You are currently viewing শব্দকুঞ্জ ঈদসংখ্যা। গল্প: আয়নায় আনিকার শিকারি মুখ- রোখসানা ইয়াসমিন মণি

শব্দকুঞ্জ ঈদসংখ্যা। গল্প: আয়নায় আনিকার শিকারি মুখ- রোখসানা ইয়াসমিন মণি

শব্দকুঞ্জ ঈদসংখ্যা-২০২৪

গল্প:
আয়নায় আনিকার শিকারি মুখ
রোখসানা ইয়াসমিন মণি

শব্দকুঞ্জ ঈদসংখ্যা-২০২৪

গল্প:

আয়নায় আনিকার শিকারি মুখ

রোখসানা ইয়াসমিন মণি 

 

আনিকা দৌড়াচ্ছে।।ট্রেন মিস হয়ে গেলে সমস্যা হবে তার। আজকের ভেতর তাকে গোয়ালগাঁ পৌঁছাতে হবে।মহাসড়ক থেকে একটি রাস্তা পূবে নেমে গেছে।এটা শহর থেকে কিছুটা কোণাকুণি বাঁক নিয়েছে।কোন রকম রিক্সাটা এদিকে নামাতে পারলেই সে দশমিনিটে বাদশামিয়া মার্কেটে ঢুকে যেতে পারবে।ওখান থেকে দুমিনিটের হাঁটা পথ। তারপর সোজা স্টেশন।পরিস্থিতি পক্ষে থাকলে টিকিট কাটবে।না হলে ট্রেনে টিটির সাথে ঝামেলা মিটিয়ে নেবে।এই রাস্তায় লোকজন কম চলাচল করে।মহাসড়ক হওয়ার আগে এই রাস্তাটির বেশ কদর ছিলো।তখন হাঁটুরে মানুষ, ঘর ফেরতা মানুষ এই পথে হেঁটে বড়রাস্তায় উঠত।এখন ফোরলেনের রাস্তা।হাইওয়ে সড়ক টপকে কেউ এদিকে বাঁক নিতে চায় না।গাড়ীর সাথে ধাক্বা খাওয়ার চান্স আছে।আনিকা তাই করলো।একটু রিস্ক নিলো। চারমোড়ের মাথায় দাঁড়াতেই একটি রিক্সা পেলো। পেয়েই ড্রাইভারকে বললো,এই রিক্সা যাবে? 

–হ, যামু আফা।কই যাইতে ছান?

–বাদশা মিয়ার মার্কেট  রেল ইস্টিশন। ছনমূড়া দিয়া নামতে হবে।পারবা? ভাইবা কও।নাইলে আমি আরেকখান দেখি।

— ফারুম আফা।তয় রিস্ক আছে এট্টু।ভাড়াডা বাড়াইয়া দিয়েন।

–চিন্তা কইরো না।দেমুনে।

 

রিক্সা ডান- বাম করে উল্টোক্রসিং কেটে এগুতে লাগলো। সাঁই সাঁই শব্দ তুলে বড় বড় গাড়ির চাকা মহাসড়কের বুক পিষে ছুটছে সামনের দিকে।গতিময় গাড়িগুলোর বাতাসের ধাক্বায় রিক্সা যেনো উল্টে যাবে এমন অবস্থা।আনিকা বললো,কাকু,চাইয়া চিন্তিয়া চালাও। পরে আবার না জানি পটল তুলতে হয়!

ড্রাইভার বললো,রিস্ক আছে খালা।পটল তুললেও তোলন যায়।কওন যায় না।তয় এই আকোব্বর মুন্সির ঠ্যাংয়ের তাকত আছে।দেহেন,কেমুন কইরা প্যাডেলরে

পঙ্খীরাজ করতাছি।হগ্গলে রিক্সা চালাইতে ফারে না।রিক্সা চালানোতেও বহুত কারিশমা জানা লাগে।

আনিকা দেখলো সত্যি,এই মাঝবয়সী লোকটি গুনগুন গান গেয়ে প্যাডেলে দিলো জোরসে টান।আর অমনি রিক্সাও হাইওয়ে মহাসড়কের ধারঘেঁষে বড়বড় গাড়ির উচাটন বাতাস উপেক্ষা করে আপনি গতিতে সামনে এগিয়ে চলছে।

 

 রিক্সাটি বাঁকের মুখে এসে থামলো। ড্রাইভার আনিকাকে বললো,খালা নামেন ।রিক্সাডারে নিচে নামাইতে হইবে।আপ্নে পেছন থেকে এট্টু টাইনে ধরেন। নাইলে বেগ সামলাইতে না পারলে গাড়ি খালের মইদ্যে ডুবি যাবে। ড্রাইভার রিক্সা নিয়ে নিচে নেমে যাচ্ছে।আনিকা গাড়ির পিছনের দিক টেনে তার সাথে সাথে গড়িয়ে নামছে।কী অদ্ভুত কান্ড। যেনো বেড়াতে আসা কেউ একজন চলে যাচ্ছে।যাকে আনিকা যেতে দিতে চাইছে না।কিন্তু আনিকা তাকে থামানোর জন্য পেছন ধরে টেনে ধরছে।কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছে না।সে চলে যাবেই। টানাটানিতে একসময় গাড়ি বাঁকের মাঝে থামলো।ড্রাইভার বললো,খালা মেলা পরিশ্রম করছেন।এবার উঠেন।

 

আনিকা গাড়িতে চড়ে বললো,কাকু, এবার পঙ্খীটারে উড়ান।বহুত দেরী হয়ে গেছে।ট্রেন ধরতে না পারলে সব শেষ। আকোব্বার আলী বললো,ছিন্তা কইরেন না খালা।এই জাগাত দিয়া গাড়ীঘোড়া কম চলে।জ্যামট্যাম নাই।আপ্নেরে পাঁচমিনিটে খালাস দেমু।

রিক্সা চলছে গতির থেকে আরো গতিতে।আনিকা ড্রাইভারের পারফরম্যান্সে খুশি।সে ভাবলো,লোকটারে  বকশিস না দিলে অন্যায় হবে। তার ওপর সে বহুত ফুরফুরা মেজাজে ওরে গান শুনাতে শুনাতে নিয়ে যাচ্ছে। রাস্তার এদিকটা এখনো গ্রাম রয়ে গেছে।একপাশে খাল অপরপাশে বিস্তীর্ণ ফসলি জমি। দূরদূরান্তে সবুজ আর সবুজ। সবুজ গাছপালার ফাঁকে 

মানুষের পাকা, আধাপাকা বাড়িঘর দেখা যায়।মানুষের হাতে অনেক টাকাকড়ি। বাড়িঘরের বাহার দেখলেই বোঝা যায়।আশপাশে যদিও গ্রামের আবহ রয়েছে তবুও মানুষের এইসব পাকাবাড়ি ইমারত দেখেে বুঝা যায়, মানুষ টেনে হিঁচড়ে গ্রামটাকে শহরের পেটের ভেতর চালান করে দিচ্ছে।গ্রাম আর গ্রাম নেই। অদূর ভবিষ্যতে গ্রাম খুঁজতে গেলে শহরকেই দেখতে হবে।

মহাসড়ক তৈরী হবার পর মানুষের পা আর গ্রামের কাঁচা পথে চলতে চায় না।হেঁটে যাবার পথও পাঁচ দশটাকা দিয়ে অটো টেম্পুতে তুলে দেয়।মানুষের আর দোষ কি? মহাসড়কই ওদের ধন্দে ফেলে দিয়েছে। 

 

গাড়ি বাদশা মিয়ার মার্কেটে এসে থামে।আনিকার দেরী হয়ে গেছে। যে সময়ে আসার কথা তার থেকেও তিনমিনিট দেরী হয়ে গেছে।অবশ্য আকোব্বরের কোন দোষ ছিলো না।বাঁক থেকে উঠিয়ে রিক্সাটিকে সে গ্রামের ভেতর সরু পাকারাস্তায় নিয়ে আসে।কিছুটা সামনে এগোতেই ঘটলো বিপত্তি। কোত্থেকে এক লরি এসে সামনে রাস্তার মুখে ব্রেক কষে থেমে যায়।মালবাহী লরি।ড্রাইভার চেষ্টা করেও সামনে নিতে পারছে না।এর একটি চাকা রাস্তার একটি খন্দে ডেবে যায়।আর ড্রাইভার তাল সামলাতে না পেরে গাড়িটি হককক,ক্যাঁকক্যাঁক ক্যাঁকর শব্দ তুলে থেমে গেলো।

আনিকার রাগ উঠলো।তার থেকেও রেগে গেলো আকোব্বর মিয়া।তার গুনগুনিয়ে গানের টানে ভাটা পড়লো। শরীরে একটা জোস নিয়ে গান গেয়ে গাড়ি চালাচ্ছিলো।নিজের সেরাটা দেখাতে তৎপর ছিলো এই মেয়েটার কাছে।যদিও মেয়েটা তাকে কাকু কাকু ডাকছিলো তাতেও আক্ষেপ ছিলো না আকোব্বরের। ডাকুক না কাকু! সোন্দর মাইয়ারা কাকু ডাকলেই কী আর জেঠা ডাকলেই কী! তাগো মুখে যেই ডাকই আসে ওইটা শুনতে জব্বর লাগে। তার চেয়ে আরো বেশি ভালো লাগে এইরকম মাইয়ারা গাড়িত চড়লে শইল্যে আপনা আপনি একটা ইজম আসে।এখন আকোব্বরের ইজমে ভাটা পড়ছে দেখে সে মেজাজ খিঁচিয়ে ড্রাইভারকে বললো,

– ওই মিয়া,এইহান দিয়া গাড়ি ছালাও ক্যান? এইডা কি ডিস্টিক বোডের রাস্তানি? হাইওয়ে থাকতে এই চিপাত হান্দাইলা ক্যান? এহন যে আটকা পড়লা আমার গাড়ি নিমু ক্যামনে? তোমগো লোড গাড়ির দপদপানির ছোটে আমগো এই চিপাচাপা রাস্তার খাল বাকলা যে উইঠ্যা গেলো হেইডা কি ঠিক কইরা দিবা? তোমগোরে যদি হারাদেশ দিয়া রাস্তা বানাইয়া দেওন অয় তাও তোমগো অইবো না। তোমগো চিপাচাপাত হান্দানই লাগবো।

 

আনিকা রিক্সা থেকে নেমে বললো,ও কাকু, এত কথা কইয়ো না।এখন উপায় বাইর করো।হায় আল্লাহ,ট্রেন আমারে রাইখ্যা যাইবো গা। আমারতো গা কাঁপতাছে।

আনিকাকে দেখে লরি থেকে ড্রাইভার নেমে এলো।এসেই বললো,সরি আপা।এককাজ করি,রিক্সাটাকে উপরে তুলে রাস্তাটা পার করে দিই। তাহলে আপনি যেতে পারবেন। আনিকা বললো,ঠিক আছে কিছু একটা করুন। আনিকাদের পেছনে আরো দু তিনটি রিক্সা ছিলো।ওরাসহ কয়েকজনে ধরে রিক্সাটিকে কাত করে রাস্তায় এনে দিলো। রাস্তায় উঠেই রিক্সা আগের গতি ফিরে পেলো।আকোব্বরের আর গানের মুড নাই।সে বুদ্ধিজীবির মতো বলতে লাগলো,বুজলেন খালা? এই দেশের উন্নতি জীবনেও অইবো না।হালার পো হালারা সিদা রাস্তা থুইয়া বেঁকা রাস্তায় হান্দাইয়া যায়।আমারতো সন্দেহ লাগতাসে, হেতে গাড়িত কইরা চোরাকারবার লইয়া যাইতেছে।শুদু আপনের লাগি,নইলে আইজ তার গাড়িরে লেংটা কইরা দেখতাম 

হালা ওইটায় কইরা কী নিয়া যাইতেছে।এই ডিস্টিকরোডের গাড়িগুলানের চাপে আমগো চিপাচাপা রাস্তাগুলার কইলজা,গুইদ্যা ভেত্তা অইয়া গেছে।কদ্দুর শান্তি মতোন রিক্সাচালামু হেইডারও উপায় নাই।

গাড়ি থামে।আনিকা দুইশো টাকা আকোব্বরকে ধরিয়ে বলে,কাকু একশো টাকা ভাড়া আর একশো টাকা বকশিস। কষ্ট করছেন আমার লাগি। তাই দিলাম। আকোব্বর টাকা পেয়ে থ হয়ে গেলো।আনিকা এরকম দেখে ভাবলো হয়তো সে খুশি হয় নাই।তাই সে বললো,,কাকু,কী হইছে?খুশি হননাই?

