শব্দকুঞ্জ ঈদসংখ্যা-২০২৪
ঈদস্মৃতি
শৈশবের আর্শিতে আমার ঈদ
তৌফিকুল ইসলাম চৌধুরী
শব্দকুঞ্জ ঈদসংখ্যা-২০২৪
শৈশবের আর্শিতে আমার ঈদ
তৌফিকুল ইসলাম চৌধুরী
ঈদ আমাদের এক মহা সুখানুভুতির দিন। আমরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতাম একমাস সিয়াম সাধনা শেষে কখন আকাশে বাঁকা চাঁদ ঈদের আগমন বার্তা নিয়ে আসবে। তখন আমাদের মত শিশুদের চাঁদ দেখার জন্য সে কি মহা আয়োজন! আমরা দলবদ্ধভাবে পশ্চিম আকাশের দিকে দৃষ্টি প্রসারিত করতাম — ঐ বুঝি ঈদের চাঁদ দেখা গেল। পশ্চিমাকাশে অপলক নেত্রে অনেক খোঁজাখুজির পর যেই না ছোট্র একফালি চাঁদের দেখা মিলতো, তখন আমাদের আনন্দ দেখে কে ! আমাদের সেকি হৈচৈ হট্রগোল। আমরা সমবেত কন্ঠে তকবির ধ্বণি করতাম, ‘ঈদ মোবারক আস্ সালাম’। তখন কে ধনী আর কেই’বা দরিদ্র — এ ধরনের কোন বৈষম্য আমাদের স্পর্শ করতো না। আমাদের বাঁধ ভাঙ্গা আনন্দ দেখে বড়রা মুচকি হাসতেন।
চাঁদ দেখা শেষে ঘরের দিকে ভোঁ দৌড়। ঘরে তখন প্লেটে সাজিয়ে রাখা হয়েছে হাতে কাটা গুরা পিঠা বা চিকন পিঠা। পিঠা গলদকরণ করে তৃপ্তির ঢেকুর তুলে টিভি- রেডিও সেটের সামনে বসতেই কানে ভেসে আসতো কবি নজরুলের কালজয়ী সে গান — ‘ ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এল খুশীর ঈদ ‘। ঈদের আগমনে বাঁধ ভাঙ্গা খুশীর আমেজ আছড়ে পড়তো গ্রাম -গ্রামান্তরে।
চাঁদ রাতে আমাদের এই যে অনাবিল আনন্দ, তা কিন্তু চট্রগ্রামের হাজার বছরের ঐতিহ্য। আবুল ফজলের ‘ আইন-ই-আকবরী ‘ গ্রন্হ থেকে জানা যায়, শাওয়াল মাসের চাঁদ দেখা গেলে চট্রগ্রামের নারী-পুরুষ সকলেই খুশীতে উদ্বেলিত হয়ে ওঠে। নানা কিসিমের আতস বাজি পোড়ায়। গেরস্তের নারীরা রাতভর রান্না ঘরে ব্যস্ত থাকে। কেউ বা পিঠা বানায়। কেউ বা সেমাই , ফিরনী, জর্দা, পায়েস — আরো কত কি! শহরের কুট্টিরা চাঁদরাতে তাদের সন্তানদের নিয়ে প্রয়োজনীয় কেনাকাটা সেরে নেয়। আমরা শিশুরা পিতা বা বড় ভাইয়ের সাথে কয়েক রোজার পর ঈদের কাপড় কেনা-কাটায় ব্যস্ত হয়ে পড়তাম। তখন কাপড় কেনা -কাটায় পোষাকের এত ষ্টাইল ছিল না। নতুন একটা শাূট, টুপী ও পায়জামা বা লুঙ্গি, সাথে একজোড়া সেণ্ডেল হলেই চলতো। তবে আমার বাবা আমাদের পিঠাপিঠি কয়েক ভাই-বোনের জন্য হরেক রকম সুন্দর সুন্দর জামা-কাপড় কিনে দিতেন। আর পায়ের জন্য নতুন সু- সেণ্ডেলও। সেগুলো ঈদের পূর্বে অন্যরা যাতে না দেখে, সেজন্য লুকিয়ে রাখতাম। মাঝে মাঝে কাপড়গুলো দেখতাম আর নতুন কাপড়ের খুশবু শুকতাম। কার জামাটা বেশী সুন্দর — তা নিয়েই আমরা আনন্দে আত্নহারা থাকতাম, খুনসুটি করতাম।
