শব্দকুঞ্জ বৈশাখী সংখ্যা। মাহফুজ আল-হোসেন এর একগুচ্ছ কবিতা

Spread the love

শব্দকুঞ্জ বৈশাখী সংখ্যা

মাহফুজ আল-হোসেন
এর একগুচ্ছ কবিতা

মাহফুজ আল-হোসেন‌ এর একগুচ্ছ কবিতা

 

এক.

 

সন্তাপ

 

ভবের হাটে পসরা বসায়ে কি লাভ বলো 

এই বিরঞ্জক বৈশাখে,

 

দেহ-ঘাট শুষ্ক কাঠ কলসি কাঁখে দাঁড়িয়ে  

সদু শাহ ঐ বুঝি ডাকে।

 

তার যত তত্ত্ব কথা প্রেমের জবাব নীরবতা 

নিখাদ হবে প্রখর রৌদ্র তাপে,

 

পরাণের যত হাউশ পুড়ে হলো ছাই তুষ তুষ

 

নিদানকালে ডুবিলাম সন্তাপে।

 

 

দুই.

 

নীল-নয়না

 

ক্যাথলাবের অপারেশন টেবিলে এক উদ্ভ্রান্ত  যুবক কলাগাছের মতো শুয়ে আছে ভাবলেশহীন;

 

জীবন মৃত্যুর কাঁটাতারে ঝুলছে এই অর্বাচীনের ভবিষ্যত;

 

অথচ, ডানপিটে ধানক্ষেতের মতো উসকোখুসকো চুলের উজবুক লোকটি  প্ল্যাটফর্ম- লাগোয়া লোকাল ট্রেনের নির্লিপ্ততা নিয়ে নিজের মধ্যেই পরিব্যপ্ত ‌।

 

এদিকে শহরের নামী শৈল্য চিকিৎসক সৈন্য -সামন্ত নিয়ে আসন্ন যুদ্ধের জন্য সশস্ত্র প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে নির্মোহ নিয়মানুবর্তিতায়। 

 

এ কী! সবাইকে চমকে দিয়ে অকস্মাৎ এক অস্থির ইঙ্গিতে অপ্সরী সহকারি সার্জনকে চোখের ইশারায় কাছে ডাকলো ওই অসভ্য যুবকটি ;

 

আর তার আরক্তিম অপ্রস্তুত কানের খুব কাছে এসে ফিসফিসিয়ে বললো: 

অন্তহীন যাত্রার আগমূহূর্তে তোমার মতো নীল নয়না কাউকে বলতে চেয়েছিলাম – ভালোবাসি!

 

 পুনশ্চ: 

অস্ত্রোপচার এখন শেষ পর্যায়ে, ওই নির্বিকার নীলাঞ্জনা নিপুণ সুঁচিকর্মে ভীষণ ব্যস্ত, আর এক আর্কটিক নোনাজল বুকের গভীরে তিনি জমিয়ে রেখেছেন আশ্চর্য এলগরিদমে।

 

 

তিন.

দারবিশের স্বপ্ন

 

কাল রাতে স্বপ্নে দারবিশকে দেখলাম

রক্তের নদী সাঁতরে রিটার বাড়ির দিকে যেতে; 

 

ওদের মাঝখানে গাজায় দাঁড়িয়ে থাকা গালিল এইস্ অ্যাসল্ট রাইফেলটা নদীটিকে  মুহূর্তেই মহাসাগর বানিয়ে দিলো।

 

আর তারই পাড় ঘেঁষে ক’দিন আগে রাফায় ধ্বংসপ্রাপ্ত অ্যাম্বুলেন্স কনভয়ের মধ্যে পড়ে থাকা কয়েক জোড়া কানের দুল থেকে মাথা তোলা এক আজদাহা অজগর তরু দত্তের ক্যাসুয়ারিনার মতোই স্মৃতিকাতরতায় ভুগছে! 

 

সেই সরীসৃপ এখন মুক্তি উপত্যকার দ্বারপ্রান্তে,  

 

আর দারবিশকে নাকি হিস হিস শব্দে জানিয়ে দিয়েছে প্রণয়ী রিটার কাছে পাওয়া বিষাক্ত প্রতিটি চুমুই সে অবধারিতভাবে ফিরিয়ে দেবে এডওয়ার্ড সাঈদীয় অপরতায়…

 

 

চার.

রাস্তার ধারের বেওয়ারিশ গাছটা

 

রাস্তার ধারের ওই বেওয়ারিশ গাছটার কি কোনো নাম আছে?

 

আর না থাকলেই বা ক্ষতি কী–

এ নিয়ে আদৌ  কি কারো‌ কোনো  মাথাব্যথা আছে ?

 

আসলে তো ওর জন্ম-পরিচয়েরই নেই কোনো ঠিক-ঠিকানা।

 

যে পাখিটা দূর থেকে উড়ে এসে এই উর্বর মাটিতে একটা বীজ ফেলে গিয়েছিলো সেই কবে , আজ পর্যন্ত সে জানতেও পারলো না তার ঐ দৈবচয়িত নিক্ষেপের ফলাফলটা কী !

