শব্দকুঞ্জ ঈদসংখ্যা-২০২৪। গল্প: ঝুড়ির দেশে বুড়ির গল্প-তারিকুল আমিন

Spread the love

শব্দকুঞ্জ ঈদসংখ্যা-২০২৪

গল্প: ঝুড়ির দেশে বুড়ির গল্প

তারিকুল আমিন

শব্দকুঞ্জ ঈদসংখ্যা-২০২৪

ঝুড়ির দেশে বুড়ির গল্প

তারিকুল আমিন

 

‘ঘুমপাড়ানি মাসি পিসি

মোদের বাড়ি এসো..!’

বনমালি তার ছোটন সোনাকে ঘুম পাড়ায়। এই কবিতাটি সুরে সুরে না বললে ছোটন সোনা ঘুমায় না। রাত প্রায় ৯টা বাজে। চারপাশে চান্দি রাতের আলোর মাঝে দেখা যায় একটি কুপি জানালার ধারে জ্বলছে। মার কোলে মাথা দিয়ে শুয়ে আছে বনরাজ। বনমালি চাঁদ ও তারাদের গপ্পো করছে।

‘ঝিকি মিকি ছোট তারা

ত্রিভুবনে ছরিয়ে দেয় আলো

খোকা খুকি ঘরে বসে,

ডাকতে থাকে আসো।’

‘মা..! চাঁদের বুড়ি কতটুকুন? আর তার কাঁথা সেলানো এখনো হয় না। তার মানে চাঁদের বুড়ি তোমার ছোটন সোনার থেকেও বেশি অলস।’ বলে ছোটন সোনা খিলখিলিয়ে হেসে উঠে।

‘তাই বুঝি! যাক আমার ছোটন এতো দিন পর সত্য কথা বলল। হা হা হা..! না ছোটন সোনা। আমরা দূর থেকে চাঁদ দেখি। তাই ভাবি চাঁদ ছোট। চাঁদ অনেক বড়’

‘ও.. তাই বল। আমি তো…!’

‘হইছে অনেক ঘ্যানাপ্যাচাল। এখন ঘুমা। সকাল সকাল আমার মেলা কাজ আছে। উঠেই তো মাঠে দিবি দৌড়।’

‘না মা, কাল আমি তোমায় সাহায্য করবানি।’

‘আহা্! সোনা আমার প্রতিদিন এককথা। কাজে সাহায্য করবানি। থাক হইছে। এখন ঘুমাতো।’

চাঁদের দিকে অপলোক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে বনরাজ। আর চোখ দিয়ে খুঁজতে থাকে বুড়ি কী করে, কোথায় বসে থাকে।

‘আচ্ছা! বুড়ি দাদুকে দেখা যায় না কেন? তবে মনে হয় সে যেই গাছের নিচে বসে আছে। গাছটা মনে হয় দাদুকে লুকিয়ে রেখেছে।’

বনরাজ উপভোগ করে রাতের নিরবতাকে। কুকুরের ডাক আর শিয়ালের ডাক এবং ঝিঝি পোকার আওয়াজ মাঝে মাঝে জোনাকি পোকার নিবু নিবু আলো দারুন লাগে ওর কাছে।

আল্লাহু আকবার (আল্লাহ সর্বশ্রেষ্ঠ)। আশহাদু আল্লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ (আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে আল্লাহ ছাড়া কোন উপাস্য নেই)। আশহাদু আন্না মুহাম্মাদার রাসুলাল্লাহ (আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে মুহাম্মদ আল্লাহর রাসুল)। মসজিদে আযান পড়েছে। এদিকে মোরগ ডাক দিচ্ছে। বনমালি ওযু করে নামাজের জন্য দাড়িয়েছে। বনরাজ ওদের মোরগ, মুরগি, হাঁস এসব ছেড়ে দেয়। দুটি ছাগল আছে একটি লালু আর অন্যটি ময়ূরি। আর একটি কালো গরু আছে। ওর নাম কালু। কালুকে বিলে নিয়ে বেঁধে আসে বনরাজ। আজ ওর মার কিছু বলার লাগেনি। সব বলার আগেই করে ফেলেছে। বনমালি তো অবাক। মনে মনে বলল,

‘আজ সূর্য কোন দিকে উঠলো। নিশ্চয় আমারে ঘুষ দেয়ার জন্য মন খুশি করার জন্য করছে। যাতে ওর কাজ করতে দেই। ওমা..! সভ্য বালকের মত হাতে কায়দা। মাথায় টুপি আর হাতে পাটি নিয়ে মসজিদে যায় দেখি। কী হল। ও বনরাজ কীরে কী হল তোর। আজ বলার আগেই সব করে ফেলছিস। আগে তো বলতে বলতে মুখে ফেনা ছুটে যেতো আর আজ হঠাৎ।’

