শব্দকুঞ্জ ঈদসংখ্যা-২০২৪
গল্প: ইউটিউব প্রেম
শফিক হাসান
শব্দকুঞ্জ ঈদসংখ্যা-২০২৪
গল্প
ইউটিউব প্রেম
শফিক হাসান
‘ঝুট-ঝামেলা নয় একার, থাকব না আর বেকার’ এমন আপ্তবাক্যে দীক্ষিত কুতুবুদ্দিন পাটোয়ারী সামান্য প্রশিক্ষণ নেওয়ার পরপরই ইউটিউবে নিজস্ব চ্যানেল খুলে ফেলল। যদিও সে এটাকে ওয়াইটিউব হিসেবে পরিচিত করাতে চায়। এত লোক ইউটিউবে কনটেন্ট বানায়, তারটা আলাদাভাবে দেখবে কেন! ইয়ুথ শব্দের আদ্যক্ষর ওয়াই, মানে ইউটিউবে তরুণ প্রজন্ম পছন্দ করে এমন কনটেন্টই বেশি আপলোড করবে। আর দেখাতে হবে, চটকদার বিষয়। যেটা সচরাচর ঘটে না। এমন দৃশ্যায়নের সন্নিবেশ ঘটানো গেলেই তরুণ ও অতরুণ প্রজন্ম এটাকে লুফে নেবে।
মানুষের কামড়ে কুকুর আহত, তরুণীর কামড়ে বিষাক্ত সাপ হাসপাতালে, বৃদ্ধের লাথি খেয়ে গরু নিহত, উচ্ছন্নে যাচ্ছে দুধের শিশু সমাজÑ এমন অদ্বিতীয় কনটেন্ট দিতে হবে বেশি বেশি।
মেট্রোরেল নিয়ে চটকদার সচিত্র প্রতিবেদন খুব বেশি হয়নি। অথচ এটা এখন আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে। আগামীতে ভ্যাটের আওতায় আসছে, সেক্ষেত্রে ভাড়ার পরিমাণ আরও বাড়লে কী করবেন মধ্যবিত্ত ও বিত্তহীন যাত্রীরা! এমন গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক বক্তব্যও ফাঁকতালে পেশ করা হবে।
পরিকল্পনামতো প্রথমবারের মতো মেট্রোরেলে উঠেই ভড়কে যাওয়ার অবস্থা হলো কুতুবুদ্দিনের। তিল ঠাঁই কোথাও নাই, মানুষজন নাকটা তুলে রেখেছে ছাদ বরাবর, যেন দম বন্ধ হয়ে না যায়! কিন্তু কুতুবুদ্দিনের থেমে থাকলে তো চলবে না! একে তাকে ওকে ঠেলা-গুঁতা দিয়ে ভিডিও শুরু করল কুতুবুদ্দিন, সঙ্গে যাচ্ছে তার মুখ নিসৃত অমূল্য বাণী। প্রমিত বাংলায় বলার চেষ্টা করল প্রাণপণÑ ‘বন্ধুরা, দেখতেই পাচ্ছেন মেট্রোরেলে কী পরিমাণ হাউকাউ। মাছের বাজারের মতো অবস্থা। এমন অবস্থা চলতে থাকলে এটা ভবিষ্যতে আরও জনবহুল এলাকা হয়ে উঠবে না? গাঁদা ফুলও এতটা গাদাগাদি করে থাকে না; আবার যদি ঘনবসতির কথা বলি…।’
কথার মাঝখানেই মোবাইল ফোনটা কে যেন ছোঁ মেরে নিয়ে গেল! কুতুব ‘আমার ফোন আমার প্রোগ্রাম’ বলে চেঁচামেচি করলেও লোকজন তেমন সাড়া দিল না। বরং ‘কেমন জব্দ’ ভাব নিয়ে নির্বিকার রইল। যাত্রীরা কেউই বোধকরি ওর উপস্থাপনা পছন্দ করতে পারেনি! দুঃখের মধ্যেও একটা থিম এল কুতুবুদ্দিনের মাথায়। ‘মেট্রোরেলে প্রেম, আন্তঃনগর ট্রেনে বিয়ে’ এমন থিম নিয়ে নাটক বানালে দারুণভাবে জমবে! ওর জানামতে, এখনো কেউ মেট্রোরেলকে প্রাধান্য দিয়ে নাটক নির্মাণ করেনি। গল্পচিত্রটা কীভাবে সাজানো যায়, ভাবতে ভাবতে বাসায় পৌঁছাল সে। পোশাক পাল্টাতে গিয়ে আরেকবার হতভম্ব দশায় পড়ল। মোবাইল ফোন ছিনতাই হলো কীভাবে, প্যান্টের পকেটেই পাওয়া গেল! কিন্তু কীভাবে গেল সেখানে? প্রশ্নের জবাব পেতে সময় লাগল না। ঘনিষ্ঠ বন্ধু তোজাম্মেল এসএমএস করেছেÑ ‘পাবলিক প্লেসে যদি আর কখনো বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করিস, তোকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়ে তোর ফোন দিয়েই সেটা লাইভ করে দেশবাসীকে দেখাব!’