 

আর কেনইবা আজ অবধি এই তল্লাটে তার ফেরার কোনো ইচ্ছা জাগেনি?

 

কী করেই বা সে বুঝবে বলুন, অনাদরে বেওয়ারিশ কুকুরের মতো বেড়ে ওঠা গাছটির রোদ্দুরে পোড়া বুকে‌র জমিনে জমে আছে কতোটা ক্ষোভ আর ভুঁই চাপা অভিমান!

 

কী করেই বা সইবে বলুন বিলবোর্ডের চোখ ঝলসানো নিয়ন আলো আর উন্নয়নের ধূলো জোর করে কেড়ে নিয়েছে ওর চিরল পাতার উজ্জ্বল সবুজ আর উচ্ছল সজীবতা।

 

অথচ দেখুন, ওর থেকে কমবয়েসী দস্যি দালানগুলো কাউকে কিছুই না বলে ক’দিনেই ধেই ধেই করে ওকে ছাড়িয়ে গেল জীরাফীয় উচ্চতায়;

 

অধিকন্তু কর্পোরেট পুঁজির অলীক অহংকারে ওরা হররোজ ধরাকে সরা জ্ঞান করে চলেছে নির্লজ্জ বেহায়াপনায়।

 

পাঁচ.

 

আমি সত্যিসত্যিই হারাবো একদিন

 

আমি  সত্যিসত্যিই পালাবো একদিন

চন্দ্রাবতীর মৃণাল বাহুপাশ ছিঁড়ে;

ময়ুরাক্ষী আকাশের নিরালোক প্রান্তরে,

হারাবো কোটালের কুটিল পাতা থেকে নামগন্ধহীন;

 

হতোদ্যম হাবল দূরবীন আর গুগল‌ মানচিত্রের 

স্থানাঙ্ক পেরিয়ে‌।

 

আমার কারণে যদি কারো হৃদয়ালিন্দে

সুতীব্র ঘাই মারে কাঁটাওয়ালা জলজ্যান্ত জিওল মাছ,

ছাই দিয়ে হাতেনাতে ধরা হোক অনতিবিলম্বে সেই ছদ্মবেশী অনুপ্রবেশকারীকে।

 

আমি একদম চাই না আমার জন্য প্রেরিত শোকবার্তা, ছিটেফোঁটা সাহিত্যকর্মের  প্রশস্তিগাঁথা, বন্ধুবান্ধবদের রচিত নিবেদিত সব কবিতা ফলাও করে ছাপা হোক পছন্দের প্রতিটি দৈনিকে, সাহিত্য সাময়িকী আর লিটল ম্যাগাজিনে ;

 

তবে গণবিনোদনের মহানব্রতে চাঞ্চল্যকর আরেকটি নতুন ঘটনার জন্ম না হওয়া অবধি আমার একান্ত ব্যক্তিগত পত্রাবলি, ডাইরির ছেঁড়া পৃষ্ঠা, আড়িপাতা ফোনালাপ কিংবা গোপন ক্যামেরায় ধারণকৃত খিস্তি খেউড় অথবা রগরগে দৃশ্যাবলির অভব্য কাটপিস ভাইরাল হোক সোশ্যাল মিডিয়ায়,  প্রচারিত হোক প্রতিটি টিভি চ্যানেলের  মারমুখি টকশোতে এবং সচিত্র কেচ্ছাকাহিনীসহ চাররঙা ট্যাবলয়েডের প্রথম ও শেষ পৃষ্ঠায়।

 

অধিকন্তু, আমার জন্য যদি নিভৃতে কারো চোখে সত্যিসত্যিই জল আসে,

খুব করে চাইছি, এখনই নেমে আসুক সে জলের অবিশ্রান্ত প্রপাত শ্রাবণধারায় …

 

© মাহফুজ আল-হোসেন

 

 

কবি পরিচিতি:

 

মাহফুজ আল-হোসেন নব্বই দশকের ব্যতিক্রমী কবি, প্রাবন্ধিক, নন্দনতাত্ত্বিক ও অনুবাদক এবং অধুনাবাদী চিন্তার লিটল ম্যাগাজিন ‘শালুক’- এর সহযোগী সম্পাদক। তিনি দ্বিভাষিক আন্তর্জাতিক লিটারারি জার্নাল Litinfinite এবং বৈশ্বিক বাংলা সাহিত্য বার্ষিকী ‘মা তোর মুখের বাণী’ -এর এডিটরিয়াল বোর্ড মেম্বার। এছাড়াও তিনি অনলাইন লিটারারি পেইজ Poetry and Literature World Vision -এর এডমিন হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। ইমেইল: mahfuzalhossain.bd2018@gmail.com

মাহফুজ আল-হোসেন
কবি ও নন্দনতাত্ত্বিক

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top