ঈদের আগের দিন ঈদের দিনের জন্য বাড়ির উঠোন ঝাড়ু দিয়ে পরিস্কার – পরিচ্ছন্ন করা হতো। যাদের ঘর মাটির, তাদের ঘর লেপার ধূম পড়তো। ঘরের সবকিছু ধুয়ে-মুছে ঝক্ ঝকে –তকতকে করে রাখা হতো। মানুষের বসার ঘর — কাচারী ঘরে সবকিছু তরে তরে সাজিয়ে রাখা হতো।
শৈশবের দিনগুলোর বা আয়োজনের কথামনে পড়লে এখনো মন হু হু করে উঠে। আমাদের গ্রামের নাম সুলতানপুর। সুলতানপুরের প্রসিদ্ধ হাজি বাড়িতে আমার জন্ম। এ বাড়িতে ১৯৩৩ সালে বিদ্রোহী কবি নজরুল তিনদিন হাজিবাড়ির আতিত্য গ্রহন করেছিলেন। এ বাড়ির আমার ছোটবেলার বন্ধুদের সকলেই এখন উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত, সমাজে প্রতিষ্টিত। নাগরিক জীবনের প্রচণ্ড কোলাহলে তাদের কাছে সে দিনগুলোর কথা মনে আছে কিনা জানি না। তবে আমার বেশ মনে আছে, গোপাল নাপিত আমাদের চুল কেটে সুন্দর অবয়ব দান করতো।
ঈদের দিন খুব ভোরে আমরা নতুন কাপড় পড়ে ছোটাছোটি করতাম। সকাল ০৮টার দিকে আমরা বন্ধুদের সাথে নিয়ে বড়দের সাথে ‘ মারহাবা ইয়া ঈদ মোবারক মারহাবা ‘ ধ্বণি তুলে ঈদগাহের দিকে ছুটতাম। আমাদের একটা ক্লাব ছিল, নাম “নতুনের কেতন “। সে ক্লাবের সিনিয়র বন্ধুরা একটা ছোট্র টিনের কৌটার মাঝে ছিদ্র করে ঐ কৌটায় চাঁদা চাইতো । দুআনা, এক আনা, সিকি, আধুলি, একটাকা, পাঁচটাকা— যে যা দিত তা দিয়ে ক্লাবের মাধ্যমে পরে নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হতো । পুরস্কার দেয়া হতো।
ঈদের নামাজ শেষে আমরা পরস্পর কোলাকুলি, ঈদগাহে বড়দের পায়ে ধরে সালাম করতাম। তারপর সবাই একজোট হয়ে একসাথে বেশ কয়েকজন মিলে এ’ ঘর ও’ঘর, এ’বাড়ি ও’বাড়ি ছুটে যেতাম। পেট ভরে সেমাই, পোলাও, ফিরনী ও হরেক রকম নাস্তা খেতাম। ঘরে গিয়ে বড়দের পায়ে ধরে সেলাম করলে সেলামী মিলতো। সেলামীর জন্য আমাদের সে-কি হুড়োহুড়ি। পরে সেলামীর টাকা দিয়ে রিক্সায় চড়ে দূরের আত্নীয়দের বাসায় বেড়াতে যেতাম, নানা জিনিষ কেনাকাটা করতাম। বিভিন্ন খেলনা কিনতাম। রিক্সাওয়ালা রিক্সায় উঠাত মাথা গুনে গুনে এবং মাথাপিছু টাকা দিয়ে ভাড়া আদায় করতে হতো।
আমাদের বাড়িতে ঈদের দিন বিকেলে খেলাধূলার আয়োজন করা হতো। এতে আমরা ছাড়াও ঘরের বৌ-ঝি’রাও অংশ গ্রহন করতো। এ স্পোট্সের উদ্যোক্তা আমার বাবা মরহুম মোজাহেরুল ইসলাম চৌধুরী ও জেঠা মরহুম সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। উনাদের উৎসাহ ও অনুপ্রেরণায় এ রেওয়াজ তাদের জীবদ্দশায় পুরো সময়টা চালু ছিল । অবশ্য তাদের মৃত্যুর পর তা আর হয়ে ওঠে নি, যদিও পরবর্তী প্রজন্মের কেউ কেউ তা চালু রাখার প্রয়াস চালান।
