শব্দকুঞ্জ ঈদসংখ্যা। গল্প: অবদমন- অনন্ত পৃথ্বীরাজ

Spread the love

শব্দকুঞ্জ ঈদসংখ্যা

গল্প:
অবদমন
অনন্ত পৃথ্বীরাজ

গল্প

অবদমন

অনন্ত পৃথ্বীরাজ

এক.

দুইদিন আগে বার্ষিক পরীক্ষা শেষ হয়েছে। তাই পড়াশোনার তেমন চাপ নেই। এসময় শুধু খাওয়া-দাওয়া আর ঘুমানো ছাড়া দ্বিতীয় কোনো কাজও নেই। এখন রাত। বিদঘুটে অন্ধকার। হঠাৎ কী এক শব্দে নুসরাতের ঘুম ভেঙ্গে গেল। তারপর চারদিকে সুনশান; নিঃস্তব্ধ নীরবতা। এই নিঝুম রাতে আশেপাশের বাড়িঘর থেকেও কারও কোনো সাড়া শব্দ পাওয়া যায় না। সবাই যেন অঘোরে ঘুমাচ্ছে। কিন্তু নুসরাতের চোখে ঘুম নাই। কয়টা বাজে ? নুসরাত ঠিক আন্দাজ করতে পারল না। ওয়ালে ঝুলানো দেয়াল ঘড়ির কাটার টিকটিক আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। দিনের বেলায় মানুষের কোলাহলে এ আওয়াজ কারও কানে বাজে না। সহসা দ্রæম করে আবার বিকট শব্দ হলো। একবার নয়, পরপর কয়েক বার। তখন নুসরাতের মনে পড়ে গেল কিছুদিন আগের কথা। তার মা বলেছিলেন, “এই ঘরে গোটা কয়েক গেছো ইঁদুরের বাসা আছে। কথাটি মনে হতেই ভয়ে তার গা ছম ছম করে উঠল। নুসরাতের পাশের লাগোয়া ঘরেই মা থাকেন। সে হয়তো ভাবল মাকে ডেকে নেবে। কিন্তু ডাকল না। মানে পরক্ষণেই সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করল। কারণ মাকে সারাদিন নানা কাজে খুব বিজি থাকতে হয়। শহরের একটি প্রাইভেট কোম্পানিতে মা চাকরি করেন। সেই কাকডাকা ভোরে মাকে বের হয়ে যেতে হয়। তারপর সারাদিনের অক্লান্ত খাটুনি। একটুও বসবার অবকাশ নেই। সন্ধ্যা নাগাদ বাসায় ফিরে দেখেন, রান্না করা থেকে ঘরগোছানো পর্যন্ত সংসারে রাজ্যের কাজ জমা হয়ে আছে। দিনের বেলায় দু’চোখের পাতা এক করবার তার সময় কোথায়! রাতে ভালো ঘুম না হলে পরদিন অফিসে সমস্যা হবে ভেবে নুসরাত মাকে জাগাতে গিয়েও নিজেকে সংযত রাখল।

 