— নাগো খালা।খুশি হইছি।তয় বেশি খুশি হইছি।এত টেকা দিলেন?আল্লাহ আপ্নের বালা করুক।

আনিকা দৌড়ায় স্টেশনের দিকে। হাঁপাতে হাঁপাতে দুই নং প্লাটফরমে লাকসামগামী ট্রেনে উঠে বসে।

 

 আনিকা বাড়ি ঢুকেই হৈ হৈ রৈ রৈ শুরু করে দেয়। মা! খালামণি কই? খালামণির জন্য সাত সাগর পাড়ি দিয়া আসছি। আনিকা হাঁসফাঁস করে ঘরে ঢুকতেই আনিকার মা বলে,এলি, ভালো কথা।এমন চিল্লাচ্ছিস কেনো? তোর খালামণিরা কলাবাগানে। চা দিয়েছি।ওরা চা খাচ্ছে।

— ওরা মানে? আর কারা আসছে? 

–তোর বিনু খালাও আসছে।

আনিকা ওয়াও বলে দিলো কালাবাগানের দিকে দৌড়।

আনিকাকে দেখে বেলি চেয়ার ছেড়ে দৌড়ে ওকে বুকে টেনে নিলো।তারপর বললো,ওহ মাই সুইটহার্ট, হাউ ডু য়্যু ডু?

–ডিয়ার খালা,আই’ম অলজো। আই এম হেপি টু হেভ য়্যু। হাউ মাচ হেভ আই ডান টু সি য়্যু।

তারপর বিনু বললো,বাহ,সেজো খালারে পেয়ে ছোটখালারে ভুলে গেলি। 

আনিকা বললো,ওহ নো বিনু,আই নো য়্যু কেম।বাট হাও লং হেভ বিন  আই ওয়াচিং মাই ডিয়ার বেলি খালা, কেন য়্যু থিংক? 

–হুম,তাহলে খালা বোনঝিতে কাঁদ।আমি দেখি।

বিনুর মুখ থেকে কথা কেড়ে নিয়ে বেলি বললো,

উই আর ডুয়িং সো। হাও বিগ দা গার্ল হেজ বিকাম?

হাও বিউটিফুল আনিকা হেজ বিকাম!সি হেজ টু লুক  লাইক মাই ফেভারিট এ্যান্জোলিনা জোলি।

 

বেলি আনিকাকে বুকের ভেতর চেপে রাখে।আর বড় করে একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে।বেলি আনিকাকে সবসময় নিজের মেয়ে ভেবে এসেছে। ওর যখন ঢাকায় পোস্টিং  তখন ছয় সাত বছরের আনিকাকে নিয়ে বেলি ঢাকায় চলে আসে। একসময় বেলির বিয়ে হয়ে গেলে ওরা কানাডায় চলে যায়।বেলি অনেক চেষ্টা করেছে আনিকাকে সাথে নিয়ে যাওয়ার জন্য। কিন্তু আনিকা রাজি হয়নি। সে শুধু তার মায়ের জন্য কেঁদেছে। 

বড় হয়ে আনিকা বুঝে জীবনে একটি ভুল হলে সে এটিই করেছে।তখন যদি সে চলে যেত তাহলে ওখানেই নিজেকে সেটেল্ড করে নিতে পারতো।

 

বেলিখালার কাছে আনিকা দু বছর ছিলো।কী সুন্দর সুখময় দিন ছিলো তার!বেলিখালা খুব সৌখিন ছিলেন। তখন তিনি ডিএমপির পুলিশ অফিসার।কী ডাকসাইটে আর তেজোদ্দীপ্ত। নিজে গাড়ি ড্রাইভ করতেন।পথে আনিকাকে আইডিয়াল মডেল প্রাইমারি স্কুলে নামিয়ে দিতেন। ছুটি হলে কখনো নিজে বা কখনো বাসার বুয়া নিয়ে আসতো। আনিকাকে তিনি নাচের স্কুল, আর্টের স্কুল,গানের স্কুলেও ভর্তি করে দিলেন।রাতে টিচার এসে পড়িয়ে যেতো।সবমিলিয়ে ছোট্ট আনিকার দিন ব্যস্ততার মধ্যে যাচ্ছিলো।

নাচে,গানে আঁকায় সেরাদের সেরা হয়ে আনিকা প্রথম হয়ে তৃতীয় শ্রেণিতে উঠলো বিপত্তি ঘটলো স্মার্ট, সুন্দরী, চটপটে বেলি ডিএমপির অন্য পুলিশ অফিসারদের সাথে এক ব্যবসায়ীর বাসায় ডিনার পার্টিতে যোগ দিয়ে। সেই রাতেই বেলি খালার সাথে ওই ব্যবসায়ীর চোখের সাথে খালামণির চোখের বাগদান হয়ে গেলো। একদিন সুন্দর দিনকাল দেখে ওমর শরীফ নামের ওই ব্যবসায়ী বেলি খালাকে বিয়ে করে কানাডায় চলে গেলেন।

 

আনিকা মায়ের বুকে ফিরে আসে।মাঝখানে দুইবার বেলি খালা দেশে এলেও আনিকার সাথে দেখা হয়নি।এবার বেলি খালার সোজা কথা আনিকাকে নিয়ে ঘুরবে, থাকবে ওরসাথে কিছুদিন। আনিকাকে দেখে ভীষণ অবাক বেলি।মেয়েটা এত রূপবতী হয়েছে! কী অদ্ভুত গায়ের রঙ! কাঁচা হলুদের মতো।সারাশরীর থেকে ছিটকে পড়া জলের জেল্লা বেরুচ্ছে।চোখ এত সুন্দর!  টানাটানা।মোলায়েম শরীর।লম্বা চুল।যেনো কুচকুচে কালো পাটের আঁশ।এত মিহি, মসৃন জামদানি সুতার মতো।  যেনো হাওয়াই মিঠাইয়ের বাক্সের ভেতর চুলগুলো কাঁকড়ার ক্লিপে গুটি মেরে আটকে আছে।

 

ওরা সবাই কলাবাগানে বসে বিকেলের নাস্তা করছে।কলাবাগানটা আনিকার বাবার হাতে করা।মিঃ সোবহান বড্ড গাছপ্রেমি।পুকুরের ধার ঘেঁষে  চওড়া রাস্তার দুইপাশে নানাজাতের কলা গাছ রোপন করেছেন।মাঝখানে সুন্দর খালি জায়গা।ওখানে প্লাস্টিকের কয়েকটা চেয়ার আর টেবিল দিয়ে রেখেছেন। যার যখন খুশি এখানে বসে পুকুরের নির্মল বাতাস খেতে পারে।আর বিকেলের নাস্তাও এখানে করা যায়।খুব সুন্দর এই জায়গাটা।সবাই পছন্দ করে। তারওপর বড় বড় কলাপাতার গুণ্ঠন ছিন্ন করে সূর্যের আলো ঢুকতে পারে না বলে জায়গাটা বেশ ছায়া ছায়া।আশেপাশের বাড়ির অনেকে এখানে মাটিতে বিছানা পেতে দুপুর বা বিকালে ঘুমায়।পুকুরের নির্মল বাতাস কলাপাতার ছাউনি সবার মনে প্রশান্তি এনে দেয়।বেলির খুব পছন্দ হয়েছে এই জায়গা।সে এই যে এখানে এসে বসেছে আর উঠছে না। সে বিনুকে বললো,বিনু,হোয়াটএভার য়্যু সে,দুলাভাই হেজ আ চয়েজ। আই রিয়েলি লাইক দিস প্লেস। বিনু বললো,হু।ঠিক বলেছো,আপা।

 

আনিকার আম্মু হাতে করে কিছু পাকোড়া, বরফি আর পাটিসাপটা নিয়ে এলো।ওদের নাস্তার জন্য। আনুকে বললো, এতদূর থেকে এলি।ভাত খাবি, চল। বেলি শুনে বলে,আপা,ও নাস্তা করুক।এই অপরাহ্ণে তাকে ভাত খেতে বলো না।বিনু বললো,বাহ! তুমি ইংলিশ টকিং ছেড়ে দিয়েছো?

বেলি শুনে হাসে,আরে বোকা,আমি দেখলাম আনিকা ইংরেজিতে কথাবলতে পারে কি না? বা বুঝে কী না?

ওকে এবার কানাডা নিয়ে যাবো।

আনিকা শুনে নাক টেনে বলে,ওহহ খালামণি! তুমি আমাকে রেখে চলে গেছো বলে ভেবেছো আমি পড়াশুনা করিনি? আমি ব্যাংকে জব করি বুঝেছো?

কতক্লায়েন্ট দেখি সারাদিন।কত মানুষ!

হুমম, তুমি ইংরেজিটা রপ্ত করেছো জেনে ভালো লাগছে।প্রতিযোগিতার বিশ্বে এখন ইংলিশ হচ্ছে স্মার্ট ভাষা।এটা জানা মানে তোমার একটা দক্ষতা অর্জন

হলো। 

 

ওরা সবাই পিঠা খাচ্ছে। আনিকাদের পুরান বাড়ি থেকে দুইজন বয়স্ক মহিলা এলো।এরা সবসময়ই আসে।সকালে আসে নাস্তার সময়।এসেই আনিকাদের কিচেনে ঢুকে পড়ে। যে পর্যন্ত নাস্তা না খাবে সে পর্যন্ত ওদের নড়চড় নেই। নাস্তা খেয়ে অবশেষে বের হয়ে যায়।বিকেলেও একই অবস্থা। একজন রশিদার মা বুড়ি আরেকজন খাদিজার মা।দুইজন কলাবাগানে এসে আনিকাকে দেখে বলে, কিতালা আনু কত্তোক্ষনে আইছোস?ইগুন কেগালা? তোগো মেজ্জন?

বুবু ইগুন আঙ্গো মেজ্জন।আঁর খালা।

আনিকার কথা শুনে ওরা এগিয়ে আসে।

–আন্নেরা আনুর মার বইন? কত্তোয়ানে আইছেন?

