শব্দকুঞ্জ শীত সংখ্যা
ওবায়েদ আকাশ এর
একগুচ্ছ শীতের পদাবলি
ওবায়েদ আকাশ এর একগুচ্ছ শীতের কবিতা
এপিসৌড : একটি জামা
[উত্তরবঙ্গে প্রচণ্ড শীতে কয়েকটি মানুষের মৃতমুখ দেখেছি আমি গণমাধ্যমে]
অনেক দিনের গুঞ্জন আজ থেমে গেল। তিলে তিলে পাই-পয়সায় কেনা শীতের জামাটি একজন প্রাজ্ঞ আবহাওয়াবিদ নেড়েচেড়ে বলে, শুকোতে দেবার আগে জামাটির যত্রতত্র যথেষ্টই ছড়িয়ে ছিল মৃত্যুর উপাদান
রঙ নেই অভিলাষ নেই– এমন মন্তব্য করে একজন সেলাইবিদ হাতে নিয়ে বলে, এ-গাঢ় মৃত্যুময় হিমে প্রথম রৌদ্রের আঁচেই আমাদের রাজনৈতিক কিংবা মানবিক প্রপাগাণ্ডাগুলো মুহূর্তে ভাসিয়ে নেবে ব্যবহৃত সমগ্র তাঁতের কারুকাজ
আজ যার মুখাগ্নির চেয়ে বড় প্রয়োজন হলো চারিদিকে নাড়ার আগুনে নির্ণেয় হিংস্র উত্তাপ, অনন্য তার নীল-কালো মুখে মাছিগুলো চুমু খেতে এসে খুইয়েছিল নিজ নিজ ডানা
কাল নেই ব্যাখ্যা নেই– এমন মন্তব্য করে একজন সুশীল পরিবেশবিদ জামাটিকে নাড়ার আগুনে ছুঁড়ে দিয়ে বলে, প্রাকৃতিক ভারসাম্য ধারণে আমাদের যতটুকু উষ্ণতার প্রয়োজন পড়েছে তার যথেষ্টই লুক্কায়িত আছে যুগ যুগ ধরে ব্যবহৃত এই সুতার সামগ্রীতে
ডিসেম্বর বা শীতের এলিজি
আর আমার জন্য পড়ে রইল শীতের বাঁশবাগান
চা-বিরতির পর তোমাকে দেখলাম একজন হাতঘড়ি হয়ে
বদলে নিচ্ছ চিঠির বাক্স, উঠোনের গোলাপগুচ্ছ…
ঝুড়িভর্তি বেতফল নিয়ে ঢেলে দিচ্ছ উদ্যানের টবে
তোমাকে দেখলাম, নামী কোম্পানির মনোগ্রাম নিয়ে
শপিং সরণির দিকে ঝুলিয়ে দিয়েছ তোমার অভ্যর্থনা
পরিবর্তিত তোমার ব্যক্তিগত উঁচু-নিচু সুরম্য মহল
বহু বিস্মৃত হালটের স্নিগ্ধতাগুলো বাতাবিলেবুর মতো
ঝড়ের মর্মর হয়ে গড়িয়ে চলেছে আজ
কাঠ চেরাইয়ের অকথ্য নৈপুণ্যের মতো, ব্যক্তিগত দুঃখগুলো
ভাগ হয়ে জুড়ে যাচ্ছে মেঘে
পরস্পর সঙ্কলিত অর্ঘ্যমঞ্জরি, জনারণ্যে
ভিখিরির হাতে তুলে দেবো বলে
আমাদের জন্য পড়ে আছে পরস্পর ভালবাসাবাসি
অনারোগ্য দ্বিখণ্ডিত চাঁদ
তোমার জন্য প্ররোচিত অন্ধকার নিয়ে উড়ে গেছে
জলের আর্দ্রতা কিছু, পৃথিবীর ঊর্বরতম ধূলি
বাঁশবাগান জুড়ে আছে বিশুষ্ক শীতের পত্রমঞ্জরি
একবেলা রমনাপার্কে
রমনার ঘাসগুলো শীতের মোসাহেবি ভেঙে
একটুও উড়তে পারছে না
না-হয় আমি যাই, ওখানে…
ক্লিবলিঙ্গ যেখানে রোজরাতে গৃহ পাতে
শীতের আঁধার কোরাসে। আর কোনো লাশঘর নেই
হাতিশাল কিংবা রান্নার ধোঁয়া…
ব্যান্ডেজ পায়ে কেউ তবু আসে। ঘুষি মেরে
ছিঁড়ে ফেলে ভেজা অশোকের পাতা–
বাড়িতে ঘুমোচ্ছে যার নবপরিণীতা
তার অম্লরোগ থাকে–
দীর্ঘ প্রাতঃভ্রমণের কালে
ঘাসগুলো শীতের প্রসন্ন রোদে
কখনো দাঁড়াতে পারে না