নুসরাতের বাবা থেকেও নেই। নেই মানে তাদের সাথে নেই। একদা তিনি এ সংসারে ছিলেন। এখন নুসরাতের বয়স চৌদ্দ বছর। অনেক দিন আগের কথা, তার বয়স তখন পাঁচ কী ছয় বছর হবে। একদিন রাতে বাবা-মার মধ্যে তুমুল ঝগড়া হয়েছিল। পরদিন সকালে মা সবকিছু গুছিয়ে মেয়েকে নিয়ে সেই যে বাপেরবাড়ি চলে এলেনÑ তারপর আর স্বামীগৃহে ফেরেন নি। বাবার কথা মাঝেমাঝে খুব মনে পড়ে নুসরাতের। কিন্তু বাবার চেহারা সে মনে করতে পারে না। বাবা কেমন দেখতে ছিলেন! তার খুব জানতে ইচ্ছে করে। বাবারও নিশ্চয়ই তার কথা মনে পড়ে। কিন্তু কই, বাবা তো একবারও তাকে দেখতে আসে না ? কোনোদিন একটিবার খোঁজও নেয় না। বাবার প্রতি যতটা ভালোবাসা আছে ঠিক ততখানি ক্ষোভ জমা হয় তার মনে। মায়ের সংসার না টেকার জন্য নানা বাড়ির সবাই প্রথম প্রথম মাকেই দোষারোপ করেছিল। ‘মেয়েদের অনেক ছাড় দিতে হয়; সবার সাথে মানিয়ে চলতে হয়’ ইত্যাদি টাইপের কথাবার্তা। ভাই-ভাবি আর পাড়া-পড়শিদের কাছ থেকে প্রতিদিন একই কথা শুনতে কার-ই বা ভালো লাগে! অনেকটা বাধ্য হয়েই মাকে বাপের বাড়িও ছাড়তে হয়। বিয়ে আসলে এমন একটি অস্ত্র যাÑ‘আপনকে পর করে, আর পরকে কাছে টানে।’ কিন্তু এ তত্ত¡টি সবার বেলায় প্রযোজ্য নয়। দুনিয়ায় সবকিছুই শর্ত সাপেক্ষ। নানুর কাছ থেকে নসরাত শুনেছে, তার মা ছোটবেলা থেকেই জেদি আর স্বাধীনচেতা স্বভাবের ছিলেন। কোনো অন্যায়ের কাছে তিনি মাথানত করেন নি। সে ভাবে যে যাই বলুক, আমার মাকে আমি চিনি। মা-বাবাকে এখনো কতটা ভালোবাসে; বাবা হয়তো তা কোনোদিনই তা উপলব্ধি করেনি, আর উপলব্ধি করতে পারবেও না। কিন্তু বাবার কাছে থেকে মা কী চাপা কষ্টই না পেয়েছিল। মেয়েদের জীবনে কিছু কষ্ট থাকে, যা ব্যথাহীন ব্যথা, শরীরে ক্ষত নেই অথচ হৃদয় দগ্ধ করে। মা টের পেয়েছিলেন, বাবার গোপনে অন্যত্র আসা-যাওয়া ছিল। মেয়েরা সবকিছু ভাগ করে নিতে পারে, কিন্তু স্বামীর ভাগ কখনো অন্যকে দিতে পারে না। আচ্ছা, মায়ের না হয় একটু অভিমানই ছিল। কিন্তু বাবা! আমার জন্যে হলেও তো মাঝে মাঝে আসতে পারত। কই, একদিনও এলো না। এসব কথা ভাবতেও নুসরাতের কষ্ট হয়। সবার বাবা আছে। কেবল আমার বাবা নেই। লোকমুখে শুনেছি, বাবা নতুন করে অন্যত্র টোনাটুনির সংসার পেতেছেন।

দুই. 

নুসরাত নবম শ্রেণির ছাত্রী। সে বেশ মেধাবী। অষ্টম শ্রেণিতে জিপিএ-৫ পেয়েছিল। ওর মধ্যে কৌতুহলের শেষ নেই। ক্লাসের শিক্ষকেরা প্রায়ই বলেন,‘এ বয়সের ছেলেমেয়েরা একটু বেশি কৌতুহলি হয়। জানার অদম্য ইচ্ছে জাগে। তবে সব সময়, সব বিষয়ে বেশি কৌতুহল হওয়া ভালো নয়।’ নুসরাত বুঝতে পারে এটা হয়তো তার বয়সের সমস্যা। সে কথা থাক। শহর থেকে একটু দূরে সরু রাস্তার মোড় ঘেঁষে চারতলা বাড়ির তৃতীয় তলায় নুসরাতদের ভাড়া বাসা। তিন রুমের ফ্ল্যাট। সে যে রুমে থাকে সেটি বেশি বড় নয়। কিন্তু খুব পরিপাটি করে সাজানো। ছোট্ট একটি বেলকুনি। সামনে বড় একটি আমগাছ ডালপালা ছড়িয়ে রাজ্য বিস্তার করে আছে। মাঝে মাঝে খুব মন খারাপ হলে সে বেলকুনিতে আসে। কত সময় সে উদাস হয়ে বসে থাকে। কখনো আবার আমগাছের পাতায় হাত বুলায়। মনে মনে কথা কয়। কী সে কথা ? তা আমরা কেউ জানি না। সে কথা তার একান্তই নিজের।

 

তিন.  