আনিকা জবাব দেয়,বুবু,হেতারা দুপুরের ওক্তে আইছে।ধরেন পিডা খান।মা বানাইছে।আনিকা বলতেই ওরা গপাগপ পিঠা নিয়ে খেতে থাকে।

বিনুর ভয় ছিলো বেলিকে নিয়ে।সে আবার কী বলে বসে,

–আপনারা আপার কাছে যান।আপা ঘরে আছে।বিনু ইশারা করে।

 –আইচ্ছা। ওরা ঘরের দিকে হাঁটা ধরে।

–আনিকা! এসব কী? বেলির প্রশ্ন শুনে আনিকা উল্টো প্রশ্ন করে,কেনো খালামণি,কী হয়েছে?

–কী হয়েছে মানে? তুমি কীসব বলেছো এগুলো?

আনিকা বুঝতে পেরে হো হো করে  হেসে ওঠে। –ওহ,এই কথা খালামণি?আমি ওদের মতো কথা বলেছি।ওরা যেভাবে বলে সেভাবে।বেলি এটা শুনে বলে,রাবিশ!

একরাত বেলি, বিনু ওদের বড় আপার কাছে থেকে পরেরদিন চলে যায়।যাওয়ার সময় আনিকাকে নিয়ে যায়।।আনিকা ওর বস থেকে একসপ্তাহের ছুটি  চেয়ে নেয়।

 

আনিকা চট্টগ্রাম চলে আসে।রাউজানে ওর খালার শশুরবাড়ি।আশেপাশে পাহাড় আর টিলায় ঘেরা।যেদিকে চোখ যায় শুধু সবুজ আর সবুজ।এতো সবুজ  পাহাড় দেখে ওর ভীষণ ভালো লাগে। বেলি আসবে শুনে ওর মেজো দেবর ঈশা খাঁন আত্মীয় স্বজন অনেককেই দাওয়াত দিয়ে রেখেছেন। বাসায় মেহমান।ঈশার ছেলে তৈমুর সে ঢাকা মেডিক্যাল থেকে এমবিবিএস শেষ করেছে।সেইসাথে জেনেটিক সিস্টেমের ওপর কী একটা প্রোজেক্টের সাথে জড়িত।দেশের নামকরা একজন কনসালটেন্টের তত্ত্বাবধানে আছে সে।বাবার কাছে জেঠু আসছে শুনে ঢাকা থেকে বাড়িতে চলে আসে।সারাবাড়ি জুড়ে আনন্দ, হৈ-চৈ। বেলি আনিকাকে সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়।দেখেন, আমার বড় বোনের মেয়ে আনিকা।এই পুঁচকে মেয়েটা আবার ব্যাংকে জব করে।মজার ব্যাপার কী জানেন?এই মেয়েটি একসময় আমার কাছে ছিলো।তখন আমি ঢাকায় জব করি।ওর বয়স ছয় সাত বছর। আমার কাছেই লেখাপড়া করে।বিয়ের পর আমি কানাডায় চলে আসি।সে চলে যায় মায়ের কাছে।বহু চেষ্টা করেছি সাথে নিয়ে যেতে।কিন্তু কিছুতেই রাজি করাতে পারিনি।একটিই কথা,মাকে ছাড়া কোথাও যাবে না।বেলির মুখ থেকে কথা কেটে ঈশা খাঁন বলেন,যায়নি তো কী হয়েছে? মেয়ে কিন্তু মানুষ হয়েছে।মাশাল্লাহ দেখতেও কিন্তু বেশ।

ঈশা খাঁনের একটি মেয়ে।বয়স আট। নাম লাবিবা। তৈমুরের একমাত্র ছোট বোন। সে আনিকাকে পেয়ে মহাখুশি। যেখানে যাবে আনিকাকে সাথে নিবেই।বিকেল হতেই বল্ল,,আনিকাপি,চলো আমরা ওই পাহাড়ের কাছে যাই।আনিকা বললো,চলো যাই।

–তোমরা একা যাবে না।তৈমুর তুমি ওদের সাথে যাও।মেয়েটা এখানে নতুন। ঈশা খাঁন ছেলেকে বললেন, তুমি ওদের ঘুরিয়ে নিয়ে আসো।

 

ওরা বের হয়। হাঁটতে হাঁটতে একটা মাঠের কাছে আসে। মাঠটি উঁচু থেকে ধীরে ঢালু হয়ে নিচের দিকে নেমে গেছে। পাশেই লম্বা দীঘল এক দিঘি।দূরে সবুজ পাহাড়। দিঘিটির একপাশে লম্বা লম্বা অনেকগাছ দেখে আনিকা থমকে দাঁড়ায়।সারি সারি প্রায় এক থেকে দেড়শো গাছ হবে। পাতাগুলো খরগোশের কানের মতো কিছুটা ভারী। নিচের দিকে ঝুলে আছে।বাহ!এত সুন্দর!তৈমুর বলে,এটা রাবার বাগান।

–রাবার বাগান? বাহ!যাবেন? দেখবো রাবার বাগান।

–চলুন। 

ওরা বাগানের দিকে হাঁটে। ঘাসের ওপর ফড়িং উড়ছে।লাবিবা দৌড়ে ফড়িং ধরে। তৈমুর কিছু বুঝে উঠার আগে আনিকাও দিলো লাবিবার সাথে দৌড়। কি হলো কী হলো বলেই তৈমুরও ছুটতে লাগলো পিছু পিছু।লাবিবা ধপাস করে ঘাসে বসে পড়ে।সাথে সাথে আনিকাও।লাবিবা বলে,আপি আরো ফড়িং ধরবো।তৈমুর অবাক হয়।আনিকার মত এত বড় মেয়ে পিচ্চি লাবিবার সাথে দৌড়াচ্ছে। ঘাসে বসছে।ফড়িং ধরছে।লাবিবা কয়েকটি ফড়িং ধরে দুইপাশের ঝুটি দুলিয়ে হি হি করে হাসছে। আনিকাও কয়েকটি ধরে লাবিবার মতো মাথা দুলে হাসছে।তারপর দু’জনে পা ঘাসে ছড়িয়ে ফড়িংগুলোর পাখনা আর লেজে গুঁতো দিচ্ছে। ফড়িংগুলোর ছটফটানি দেখে দুজনেই হেসে গড়াগড়ি খাচ্ছে। 

 

তৈমুর তাড়া দেয়।কী ব্যাপার! রাবার বাগানে যাবেন না? তৈমুরের তাড়া পেয়ে ওরা ওঠে।বাগানে গিয়েই ঘটলো বিপত্তি। আনিকা কখনো রাবার গাছ দেখেনি। সারি সারি গাছ।কচকচে পাতা।পাতাগুলো তেলতেলে।মনে হয় কেউ অলিভ অয়েল মাখিয়ে দিয়েছে। গাছগুলোর বুকে দুটি তিনটি করে ছোট বালতি ঝুলতে দেখে সে অবাক হয়। গাছগুলোর বুকে ছোট ড্রেন।ওগুলো থেকে দুধের মতো সাদা জল বালটিতে পড়ছে।

আনিকা খুব মুগ্ধ হয়।,ওয়াও কি সুন্দর! সে বালটির ওপর উপুড় হয়ে দুধপড়া দেখছে। লাবিবা এসে আনিকার হাত বালটিতে চুবিয়ে বলে,দেখো দুধগুলো আঠা আঠা।আনিকার সাথে লাবিবাও বালটিতে হাত দিয়ে রাবার গাছের দুধ নাড়ছে।লাবিবা তার দুধচুবানো আঙুলের ভেতর ফড়িংয়ের পাছা ডুবিয়ে দেয়।ফড়িং ওই দুধে আটকে যায়।লাবিবার এই দুষ্টুমি দেখে আনিকাও তাই করে।ফড়িংগুলো আটকে যেতে দেখে ওদের কি হাসি! আনিকাও হাসছে লাবিবার মতো।হাসতে হাসতে ডানে পড়ে আবার বামে।রাবার বনে তখনও নিরবতা।কিন্তু এই দুটি ছোট শিশুর হাসিতে এখন বনপাড়া ম-ম করছে। তৈমুর আনিকার কাণ্ডে অবাক।সে কী করে পারছে এরকম জীবন্ত ফড়িংকে আঠা দিয়ে আটকে দিতে? তাও লাবিবা যা করে সেও তা করে।এমনকি লাবিবার মতো দৌড়া,হাসে কথাও অবিকল নকল করে তার মতো।

 

একে তো বন,তার ওপর সন্ধ্যা। অন্ধকার এগিয়ে আসছে। তৈমুরের ডাক,আনিকা চলুন ফিরি।

-আপনি আমার নাম জানেন? জিজ্ঞেস করে আনিকা।জ্বী জানি।তবে এও জানি আপনি লাবিবার মতো।

-মানে? 

– মানে হলো লাবিবা আর আপনি সমবয়সী।

আনিকা তৈমুরের কথা শুনে হি হি করে হাসতে হাসতে লুটিয়ে পড়ে।লাবিবাও। 

এবার আনিকা বলে,আপনি আমার দাদার মতো।তবে তিনি বেঁচে নেই। এটা বলে আনিকা হাসতে থাকে।

–আপনার দাদার মতো—ঠিক বুঝিনি।

–মানে, আমার দাদর মত ইয়া গম্ভীর,চুপচাপ, রাগী রাগী।

— আমি রাগী? আমাকে এমন মনে হয়? তৈমুর এটা শুনে থতমত খেয়ে যায়।

 

তৈমুর ঈশা খাঁনের ছেলে।স্বভাবে চুপচাপ,গম্ভীর। সে সহসা কারো সাথে মিশতে পারে না।ঢাকা মেডিক্যাল থেকে এমবিএস শেষ করে বিসিএসের প্রস্তুতি নিচ্ছে। দিনরাত পড়ার টেবিলে বসে থাকা আর কী একটা গবেষণা ছাড়া ওর কোন কাজ নেই।জেঠু আসায় কিছুটা রুটিন চেঞ্জ হয়েছে।জেঠুর সাথে দেখা করতেই ঢাকা থেকে উড়াল দিয়েছে। বাড়িতে আসার পর মেয়েটিকে নিয়ে ঘুরে আসার দায়িত্ব বাবা দিলো কাঁধের ওপর চাপিয়ে। অচেনা মেয়ে।তাছাড়া মেয়েদের থেকে একশত হাত দূরে থাকে তৈমুর। সে লাজুক প্রকৃতির।তৈমুরের এ অবস্থা দেখে আনিকা তাকে মৃত দাদার মত বানিয়ে ফেলে।কী অদ্ভুত মেয়ে!

তৈমুর কিছু বলে না।চুপচাপ বাসার দিকে হাঁটতে থাকে।বাসায় ফিরতে সন্ধ্যা হয়। তৈমুরের মা আয়েশা খানম ওদের দেখে টেবিলে নাস্তা নিয়ে এলেন।ওরা নাস্তা নিয়ে বসছে। সোফার একপাশে তৈমুরের দাদী রিজিয়া খানম বসা।খুবই ধবধবে ফর্সা মহিলা। চুলগুলো পেকে সাদা জড়ির মতো চিকচিক করছে।চোখে সোনার চেইন বাঁধানো চশমা। খুব বনেদী বোঝা যায়।আনিকাকে দেখে আয়েশা খানমকে জিজ্ঞেস করেন,বউ,হ চাই ইবে হন মাইয়া?হন তি আইসসে?