কেননা, কেউ নবপরিণীতা
একদিন ঘুম ঢুলু ঢুলু শুয়ে পড়ে ঘাসে
ক্লাসের গরাদ ভেঙে ছুটে আসে হৃত বিদ্যালয়
সাম্প্রতিক কলেজের আলো
নিরাপদ দূরে দূরে
এইসব জানাজানি করে তারা
শীতের বিবর্তনগুলি
শীতের প্রবন্ধগুলো শেষ হয়ে এলো। খোলনলচে পালটে ফেলেছে কলাইয়ের মাঠ। আজ কি উঠেছে চাঁদ? ঘাসপাতায় জমে উঠছে পরিব্রজ শিশিরের সুখ। দেখো, সন্ধে হলে পূর্বাপর প্লাবনের মতো অন্ধকার নিভৃত শোকে আমি শীতের প্র¯্রবণ দেখি। আর আমার অধ্যয়ন জুড়ে সুর তোলে নিঃসঙ্গ পেঁচার ভৈরবী। আমি তার প্রাণান্ত অন্ত্য্যমিল ভেঙে খুঁজে পাই পতনের বৈরাগ্য শুধু। তবে কি ঝরেছে শিশির? হাইব্রিড ফলনের কিছু অভাবিত সুখদুঃখ থাকে। আর এই দীর্ঘ প্রবন্ধব্যাপে উল্লিখিত যা যা থাকে– চাদর গোটানো মুখ, মাছ ভাজার ঘ্রাণ, আবাল্য আমাকে কারো ভালবাসার ওম… আজ আমার সংসারে তাকে ব্যবহৃত তুলসীপাতা, অব্যর্থ পথ্যের মতো উপলক্ষে প্রযত্নে রেখেছি
সন্ধ্যাতারা
শীতের প্রকার জেনে জেগেছিল সন্ধ্যাতারা
অনন্ত আকাশে
শীত, বহুদূর প্রবাসে বসে ফাগ্লুনের গল্প বলে
উড়ে যায় নিকট পরিজনে
কাতরতা, মূলত শীতের অন্য নাম
অসংখ্য প্রকার তার পৃথিবীতে প্রচলিত আছে
কোনো এক শীতের উষর বারান্দায় বসে
গুনে দেখি মেঘবর্তী ঝরাপাতাগুলি
সন্ধ্যাতারা ভেসে থাকে তারও বহু পরে
কাতর মুহূর্তগুলো চিনে রাখে
রোগশয্যায় শ্বেতাভ চাদর, আর
চিকিৎসক বলে দেন শীতের প্রকৃত প্রকার
ঘুম নেই, সন্ধ্যাতারা মিশে থাকে আলোকমালায়
গাছের কোটর থেকে বেরিয়ে আসছে শীতকাল
আর আমার আছে– এইসব শীতের মুগ্ধতা
যৌবন-বান্ধব বলে কিছু কি আছে?
যা আমাকে প্রশ্ন করেছিল শীতকাল
রাত্রিদিন ভালবাসি– ধানকাটা শেষ হবার পর
ধূসর খড়ের মাঠ
শীতকাল নিয়ে আমার এক কিশোরীর গল্প আছে
পৌরাণিক ধাতব আয়নায় গড়া তার প্রসন্ন শরীর
বাঁকা ভ্রু, চাঁদের মতো মুখ, বোকার মতো হাসে…
একবার আগুনের ফুলকি উড়িয়ে
অনন্ত কাল ধরে রৌদ্র পোহায়
একবার ভালবাসলে– অনন্ত কাল ধরে
বিরহ নাটকে একক সম্রাজ্ঞী সে
গাছের কোটর থেকে বেরিয়ে আসছে শীতকাল
কুয়াশারা বমি করছে–
উনুন থেকে রসের হাঁড়ি ঠোঁটে করে, ঝরে পড়ছে
অশান্ত সকাল
শীতার্ত চাঁদের ঘরে খদ্দেরের ঝগড়ার রীতি
ভেঙে দিচ্ছে শীতরাতের ঘুম
এখনো শীতের কিশোরী ঘাসের মতো হাসে–
বোগল থেকে সৌরবর্ষ খুলে রেখে
সভ্যতার মানচিত্র তাড়ায়
আমারও শীতের মুগ্ধতা আছে– কেননা
হাতে হাত ঘষে এখনো আগুন জ্বালাতে পার
ওবায়েদ আকাশের জন্ম : ১৩ জুন ১৯৭৩; সুলতানপুর, রাজবাড়ী। একাডেমিক
পড়াশোনা : বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতকোত্তর।
