শব্দকুঞ্জ ঈদসংখ্যা
কবিতার প্রহর-২
শব্দকুঞ্জ ঈদসংখ্যা-২০২৪
কবিতার প্রহর-২
ফেলে আসা সূর্যোদয়ের স্মৃতি
গৌতম ঘোষ–দস্তিদার
সূর্য ঢলে গেছে সে তো
পোনেশো বছর গেল পেরিয়ে
পশ্চিম আকাশের পথে
যদিও তার পা–দুখানি বাড়িয়ে
পাটে যাবার আগে তবু
নক্ষত্র থাকে ইতস্তত দাঁড়িয়ে
ফেলে আসা সূর্যোদয়ের স্মৃতি
তবু আজও যায়না হারিয়ে
পুবের সে দেশে সোনা ছিল ধানে
আর পাট ছিলো নদী জুড়ে
মাঝির কণ্ঠ ভ’রে ছিল গানে
কত জন্মের চেনা ভাটিয়ালি সুরে
আজও তাকে চাই শয়নে স্বপনে
যতই সে থাক দৃষ্টির থেকে দূরে
তার কথা আজও ঢেউ তোলে প্রাণে –
কাছে রবে, যাবে না কোনো দূরে
তার–ই ভাষায় তার–ই ছন্দে তার–ই ঘ্রাণে
পাই সে পুবের বাড়ি, জীবনের যতো মানে …।
(বাবু বাগান লেন, কোলকাতা, ভারত)
ভ্রমণ
অংশুদেব
আমার পা বসে আছে ঘরে
জুতো ঘুরছে বিশ্বময়
হাতের মধ্যে হাতের মিছিল
ভাঙেনি রাজপথ
নৌকা ভরে আসে বিপ্লব
ঘরে ঘরে অন্ধকার
তোমার স্বাধীনতা
আমার গলায় দাগ
পায়ে পায়ে পশু ও মানুষ একাকার
১৯ জানুয়ারি ২০২৪
( দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা, ভারত)
তোমার জন্য…..
অমিত কুমার সাহা
তোমার জন্য হলদে রঙের নতুন চিঠি,
লালচে খামে বন্দী করা অনেক কথা;
তোমার জন্য বিকেল শেষের হুটোপুটি,
দু-এক কলম সময় করে লিখতে বসা।
তোমার জন্য বইয়ের তাকে সরছে ধুলো,
কয়েক বছর জমতে থাকা ইচ্ছে করে;
তোমার জন্য একলা ঘরে রবির আলো,
গুনগুনিয়ে উঠছে হঠাৎ মনের কোণে।
তোমার জন্য মাঝবয়সী প্রেমের স্রোত,
নীলচে নদী মিশছে যেন ঘোলা জলে;
তোমার জন্য নোনতা সময় নিচ্ছে শপথ,
অচেনা বন্দর নোঙর চেনায় প্রতি পলে।
(পশ্চিমবঙ্গ,ভারত)
সব কিছু রেখে চলে যাব
তুষার ভট্টাচাৰ্য
সব কিছু রেখে চলে যাব – এই চরাচর জুড়ে
হেমন্তের পাকা ফসলের মাঠ, গাজন তলা,
চন্ডীমণ্ডপ,
রুপোলি চাঁদের থালায় বেড়ে খাওয়া
গরম ভাতের স্বপ্ন ;
ভুলে যাব সব দুঃখ ব্যর্থতা অভিমান
সঙ্গে নেব না কিছুই
শুধু নিজের শিকড়ে রেখে যাব
নদীর পলিমাটির ঘ্রাণ ;
চলে যাবার আগে দু’হাতের মুঠোয় তুলে নেব
অন্তহীন স্মৃতির অক্ষর
দু’চোখে লেগে থাকা বিষাদ চিহ্ন মুছে
আর একবার শুধু দেখে যাব –
ধবল জোছনার আয়নায় ভেসে ওঠা
রাত পরীর রূপকথা মায়াবী মুখ ;
সঙ্গে নেব না কিছুই
সব কিছু রেখে চলে যাব
রাত্রিচর পাখির মতন উড়ে
ওই আকাশ গঙ্গায়
(মুর্শিদাবাদ ,পশ্চিমবঙ্গ , ভারত)
আদিম নীরবতা
অসীম কুমার সমাদ্দার
তোমার স্পর্শে চাঁদের দেখা মেলে
নিমেষে ছুটে চলি অনন্তের দিকে ,
নিঃশব্দে , চুপিসারে এক অদ্ভুত বিহ্বলতায় ,
দিনরাত এক করে কবি খোঁজে কাঙ্খিত মদিরা ,