এটা মন্দের ভালো। ফোনটা ফেরত পাওয়া গেছে। তোজাম্মেল দেখতে-শুনতে ভালো, মেট্রোরেলের নাটকটায় নায়ক বানিয়ে দিলে আপত্তি করবে বলে মনে হয় না। পারিশ্রমিকও দেওয়া লাগবে না। মনে মনে উৎফুল্ল হয়ে উঠল কুতুবুদ্দিন। কিছুদিন পর ‘ট্রেনের বাড়ি উত্তরায় নাকি মতিঝিলে’ নাম দিয়ে প্রথম কনটেন্ট আপলোড করল। নির্মাতা, প্রযোজন ও উপস্থাপক হিসেবে কুতুবুদ্দিনের নাম ও ফোন নম্বর স্ক্রলে গেল। সেখান থেকেই নম্বর নিয়ে কল করল কিন্নর কণ্ঠী একজন। সোজা কথায় বিশ্বাসী সে; বলল, ‘আপনার সঙ্গে সরাসরি কথা বলা যাবে? জরুরি আলাপ আছে।’
কুতুবুদ্দিন খুশিই হলো কণ্ঠ শুনে। প্রেমিকা ভেগে গেছে। এখন যদি আরেকটা জুটে যায়, মন্দ কী! আবেগ লুকিয়ে রেখে বলল, ‘আচ্ছা। ঠিকানা দিচ্ছি। চলে আসুন।’
‘আপনার বাসা কি মেট্রোরেল স্টপেজের পাশে?’
‘না। তবে অনুমতি দিলে আমিই আসতে পারি আপনার কাছে। মেট্রোরেল বা বাস স্টপেজ থেকে দূরে হলেও সমস্যা নেই আমার।’
‘আপনি এলেই ভালো হয়। বোঝেনই তো, ঘরে-বাইরে সুন্দরীদের কত বিপদ! ঠিকানা টেক্সট করে দিচ্ছি।’
করিমা কর্ণিকা তার নামের মতোই সুন্দর। বলার সময়ও বাড়িয়ে বলেনি। এমন মেয়ে বিপদে না পড়াটাই অস্বাভাবিক। কুতুবুদ্দিন কোনো কিছু গোপন না করে সব খুলে বলল। কোন জ্বালায় তাকে ওয়াইটিউবার হতে হলো।
করিমা কর্ণিকা আশ্বস্ত করে বলল, ‘আমার সঙ্গে পরিচয় হয়েছে, এখন থেকে আপনার টাকার অভাব হবে না। আপনি আমার দিকটা দেখবেন, আপনার দিকটা আমি দেখছি। ফিনানশিয়াল সাপোর্ট তো পাবেনই, অন্য কোনো সাপোর্ট চাইলে সেটাও পাবেন।’
জন-প্রিয়া নায়িকা হতে ইচ্ছুক করিমা কর্ণিকা কুতুবুদ্দিনের ভরণপোষণের দায়িত্ব নেয়। মাস শেষে ভালো অংকের টাকা দেবে। বিনিময়ে তাকে নাটক ও মিউজিক ভিডিওর নায়িকা বানিয়ে দিতে হবে।
এতদিনে কুতুবুদ্দিনের আত্মবিশ্বাস বেড়েছে কিছুটা। সেটার সঙ্গে চাপা যুক্ত করে বলল, ‘ভালো শিক্ষকরা কত গাধা-ঘোড়া পিটিয়ে মানুষ বানিয়ে দেয়, আর আমি আপনাকে নায়িকা বানাতে পারব না! এই দেশের তরুণ থেকে বৃদ্ধরা পর্যন্ত আপনাকে দেখার জন্য উতলা হয়ে থাকবে, তাদের হৃদয়ের দেবী করে রাখবে।’
‘আমি সেটাই চাই, কুতুব ভাই। দেবী আমি রানিও আমি, নহি কোনো সামান্যা নারী। এটাই তো আমার জীবনের স্বপ্ন!’
আবেগের আতিশয্যে করিমা কর্ণিকা হাত আঁকড়ে ধরল কুতুবুদ্দিনের।
‘টপ টু বটম সব নায়ক আপনার সঙ্গে অভিনয় করতে আসবে। তাদের আসতেই হবে। এদিকটা আমি ম্যানেজ করব। আবার মিডিয়াগুলো ব্যস্ত থাকবে করিমা কর্ণিকার সুনাম প্রচারের জন্য!’