ঈদের দিন সন্ধ্যায় হারিকেন বা কুঁপি জ্বালিয়ে বসতো পুঁথি পাঠের আসর। বাড়ির উঠোনে সামিয়ানা টাঙ্গিয়ে তার নীচে সকলে বিশেষ করে আমরা শিশুরা জটলা করে বসে পুঁথি পাঠ শুনতাম। পুঁথি পাঠ করতেন লুলু কাকা। তিনি প্রথমে সুর করে পুঁথি পাঠ শুরু করতেন, অতঃপর আঞ্চলিক ভাষায় তা অনুবাদ করে গল্প আকারে শুনাতেন। তার পুঁথির বিষয়বস্তু রুপকথার গল্পকেও হার মানাতো। অনেক রাত পর্যন্ত পুঁথি শুনে রাতে বড়দের সাথে ঘরে ফিরে ঘুমাতাম। ঘুমের ঘোরে স্বপ্ন দেখতাম, পাতালপুরীর পরী রাজকন্যা তার পাখনায় করে আমাদের নিয়ে যাচ্ছে পরীস্হানে।
ঈদের পরদিন বাড়ি থেকে দূরবর্তী পূর্ব রাউজান রবার বাগান এলাকায় আয়োজন করা হতো পিকনিকের। আমার বাবা ও জেঠার আয়োজনে বহু বছর তা চালু ছিল। কিন্তু একবার আমার জেঠাতো-ভাইয়ের সিগারেটের আগুনে বাগানে আগুন ধরে গেলে তা পরিত্যক্ত হয়।
আমরা ঈদের পর বেশ কয়েকদিন ধরে আত্নীয়-স্বজনদের বাসায় বেড়াতাম। তারা আমাদের পেয়ে বেশ স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতো। এখন আর সেদিন নেই। ব্যক্তি স্বাতন্ত্রের এ যুগে মানুষের বেড়ানোর পরিধি ও সময় যেন অনেক সীমিত হয়ে এসেছে। মানুষ ঘরে ঘরে বা বাড়ি বাড়ি বেড়ানোর চেয়ে ঘরে বসে রেডিও-টিভির ৫/৭ দিনব্যাপী ঈদ আয়োজন, ফেসবুক, ইন্টারনেট নিয়েই ব্যস্ত থাকতে বেশী পছন্দ করছে। সুযোগ পেলে ছুটে যাচ্ছে দূরের কোন পর্যটন কেন্দ্রে। এখনকার ঈদে জাঁকজমক-আড়ম্বর থাকলেও আমাদের ছেলেবেলার গ্রামের সেই আন্তরিকতার ছোঁয়ায় যেন ভাটা পড়েছে। সবকিছু মনে হয় বড় বেশী মেকি।
লেখকঃ বাংলাদেশের প্রাবন্ধিক, গবেষক ও কবি।
তৌফিকুল ইসলাম চৌধুরী বাংলাদেশের সাহিত্য জগতের এক পরিচিত মুখ। বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক হিসেবে তিনি যেমন নন্দিত, তেমনি নিষ্ঠাবান গবেষক হিসেবেও সমাদৃত। কবিতায়ও তার পারঙ্গমতা লক্ষণীয়। শুদ্ধ সাহিত্যের প্রতি নিবেদিতপ্রাণ এ লেখক নিরবচ্ছিন্ন লেখালেখির মাধ্যমে ইতোমধ্যেই প্রদর্শন করতে সক্ষম হয়েছেন তার বহুমাত্রিক সৃজন কুশলতা। তিনি ৭ এপ্রিল ১৯৫৭ সালে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম জেলার রাউজান পৌরসভার ৮নং ওয়ার্ডে ‘বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুলের স্মৃতিধন্য’ হাজীবাড়িতে জন্মগ্রহন করেন। মাতৃকূলে তিনি মধ্যযুগের শেষপাদের কবি বাকের আলী চৌধুরীর সরাসরি অধঃস্তন পুরুষ। তার পেশাগত জীবনের শুরু “সহ- সম্পাদক” হিসেবে সাংবাদিকতা পেশা গ্রহনের মাধ্যমে । পরবর্তীতে জীবিকার প্রয়োজনে বিভিন্ন শিল্প- কারখানা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের উচ্চতর পদে তার চাকরী জীবন আবর্তিত হলেও তার চেতনার গভীরে লুকিয়ে থাকা এক গভীর সংবেদনশীল স্বপ্নবিলাসী লেখক- মন তাকে প্রতিনিয়ত তাড়িত করে। আর এ তাড়না থেকেই লেখনীর মাধ্যমে তিনি স্বপ্নের কল্পছোঁয়ায় বাস্তবতাকে নিয়ে যান মোহনীয় এক অলৌকিক ভুবনে, যেখানে পাঠক খুঁজে পায় তার নিজের চেনা জগত, জীবন আর কর্মক্ষেত্র ।
