শব্দকুঞ্জ বৈশাখী সংখ্যা
গল্প: কয়লার ফুল
স্বপঞ্জয় চৌধুরী

গল্প
কয়লার ফুল
স্বপঞ্জয় চৌধুরী
এক
শহরের পাড় ঘেঁষে চলে গেছে একটি সরু রেল লাইন। রেল লাইন থেকে যতদূর আগানো যায়, ততদূরেই পরিবর্তিত হতে থাকে দৃশ্য, ঘ্রাণ। ক্রমশ বিশুদ্ধ বায়ু, বিস্তর সবুজ, হলুদ শর্ষে, কাচা পাতার গন্ধ। আর মাত্র তিনটি স্টেশন পেরুলেই হরিশ মেথরের বাড়ি। হরিশ মেথর গত হয়েছে মাস তিনেক হলো। শহর থেকে একজন ভদ্রলোক এসেছে হরিশের সাথে দেখা করতে। কিন্তু হরিশ যে এ পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেছে এ খবরটি তাঁর কানে পৌঁছায়নি। হরিশের মৃত্যুতে বৃদ্ধা বউ আর মেয়ে পড়ে গেছে এক অথৈ সাগরে। শহর থেকে একটা অর্থের যোগান হতো প্রতি মাসে। সেটিও হরিশ না থাকায় বন্ধ। হরিশের পাশের বাড়ির ছেলে গনেশ মাঠের কাদার মধ্যে শুকোরের পেছন পেছন দৌড়াচ্ছে। সবচেয়ে বড় নাদুস নুদুস শুকোরটাকে খপ করে এক থাবায় ধরে ফেলে গনেশ। অনেক হয়েছে অনেক পীড়া দিয়েছিস ব্যাটা। আজ তোর চর্বি ঝলসে খাবো। এহ্ গায়ে গতরে গোস্তের পাহাড় বানিয়েছিস। তোর মালিকতো আমার দেনা না দিয়ে মরেছে। আজ তোকে মরতে হবে। হরিশের মেয়ে লীলাবতি ঘোষ কোমড়ে কাপড় বেঁধে হুংকার দিয়ে আসে গনেশের দিকে।
-“ এই গনেশ শুয়োরোক হাত দিবিনে, হাত কেটেক ফেলবো”।
Ñ “ উহ্ হাত কাটি ফেলবি আমার মহারাণী আছে। তুহার বাপ যে আমার পাঁচ হাজার টাকা না শোধ করি মরিলু।
সেটি শোধ কর আগে।”
-“ তাই বলে শুকোর ধরে টান দিবি।”
গনেশে খিল করে হেসে ওঠে- “ তোর কাপড় ধরে টান দিইনি এইতো বেশি”
Ñ “ কী বলহেছিস তুই, দাঁড়া শুয়োর, দাঁড়া”
এই বলে লীলাবতি গনেশকে কাদার মধ্যে চুবোতে থাকে। শালা তোক দেখাচ্ছি মজা। হামাগ শাড়ি ধরে টান দিবি এত সহজ।
হরিশের বউ হাক ডাক দেয়। “ কী করছিস রে মুখপুড়ি, এদিকে আয়। বাড়িতে অতিথি আইসেছে”
লীলা গনেশের শার্টের কলার ছেড়ে কাদা থেকে উঠে আসে। শালা আজ তোকে ছেড়েক দিলাম। ফের ওলট পালট কথা বলিস প্রাণে মেরে ফেলিব।
এক দীর্ঘদেহি কোট টাই পড়া ভদ্র লোক উঠোনে বসে আছে নড়বড়ে একটা চেয়ারের ওপর। এদিক ওদিক নড়া চড়া করলেই ধপাস করে ভূপতিত হয়ে কোমর ভাঙার উপক্রম হতে পারে।
-‘ অনেকদিন ধরে আসবো আসবো করে আসা হয়না। হরিশের কিছু টাকা পাওনা ছিল আমার কাছে। দেশ স্বাধীনের পর হরিশ আমার বাড়িতেই ছিল। আমি ওর কাছ থেকে কিছু টাকা ধার নিয়েছিলাম । বেচারা ব্যবসা বাণিজ্য করার জন্য শহরে পাড়ি দিয়েছিল। আমাকে ও বড় ভাইয়ের মতো মনে করতো। বিপদে আপদে এগিয়ে আসতো সবার । যদিও ওর পেশাটাকে সবাই খাটো করে দেখতো। কিন্তু মানুষ হিসেবে ছিল চমৎকার। মাঝে মাঝে আমি ওকে মানি অর্ডার পাঠাতাম। কিন্তু আমারওতো বয়স হয়েছে। কবে চলে যাই। তার কারও দেনা কাঁধে নিয়ে মরতে চাইতে। এই নিন বোন এই খামে হাজার পঞ্চাশেক টাকা রয়েছে। আশা করি এই সময়ে এটি আপনার কাজে আসবে। হরিশের বউ মাধবী রানী একসাথে এত টাকা কখনো দেখেনি। তাই টাকা খামটা হাতে নিতে যেন তার হাতটি কাঁপছিল।