আয়েশা খানম জবাব দেন,মা,ইবা হইলদে বেলির ঢর বইনর মাইপোয়া।ইতারা লাকসাম থাকে,মাইয়া ইবে চ’রি গরে,এডে হতদিন থাইবো।

রিজিয়া খানম বললেন,মাইপোয়া ইবে গনগরি সুন্দর আছে।

 

রিজিয়া খানমের কথা শুনে আনিকা অবাক।এতো সুন্দর মহিলা এরকম ভাষায় কথা বলে? সে চিটাগাংয়ের ভাষার কথা শুনেছে।কিন্তু কখনো নিজ কানে শুনেনি।আজ শুনে তার কাছে ভাষাটাকে চীনদেশের ভাষার মতো মনে হয়। এখানে আসার পর এই প্রথম সে এই মহিলার কাছে এরকম ভাষা শোনে।

এই বাসায় আর কাউকে সে এ ভাষায় কথা বলতে শুনেনি। কৌতূহলী হয়ে সে রিজিয়া খানমের কাছে গিয়ে বসে। রিজিয়া তাকে দেখে আনিকার মুখে কপালে হাত দিয়ে জিজ্ঞেস করে, অবা সুন্দরী মাইয়া,তোঁয়্যার নাম কি?আনিকা বুঝতে পেরে বলে,আনিকা।

এরপর রিজিয়া খানম আরো কী কী জিজ্ঞেস করে।আনিকা কিছু বুঝে টুঝে জবাব দেয়। তৈমুর খেয়াল করে আনিকা তার দাদীর মতো একগালে হাত রেখে কথা বলছে।দাদী যেমন মাথা ঝাঁকায় কিছুক্ষণ পরপর আনিকাও তাই করে। তৈমুর খেয়াল করে আনিকা নিজ ইচ্ছায় এসব করে না।অবচেতনে এরকম করছে।তার এইসব নকল করা সে নিজেও জানে না। এমনকি যারা তার সাথে আছে তারাও জানে না।

 

তৈমুর পুলক অনুভব করে।মেয়েটা এক্সপেরিমেন্টাল। তাকে ফলো করা দরকার। জীববিজ্ঞানের অদ্ভুত চরিত্র মনে হয় আনিকাকে।পৃথিবীতে এরকম ঘটনা আছে।কদাচিত। কিছু মানুষ আছে যার ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য বলে কিছু নেই।এই মানুষগুলো যাদের সংস্পর্শে আসবে ঠিক তাদের মতো আচরণ করে।তবে সমস্যা আছে এসব মানুষের জন্য। এদের নিজেদের কিছু নেই বলে এরা চোরের পাল্লায় পড়লে চোর হতে পারে,ডাকাতের পাল্লায় পড়লে ডাকাত।সাধু সন্নাসীর পাল্লায় পড়লে দরবেশ বা আউলিয়া হয়ে ওঠে। আসল কথা হলো,যে কোন কিছুই হতে পারে।তবে মেয়েটা চাকরি করে।নিশ্চয়ই পরিবারের আবহটা লেখাপড়ার মধ্যে ছিলো তাই পেয়ে গেছে।এরা অফিস আদালতে গেলে বসের আচরণ দেখে বসের আচরণ শুরু করে।অধীনস্থদের দেখলে ঠিক তাদের মতো হয়ে যায়।সমস্যা তখন ওখানে।পৃথিবীতে এরকম কেস দুয়েকটা।এগুলো রেয়ার।এই রেয়ারের মধ্যে আনিকা একজন।তৈমুর নিজেকে প্রস্তুত করে।

 

সকাল বেলা। তৈমুরের কাঁচের জানালা গলে সোনামুখি রোদ হামাগুড়ি দিচ্ছে।জানালার ওপাশেই সারি সারি নারকেল পাতা হালকা বাতাসে দুলছে।রোদের চমকে আশেপাশে ঘুমিয়ে থাকা গাছগুলো গা -ঝাড়া দিচ্ছে।তৈমুরের মতো।তৈমুর হা দিয়ে বড় শ্বাস ছাড়ে।বিছানায় আরো গড়াগড়ি খায়।সে চমকে উঠে।নিচ থেকে হিহি হাহা শব্দ শুনে।যা ভেবেছে তাই।আনিকা,ওদের কাজের ছেলে লোকমানের সাথে হাসছে।লোকমানের হাতে পানিভর্তি ঝাঁজি।গাছে পানি দিচ্ছে।আনিকা তার হাত থেকে ঝাঁজি নিয়ে ফুলগাছে পানি ঢালছে। সাথে তার সহকারী মালি আলেয়াও আছে।আলেয়া গাছের ওপর পানি ঢালছে।আনিকাও আলেয়ার মতো ঢালছে।আলেয়ার মত তার কোমড়ে ওড়না গোঁজা।লোকমান একটু খুঁড়িয়ে হাঁটে।আনিকাও লোকমানকে অনুসরণ করে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হেঁটে গাছে পানি ঢালে আর হিহি করে হাসে।আলেয়া কিছুটা টেনে কথা বলে।আনিকাও আলেয়ার মতো টেনে বলছে,আ-লে- য়া,,  আ- আ-  মি   গা -ছে-দে – র    গো – স -ল     ক -রা -চ্ছি। আলেয়া আবার টেনে টেনে বলে,আ-ফা,  লো – ক – মা -ন -রে     ক–ন,    গা – ম -ছা    আ- ন -তে। গাও    না 

মো – ছা- ই -লে       গা -ছে -র     জ্ব–র     হ-বে।

আলেয়া আর আনিকা হেসে কুটিকুটি। তৈমুর ভাবে।তাকে আরো শিওর হওয়া দরকার। এত অল্প অবজার্ভেশনে কিছুই নিশ্চিত হওয়া যাবে না। হয়তো মেয়েটার চরিত্রই এরকম। কী অদ্ভুত! আজীবন মেয়েদের থেকে দূরে থাকা তৈমুর এখন আনিকাকে ভাবছে।

 

রাতে খেতে বসে সবাই একসাথে।ডাবল ডাইনিং দেয়া হয়েছে। মেহমান বেশি থাকলে বড় হলরুমটাতে ডাইনিং সাজানো হয়।আজ তৈমুর একটু আগেই এসেছে।তার উদ্দেশ্য আনিকাকে ভালো করে খেয়াল করা। বেলি খালা আর তৈমুরের মায়ের মাঝখানে আনিকা বসা। একটু দূরে লাবিবা।লাবিবার সাথে তৈমুর বসেছে।তৈমুর দেখে,আনিকা স্বাভাবিক ভাবেই খাচ্ছে। ছোট ছোট পুটঁলি বেঁধে গালে পুরে দিচ্ছে খাবার।বিকেলে নাস্তার সময় খেয়াল করেনি সে কীভাবে খায়?আনিকার খাওয়ার স্টাইল অদ্ভুত লাগছে তৈমুরের কাছে। হঠাৎ বেলি খালার ফোন আসে।তিনি চেয়ার ছেড়ে উঠে গেলেন।আয়েশা খানম আনিকাকে আরেকটু পোলাও দিলেন।আনিকা না না করে ঠেলে দেয়।তৈমুর দেখে এবার আনিকা আর পুঁটলি বাঁধছে না।গোল করে লোকমা বানিয়ে মুখে তুলে দিচ্ছে। 

মানে কী? তৈমুর চিন্তায় পড়ে যায়।একই মেয়ের দুইরকম খাবার স্টাইল।আয়েশা খানমকে খেয়াল করে সে বুঝে নেয়।আনিকা এখন আয়েশা খানমকে ফলো করছে। তার মানে একটু আগে সে বেলি জেঠিমণির খাবার অনুসরণ করেছে।

 

এভাবে দুদিন কাটলো।তৈমুর একদিনের কথা বলে এসেছে।এখন সে যেতে চাচ্ছে না দেখে ঈশা খাঁন বলেন,তুমি ঢাকা যাচ্ছো কবে?

বাবার এই প্রশ্ন শুনে তৈমুর কী বলবে বুঝতে পারে না।ঢাকা যাওয়া জরুরী।আসার সময় কোন বই নিয়ে আসেনি।কে জানতো,হঠাৎ এরকম করে সে বাড়িতে আটকে যাবে? আনিকা মেয়েটা তাকে টানছে।দ্রুত ঘূর্ণনে আছড়ে পড়ছে তৈমুর।মেয়েটার কোন নিজস্ব শক্তি নেই। কিন্তু কোথাও না কোথাও মেয়েটার কিছু আছে।ঈশ্বর কণার মতো তার ভেতরেই লুকিয়ে আছে সে তত্ত্ব।  তৈমুর আনিকার সাথে কথা বলতে চায়।ডাকতে চায়।কিন্তু লজ্জা, সংকোচের জন্য সে কাছে ভেড়ার সাহস পায় না। তাছাড়া মেয়েটার বিশেষত্ব সন্দেহজনক।তৈমুরের কৌতূহল জাগছে মেয়েটার প্রতি।যে কারণে কৌতূহল এটা সবখানে বলা সম্ভব না। মেয়েটাকে জানা খুব জরুরি। বাড়িতে আসা তার সার্থক না নিরর্থক হয়েছে তা সময় বলে দেবে।

তবে বাবাকে কিছু একটা বলা দরকার।সে আসার সময় বাবাকে বলেছে বাড়িতে এলে তাকে থাকার জন্য  যেনো জোর করা না হয়। এখন হয়েছে উল্টো। সে নিজেই যেতে চাচ্ছে না।বাবাকে নির্দিষ্ট কারণ বলতে না পারায় ঈশা খাঁন মুচকি হেসে বলেন,ঠিক আছে আরো ক’দিন থাকো।

মাঠের শেষদিকে তৈমুরদের বড় বড় গাছের বাগান। সেই গাছের কাঁধে দড়ি ঝুলিয়ে দুটি দোলনা টানানো। আনিকা সেখানে দুলছে।লাবিবা তাকে পেছন থেকে ধাক্বা দিচ্ছে। আনিকার অনেক লম্বা চুল। আনিকা উপরে উঠলে চুলগুলো বাতাসে ভেসে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে।নিচে নেমে এলে মাটি ছুঁয়ে সামনে দৌড়োয়।যেনো কোন ছোট্ট ছেলে গাড়ির খালি টায়ার কাঠির আঘাতে দুরন্ত রাস্তার ওপরে দৌড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে। এ এক দারুণ খেলা। প্রকৃতির নির্মল বাতাস কাঠির মতো আঘাত দিয়ে মাটি ছুঁয়ে দৌড়িয়ে নিচ্ছে আনিকার চুল।গাড়ির টায়ারের মতো চুলগুলোও কুচকুচে কালো আনিকার। তৈমুর বাগানে ঘুরে ঘুরে আনিকা আর লাবিবার দোল খেলা দেখে।

মেয়েটা এত সুন্দর সে এতদিন বুঝতে পারেনি কেনো? তৈমুর ওদের দিকে এগিয়ে গেলো। 

দোলনায় চড়ছেন?  তৈমুর আনিকাকে বললো। তারচেয়ে চলুন,ওই দিঘির পাড়ে।ওখানে কাল মাছ ধরবো।জায়গাটা দেখে আসি।

আনিকা দোলনা থেকে নামে। দিঘির দিকে এগিয়ে যায় ওরা।লাবিবাকে পেছনে আসতে দেখে তৈমুর তাকে মায়ের কাছে পাঠিয়ে দেয়।তুই মায়ের থেকে পিঠা নিয়ে আয়।মাকে দেখছি পিঠা ভাজতে ।আমরা ওদিকটায় আছি।

