও। কণ্টক যন্ত্রণা উপভোগ করি, আর ভাবী কত না বিমূর্ত ভাবনা। আমার নীরব আর্তি কেউ দেখে না, কেউ বোঝে না; জীবন নদীতে আমার আর উঠে না ঢেউ-তরঙ্গ। তামাদি জীবন নিয়ে পড়ে আছি মরা নদীর মতো সবার অলক্ষ্যে।
সৌমেন দেবনাথ, কবি ও গল্পকার, একটি এমপিওভুক্ত কলেজের প্রভাষক।