-“বাবু গরিবের বাড়ি দুপুরে চারটি ডাল ভাত খেয়ে যাবেন।”
-“ ভদ্রলোক নাগো বোন , শহরে অনেক কাজ ফিরতি টিকিট কেটে এসেছি এক ঘন্টা পরেই ট্রেন। এখন না উঠলে
ট্রেনটা যে মিস হয়ে যাবে।”
লীলাবতি একটি গ্লাসে শরবত নিয়ে এসে বলে- “ বাবু অন্তত, এটুকু মুখে নিন”
লীলাবতির মায়াবি চোখের দিকে তাকিয়ে সে না করতে পারে না। এক নিঃশ^াসে ঢক ঢক করে শরবত খেয়ে ফেলে।
-“ আজ আসি মা”
“ সময় পেলে আসবেন বাবু”
দুই
বিকেল হতেই পাওনাদার , উৎসুক পাড়ার লোক ভিড় জমায় হরিশের উঠোনে।
এক বৃদ্ধ হাক ডাক দিয়ে বলে- “ কইগো হরিশের বউ, বাইরে আসো। আরে সুসংবাদতো চাপা থাকেনা। এ কয়মাসতো অনেক ঘুরালে তা বাপু এবার আমার পাওনাটা মিটিয়ে দাও। বাড়ি চলে যাই।”
একে একে অনেকের ধার দেনা মিটায় হরিশের বউ মাধবী। আঙুলে থুথু লাগিয়ে টাকা গুনতে থাকে লীলাবতি।
ভিরের ভেতর থেকে গনেশ এসে বলে- “ তা আমার পাওনাটা কি পাবো।”
রাগে কটমট করতে থাকে লীলাবতি- “ পাবি বৈ কি, কিন্তু ফের যদি ওলোট পালট কথা বলিশ একদম হাগার টাংকি থেকে চুবাইক নিয়ে আসবো।”
গনেশ দুকান ধরে জিহবাও কামড় দেয়।
-“না না তা হবে না কখনো। শত হলেও তুইতো আমার বোনের মতো।”
সবার দেনা পাওনা মিটাতে মিটাতে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে হয়ে যায়।
শুয়োরের খোয়ারে শুয়োরগুলোকে গুনে গুনে ঢুকিয়ে দিয়ে আসে লীলাবতি।
সবার দেনা পাওনা মিটিয়ে হাতে মোটে আছে আট হাজার টাকা।
ঘরের ভেতর থেকে লীলাবতির মা কোঁকিয়ে উঠছে।
– “ লীলা মা লীলা। আমার কেন যেমন লাগছে। এদিকে আয়।”
লীলার মা মাধবী ভূপতিত হয়ে গেল। লীলা করবে বুঝতে পারে না। পাশের বাড়িতে গিয়ে গনেশকে ডেকে নিয়ে আসে। গনেশ বলে তুই কাকিকে ঘরের বাইরে আন। আমি ভ্যান নিয়ে আসি।
তিন
হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছে মাধবী। স্যালাইন চলছে। একটা সাডেন স্ট্রোক হয়েছে। ঠিক সময় মতো হাসপাতালে আনায় এ যাত্রায় রক্ষা। আরও দু’দিন থাকতে হবে। রাতে মায়ের পাশে শুয়ে কাঁদতে থাকে লীলা। গনেশের মা ভাত নিয়ে আসে লীলার জন্য । গনেশের মাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে লীলা।
-“ হামার এ মা টা ছাড়া কেউ নাইগো কাকি।”