পেশা : গণমাধ্যমে চাকরি। বর্তমান কর্মস্থল : দৈনিক সংবাদ। প্রকাশিত গ্রন্থসংখ্যা :
কবিতা, অনুবাদ, গল্প, প্রবন্ধ, সম্পাদনা মিলিয়ে ৩৭টি।
কাব্যগ্রন্থ:
পতন গুঞ্জনে ভাসে খরস্রোতা চাঁদ (২০০১), নাশতার টেবিলে প্রজাপতিগণ (২০০৩),
দুরারোগ্য বাড়ি (২০০৪), কুয়াশা উড়ালো যারা (২০০৫), পাতাল নির্মাণের প্রণালী
(২০০৬), তারপরে, তারকার হাসি (২০০৭), শীতের প্রকার (২০০৮), বিড়ালনৃত্য, প্রেতের মস্করা (২০০৯), যা কিছু সবুজ, সঙ্কেতময় (২০১০), প্রিয় কবিদের রন্ধনশালায় (২০১১), শুশ্রূষার বিপরীতে (২০১১), রঙ করা দুঃখের তাঁবু (২০১২), বিবিধ জন্মের মাছরাঙা (একটি দীর্ঘ কবিতা, ২০১৩), তৃতীয় লিঙ্গ (কয়েকটি দীর্ঘ কবিতা, ২০১৩), হাসপাতাল থেকে
ফিরে (২০১৪, কলকাতা), ৯৯ নতুন কবিতা (২০১৪), পাতাগুলি আলো (২০১৬), তথ্যসূত্র পেরুলেই সরোবর (২০১৮), সর্বনামের সুখদুঃখ (২০১৯) এবং পৃষ্ঠাজুড়ে সুলতানপুর
(২০২০), নির্জনতা শুয়ে আছে সুমদ্র প্রহরায় (২০২১)
কাব্য সংকলন:
ঋতুভেদে, পালকের মনোবৃত্তিগুলি (কাব্য সংকলন, ২০০৯), স্বতন্ত্র ৬০টি কবিতা
(কাব্য সংকলন, ২০১০), ওবায়েদ আকাশের কবিতা ॥ আদি পর্ব (কাব্য সংকলন, ২০১১), উদ্ধারকৃত মুখমণ্ডল (বাংলা একাডেমি প্রকাশিত নির্বাচিত কাব্য সংকলন, ২০১৩),
মৌলিক পৃষ্ঠায় হেঁয়ালি (কাব্য সংকলন, ২০১৭, কলকাতা), বাছাই কবিতা
(২০১১থেকে২০১৮ পর্যন্ত নির্বাচিত কাব্য সংকলন, ২০১৮), স্বতন্ত্র কবিতা (স্বতন্ত্র
কাব্যসংকলন, ২০১৮), শ্রেষ্ঠ কবিতা (কলকাতা, ২০১৯)। কাগুজে দিন কাগুজে রাত (২০২২)
Translated Book (Poetry Collection)
Faux Assassin -Translated by : Ashoke Kar, Haikal Hashmi, Mahfuz Al-Hossain, Razia Sultana and Kamrul Hasan. (2019)
শিশুতোষ গ্রন্থ : ভূতের বাপের শ্রাদ্ধ, ২০১৯
অনুবাদ:
ফরাসি কবিতার একাল / কথারা কোনোই প্রতিশ্রুতি বহন করে না’ (২০০৯)
‘জাপানি প্রেমের কবিতা / এমন কাউকে ভালোবাসো যে তোমাকে বাসে না’ (২০১৪)
গদ্যগ্রন্থ :
‘ঘাসের রেস্তরাঁ’ (২০০৮),
‘লতাপাতার শৃঙ্খলা’ (২০১২)
সম্পাদনা গ্রন্থ :
‘দুই বাংলার নব্বইয়ের দশকের নির্বাচিত কবিতা’ (২০১২),
পাঁচ দশকে বাংলাদেশ : সাহিত্য সংস্কৃতি সমাজভাবনা (বিশিষ্ট কবি লেখক বুদ্ধিজীবীর
সাক্ষাৎকার সংকলন, ২০১৮),
সম্পাদিত লিটল ম্যাগাজিন :
শালুক (১৯৯৯–)
পুরস্কার :
এইচএসবিসি–কালি ও কলম তরুণ কবি ও লেখক পুরস্কার ২০০৮
কলকাতা লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরি ও গবেষণা কেন্দ্র পুরস্কার ২০০৯
লন্ডন থেকে প্রাপ্ত সংহতি লিটারারি সোসাইটি বিশেষ সম্মাননা ২০১২
কলকাতা থেকে ঐহিক মৈত্রী সম্মাননা পদক ২০১৬