শব্দকুঞ্জ কাশফুল সংখ্যা
আলী সিদ্দিকী’র একগুচ্ছ কবিতা
আলী সিদ্দিকী’র একগুচ্ছ কবিতা
ঝড় হয়ে নাচি
ঝড়ের ভেতর মুখ ডুবিয়ে বসে আছি।
ঝড় যেন এক তুমুল আলিঙ্গন
সুখের, বেদনার – মৃত্যুময়।
হৃদয় নিংড়ানো তার হাহাকার ধ্বনি – অনতিক্রমণীয়
এক প্রতাপশালী ঢেউ
এক রুদ্ধশ্বাস প্রলয়ের বুকফাটা আর্তচিৎকার
যেন অনন্য এক হন্তারকের উন্মত্ত নৃত্য
আকাশ মথিত করে ছুটে আসা এক
অবিনাশী বজ্রনির্ঘোষ।
পাঁজরের হাঁড়গুলো গুড়ো হয়ে ঝরে পড়ে
তোমাকে ছুঁয়ে প্রাণ পাওয়া আঙুলগুলো ভাঙে
শুকনো কাঠির শব্দে
প্রখর নখরে খুবলে নেয় তোমার চুমুমগ্ন ঠোঁট জোড়া
তোমার আঙুলের স্পর্শে নিবিড় ঘন হয়ে ওঠা
চুলগুলো তুলে নেয় ছোঁ মেরে
তোমাকে আলিঙ্গনের প্রিয় বামহাত মুচড়ে দেয়
অবশেষে তোমাকে ধারণকৃত হৃদয় ছিন্ন করে নেয়।
ঝড়ে মুখ ডুবিয়ে আছি-ঝড় হয়ে নাচি।
এলিয়েন
পঁচে-গলে যাওয়া পৃথিবীটা তোমাদের দিয়ে
একদিন চলে যাবো কোমল পূর্ণিমার দেশে,
সপ্তবর্ণ আলোর ঝর্ণাধারা হয়ে এসেছিলাম
বর্ণিল পতাকা হাতে আমি পরিব্রাজক বেশে।
মানুষ সামনে-পেছনে দুই কিম্ভূত মুখে ঘোরে
সুখের নামে তারা বেয়াড়া রকম বিবাদকামী,
মুখে আর মনে দু’ধারি আরশিতে দ্বিচারিণী
মুখোশের পেছনে শয়তানি লুকিয়ে অন্তর্যামী।
মারী আর মড়কের ছোবলে বিপন্ন প্রাণ কাঁদে
দুর্যোগ দুর্বিপাকে প্রতিনিয়ত করতে হয় লড়াই,
শক্তির মত্তার নামে করে যতো নিছক দেমাগ
আপন স¦ার্থে অহেতুক করে ঠুনকো সব বড়াই।
এতো ছেঁড়াছিঁড়ি রক্তারক্তির গলিত পৃথিবীতে
আমি যেনো অনাবশ্যক অনাদৃত এলিয়েন এক,
বাতাস নদী প্রকৃতি সূর্য সবকিছুই হলো বিরূপ
বন্ধু-স¦জন সবাই পরস্পর প্রতিপক্ষ অনাবশ্যক।
এক স্নিগ্ধ মনোরম দেশ ছেড়ে একদিন এসেছি
ঘোরের ভেতর বিপদ-সংকুল হানাহানির গ্রহতে,
ছোবলময় দংশনের প্রহরসহ এই পৃথিবী দিয়ে
চলে যাবো ছেড়ে আসা প্রিয়তম একান্ত শূন্যতে।
পঞ্চবতী সমাহার
১.
আঁধার-জমাট কক্ষপথে
দিলে ছেড়ে মুখর এ-হাত,
উড়ে চলে মাতাল প্রপাত।
২.
পাথর ঠুকে জ¦লে আগুন
জ¦লে নিরন্তর রিক্ত জলে,
আঁকো দহন রূপের ছলে।
৩.
আসে সবুজ আলো হাসে
নাচে সুদূরের স্নিগ্ধ নূপুর,
তুমিহীন কাঁপে চৈত্র দুপুর।
৪.
নাড়ীপোঁতা ঘ্রাণে মাতাল
জনমের জমাট পাটাতন,
জগত করে জীবন শোষণ ।
৫.