 

তৈমুর আর আনিকা ঘাটলার সাথে বাঁধানো বেঞ্চিতে বসে আছে। দিঘির জলে সূর্যের ছায়া। চিকন চিকন ঢেউ ঝিকিমিকি রোদের তালে দুলছে।ঢেউগুলো জলের তোরণ ভেঙে এগিয়ে যায় সম্মুখে। আনিকার সরু নাকের মতো।দুই ভ্রুর খাঁজ কেটে ঈষৎ সরু নাক  উর্ধ্বগামী প্রান্তরেখার জমিন চুৃঁয়ে বয়ে গেছে নীচের দিকে। যেনো নদীর মোহনা মিলেছে তিলক আঁকা দু’ঠোঁটের প্রান্তে। তৈমুর আনিকাকে খুঁটে খুঁটে দেখছে। মেয়েটা সুন্দরী। সুন্দরী বললে ভুল হবে।রূপবতী।রূপবতী বললেও ভুল হবে।মায়াবতীদের মতো মনে হয়। কী শান্ত দুটো চোখ। দিঘির জলের মতো স্বচ্ছ টলোমলো পাপড়ির পাখনাগুলো।প্রতিটি পাখনা হামিংবার্ডের মতো মনে হয়।উড়ছে প্রাণবন্ত। কিন্তু মাটির নাগাল পাচ্ছে না।তৈমুর ভাবে,যাহ, আমি এসব কী ভাবছি? যতসব তরল চিন্তা। রাউল্টের সূত্র ভুলে গেলে চলবে না। তৈমুরের ভেতরকার মন মননের দ্রবন অনুদ্বায়ী করা যাবে না।না হলে ওর বিচ্যুতি হওয়ার সম্ভাবনা আছে।তরলায়িত দ্রবনের চাপ লঘু রাখতে হয়।চাপ যত লঘু রাখা যায় তত ভালো।

 

তৈমুর নিজের ভেতর ফেরে।আনিকার দিকেও ফেরে।

মেয়েটা পৃথিবীর দিগন্ত বরাবর মাথা কোণাকুণি এঙ্গেলে রেখে দূরে তাকিয়ে আছে।আশ্চর্য!  মেয়েটির মুখের অবয়ব মেগালিথ পাথরের মতো। যেনো কোনো দৈব মেগালিথ পাথর কুঁদে তার মুখে নির্দিষ্ট একটি নারীর মুখ বসিয়েছে।এই মুখ এন্টিক।কিছুর সাথেই মেলে না।মেয়েটি নিশ্চয়ই  নিওলিথিক পিরিয়ডের। সে ওই পিরিয়ড ছেড়ে ডায়নামিক পৃথিবীতে এলো কেনো? হঠাৎ তৈমুরের মনোজগত পাল্টে যায়।মেয়েটি আর দশজনের মতো সাধারণ কেউ নয়।সে যে কী এটা তৈমুর জানে। আর জানে বলেই সে মেয়েটাকে অবজার্ভ করছে। তৈমুর আশ্চর্য হয়। মেয়েটার কোন উচ্ছ্বলতা নেই।এত সুন্দর একটি জায়গায় নিয়ে এলো অথচ কোন রিএ্যাক্ট দেখাচ্ছে না।একটু আগেও লাবিবার সাথে কত হেসেছে। হয়ত তৈমুরকে দেখে ওর সংকোচ, লজ্জা, দ্বিধা কাজ করছে। আসলে ব্যাপার তা নয়।তৈমুরের গাম্ভীর্যতা ওকে পেয়ে বসেছে।এখন তৈমুর যদি ঠা- ঠা করে হাসতো, উড়াল উড়াল থাকতো আনিকাও তাই করতো।অদ্ভুত প্রতিক্রিয়ার মধ্যে মেয়েটির দিন পার হচ্ছে কেউ জানে না।বিশ্ব জগতে আনিকার মত অনেক বিচিত্র প্রাণী আছে। মরুভূমির টিকটিকি এরকম।যখন যেখানে যায় নিজের আকার পরিবর্তন করার অসাধারণ ক্ষমতা রাখে ওরা। পাখি, সাপ, অন্যান্য কীটপতঙ্গ যেখানে যেমন আবাস, তেমন রঙের ডিম পাড়ে।বাসা করে।যেনো শিকারীদের ধোঁকা দিতে পারে। কিন্তু আনিকা এমন হবে কেনো?

তার সাথে কথা বলা দরকার।তৈমুর নিরবতা ভাঙে। আজ সে সাহস নিয়ে এসেছে।

 

আনিকা? তৈমুরের ডাকে আনিকা মুখ ফেরায়,

–জ্বী বলুন। 

— আপনাকে আজ কিছু কথা বলবো।আপনি শিক্ষিত, রুচিশীল, প্রাণবন্ত ও অসাধারণ একটি মেয়ে।আমার এসব কথায় কিছু মনে করবেন না।এগুলো বলার কারণ আছে।আপনি যদি অভয় দেন তাহলে বলতে পারি।কথাগুলো শোনা আপনার প্রয়োজন।

আনিকা কিছুটা অবাক হয়,তারপর বলে, বলুন।

-দেখুন আনিকা, আমি কীভাবে শুরু করি?আপনি ব্যপারটাকে কতটুকু সহজে নেন সেই সংকোচ রয়ে গেছে।ব্যাপারটা আপনাকে নিয়ে।

আনিকা বিস্ময় প্রকাশ করে বলে,আহা,আপনি বলুন!

আমি শুনছি।আর এখানে আপনি আর আমি।কথা অন্যরকম হলে আমরা দুজনই জানবো।আর কেউ জানার ভয় নেই।

–দেখুন আনিকা, আপনি একটি পরিবর্তনের মাঝে আছেন। সেটা আপনি জানেন না।

–মানে? মানে হলো,আপনার নিজস্বতা বলে কিছু নেই।আপনার শারীরবৃত্তীয় পরিবর্তন অদ্ভুত আর আলাদা। আপনার বিকাশজনিত ত্রুটি আছে। আপনার এই ত্রুটি সুক্ষ্ম।জানি না, কখনো আর কেউ  আপনাকে এসব বলেছে কী না?

আনিকা বলে,যেমন,ব্যাখ্যা করুন।

 

–দেখুন আনিকা, এই ব্যাখ্যা ব্যাপক।জীববিজ্ঞানের ভাষায় একে বলে ‘প্রকৃতির স্ববিরোধ’। কোনজীবের ফিনোটাইপ বংশানুবিজ্ঞানের মিথস্ক্রিয়ার ওপর নির্ভর করে। ফিনোটাইপ হলো কোন জীবের চারিত্রিক বৈশিষ্টের বাহ্যিক প্রকাশ।।বংশানুক্রম বিভাজনে অনুগুলো পারিপার্শ্বিক চাপে দ্রুত ছোটাছুটি করে ও নিজেদের নিজস্বতা হারিয়ে ফেলে। তখন প্রকৃতির মাঝে তাকে নিয়ে স্ববিরোধ শুরু হয়।যা ওই ব্যক্তি জানে না।আমাদের ম্যাডিকেল সায়েন্সে এ ব্যাপারে সিনিয়ার কনসালটেন্ট ডাঃ জগলুল আলমের একটি থিসিস আছে। এটির ওপর হাভার্ড ইউনিভার্সিটিতে একটি পোগ্রাম হয়। পৃথিবীর বিখ্যাত সব ডাক্তারদের নিয়ে।সেখানে উপস্থিত থাকে ইউনিয়ন অব ডক্টরস ফোরাম।সেখানে ডাঃ জগলুল আলম বিশ্বের বিখ্যাত ডাক্তারদের সাথে একটি থিসিস বর্ণনা করেন। তারপর সেই থিসিস তিনি আমাদের ব্যাখ্যা করেছেন।পৃথিবীতে এরকম ‘প্রকৃতির স্ববিরোধ’ নিয়ে জন্মগ্রহণ করেছে অনেক প্রাণী।এই প্রাণীদের ফিনাইলএ্যালানিন নামক প্রোটিন নিয়ে কাজ করতে গিয়ে তারা এই জিনিসটি পান।বংশগতির বাহন হিসেবে মা – বাবার ক্রোমোজম সবসময় জেনেটিক কোড বহন করে না।এরকম কেস রেয়ার।তারা মনে করেন,অন্যান্য প্রানীদের এমন হলে মানুষও এমন হওয়ার কথা।কারণ, বাস্তুজগতে মানুষও প্রাণী। আমি আপনাকে পুরো থিসিসটা দেবো।আপনি পড়লে জানতে পারবেন।এতটুকু বলে তৈমুর থামে।

 

আনিকার বিস্ময়ের সীমা রইলো না।সে নিজের সম্পর্কে এসব শুনে বললো,আপনি ভাবছেন আমি এই প্রকৃতির স্ববিরোধী সন্তান?

— এক্সেট বলতে পারছি না।তবে অনুমান।

— আপনি অনুমানের ওপরই আমাকে নিয়ে গবেষণা করছেন?

— অনেকটা এরকম।দেখুন, ডারউইন কিন্তু প্রকৃতি পর্যবেক্ষণ করে জীবের বিবর্তনবাদ আবিষ্কার  করেছেন।আর এটি আপনার পড়ার কথা।

তিনি প্রাণীজগতের রূপান্তর সম্পর্কে কিছুই জানতেন না।প্রকৃতি পর্যবেক্ষণ ও ভূতত্ত্ব গবেষণা করে তিনি ‘অন দি অরিজিন অফ স্পিসিস’ বইটি লিখেন। তার এই বই  জীববিজ্ঞানের অভূতপূর্ব মাইলফলক।আর আমি প্রকৃতির স্ববিরোধ সম্পর্কে আগে থেকে কিছুটা জানি।এই জানার ফলে আমি আমার আশেপাশের মানুষগুলো দেখতে শুরু করি।বলতে পারেন গোপন গবেষণা। কারণ ডঃ জগলুল আলমের মতে প্রকৃতিতে স্ববিরোধ নিয়ে জন্মগ্রহণ করা মানুষ আছে। আমাদের আশেপাশেই আছে।সুক্ষ্ম চোখে ওদের খুঁজতে হবে।চোখ করে ফেলতে হবে দূরবীন। আমি আজ দু’বছর খুঁজে চলেছি।

 

আনিকা তৈমুরকে থামিয়ে বলে, পেয়েছেন?

— দেখুন, আনিকা।যদিও আমার অবজারভেশন আপনাকে নিয়ে তবুও আমার আরো কিছু ক্লিয়ার হওয়া চাই।আপনি আমাকে হেল্প করুন।মনের সব দ্বিধা ঝেড়ে আপনি আপনার জীবনের অজানা জিনিস আমাকে জানতে দিন। এতে আপনার উপকার হবে।

— কী উপকার?

–এই যেমন ধরুন,আপনি আপনার অফিসে কাজ করেন।কাজ করতে করতে আপনার পাশের সহকর্মীর চলাফেরা,কথা,কাজের ধরণ কপি করছেন।এরকম কি মনে হয়েছে কখনো যে আপনি তাদের অনুসরণ করছেন?