Ñ ‘না মা এমনি। মা আমাকে দোয়া কর। তোমার ছেলে যাতে একদিন অনেক বড় হয়। আমাদের দুঃখ যাতে মুছে যায়। আমি এখন থেকে তোমাকে সাহায্য করবো। খেলার সময় খেলাধুলা করবো। তোমার কথা মেনে চলবো। মাঠে কাজ করতে যাবো। বাবাকে সাহায্য করবো। মক্তবে যাবো। স্কুলে যাবো। মা আমি সঠিক সময় ব্যবস্থাপক হয়ে উঠতে চাই। সময়ের সঠিক ব্যবহার করতে চাই।’

‘কী বলিস এসব বাবা।’

‘মা কথায় আছে “যা আছে তাই দিয়ে, যেখানে আছে সেখান থেকে, আপনি যা পারেন তাই করুন” এতো দিন তোমাদের অনেক কথা শোনাতাম মা। আমায় ক্ষমা কর। আমার যা আছে তাই দিয়ে আমি না পাওয়া জিনিস অর্জন করবো। এখন যাই মা মেলা দেরি হইয়া গেছে।’

‘যা বাজান। ফ্রিআমানিল্লাহ।’

মক্তবে যায় বনরাজ। হঠাৎ চোখ যায় বাবার দিকে। দেখে আর ভাবে সত্যিই এই কুয়াশার মধ্যেও বাবা ঘরে না শুয়ে মাঠে কাজ করছে। কারণ আমি যাতে শিক্ষিত হই। শেষ বয়সে তাদের দুটো শক্তিশালী হাত হয়ে উঠতে পারি।

‘কীরে বাজান মক্তবে যাস।’

‘হ বাজান। আমি মক্তবে যাই।’

‘আচ্ছা, যা বাজান। ভালা কইরা পড়িস।’

দূর থেকে আরবির হরফগুলো শোনা যায়। আলিফ, বা, তা, ছা, জিম…! বনরাজ ভালো ছেলের মত গিয়ে বসে পড়ে। হুজুরকে পড়া দেয়। আবার পড়া নেয়। কোনো দুষ্টমী করে না। মক্তব ছুটি হইয়া যায়। হুজুর ডাকে।

‘বনরাজ তুই হঠাৎ…!’

‘জি হুজুর। আমাকে দোয়া করবেন। আমি যাতে মানুষের মত মানুষ হতে পারি। মানুষ বেইমানি করে। কিন্তু সঠিক সময় ব্যবস্থাপক হলে সময় কখনো বেইমানি করে না। হুজুর আমি সময়কে পোশ মানাতে চাই। দোয়া করবেন।’

এই বলে চলে আসে বনরাজ। মক্তব থেকে এসেই কালুকে খেতে দেয়।

‘বনরাজ। বাবা বনরাজ। ভাত রান্না হইছে। তুই খেয়ে তোর বাজানরে দিয়া আয়।’

বনরাজ ভাত খায়। একটি পুটলিতে ভাত নেয়। মাঠে বাজানকে দিয়ে স্কুলে চলে যাবে। হাতে বই, মাথায় ভাতের পুটলি নিয়ে মেঠো পথের আইল দিয়ে চলে যায়।

‘বাবা..! এই নাও তোমার খাওন। পরে কাজ করো। সকালের খাবার দ্রæত শেষ কর।’

‘ঐখানে রাখ বাজান।’

‘আমি স্কুলে গেলাম। তুমি খেয়ে নিও। দেরি করনা।’

বনরাজ সেই পথ ধরে স্কুলে চলে যায়। স্কুলের ঘন্টা শোনা যায়। ছাত্র-ছাত্রীরা দৌড় দিয়ে ক্লাস রুমে চলে যায়। বনরাজকে দেখে বন্ধুরা রীতিমত অবাক। ওদের মধ্যে কথা চলতে থাকে। অন্য পোলাপান কাগজ ছোড়াছুড়ি করে। স্যার অতিনকর্মকার চলে আসে। আজ ওদের প্রথম ক্লাস। প্রথম বছর শুরু হল। আজ বই দিবে। আজ বই উৎসব। বনরাজ টেনেটুনে ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে উঠেছে। প্রথম দিনই অতিনবাবু বনরাজকে দেখে অবাক। পরে সবাইকে বই দেয়। বনরাজের হাতে বই দিয়ে বলল,

‘আমার খুব ভালো লেগেছে তুই এসেছিস। সময়কে কাজে লাগা। প্রথম ক্লাসে তোকে দেখে আমি সত্যি অনেক খুশি। তুই অনেক বড় হ বনরাজ। দোয়া রইল।’

‘দোয়া করবেন স্যার। আমি যাতে ঐ চান্দের বুড়ির মত সময় ব্যবস্থাপক হয়ে উঠতে পারি। ঠিক সময় মানুষকে সঠিক সেবা দিয়ে আলোকিত করতে পারি। আবার দিনে যাতে ঘন কালো ছায়া দূর করে সূর্য হয়ে উঠতে পারি।’

‘দোয়া রইল বনরাজ। তুই শুরুটা ভালো করেছিস। দেখবি শেষটা তোর ভালো হবে। কথায় আছে “যার সব ভালো তার শেষ ভালো”

ছুটির ঘন্টা পরে। সবার মত বনরাজও চলে যেতে লাগে। পিছন থেকে অতীন কর্মকার ডাকে।

‘বনরাজ একটু এদিকে আয় তো।’

‘জি স্যার।’

‘আজ খেলাধুলা শেষ করে ঠিক চারটার দিকে বই নিয়ে পড়তে আসিস।’

‘কিন্তু স্যার।’

‘কোন কিন্তু নয়। আসতে বলেছি আসবি।’

‘ঠিক আছে স্যার। আমি আসবো।’

বনরাজ দুপুরের খাবার খেতে বসেছে। খাওয়া প্রায় শেষ। বন্ধুরা এসেছে।

‘বনরাজ খেলতে যাবি না?’