একটু পর আবার সেই একই রকম বিকট শব্দে কান ফেঁটে যাওয়ার উপক্রম হলো। নুসরাত কিছু বুঝে উঠতে পারল না। এতো বিকট শব্দ কিসের! বালিশের ওয়্যারে কান চেপে শব্দ নিবারণের চেষ্টা করল সে। সহসা কয়েকদিন আগের কথা মনে হলো তার। একদিন ক্লাসে বাংলা টিচার জাহানারা ইমামের ‘একাত্তরের দিনগুলি’ পড়াতে এসে মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে বলেছিলেন। যুদ্ধের সময় কারও কোনো ন্যায়-অন্যায় বোধ থাকে না। শত্রæ পক্ষ পাখির মতো গুলি করে মানুষ হত্যা করে। যুদ্ধের দিনগুলো হয় অবর্ণনীয় কষ্টের। আর গুলির শব্দও বিকট হয়। কথাটি মনে হতেই সে যেন এবার ভয়ে ঠক ঠক করে কাঁপতে লাগল। তার চোখের সামনে ভেসে উঠল ৭১’এর সেই ভয়াবহ দিনগুলি। তখন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনি সামনে যাকে পেয়েছে গুলি করে হত্যা করছে। তাদের কাছে বাংলার মানুষগুলো যেন মানুষ নয়, জীব জানোয়ার বা অন্যকিছু। তবে নুসরাত আশ্চর্য হয়েছিল এই ভেবে যে, এতো কষ্ট স্বীকার করেও এদেশের মানুষ নিজের মাতৃভূমিকে বিদেশি বেনিয়াদের হাতে তুলে দেয়নি। যে যার সাধ্যমতো যুদ্ধ করেছে। নিজের রক্ত দিয়ে দেশের মর্যাদা রক্ষা করেছে। সাহসী জাতি হিসেবে বিশ্ব বাংলাদেশকে চেনে। শিক্ষক আরও বলেছিলেন, এ বছর আমাদের স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী পালিত হবে। নুসরাত আঙুলের ডগায় অংক কষে তারিখ হিসেব করে নিল। ডিসেম্বর মাসের ১৫ তারিখ শেষ হয়ে এখন বোধ হয় ১৬ তারিখ পড়ল। এবার নুসরাতের কাছে সব স্পষ্ট হয়ে গেল। ভয়ের বদলে তার মনে জেগে উঠল অপার এক আনন্দ। আজ ১৬ই ডিসেম্বর, ২০২৩ সাল। প্রথম প্রহরে দেশপ্রেমিক জনতা আতশবাজি ফুটিয়ে স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীকে বরণ করে নিল। এক মাহেন্দ্রক্ষণ। ভাবতেই তার খুব ভালো লাগছে। দেশের কথা, দেশের মানুষের কথা ভাবলে তার রক্ত গরম হয়ে ওঠে। এদেশের জন্য কিছু একটা করতে চায় সে। বড় হয়ে দেশকে অনেক উপরে নিয়ে যেতে চায়। নুসরাতের ইচ্ছে হলো অন্যদের সাথে সেও এই অপার আনন্দ অনুষ্ঠানে যোগ দেবে। কিন্তু পারল না। কারণ মানুষের জীবনে সব ইচ্ছে একসাথে পূরণ হয় না!   

 

 

অনন্ত পৃথ্বীরাজ, জন্ম ৩০ অক্টোবর, ১৯৮৭। জগন্নাথ বশ্বিবদ্যিালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর। পেশা শিক্ষকতা। বর্তমানে ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট গার্লস পাবলিক স্কুল এন্ড কলেজে কর্মরত আছেন। প্রকাশিত গ্রন্থ- কাঠপোকা (গল্পগ্রন্থ), বিষণ্ন বিকেলের গল্প (গল্পগ্রন্থ), আরিফ নজরুলরে কবিতা : স্বপ্ন সেঁকে বাস্তবে ফেরা (গবেষণাগ্রন্থ), রমনা পার্কের ইতিহাস (গবেষণাগ্রন্থ)।

অনন্ত পৃথ্বীরাজ
গল্পকার

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top