তোমার চাউনির রহস্যময়তার পরীক্ষা চলে
স্থলে, জলে ,অন্তরীক্ষে এক মোনালিসাকে সঙ্গী করে ।
তুমি কিন্তু হাসো , ফিরে যাও সুদূর অতীতে
একরোখা মন বলে যদি কিছু থাকে
অনুরণিত হয় তোমার অপাপবিদ্ধ পেলবতায় ।
জন্মের সন্ধিক্ষণে তুমিই দিয়েছিলে অমৃত ,
পান করে হাভাতেরা ফিরে যায় প্রেমিকার স্বপ্নে ,
সব আদমেরা উপহার পায় হৃত ভালোবাসা ,
তুমি এখানে হেরে গিয়ে জেতাও বারবার
অজস্র তৃষিতকে মহাপ্রলয়ের সন্ধিক্ষণে
প্রকৃতি ঠিক তখনই খুঁজে পায় আদিম নীরবতা ।
(গাড়িয়া , কলকাতা)
নদী খুঁজি
প্রাণজি বসাক
এই শহরযাপনে প্রতিদিন একটা নদী খুঁজি বহতা নদী
মরা নদী যাই হোক শহরে আনাচকানাচে একটা নদী
থাকা চাই -একটা নেশায় বহুদূর চলে যাই থেমে পড়ি
অক্ষর খুঁজি শব্দ খুঁজি জল খুঁজি পাই না ঘুরে দাঁড়াই
তখন পেছন তাকিয়ে দেখি রুগ্ন শহরটি কোথাও নেই
তাবৎ ঘরবাড়ি অট্টালিকা সব কোথায় দূরে সরে গেছে
এমন উদ্ভট বিপদ দেখে একটা প্রিয় নদী স্মরণ করি
তৎক্ষনাৎ সে-নদী কোত্থেকে এসে নির্দ্বিধায় পাশে বসে
মানুষেরাও পাড় ঘেঁষে দাঁড়ায় যেন ফুরফুরে আমেজে
প্রতিদিন একটা নদী খুঁজি – খুঁজি আর প্রতিদিন মরি
(নয়াদিল্লী, ভারত)
জানালার পাশে
জাহিদুল ইসলাম মাটি
কতবার যে তাড়িয়ে দিয়েছি
তারপরও পাখিটি ফিরে আসে তার নীড়ে
আমার জানালার পাশে এসে ডানা ঝাপটায়
গান গায় আপন মনে
অসাধারণ ছিল সেই সুর সঙ্গিত
অথচ তীব্র বিরক্তিকর ছিল আমার কাছে
অতঃপর যে পাখিটির সুর স্তব্ধ করে দিতে চেয়েছিলাম
যে পাখিটিকে তাড়িয়ে দিতাম সকাল বিকাল
সেই পাখিটি আর আসে না নীড়ে
শোনায় না তার প্রিয় গান
অতঃপর আমি নিজেই নিরব সন্ধ্যা হয়ে যায়।
ঘরের জানালায়, বাড়ির ছাদে, বাগানের গাছে গাছে
মাটির হাঁড়ির বাসা বানিয়ে দিয়েছি
তবুও সে – আর ফিরে আসিনি।
পাখিটি হারিয়ে এখন বুজতে পারি
কত দুঃখময় ছিল তার সুর-সঙ্গিতে।
(যশোর, বাংলাদেশ)
বাংলা
নবমিতা চ্যাটার্জী
নিজেকে যদি প্রশ্ন করি, কোনটা প্রিয়
সেন্ট মার্টিনের আদিম নীল জল
না চন্দননগরের ইতিহাস-গলিপথ
“সুনীল” না “হুমায়ুন”
“মিসির আলি” না “নীল রোহিত”
এককথায়, উত্তর দিতে অপারগ|
তবে জানি প্রায় রাতে “হিমু” আর “শ্রীকান্ত”
এক সাথে আমার স্বপ্নে আসে,
কথা হয় কিছুক্ষন …
আমাদের পূর্বসূরিদের কোনটা বেশি পীড়া দিয়েছে
১৯৪৭ না “একাত্তরের দিনগুলি”
এটাও ঠিক অনুমান করতে পারি না …
কিন্তু এটা জানি,
এপারের ফজরের নামাজের প্রতিটি নেক ভাবনায়
ওপারের সন্ধ্যারতির প্রতিটি মন্ত্রের উচ্চারণে,
বাংলা মিশে আছে
যে বাংলা, আমার নিঃশ্বাস জুড়ে!