‘হ যামু। দারা আমি আসতাছি।’

‘ঠিক আছে তাড়াতাড়ি আয়।’

ওরা মাঠে খেলতে থাকে। তারপর এক পর্যায় নদীতে গোসল করতে যায়। পরে চলে আসে বাসায়। তৈরি হয়ে বই নিয়ে হাটা দিল।

‘আরে কই যাস। আবার শুরু করলি। বই পেতে না পেতেই আইসক্রিম কিনে খেতে যাস।’

‘না মানে…!

‘ঐ মানে টানে বুঝি না। একদিন তো ঘরে বইগুলো রেখে চাঁদমুখ খানাতো দেখবি তাই না। না তোর কোন কথা শুনমু না।’

‘মা আমি বই বিক্রি করবো না। স্যার বলছে বিকেলে তার কাছে বই নিয়ে পড়তে যেতে।’

‘কী বলিস বাজান। তাহলে টাকা। তুই তো জানিস তোর বাজান..!’

‘হ মা। স্যারকে বলতে গেছি স্যার আমার কথা শুনতে রাজি নয়।’

‘ঠিক আছে বাজান। দেখ স্যার কী বলে।’

পরে ঠিক চারটার দিকে স্যারের বাসায় চলে যায়। বনরাজ যে সঠিকভাবে টাইম ম্যানেজমেন্ট করতে শিখে গেছে। তার জন্য স্যারের খুশিতে আর গর্বে বুক ভরে যাচ্ছে। স্যার পড়ানো শুরু করে। আরো অনেক ছাত্র-ছাত্রী পড়ে। স্যার ভিতরে চলে যায়।

‘কীরে ফকিন্নি, তুই এইখানে আসলি কেন? টাকা পাবি কই?’

‘ঐ ফেলকরা ছাত্র। কীরে এতো টাকা কই পাবি। হালার পুত। জানিস স্যার অনেক টাকা নেয়। মাসে ১০ টাকা আর চাল, ডাল ইত্যাদি।’

‘দু’মাসে তো মনে হয় একবার চোখে দেখোস।’

স্যার চলে আসে।

‘নিতাই। ছি! এসব বলতে নেই। আর ভুলে যেও না ও তোমাদের বন্ধু। বন্ধুর সাথে এভাবে কথা বলতে নেই।’

‘স্যার ওরা তো মুসলমান। ও গেলে ঘরটা…!’

‘নিতাই তুমি চলে যাও। তোমার মত ছাত্র আমি পড়াতে চাই না।’

নিতাই চলে যায়। এরপর সবাই পড়তে থাকে। প্রায় সন্ধ্যা হয়ে গেছে। নিতাই পথে দাড়িয়ে রয়েছে। বনরাজের বই টেনে ছুড়ে ফেলে দেয়।

‘কী করছো নিতাই তুমি এসব।’ দ্বিপকর্মকার বলল,

‘নিতাই তুমি কিন্তু কাজটা ভালো করোনি। ওর ধর্ম আলাদা হতে পারে। কিন্তু ওতো মানুষ। আমাদের ধর্মে এসব নেই। আর ওদের ধর্মেও।’

পরে বই নিয়ে দ্বিপ আর বনরাজ যার যার ঘরে চলে যায়।

চাঁদের বুড়ির গপ্প শোনা শেষ। এখন একটি ভুতের গল্প শোনাও। গল্পের এক পর্যায় ঘুমিয়ে যায় বনরাজ। বনমালি পাশের রুমে চলে যায়। আজও কুপি নিভায়নি বনমালি। ওরা লোকালয় থেকে অনেকটা গভীর জঙ্গলে থাকে। হঠাৎ একটি শব্দ শুনতে পায়। ঘুম ভেঙ্গে যায় বনরাজের। কুপি নিয়ে দেখতে যায়। গিয়ে দেখে একটি চিরকুট।

প্রিয় বনরাজ,

তোমার মধ্যে আমি আকাঙ্খা দেখেছি। যাকে ইংরেজিতে বলা হয় ডিজায়ার। এখন তোমাকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে তুমি জীবনে কী হতে চাও। ভাবতে হবে। চিন্তা করতে হবে।

ইতি

ঝুড়ির দেশে

বুড়ির গপ্পো।

তারিকুল আমিন , প্রাবন্ধিক, গল্পকার, আবৃত্তি ও অভিনয়শিল্পী

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top