তার সাহিত্যাঙ্গনে অভিষেক ঘটে ছড়া লেখার মাধ্যমে, সত্তর দশকের প্রখ্যাত ছড়াকার অকাল প্রয়াত বখতেয়ার হোসেনের হাত ধরে। তখন তিনি সপ্তম শ্রেণীর ছাত্র। এক সময় তিনি ঝুঁকে পড়েন প্রবন্ধ চর্চায়। প্রখর অন্তর্ভেদী নিরীক্ষণ ক্ষমতার অধিকারী এ লেখকের গদ্য সাহিত্যে সৃষ্টিশীলতা ঈর্ষণীয়। কবিতা, ছড়া, গল্প, অনুবাদ–সাহিত্যের এসব শাখাতেও তার স্বাচ্ছন্দ্য ও স্বতস্ফূর্ত বিচরণ দেখা যায় । স্বভাবে অন্তর্মুখী ও নিভৃতচারী এই লেখক প্রচুর লেখাপড়া করেন, তার লেখনীতে তা স্পষ্ট– যা সচেতন পাঠকদের দৃষ্টি এড়ায় না। তার তথ্যসমৃদ্ধ, জীবন ঘনিষ্ট, সহজবোধ্য সাবলীল লেখায় এক ধরনের সম্মোহনী নিজস্বতা থাকে, যা পাঠককে তার সৃষ্টি বলয়ে নিবিষ্ট রাখে। শিক্ষাক্ষেত্রে বি এ (অনার্স), এম এ ডিগ্রীধারী এ ব্যক্তিত্ব নানা বিষয়ে বই লিখে ইতোমধ্যেই সাহিত্যাঙ্গনে সুসংহত অবস্হনে চলে এসেছেন, যা তাকে জাতিয় পর্যায়ের লেখক হিসেবে পরিচিতি এনে দিয়েছে। দেশের বাইরেও কানাডা, ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, চীন, আয়ারল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশে সাহিত্যিক হিসেবে বিশেষত বাংলা ভাষাভাষিদের মধ্যে তার গ্রহনযোগ্যতা রয়েছে। একারণে বিদেশেও অনেক উচ্চ মানসম্পন্ন জার্নালে তার লেখা প্রকাশিত হয়েছে এবং হচ্ছে। তার মানসম্পন্ন ও পাঠক-নন্দিত গ্রন্হে প্রতিটির একাধিক সংস্করণ, এমনকি কোন কোনটির সংস্করণের পর সংস্করণও বেরুয়।
তার প্রকাশিত গ্রন্হসমুহের মধ্যে ‘সাহিত্য ভুবনের কীর্তিমান সারথি ( প্রবন্ধ), পানপাত্রে দ্রাক্ষারস( কবিতা) , অচেনা মহাকাশঃ ভেতরের কথা( প্রবন্ধ), ভিনগ্রহের প্রাণী ও মানব জাতি( প্রবন্ধ), চট্টগ্রামঃ অতীত ও ঐতিহ্য (প্রবন্ধ), বাংলাদেশ (১৮৫৭-১৯৭১)ঃ সরকার রাজনীতি ও গণতন্ত্র চর্চা (প্রবন্ধ), বাংলাদেশে সরকার ও রাজনীতির চালচিত্র (১৯৭১-১৯৯১) (প্রবন্ধ), ভিনদেশি রুপকথা( রুপকথার গল্প), ছড়ার রাজ্যে পরীর নাচন (ছড়া), পরীর শহর (কবিতা) পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছে।
সাহিত্য ক্ষেত্রে অনন্য অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে তিনি ১৯৮২ সালে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের তথ্য, বেতার, ক্রীড়া ও সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় কর্তৃক ‘ প্রবন্ধে ‘ “বাংলাদেশ পরিষদ সাহিত্য পুরস্কার”, ২০০২সালে “সৃজনী সাহিত্য পদক”, ২০০৭ সালে “মাসিক চাটগাঁ ডাইজেস্ট পদক”, ২০১১ সালের ১২ ফেব্রুয়ারী ‘ প্রবন্ধ ও গবেষণায় ‘ “মহাকবি নবীন সেন স্মৃতি পদক”, ২০১৬ সালে কলকাতার ‘অণুবীক্ষণ অনুকাব্য পত্রিকা সম্মাননা’ লাভ করেন।