সাধো সুর সাধের বর্মচারি
সাধ্যের সীমানা রাখো বেঁধে,
যায় সব ভেসে আকুল কেঁদে।
ঢেউয়ে ভাসা জীবনানন্দ
মা বলেছিলো, আকাশ তখনই শূন্য হবে যখন মেঘের হবে ছুটি
বনের শীর্ষে তা ধিন-ধিন সূর্য নাচে কাঁপিয়ে জগতফুলের ঝুঁটি।
মা বলেছিলো, দোলপূর্ণিমায় চাঁদের বুড়ি মিছেই চরকা কাটে
কে না-জানে এই জগতের সবাই বিকোয় কানাকড়ির এ-হাটে।
আকাশ বিকোয় মেঘের কাছে সূর্য বিকোয় নিপুণ বৃষ্টির ধারায়
সব্বাই জানে দুরন্ত নদী ছুটে গিয়ে গহীন সাগরে পথটি হারায়।
নারী হারায় সুখের আশায় অলীক কোনো স¦প্নময়তার মোহে
চির জাগরিত সত্তা বলে, দোঁহে-দাহে পোড়ে অর্বাচীন দ্রোহে।
মা বলেছিলো, ফেরেশতা নয় মানুষরূপে শয়তান জাগে জগতে
বহু বর্ণিল চমক থাকে বচন-বাচন চাল-চলন ও মোহন ভঙ্গিতে।
নদী হারায় ঢেউয়ের হংসী ঢংয়ে নানান রঙে রূপ রোশনার বড়াই
জীবন মৃত্যু চির ভৃত্য দেয় পাড়ি দেয় সে হাজার মাইলের চড়াই।
মা বলেছিলো, লালচুলো শ্যামলা মেয়েরা নয় ঘরের পোক্ত বাঁধন
ঝটাধারী সন্ন্যাসী যেমন হয় না কখনো সত্য পথের সঠিক সাধন।
কতো কী বলেছিলো মা আমার, নিংড়ে বয়েসের সকল রূপরসগন্ধ
পথ চলি আজো ধুঁকে-শুঁকে অন্তহীন ঢেউয়ে ভাসা এক জীবনানন্দ।
হেমন্তের কলধ্বনি
হেমন্তের কাশবন দিয়েছিলো তোমাকে
উড়াল দেবার অনন্য পাখা একদিন
দিয়েছিলো মেঘরাজ্যের সকল খোলা সীমান্ত
দিয়েছিলো রঙের বর্ণরেখায় সাজানো সতরঞ্জি ভূবন
দিয়েছিলো আকাশ নামে অনিন্দ্য এক সামিয়ানা
দিয়েছিলো হেমন্তের মাঠে সোনালী মধুধানে
আন্দোলিত মধুমাস;
ভোরের আলোয় নেচে ওঠা পাতাদের ঠোঁটে
লেগে থাকা রাতের সোহাগ নিয়ে শিশিরের জেগে ওঠা
দিয়েছিলো প্রেম
দিয়েছিলো ¯পর্শের ভেতর বেঁচে থাকার হিরন্ময় প্রহর
দিয়েছিলো প্রাণের ভেতর গানের দোলায়
উন্মোচনের আলো
দিয়েছিলো জেগে থাকার অদম্য সাহসিকতা
নবান্নের ঘ্রাণে ঘ্রাণে মেতে থাকা হালখাতার বারোমাস।
হেমন্তের বাতাস উড়িয়ে আনে ভূখন্ডে
আদুরে শীতের রেণুকণা
পিঠাপুলির মৌতাতে মর্মরিত প্রাণে জাগায়
উৎসবের কলধবনি
দূরের আমি যতো দূরে যাই না কেনো
ততো তোমার কাছেই ফিরি
কুয়াসায় কুয়াসায় আলোর উৎসে প্রাণে নাচে
তোমার জয়ধ্বনি।
আলী সিদ্দিকী জন্ম ১৯৬১, চট্টগ্রাম শহরের উপকণ্ঠে, রামপুর ওয়ার্ডে। গল্পকার, কবি ও প্রাবন্ধিক হিসেবেই অধিক পরিচিত। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে মাস্টার্স করেন। কর্মজীবন শুরু করেন মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টে। ১৯৯১ এর ভয়াল ঘূর্ণিঝড়ের সময় যোগদান করেন কমিউনিটি ডেভেলপমেন্ট সেন্টার (কোডেক)-এ। এরপর ব্রিটিশসংস্থা ওভারসীজ ডেভেলপমেন্ট অ্যাডমিনিস্ট্রেশন ও অ্যাকশন এইড-এ খণ্ডকালীন কাজ করেন। পরবর্তীতে ইউএসএআইডি পরিচালিত আরবান ফ্যামিলি হেলথ প্রোগ্রামের আওতায় প্রকল্প পরিচালক হিসেবে কিছুদিন কর্মরত ছিলেন। ২০০০ সালে সপরিবারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসী হন এবং ডেভরাই ইউনিভার্সিটি থেকে হিউম্যান রিসোর্স ম্যানেজমেন্টে এমবিএ সম্পন্ন করেন। বর্তমানে জনসন এন্ড জনসন-এ কর্মরত আছেন। লিখেছেন দৈনিক আজাদী ও দৈনিক পূর্বকোণ পত্রিকায়। বর্তমানে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় নিয়মিত কলাম ও গল্প লেখার পাশাপাশি কবিতাতেও সিদ্ধহস্ত। প্রবাসজীবনেও লেখালেখি করছেন নিয়মিত। প্রকাশিত গ্রন্থ ১২। দেশ-বিদেশের পত্র-পত্রিকা এবং ওয়েবম্যাগে লিখে চলছেন সৃজনশীল সব লেখা।