আনিকা চুপ হয়ে যায়।কথা সত্যি।এরকম বহুবার হয়েছে।তার দুই পাশে হেলেন আর রবিন নামে দুজন কলিগ কাজ করে।হেলেন উচ্চস্বরে হাসে।একদিন আনিকা দেখে সেও হেলেনের মত হাসে।অফিসে উচ্চহাসি হেলেনেরটা সবাই কোনরকম সহ্য করেছে।সাথে আনিকা যুক্ত হওয়ায় ম্যানেজারের কাছে কমপ্লিন যায় আনিকার বিরুদ্ধে। এতদিন ওরা হেলেনের উচ্চহাসি সহ্য করেছে।আনিকারটা কোনরকমেই সম্ভব নয়।আনিকা আগে এরকম হাসতো না। হেলেনকে দেখে সে নাকি এসব শিখেছে।আবার রবিন কথা বলার সময় চুকচুক শব্দ করে।আনিকাও কাজের ফাঁকে কথা বললে রবিনের মতো চুকচুক  করে।আর ওরা আনিকার এসব দেখে হো হো করে হেসে উঠে।ফলে অফিসে ব্যাপক সমস্যা দেখা দেয়।এক আনিকার হো হো করে হাসা,দুই রবিনদের সাথে কথা বলার সময় আনিকার এই শব্দে নতুন হাসির জন্ম। ফলে অফিসের ফাইল স্লো গতিতে এগুতে থাকো।ব্যাংক বলে কথা।কত রকমের ক্লায়েন্ট। ওরা একটু বাড়তি সময় ব্যাংকে থাকে? কাজ কখন শেষ হবে,সামান্য দেরী হলে অফিসারদের খোঁচাতে থাকে।

শুধু এই না,আনিকার মনে পড়ে তাদের পুরান বাড়ির বুড়ি দাদীদের কথা।তাদের হাঁটা  চলা সে কপি করে।এমনকি তার বোনদেরও।তার মায়ের ভাত খাওয়ার সময় যে শব্দ হয় সেটাও সে কপি করে।অথচ তার মায়ের শব্দ হলে কেউ কিছু বলে না। আনিকার শব্দ বের হলেই ওরা বলে,ছিহঃ আনু আপু,খাওয়ার সময় এমন ভসভস শব্দ করে কেউ? আনিকার এসব মনে পড়ায় সে তৈমুরকে বলে আপনার কথা ঠিক।

—দেখুন আনিকা,এটায় আপনার কোন হাত নেই।তবে এসব কেনো এবং কী কারণে তা ব্যাখ্যাতীত।বিশাল ব্যাপার।এই ক্ষুদ্র সময়ে আপনাকে এটা বোঝানো অসম্ভব।চিকিৎসা বিজ্ঞানে এটাকে সেক্স লিঙ্ক ডিজঅর্ডার বলে।বা অন্যকিছুও হতে পারে। আপনার মনোজাগতিক আরো কিছু ব্যাপার জানা দরকার।যেমন আপনার শৈশব। আপনি নিশ্চয়ই মা- বাবার বড় সন্তান। খুব আদরের!

— হুম তবে খুব আদরের বুঝলেন কী করে?

— কী যে বলেন না! দেখলেই বুঝা যায়।সে যাক।

এবার বলুন,ছোটবেলায় মা – বাবা থেকে দূরে ছিলেন? আই মিন,আপনার নির্দিষ্ট পরিবেশ ছেড়ে আর কোথাও?

–ছিলাম ঢাকা উত্তরায়।আমার বেলি খালামণির বাসায়।তখন আমার বয়স ছয় সাত হবে।খালামণি তখন ওখানে চাকরি করতেন।

— আমি জানি।তবে কতবছর ছিলেন?

–দু বছর। তৈমুর বুঝতে পেরে একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে।

দেখুন আনিকা,পৃথিবীর সবাই কমবেশি প্রকৃতির স্ববিরোধী হয়।কারোটা কম, কারোটা বেশি।এর প্রকৃতি অনেকটা জীবনযাপনের ওপর নির্ভর করে।এই যেমন ধরুন, আপনি আপনার মা -বাবা ছেড়ে ওখানে ছিলেন।এত কম বয়সে আপনার মা- বাবার সান্নিধ্যে থাকার কথা। তা না করে চলে গেলেন খালামণির কাছে।তিনিও থাকতেন বাইরে। কাজের লোক ছিলো।তার দ্বারা আপনার জীবন প্রভাবিত হয়েছে।এটাও আপনার প্রকৃতি স্ববিরোধী হওয়ায় ভূমিকা রেখেছে।সে যাক,আরো কিছু প্রশ্ন করি,এবার এটা একান্তই ব্যক্তিগত।ধরুন,এই কথাটি ওই গাছ আপনাকে জিজ্ঞেস করছে এখানে আমি নেই। তাই নিশ্চিন্তে জবাব দেবেন।আনিকা চোখ বড় করে তৈমুরের প্রশ্নের জন্য ওর দিকে তাকিয়ে আছে।

 

তার হৃৎপিণ্ড এমনিতেই ধুকপুক করছে এসব শুনে। এখন আর কী শুনতে হবে কে জানে? তার অস্বস্তি হচ্ছে।।খারাপ লাগছে।ঘামছে একটু একটু।

কী বলতে চায় তৈমুর? আনিকা আগ্রহ নিয়ে বল্ল,আমি শুনছি আপনি বলুন।

দেখুন আনিকা,হয়তো এই কথায় আপনি বিব্রত হতে পারেন।তবে এটা আমার জানা জরুরী।এতে আপনার সাচ্ছন্দ্য জীবন যাপনের জন্য কিছু পরামর্শ দিতে পারবো।আমরা অলরেডি একটি ফান্ড গঠন করেছি এই গবেষণার জন্য। প্লিজ, আপনার হেল্প দরকার।

— আমার হেল্প?

–জ্বী

– তা কী ধরনের হেল্প চাচ্ছেন?  আর আমি কী করেই বা আপনাকে হেল্প করবো?

–প্লিজ আগে শুনুন।তারপর বলুন। বলুনতো,আপনি প্রেমে পড়েছেন? মানে আপনার কোন বয়ফ্রেন্ড আছে কী না বা ছিলো কী না?

— এটা জানা খুব জরুরী?

–হুম,জানা দরকার।

দেখুন,আমি প্রেম করিনি।আমার কোন ছেলেবন্ধু নেই।

— গুড,, প্রকৃতি স্ববিরোধীরা কখনো প্রেমে পড়ে না।পারে না।কারণ তাদের কোন অস্তিত্বই নেই। এদের চেনা অনেক উপায়ের মধ্যে এটিও একটি।তবে সমস্যা আরেক জায়গায়।এদের নিজের কোন অস্তিত্ব নেই বলে যে এরা অন্যরকম হয়রানির শিকার হবে না তা কিন্তু নয়।

–বুঝিনি।বুঝিয়ে বলুন।

আসলে আমি বলতে চাচ্ছি….তৈমুর একটু ইতস্তত 

করে।আনিকা কী ভেবে বসে কে জানে? এমনিতে মেয়েটিকে সে কিছু কথা বলে ফেলেছে।সেজন্য মেয়েটি প্রস্তুত ছিলো না। এখন বলতে যাওয়া কথাটির কী রিয়াক্ট হয় কে জানে? তবে তৈমুর ভাবে আনিকা যত কিছুই মনে করুক তাকে কথাটি বলা দরকার। তাছাড়া সে একজন ডাক্তার। জেনেটিক গবেষক ও কনসালটেন্ট ডাঃ জগলুল আলমের গবেষণা কার্যক্রমের বাংলাদেশ অঞ্চলের একজন সদস্য। তাদের বিভাগের কাজই হচ্ছে প্রকৃতির স্ববিরোধী হয়ে যারা জন্ম গ্রহণ করেছে তাদের খুঁজে বের করা।মেডিকেল সায়েন্সে এটি নিয়ে ব্যাপক আলোচনা, হৈ-চৈ হচ্ছে।পৃথিবী জুড়ে বিজ্ঞানী ও ডাক্তাররা একজোট হয়ে কাজ করছে প্রমাণ উপস্থাপনের জন্য। বলতে গেলে গবেষণাগার অপেক্ষায় আছে জীববৈচিত্র্যের আরেকটি নতুন অধ্যায় উন্মোচনের জন্য।সবাই যখন এমন মানুষ বের করার জন্য হণ্যে হয়ে ঘুরছে সেখানে আনিকাকে তার সম্মুখে নিয়ে এলো কোন দৈব?

তৈমুর আনিকার দিকে থির চোখে তাকিয়ে থাকে।এই প্রথম সে বুকের গহিনে একটি ধাক্বা খায়। সাগরের ঢেউ যেমন জলের নিচ থেকে ডুবে আবার ওপরে ভেসে  পাক খেতে খেতে সম্মুখে এগিয়ে বালিয়াড়িতে আছড়ে পড়ে তেমন করে কী যেনো তার ভেতর আছড়ে পড়ছে। এমনই হতে হবে? ‘প্রকৃতি স্ববিরোধ’ রূপে যাকে পেয়েছে সে নারীই হতে হবে? পুরুষ হলে কী এমন ক্ষতি হতো? কেনো আনিকার মতো এমন কান্তিময় মুখশ্রীকে সে পেলো? আর পেলোই যদি সে কেনো? আর কেউ ছিলো না? মেয়েটা এত সুন্দর!  মনে মনে আনিকার চোখ আলাদা করে তৈমুর। এত সুন্দর চোখ সে কখনো দেখেছে? না,সে মনে করতে পারে না।এরপর সে চোখ থেকে ভ্রূ আলাদা করে।কীসের সাথে তুলনা করবে সে এই ভ্রূযুগল? তৈমুরের চোখ প্রকৃতির ভেতর ঘুরতে থাকে।

আনিকার সৌন্দর্যের ভেতর তৈমুরের পৃথিবী  ভ্রমণ করে আসে। সে নুয়ে যায়।কী হয় ডাঃ তৈমুরের? আনিকার অন্তর্জালে কি আটকে যাচ্ছে সে?

দূর দিঘির পাড়ে থরে থরে সুসজ্জিত নারকেল বাগান। কচি সবুজ চিরল নারকেল পাতা আবিন্যস্ত আকাশের ওপর থেকে নিচু জমিনের দিকে ঝুৃঁকে হেলে আছে।ঠিক, আনিকার ভ্রূযুগলের মতো।অপূর্ব!তৈমুর আনিকার ঠোঁট,চিবুক,নাক প্রতিটি আলাদা করে দেখে। ওহহ!  এত সুন্দর একসাথে? অসহ্য! না,সব সুন্দর একসাথে থাকতে নেই।কিছু ত্রুটির দরকার।শারীরিক সৌন্দর্যে কিছু ত্রুটি থাকা চাই।এটাই প্রকৃতির নিয়ম।প্রকৃতিতে সৃষ্ট সকল সৃষ্টির হান্ড্রেড পারসেন্ট পারফেক্ট হয় না।হয় না মানে হয় না। এটাই সায়েন্সের যুক্তি। তবে, প্রকৃতির স্ববিরোধী যারা,তাদের বেলায় কী? হয়তো এটাই আবিষ্কার করতে চায় মেডিকেল সায়েন্স।প্রকৃতির বাইরেও আরেক প্রকৃতি আছে কী না এটা জানা গেলে আমূল পরিবর্তন আসবে পৃথিবীতে। 

এই পর্যন্ত বিজ্ঞানের যত আবিষ্কার আছে এটা আবিস্কার হলে জগতের সকল বিজ্ঞানী আর ডাক্তারদের পৃথিবী নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে  ।বিজ্ঞানীরা আজীবন যে প্যারালাল পৃথিবী নিয়ে ভাবছেন এই আবিষ্কার তাদের বিশ্বাস ও যুক্তিকে নতুনভাবে উপস্থাপন করার সুযোগ এনে দেবে। 

 

তৈমুররা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।যেখানেই এরকম মানুষ পাওয়া যাবে সাথে সাথে তারা মিঃ জগলুলকে কন্ট্যাক্ট করবে।এরকম কন্ডিশন আছে তাদের গবেষণাপত্রের মড্যুয়ুলে। তৈমুর কী করবে? ওর কষ্ট হচ্ছে খুব।শুধু ওর একটি কল বা যোগাযোগে……

— হ্যালো, মিঃ জগলুল! আমি ডাঃ তৈমুর বলছি ডিপার্টমেন্ট নং বারো, গবেষণা প্রোজেক্ট আট এর জুনিয়ার সহকারী,,আমার এলাকা রাউজানে দল পাঠাতে পারবেন? আমি ‘প্রকৃতি স্ববিরোধ’ একজন নারী পেয়েছি…….