গনেশের মা সান্ত¡না দেয়। – “মন শক্ত কর পাগলি। সব ঠিক হয়ে যাবে।”
দু’দিন পর হাসপাতালের একাউন্টস থেকে বারো হাজার টাকার বিল ধরিয়ে দেয় লীলার হাতে। লীলার কাছে মাত্র আট হাজার টাকা আছে বাকী চার হাজার টাকা কিভাবে জোগাড় করবে। এই ভাবতে তার মাথা ভনভন করছে।অনেক কাকুতি মিনতি করেও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের মন গললো না। বিল পরিশোধ না করে মাকে রিলিজ করতে পারবে না।
সে গ্রামের মহাজনের কাছে যায় টাকা চাইতে।
মহাজন চৌকিতে বসে হুক্কা টানছে।
-“ তোর বাবা হরিশতো আমার কাছে থেকে এডভ্যান্স নিয়ে মরিছে। আমার হাগার টাঙ্কি এখনও ফুল। সেটা
পরিস্কার করার ব্যবস্থা যদি করতে পারিস। তাহলে বিবেচনা করতে পারি। ”
– “ বাবু আমি পারবো। আমাকে যে পারতি হবেক।”
– “ না না তুই পারবি নে। মেয়ে ছাওয়াল মানুষ। তোক মানাবে না এ কাজ”
– “ আমার মা হাসপাতালে। তাকে বাড়ি নিতে পারছি না বাবু। আমাকে কাজটা দিন।”
-“ ওঠ ওঠ কাজে নেমে পড়। ওই রান্না ঘরের ওপাশে সাবল, বেলুঞ্চি আর ঝুড়ি আছে”
লীলা কোমরে গিট বেধে নেয়। টাঙ্কির ঢাকনা খুলতেই তার পেটের ভেতর থেকে যেন সব উগড়ে আসতে চায়। কিন্তু তাকে যে এ কাজ পাড়তেই হবে। বাপ দাদার পেশা । না পাড়লে যে তাদের অপমান হবে। লীলা সাবল দিয়ে টাঙ্কির পাইপে একটি ঘুটা মারে। ড্রেন দিয়ে গলগলিয়ে মানব মল নির্গত হতে থাকে।
“ সাব্বাশ বেটি এইতো হচ্ছে”
লীলা ঘণ্টা খানেকের মধ্যে পুরো টাঙ্কি পরিস্কার করে ফেলে। মহাজনের কাছ থেকে টাকা নিয়ে মাকে হাসপাতাল থেকে ছাড়িয়ে আনে।
চার
লীলার এই মলভাণ্ডার পরিস্কারের কথা সারা গ্রামে ছড়িয়ে যায়।
অনেকে কাজের ডাক আসে। তাকেতো সংসার টিকাতে হবে। কিন্তু গনেশের লীলার এই কাজ পছন্দ হয়না।
গনেশ লীলাকে কয়লাফিল্ডে কাজ করার প্রস্তুাব দেয়। অন্তত হাগামুতা পরিস্কারের চেয়ে কিছুটা হলেও সম্মানজনক কাজ।
-“ কাল ভোরে রেডি থাকিস। তোকে কয়লা ফিল্ডে নিয়ে যাব।”
কয়লা ফিল্ডের ম্যানেজার লীলার দিকে তাকিয়ে একটা অদ্ভূত হাসি দেয়।
-“ কি পারবেতো কাজ করতে। কয়লার কাজ, নিজেকে কয়লা হতে হবে। কয়লা সেচে আনতে হবে মুক্ত।”
লীলা মাথা নাড়িয়ে বলে- “ আমাক পাড়তেই হবে”
গনেশ লীলাকে কয়লাফিল্ডে নিয়ে যায়। তার টুকরিতে কয়লা ভরে দেয় আর লীলা সেই কয়লা ফিল্ড থেকে একটু দূরে পাহাড়ের মতো একটা স্তূপে নিক্ষেপ করে।
সকাল গড়িয়ে সন্ধ্যে হলো। লীলা পাশের নদীতে হাত মুখ ধুতে যায়। নদীর স্বচ্ছজলে নিজেকে দেখে আতকে ওঠে লীলা। তার শ্যামবরণ মুখশ্রী যেন কয়লায় পোড়া কোনো বাসন।