(পশ্চিমবঙ্গ , ভারত)
ধরা দেয় না সে
পিয়ালী চক্রবর্তী
সাদা কালো অথবা রঙিন ক্যানভাসে ডুবে
খুঁজে ফেরে ক্লান্তিতে
তবুও দেয় না ধরা সে
কখনও দিনে কখনও রাতে ঘুরে ফিরে আসে বারবার ।
নিঝুম রাতে স্পষ্ট তার আগমন
নরম ঠোটের ছোঁয়া গাল স্পর্শ করে , গরম নিশ্বাসে শিহরণ জাগায় !
জড়িয়ে থাকি ছেড়ে যাওয়ার ভয়ে –
তবুও ক্যানভাসে ধরা দেয় না সে !
দিনের আলোয় মিলিয়ে যায় তার মুক্ত মনের হাসি
হন্যে হয়ে খুঁজতে থাকি দিকবিদিক
হাহাকার করে ওঠে মন
ঝাপসা হয়ে আসে চোখ
তবুও ক্যানভাসে ধরা দেয় না সে !
(উত্তর ২৪ পরগণা, ভারত)
ঈদের চাঁদ উঠবে না
মুহা আকমাল হোসেন
সব আকাশে কি ঈদের চাঁদ উঠে!
যেখানে আকাশ সম্পূর্ণ ভাবে উপনিবেশিক নীল
দাঙ্গার কালো রক্তের বসন্ত দাগ
যেখানে গোমাংসের মতো নিষিদ্ধ ঈদগাহ।
যেখানে সাধ করেই শিশুটি বাবার পিছন পিছন যেতে পারে না
যে পাড়া দিয়ে গতকাল চলে গেছে বুলডোজার
ক্ষমতার চাকার ছাপ পড়ে আছে লাজুক মাটির গায়ে
যে মেয়েটি শখের মেহেদী আঁকতে পারেনি চাঁদ রাতে
সব আকাশে কি ঈদের চাঁদ উঠে!