কুতুবুদ্দিন যেভাবে ভেবেছিল, সেভাবে এগোল না কাজটা। তিন মাসের মাথায় করিমা কর্ণিকা একপ্রকার ধমকই দিল মোবাইল ফোনে। যুগপৎ উষ্মা-রাগ ঝেড়ে বললÑ ‘কী করছেন আপনি কুতুব ভাই, দৈনিক সন্ধ্যার আবছায়া পত্রিকায় আমার ছবিসহ কোনো নিউজ এখনো এল না কেন? অথচ এত সুন্দর অভিনয় করি! শিল্প ও শিল্পীর মূল্য কি এতই কম?’
বোঝানোর চেষ্টা করে কুতুবুদ্দিন বলে, ‘দেখুন, সন্ধ্যার আবছায়া পত্রিকায় আপনার নিউজটা প্রকাশ না করলে আমি কী করতে পারি? পত্রিকাটা তো আমার বাবার নয়।’
‘তা হবে কেন? ফকিরের ছেলের আর কী থাকবে, হাত পেতে টাকা নেওয়ার মুরোদ ছাড়া!’
হতভম্ব হয়ে গেল কুতুবুদ্দিন। এসব কী শুনছে সে? এত সুন্দরী একটা মেয়ে, এমন বিশ্রী কথা কীভাবে উচ্চারণ করে! নিজেকে সংযত রাখার চেষ্টা করে সে বলে, ‘আমি চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। অথচ আপনি আমাকে অপমান করছেন, করিমা!’
‘আর আপনি বুঝি আমাকে খুব মানে-সম্মানে রেখেছেন! তিন মাসে আপনাকে দুই লাখ টাকা দেওয়া শেষ, অথচ এখনো আমার জনপ্রিয় তারকা হওয়ার কোনো লক্ষণই নেই! টেলিভিশনে দেখায় না, খবরের কাগজে রঙিন ছবি ছাপায় না।’
‘হতাশ হওয়ার কিছু দেখছি না। ইউটিউব প্রেম নাটকটা রিলিজ হোক, তারপর দেখবেন জনপ্রিয়তা কাকে বলে! আপনি হয়ে উঠবেন প্রজন্মের মানসপ্রতিমা।’
‘এসব আমার আরও আগেই দেখা হয়ে গেছে মি. কুতুবুদ্দিন পাটোয়ারী! টুথপেস্টের টিউব আর ইউটিউব হচ্ছে তীরের মতো বিষয়, বেরিয়ে গেলে আর ফেরানো যায় না! যা করার প্রথমবারেই করতে হয়। আপনার যে অবস্থা দেখছি, আমার মনে হয় না বেশিদূর এগোতে পারবেন। ভেবেছিলাম আপনি পারবেন, আবার আমার কপাল পুড়ল!’
এবার ধন্দে পড়ে গেল কুতুবুদ্দিন। শেষমেশ যদি এই চাকরিও চলে যায়, কী করবে সে! এখন পর্যন্ত কোনো মৌলিক কনটেন্ট বানাতে পারেনি। বাধ্য হয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু মনসুরকে আচ্ছা করে ধরে, সে ইউটিউবের নিয়মিত দর্শক। চাইলে ভালো কোনো থিম দিতে পারবে। দ্য নিউ সে কনটেন্টের ভিউ হবে ফাটাফাটি। কিন্তু কীসের কী! মনসুর শর্ত দিয়ে বসলÑ ‘সব পাবি, আগে আমার প্রেমিকা মালবিকাকে নিয়ে একটা তথ্যচিত্র বানিয়ে দে! কৌশলে সেখানে আমার নামও উল্লেখ করবি। কখনো মালবিকা যদি আমাকে ছেড়ে যাওয়ার পাঁয়তারা করে, ভিডিওটা ভাইরাল করে দেওয়ার হুমকি দিয়ে ওকে যেন সহজেই ফেরাতে পারি!’
দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল কুতুবুদ্দিন। সেন্সর বোর্ডহীন ইউটিউবেও এত প্যাঁচ আর এত জ্বালা থাকে! একটা টেস্টটিউব ব্যবহার করা গেলে উটকো ঝামেলাগুলো এড়াতে পারত। শেষে যেন কেউ পল্টি দিতে না পারে। কিন্তু এমন টেস্টটিউবের নাগাল কোথায় পাবে সে। আদৌ আবিষ্কার হয়েছে কি এমন কোনো জিনিস!
শফিক হাসান
কবি, গল্পকার ও রম্যলেখক