গনেশ পানিতে ঠিল মেরে বলে- “ তুই হলি কয়লার ফুল। যা সুবাশ ছড়ায় না, সুবাশ ছিনিয়ে আনে।”
গনেশ আর লীলা বাড়ির দিকে রওয়ানা দেয়। আজ গনেশকে কেন যেন একটু বেশি আপন মনে হচ্ছে লীলার। তার সেই বিশ্রী হাসিটিও যেন আজ অনেক সুন্দর লাগছে। লীলা গনেশের পকেট থেকে একটা বিড়ি নিয়ে ধরায়। গনেশ অবাক হয়। লীলা খিলখিল করে হেসে ওঠে- “ কয়লার ফুলের সুবাস ছড়াবো আজ”
লীলাবতির বিড়ির ধোঁয়া শূন্যে মেলাচ্ছে। গাঢ় গোধূলির রঙে লীলাবতির মুখটা এক ব্যাখ্যাতিত সৌন্দর্য ছড়াচ্ছে। তাকে আসলেই কয়লার ফুলের মতো দেখাচ্ছে। গোধূলির রঙ মুছতে থাকে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক আরও গাঢ় হতে থাকে। আরেকটি সকাল হাত পেতে বসে আছে যেন।
স্বপঞ্জয় চৌধুরী।
কবি, প্রাবন্ধিক, অনুবাদক ও কথাসাহিত্যিক।
জন্ম :১৯৮৪ সালের ৬ জুন।
জন্মস্থান: মাদারীপুর জেলার কালকিনী থানার অন্তর্গত সাদীপুর গ্রামে।
পড়াশোনা: ঢাকা কলেজ থেকে হিসাববিজ্ঞানে স্নাতোকত্তোর
পেশা ও কর্মস্থল: সহকারী অধ্যাপক, হিসাববিজ্ঞান বিভাগ, সাউথ পয়েন্ট কলেজ।
ইতিপূর্বে কাজ করেছেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে এ্যসিসট্যান্ট কো-অর্ডিনেটর পদে।
এছাড়াও তিনি বিভিন্ন সময় জাতীয় দৈনিক খন্ডকালীন সাংবাদিকতা ও সাপ্তাহিক
পত্রিকায় সম্পাদনা করেছেন।
লেখালেখির ক্ষেত্র: কবিতা, গল্প, অনুবাদ, প্রবন্ধ, উপন্যাস, ছড়া গান, চিত্রনাট্য ইত্যাদি ।
প্রকাশিত গ্রন্থসমূহ: কাব্য : পতঙ্গ বিলাসী রাষ্ট্রপ্রেম(২০১১), কালযাত্রার স্নিগ্ধ ফসিল (২০১৬) ,
দ্রোহ কিংবা পোড়ো নদীর স্রোত (২০১৮); কিশোর কাব্য: মায়ের মতো পরি
( ২০২০), গহিনে অরণ্য নদী (২০২১), জলাঙ্গি ও ভাটপুষ্পসমূহ (২০২৩),
গল্প: জলপিপিদের বসতবাড়ি (২০১৩) , ডুবেছিল চাঁদ নিশিন্দা বনে (২০২১)
মৃৎচক্রের দিনগুলি ( ২০২৩)
প্রবন্ধ: নিগূঢ় শিল্পের কথাচিত্র (২০২১), শিল্প সাহিত্যের নিবিড় অনুসন্ধান ও পাঠ
বিশ্লেষণ- নিভৃত ভাবনার জলযান (২০২৪)
অনুবাদ (কাব্য): ভিন পাখিদের স্বর (২০২২)
সম্পাদনা: International Anthology of Poetry for Peace and
Humanity- Starlight in Bird’s Eye,
পাখির চোখে নক্ষত্রের আলো(২০২৪)
লিখেছেন বিভিন্ন দেশী বিদেশী দৈনিক ও সাহিত্য পত্রিকায়।
পুরস্কার: সাহিত্য দিগন্ত লেখক পুরস্কার-২০২০ (গল্পগ্রন্থ- জলপিপিদের বসতবাড়ি)
বামিহাল তরুণ সাহিত্য পুরস্কার-২০২২ (প্রবন্ধ-নিগূঢ় শিল্পের কথাচিত্র)
বাঙালির কণ্ঠ সাহিত্য পুরস্কার-২০২০ (কাব্যগ্রন্থ- দ্রোহ কিংবা পোড়ো নদীর স্রোত)
ইন্টারন্যাশনাল পিস এম্বাসেডর সম্মাননা(২০২০)
দাবানল সাহিত্য পুরস্কার (২০০৪)