(পশ্চিমবঙ্গ, ভারত)
নির্জনতা
মহেশ্বর গোস্বামী
একলা মানুষ অতি দীর্ঘকাল ধরে
একলা একলা বসে থাকবে
তারপর বিশেষ একজন মানুষ তার কাছে এসে বসবে
তার কাঁধে হাত রাখবে
একলা মানুষ তার সাথে হাসবে – কাঁদবে
সব দুঃখ ভুলে যাবে
তারপর তাকে জড়িয়ে ধরে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়বে
অবাস্তব স্বপ্ন দেখতে দেখতে
পরদিন সকালে চোখ খুলতেই সে দেখবে
সেই বিশেষ একজন মানুষ তাকে কিছু না বলেই
কোথায় যেন চলে গেছে
কিন্তু সে অবাক হবে না
এতদিনে সে জেনে গেছে
কেউ অনেকটা কাছে আসার পর
কিছু না বলে হঠাৎ করেই চলে গেলে অবাক হতে নেই
কারণ মানুষ কাছে আসে
একলা মানুষকে আরও বেশি করে
একলা করে দিয়ে
নাগালের বাইরে চলে যাওয়ার জন্যই…
(পুরুলিয়া, ভারত)
নৈসর্গিক
সুরাইয়া চৌধুরী
কিছু কিছু অনুভব গভীর অতল
ফেরারি বাতাস যেন ফিরেফিরে আসে
কাউকে জানান দেয়, দেয় না আবার
নিমগ্ন কথার ঘোর অতলান্ত খুঁজে।
গভীর জলের তলে উজান গমন
লুকিয়ে ডুবজলে উছলে উঠে
আলগা বাতাস যখন ছড়িয়ে পড়ে
শুকনো পাতার মত এলো মেলো ওড়ে।
হারানো কোন এক গানের আবেশ
রিন রিন সুর তোলে পংক্তি কথায়।
নৈসর্গিক মুগ্ধতায় নিমগ্ন চরাচর
প্রান্তরে ঢেউ তোলে বিষণ্ণ বিধুর।
নিঝুম সুরের গান শূন্যতায় ঘোরে
ঘোর লাগা সুরে খোঁজে নিসর্গের ভোর।
(গুলশান, ঢাকা, বাংলাদেশ)
পয়লা বৈশাখ
সুদীপা চৌধুরী
প্রতিবছর আসে পয়লা বৈশাখ
কবি সমাজ রচে কত আশার কবিতা
পরে সারাবছর পুড়ে হচ্ছে খাক
দ্বিপদ সভ্য জীবের পুঞ্জিত মানবতা।
মেতে আছি এক হীন বহ্নুৎসবে
কাটছে দিন মোদের হেলায় অবলীলায়
কম্পিত হয় ভুমি মোদের গরবে ,
যখন একশ্রেণী পড়ে রয় হয়ে বড় অসহায় নিরাশায় নিরাশ্রয় জঠর
জ্বালায়।
কিছু শ্রেণী ভোগ করে অপ্রমেয়
সাউথ সিটিতে বা কোয়েষ্ট মলে
জোটায় চোব্য চোষ্য লেহ্য পেয়।
পাশে নিরন্ন শিশুর দুচোখ ভরা জলে কেও বা বাবুর জুতো জোড়া চকচকে করে
হারিয়ে মূল্যবোধ বিকিয়ে মানবিকতা
সুস্থ সভ্য সমাজ মেতেছে নববর্ষ উদযাপনে!
কেন আমরা নিতে পারি না এ শপথ
আজি এই বৈশাখের নব প্রভাতে
উন্মুক্ত করব যত আছে বন্ধ পথ
হা-ভাতারে রাখব দুটো ডাল-ভাতে।।
(পশ্চিমবঙ্গ, ভারত)
চাঁদ
শম্পা ঘোষ
চাঁদের হাসি বাঁধ ভেঙেছে ,
অস্থির দোটানায় হৃদয়ের মারপ্যাচ.
সব খেয়ালি মনে স্বপ্ন আর বাস্তবকে দূর করা যায় না
সীমাহীন আলোর বিন্দু ভেঙে যায় জোয়ারের টানে
আশ্চর্য মিরাকালে উঁকি দেয় জল শামুকের চলাফেরা,
কখনো জ্যোৎস্না আলোয় স্নান করতে করতে ভুতুড়ে ডিলেরিয়াম কাজ করতে থাকে,
তবুও দক্ষিণ আকাশে ফিরে আসে অন্তর্জাত বিচ্ছুরণ,
খুশির অথবা দুঃখের হাজার প্রশ্ন শেষে শব্দের অনুভূতির বিন্যাস,
প্রশান্তির বর্ণময় অধ্যায়ে চাঁদ থেকে যায়
দৈব মুহূর্তের ফসিল চিহ্ন হয়ে।
(হুগলী , পশ্চিমবঙ্গ, ভারত)