ওহহ! কী হবে ব্যাপারটা তখন? মুহূর্তেই বাংলাদেশ হয়ে উঠবে পৃথিবীর শিরোনাম। তৈমুর হয়ে যাবে মহানায়ক।রাউজানে পুলিশ, মিডিয়া,বিমান,ডাক্তার, বিজ্ঞানীদের থৈ থৈ কাণ্ড আর রৈ রৈ ব্যাপার। সারা পৃথিবীতে একটিই খবর, বাংলাদেশ নামক একটি দেশে প্রকৃতির স্ববিরোধী মানুষ পাওয়া গেছে।যারা মানুষের মতো দেখতে অবিকল অথচ ওদের কোন নিজস্বতা নেই।এই নিয়ে কত গল্প, নাটক, কল্পিত কল্পনা তৈরী হবে। কেউ বলবে প্রকৃতি স্ববিরোধী বলে কিছু নেই।এ হচ্ছে এ্যালিয়েন।পৃথিবী ধ্বংস করার বিশেষ অনুজীব কোন গোপন শত্রু এই শিশুর ভেতর ঢুকিয়ে তাকে দিয়ে পৃথিবীর খবরাখবর আর কোন জগতে পাঠাচ্ছে।  এই এ্যালিয়েন এই পর্যন্ত পৃথিবীর কী কী খবর 

বহির্জগতে পাঠিয়েছে কে জানে? ওর মা- বাবার হিস্ট্রি চেক করো।ভাইবোনের সাথে ওর ডিএনএ কেমন রিলেটেড! আত্মীয়-স্বজন এমনকি তার শৈশব কৈশোর কিছুই রেহাই পাবে না।মোটকথা ভীষণ এক ডামাডোল 

শুরু হবে পৃথিবীতে। বাংলাদেশ আর বাংলাদেশ থাকবে না।আন্তর্জাতিক ইস্যুতে পরিণত হবে।রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক প্রোপাগান্ডায় বাংলাদেশ তখন ভীষণ দরকষাকষির মধ্যে পড়বে।সবচেয়ে ভয় মাফিয়াদের জন্য। আনিকা যে কোন

মুহূর্তে চুরি হয়ে যেতে পারে।ওর নিরাপত্তা কে দেবে? বাংলাদেশের সেই সামর্থ্য আছে?মাফিয়া ডনেরা লক্ষ লক্ষ বাংলাদেশ কেনার ক্ষমতা রাখে। মাফিয়া শুধু হীরাজহরত, অস্ত্র আর রাজনীতির ঝনঝনানিতে নয়, বিজ্ঞানী আর ডাক্তারদের মাঝেও আছে। তৈমুর শুনেছে বড় বড় গবেষণাগুলোয় মাফিয়াদের লগ্নি আছে।ওরা স্বনিয়ন্ত্রিত। আন্ডারগ্রাউন্ডে চলাচল ওদের। 

ওরা সম্পূর্ণ ধরাছোঁয়ার বাইরে।তৈমুরের ভয় হয়।

 তার নিজের জন্য। যদি কোনভাবে আনিকার ব্যাপারটা ফাঁস হয়ে যায় তাহলে তারও বাঁচার আশা ক্ষীণ।ডঃ জগলুল খুন হবেন।এমনকি তার ল্যাবরোটরি নিশ্চিহ্ন হওয়ার সম্ভাবনা আছে।পৃথিবীতে এত দেশ থাকতে কীনা প্রকৃতির স্ববিরোধী মানুষ বাংলাদেশই পাওয়া গেছে? আর কোন দেশ ছিলো না? ডঃ জগলুলকে কিনতে চাইবে পৃথিবীর রথি মহারথি বিজ্ঞানীরা। তিনি বিক্রি হবেন? কে জানে? যদি না হন? তিনি বিক্রি হলেই কি না হলেই কী? মাফিয়ারা খবর পেলে বিমান নিয়ে সোজা ঘ্যাটাং কচ করে নিয়ে যাবে আনিকাকে। হয়ত দু রাউন্ড গুলি খরচ হবে মিঃ জগলুলের জন্য। ব্যস আর কী!

নাহ্,এবার তৈমুর আর ভাবতে পারছে না।মেয়েটাকে যে করেই হোক তার প্রটেক্ট করতে হবে।যে করেই হোক।তাকে বোঝাতে হবে, সে যে প্রকৃতি স্ববিরোধী ভুলেও যেনো কারো কাছে একথা শেয়ার না করে।এমনকি তার মা -বাবা ভাই-বোন,আত্মীয় -স্বজনকেও না। সোজা কথা কাউকে না। তৈমুর আনিকার ভয়ার্ত মুখ কল্পনা করে। 

 

সে কল্পনায় দেখে তাকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে ওয়ার্লড সায়েন্স এন্ড রিসার্চ ইনভেস্টিগেশনস।ভয়ে মেয়েটা পুঁটলি হয়ে যাচ্ছে। কাঁদছে।আমাকে ছেড়ে দাও।আমাকে নিও না।আমি আমার মা – বাবা, ভাই-বোন রেখে কোথাও যাবো না।খালামণি,ও খালামণি!!!

আমি ছোটকালেও তোমার সাথে যাইনি।এখন এই বড়বেলায় আমার মা – বাবা, ভাই,-বোন ছেড়ে কোথায় যাচ্ছি? আমাকে ওদের হাত থেকে ছেড়ে আনো খালামণি?তৈমুর, আমাকে বাঁচান! বাঁচান তৈমুর!

 তৈমুর বিচলিত।তার চোখে মুখে শঙ্কা।এই একটি মেয়ের জন্য পুরো পৃথিবী জুড়ে যে ভূমিকম্প তৈরী হবে এটা যদি সে জানতো? অথচ ওরা কতো নিশ্চিত আর নির্ভরতায় এই দিঘির ঘাটে বসে আছে।

তৈমুরকে হঠাৎ চুপসে যেতে দেখে আনিকা বলে ওঠে,কী ব্যাপার? হঠাৎ চুপ হয়ে গেলেন? কী যেনো বলবেন বলেছিলেন?

আনিকার ডাকে তৈমুর সম্বিত ফিরে পায়।যাহ, কী সব আজেবাজে ভাবনা ভাবছে সে? কিন্তু দৃষ্টিতে ঠিকই উদাস চাউনি। তৈমুর বলে,

-জ্বী,না আসলে বলতে চেয়েছিলাম…

–জ্বী বলতে চেয়েছিলেন,বলুন! আমি শোনার অপেক্ষায় আছি।

— দেখুন আনিকা,আপনি যদিও প্রেমে পড়েননি, বা করেননি  বা আপনার বয়ফ্রেন্ড নেই এটা মেটার না।মেটার হচ্ছে আপনার মতো যারা তারা কোথাও না কোথাও সেক্সুয়াল হ্যারেসমেন্টের শিকার হয়।আমি সেই জিনিসটি জানতে চেয়েছি।আসলে আমার এই কথা বোঝার মতো আপনি যথেষ্ট এডাল্ট।

কিছু যদি মনে না করেন,আপনি—— কী—-এই ধরনের কিছু—-!

তৈমুরকে আর এগোতে দেয় না আনিকা।এখানে আর  থাকতে ভালো লাগছে না তার।গা গুলছে।পৃথিবী টলছে।মুহূর্তেই পৃথিবীকে অভিশপ্ত মনে হলো আনিকার।।মনে হলো পৃথিবীটা শয়তানের আস্ত এক কারখানা। এই পৃথিবীর সবাই শয়তান।সেও নির্ঘাত শয়তান।অভিশপ্ত। না হলে ওর বেলায় এমন হবে কেনো?

সে উঠে দাঁড়ায়।তৈমুরকে রেখে হাঁটতে থাকে।তার পা চলে না।একটার সাথে একটা ঠোকর খাচ্ছে।

আনিকাকে উঠে যেতে দেখে তৈমুর দৌড়ে আসে।প্লিজ, আনিকা যাবেন না আমার কথা শুনুন!আমার দরকার আছে।আপনি চুপ থাকবেন না।আপনাকে আমার অনেক কথা বলার আছে।

— সামনে থেকে সরুন,

— প্লিজ আনিকা! তৈমুর কাতর,আমি কি খুব কষ্ট দিয়ে ফেলেছি?সরি,আনিকা, আজ না হয় থাক,আরেকদিন বলবেন।

— আপনি আমাকে কি পেয়েছেন? গিনিপিগ?  গিনিপিগ হবো আপনার গবেষণার? আনিকার চোখে মুখে রাগ।

— প্লিজ, আনিকা যাবেন না! আপনার সাথে এটা ছাড়াও অনেক কথা আছে।

আনিকা তৈমুরকে আর কোন সুযোগ না দিয়ে দ্রুত সামনে হাঁটছে।

 

আনিকারা খেলছে।ওর চাচাতো বোন ময়না,রাঙা, হিরা,পান্নাদের সাথে। স্কুল থেকে এসে ব্যাগ রেখেই ওরা দৌড়ায়। কখন খেলবে।খেলা শেষে রাতে পড়া তৈরী করে খেয়ে দেয়ে যে যার মতো ঘুমাতে যায়।ওদের বড় পরিবার। বাড়িটিতে ওরা ছাড়াও ওর ফুফাতো ভাই বোনেরা থাকে।ওদের দূর সম্পর্কের বড় একটি ফুফাতো বোন আছে। স্বপ্না।স্বপ্না আপার কাছে একেকদিন একেকজন শোয়। ঘুমের মধ্যে একদিন আনিকা জেগে যায়।স্বপ্না আপু তার বুকের ওপর হাত বোলাচ্ছে। দুই হাত দিয়ে দুমড়ে মুচড়ে দিচ্ছে আনিকার স্তন।আনিকা তখন ছোট।স্বপ্নার হাতের চাপে সে ব্যথায় কঁকিয়ে ওঠে। ঘুমের ঘোরে আনিকা বলে,আপু কী করেন এসব? স্বপ্না বলে, এগুলো ব্যায়াম।এগুলো করলে শরীর ভালো থাকে।

–আপু, আমার এসব ভালো লাগে না।

–কী কস?

–হুম আপু।আমি ব্যথা পাই।আর আপনার সাথে যতবার ঘুমাই ততবার আপনি এসব করেন।আপনি এসব করেন কেনো?

–তোর সাথে কই আর এমন করলাম?তোর তো দেখি দুধই নাই।দুধ নাই মাইয়ার দেমাক দেখো।কয় ব্যথা পায়।

— আমি ব্যথা পাই বলেইতো বললাম!

ধুর যা!ময়নার সাথে মজা পাই।তোর চেয়ে বয়সে ও কত ছোট। তার শরীর গাট্টাগোট্টা। কাল থেকে তুই আমার কাছে শুবি না।ময়না শুবে।দে এখন আমার দুধই টিপে দে।এই বলে স্বপ্না আনিকার হাত স্বপ্নার বুকে চেপে ধরে।ছোট আনিকার সারা শরীর গিনগিন করে।গা গুলতে থাকে। ময়নার সাথেও এমন হয়? কী বললো স্বপ্না আপু? রাঙা,হীরা পান্না?ওরাওতো স্বপ্না আপুর কাছে শোয়। তাহলে?

স্বপ্না উঠে বসে।আনিকার হাত সরিয়ে হঠাৎ ওর মুখের ওপর ঝুঁকে বলে,বাহ,তোর ঠোঁটগুলানতো সুন্দর। দেখি দেখি!  এ্যাই, এইদিকে দেখ।আমার ঠোঁটগুলানও দেখ,বলেই স্বপ্না ঝুঁকে আসে আনিকার ঠোঁটের ওপর।

–আমি আম্মুকে সব বলে দেবো।সত্যি বলছি আপু, কালই আম্মুকে সব বলে দেবো।স্বপ্নাকে এরকম করতে দেখে আনিকা ভয় পেয়ে ওর মায়ের কথা মনে করে।

স্বপ্না থেমে যায়।আনিকার মুখে মায়ের কথা শুনে সে ভাবে,আরে মেয়ে বলে কী!

–তাই? মাকে বলবি? বলবি যে স্বপ্না আপু দুধ টেপায়,শরীর টেপায়, ঠোঁট টেপায়, এসব?

যা বল,দেখি তোর শরীরে হাড় কয়টা আছে? মেরে লাশ করে ফেলবো, বুঝলি? আর তুই বললে তোকেই মামী আগে মাইর দেবে।বলবে,সব মিথ্যা বানিয়ে বলছিস।তোর কথা বিশ্বাস করবে ভেবেছিস? আর আমার মাইরতো আছে।কয়দিকের মাইর খাবি! ভালো কথা মনোযোগ দিয়ে শুন,কাউকে বলবি তো জবাই হবি।বলে দিলাম।মনে থাকবে?

আনিকা জবাব দেয় না।

— কীরে কথা বলস না ক্যান? কী বলেছি মনে থাকবে?

আনিকার জবাব না পেয়ে স্বপ্না আনিকাকে একটা ঝাঁকি মারে।আনিকা একটু ব্যথা পেয়ে বলে, মনে থাকবে।স্বপ্না কবুতর পাঠের মতো আবার জিজ্ঞেস করে,কী মনে থাকবে? 

–আমি কাউকে জানাবো না।আনিকার জবাব।এইতো গুডগার্ল বলে স্বপ্না আনিকার আঙুল তার তলপেটে ঘষতে থাকে। পরদিন বিকেলে মাঠে খেলতে আসে সবাই।আনিকা বিমর্ষ বসে থাকে।

সবাই খেলছে।আনিকাকে খেলতে না দেখে পান্না এগিয়ে এসে বলে,কীরে! বসে আছিস একা,শরীর খারাপ?

— আপু একটু বসবে? পান্না ওর পাশে বসলে সে গতকাল রাতের সব কথা পান্নাকে বলে।পান্না শুনে মুখ নীচু করে থাকে।মাটি আঙুল দিয়ে খোঁচায়।জবাব দেয় না।

— কী ব্যাপার আপু,তুমি এসব জানো?পান্না মাথা দোলায়।

— জেনে চুপ ছিলে?কিছু বলোনি? 

–না,

– কেনো?

–কী করবো বল? তিনি মারবেন।ভয় দেখান।

ওদের কথা বলতে দেখে ময়না আর হীরা খেলা রেখে দৌড়ে এলো।

— কী ব্যাপার!তোমরা খেলা রেখে কী কী গুজুর গাজুর করছো?

আনিকা গতকালের ঘটনা বলে।আরো বলে,এসব তোমাদের সাথেও হয়।অথচ তোমরা তাকে কিছুই বলোনি।ময়না বলে,কি বলবো আমরা? আমাদের কাছেতো ভালোই লাগে।আর এটা বলার কী আছে?আর তাতে তোমার এত মন খারাপ হয় কেনো?

আমাদের মতো ভালো লাগাতে থাকো।দেখবে আরাম লাগবে।

আনিকা চরম বিস্মিত হয়।ছিঃ ছিঃ তোমরা এত খারাপ! আমি আর নেই তোমাদের সাথে। আনিকা উঠে দাঁড়ায়।ওদের সাথে থাকতে ওর ভালো লাগছে না। সে বাড়ির দিকে হাঁটছে।ওকে যেতে দেখে ময়না আর হীরা ব্যঙ্গ করে বলে,দেখো ভালো মানুষ যায়। ওদের কথা শুনে অন্যরা হো হো করে হেসে ওঠে।

 

 আনিকার নিজেকে খুব অসহায় লাগে ।প্রচন্ড ঘৃণা তাকে গিলছে এখন। কাছের মানুষগুলোর এমন আচরণ দেখে সে অবাক হয়।ধীরে ধীরে তার অবচেতনে এক ধরণের হতাশা,আতঙ্ক, অবিশ্বাস তৈরী হয়। নিজেকে অন্য কেউ মনে হওয়ার মতো বোধ ভেতরে ভেতরে জন্ম নিতে থাকে।

 

আনিকা টলতে টলতে বাসায় ঢুকে।ওর গা গুলতে থাকে। ওয়াসরুমে গিয়ে ওয়াক করেই বমি করে। আজ এত বছর পর তৈমুর জানতে চেয়েছে সে সেক্সচুয়াল হেরেন্সমেন্টের শিকার কী না? আনিকা কী করে এসব অতীত স্মৃতি তৈমুরকে বলবে?এ কি সম্ভব? কোন মেয়ে না,যদি কোন ছেলের জীবনেও এসব ঘটে সে ছেলেও কি এসব বলতে পারবে?স্বপ্না মেয়ে হয়ে যদি মেয়েদের সাথে এসব ঘটাতে পারে তবে এরকম ছেলেও নিশ্চয়ই আছে। যারা একইরকম কাজ করে।আনিকা আবার ওয়াক করেই বেসিনে দৌড়ালো।

এই দুঃসহ স্মৃতি আনিকা ভুলেই গিয়েছে।রাউজানে নিয়তি তাকে টেনে নিয়েছে অতীতে।টেনে  নিয়ে কী খেলা না  শুরু করেছে? আনিকা এই পৃথিবীর মানুষ।তবে দূর্লভ প্রজাতির।অন্তত তৈমুরের আকার ইঙ্গিতে এটাই স্পষ্ট। দূর্লভ প্রজাতির হয়ে সে কী করে এই মানুষপ্রজাতির ভেতর বসবাস করবে?তৈমুরের প্রতি আনিকার রাগ হয়।সে তাকে এসব না বললেও পারতো।আনিকা আর ভাবতে পারে না।

ক্লান্ত চোখে সে দূরে চেয়ে থাকে। আজ পাহাড়ও ধূসর লাগছে।চিরচেনা সবুজের ভেতর নিজেকে পান্ডুর বিবর্ণ হরিৎের মতো মনে হয়।বড় অচেনা লাগে সব। নিজেকে সে প্রশ্ন করে,আমি কে? কে আমি?

এই স্তব্ধ বিকেলে আচম্বিতে চারদিকে বিষন্নতাই ছড়িয়ে পড়ে। কোন জবাব আসে না। স্তব্ধ আনিকার কানে তৈমুরের কথাগুলোই ভাসে।সে প্রাকৃতিক স্ববিরোধী। 

যদি মিলে যায় সে সেক্সুয়াল হেরেসমেন্টের শিকার   তাহলে আনিকা কি তৈমুরের গিনিপিগ হবে?

 

আনিকা আর কিছু ভাবতে চায় না।ভাববেও না।সে ওঠে।টেবিল ল্যাম্পের নিচে রাখা ছোট্ট ব্যাগটি নিয়ে  বের হয়ে আসে।এখানে আর একদণ্ড নয়।যত তারাতাড়ি সম্ভব এখান থেকে যেতে পারলে বাঁচে।

তৈমুর কী ভাবছে এখন তাকে নিয়ে?তার এই চলে আসায় সবাই অবাক হবে।সবার চেয়ে বেশি হবে তৈমুর।হয়তো নিজেকে অপরাধীও ভাববে।তার জন্যই আনিকা চলে গেছে। আনিকা নিজে নিজে বলে, ভাবুক,যার যা খুশি ভাবুক। অনেক চিন্তা আর ভাবনার ভেতর খুব শূন্যতা আর একাকীত্ব গ্রাস করে আনিকাকে।

ওইদিকে তৈমুর ঘাটলায় বসে আনিকাকে নিয়ে কত কী ভাবছে।মেয়েটিকে ভালোবাসছে। যে মেয়েটির কোন অস্তিত্বই নেই। তৈমুরের অস্তিত্ব দিয়ে আনিকাকে নিজের করে নেবে এরকম ভাবনায় সে ঘুরপাক খাচ্ছে। একমাত্র তৈমুর ছাড়া এই মেয়েটিকে কেউ রক্ষা করতে পারবে না। তৈমুরের সকল অস্তিত্ব কপি করে দেবে আনিকার ভেতর।পৃথিবীর আর কেউ বুঝতে পারবে না আনিকার ভেতর একটি পুরুষের প্রবাহ বিরাজমান।পৃথিবীও জানতে পারবে না তার গর্ভের ভেতরই লুকিয়ে গেছে ‘প্রাকৃতিক স্ববিরোধ’ কোন বিশেষ প্রাণী।

তৈমুরের এসব কথা তার ভাবনার ভেতরই রয়ে গেলো।বাসায় এসে দেখে বিশাল এক শূণ্যতার গহবরে দুলছে তৈমুরের পৃথিবী।

 

 

রোখসানা ইয়াসমিন মণি। জন্ম ১৫ মার্চ কুমিল্লা জেলার  লাকসাম উপজেলার ডোমবাড়িয়া নামক গ্রামে।কবিতা দিয়ে লেখালেখি শুরু হলেও তিনি গল্প, উপন্যাস লিখেন।দুটি গল্পগ্রন্থ এবং একটি সায়েন্স ফিকশন উপন্যাসসহ প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা তিন। জাতীয় দৈনিক এবং লিটল ম্যাগাজিনে লেখালেখি ছাড়াও আন্তর্জাতিক সাহিত্য পত্রিকায় নিয়মিত লিখছেন।তিনি বাংলাদেশ বেতারের তালিকাভূক্ত গীতিকার ও  আবৃত্তিশিল্পি হিসেবে কাজ করছেন।

রোখসানা ইয়াসমিন মণি
গল্পকার

Leave a Reply