You are currently viewing শব্দকুঞ্জ ঈদসংখ্যা-২০২৪। গল্প: উপহার-দীপঙ্কর সাহা

শব্দকুঞ্জ ঈদসংখ্যা-২০২৪। গল্প: উপহার-দীপঙ্কর সাহা

শব্দকুঞ্জ ঈদসংখ্যা-২০২৪

গল্প: উপহার
দীপঙ্কর সাহা

শব্দকুঞ্জ ঈদসংখ্যা-২০২৪

উপহার

দীপঙ্কর সাহা



এক – যাত্রা বিপর্যয়



শেষ পর্যন্ত ফ্লাইট মিস্ করলো সৃজিতা। অফিসে একটা জরুরি মিটিং ছিল।
ফলে অফিস থেকে ফিরতেই আজ বেশ দেরি হয়ে গেল।
 

সময়টা দু’হাজার কুড়ি সালের মাঝামাঝি। করোণার প্রথম ঢেউ তখন থাবা বসিয়ে
রেখেছে পৃথিবীর বুকে। রাত্রি বেলা সুরজিতের হোয়াটসঅ্যাপে ভিডিও কল এলো। মুখটা শুকনো,
গালে দিন দুয়েকের শেভ না করা দাড়ি।
 

– শোনো আমি করোণা পজিটিভ। দিন দুয়েক ধরে জ্বর আর গলা ব্যাথা । প্যারাসিটামল
খাচ্ছি। গতকাল থেকে মুখে স্বাদ গন্ধ নেই দেখে, অন লাইনে ডাক্তারের সাথে কথা হল, উনি
টেস্ট করতে বলায়, করতে দিলাম। আজ রিপোর্ট পেলাম, পজিটিভ। তুমি কি কাল আসতে পারবে?

না গিয়ে উপায় কি! সুরজিৎ একা থাকে ব্যাঙ্গালোরে। এই অসুখে তো একঘরে
হয়ে পড়ে থাকবে, কেউ ফিরেও তাকাবে না। খাবার ব্যাবস্থা, চিকিৎসা আরো আনুসাঙ্গিক সব
কিছু একা সামলাবে কি করে সুরজিৎ! তারপরে যদি বাড়াবাড়ি কিছু হয়!
 

এদিকে অফিসে জরুরি কাজে আটকে আছে সৃজিতা। কালকেই একটা জরুরি মিটিং আছে,
চার পাঁচ জায়গা থেকে সৃজিতার টিমের মেম্বাররা অনলাইন এটেন্ড করবে।
 

এদিকে ওয়ার্ক ফ্রম হোম করা যাবে না। কারণ সার্ভারের কিছু কপি প্রোটেক্টেড
জরুরি ফাইল থেকে ডাটা সংগ্রহ করে প্রেজেন্টেশন দিতে হবে সৃজিতাকে। এই ফাইলগুলোর এ্যকসেস
সৃজিতা ছাড়া টিমের কারো নেই। তাও আবার রিমোট এ্যকসেস হয় না, শুধুমাত্র অফিসের কয়েকটি
বিশেষ টার্মিনাল থেকেই এবং কোম্পানির মাত্র দু’তিন জনের জন্যই সংরক্ষিত গোপন ফাইলগুলি।
 

ফলে সকালের ফ্লাইটে ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও স্থান বুক করা গেল না। অনেক
চিন্তা ভাবনা করে সৃজিতা সন্ধ্যা পার করে রাত্রের দিকের ফ্লাইট বুক করলো। সুরজিৎ কে
  বলে দিল একটা এস-এম-এস করে দাও, পথে দরকার হতে পারে। 

জিনিস পত্র প্যাক করাই ছিল। অফিস থেকে ফিরে, ক্যাব বুক করতেই পেয়ে
গেল চট করে। উবের ক্যাবটা চলছিলো ভালোই। পথে তিন জায়গায় পুলিশ চেক।
 

লক ডাউনের দুর্ভোগ। এয়ার টিকিট আর সুরজিতের এস-এম-এস টা মোবাইলে খুলেই
রাখা ছিল। দেখিয়ে তবে মুক্তি।
 

করোণা তখন জমিয়ে খেলা শুরু করেছে, পৃথিবীর বুকে। চারদিকে একটা ভয়ের
বাতাবরণ। তার মাত্র মাস ছয়েক আগে সুরজিৎ যখন প্রমোশন উইথ ট্র্যান্সফার নিয়ে, ব্যাঙ্গালোর
চলে গেল, তখন কি ঘূণাক্ষরেও কেউ আজকের পরিস্থিতির আঁচ করতে পেরেছে?
 

না অবশ্যই পারেনি। পারলে কি আর, এই ভাবে সুরজিৎ সৃজিতাকে একা ফেলে রেখে
ব্যাঙ্গালোর চলে যেতে পারতো!
 

রাস্তায় গাড়িঘোড়া একটু কম হলেও, প্রায় প্রতিটি সিগন্যালে দাঁড়াতে
হচ্ছে এবং সৃজিতার টেনশন বাড়িয়ে দিচ্ছে। লেকটাউনের যানজট ছাড়িয়ে গাড়িটা ভালোই
চলছিল। একটু দেরি হলেও মনে হচ্ছে ফ্লাইটটা ঠিক ধরা যাবে।
 

এমন সময় একটা পুলিশ ভ্যান ক্যাবটার গা ঘেঁষে ওভারটেক করতে গিয়ে, ধাক্কা
মেরে চলে গেল। উবের ক্যাবটা দিশাহারার মতো খানিকটা এগিয়ে থমকে দাড়াল।

– ম্যাডাম, আপনি অন্য গাড়ি দেখে নিন, এ গাড়ি আর যাবে না, ব্রেক লাগছে
না। ক্যাব চালকের কথায় সম্বিত ফিরে পেল সৃজিতা।
 

অন্য ক্যাব পেতে পেতে পরিস্কার বোঝা গেল ফ্লাইট আজ মিস হয়ে যাচ্ছে।

এদিকে অফিসের কাজের চাপে সৃজিতা অনলাইন চেক ইন করতে একদম ভুলে গেছে। ইতিমধ্যে সৃজিতা
এও দেখে নিয়েছে পরশু রাতের আগে আর কোন ফ্লাইটে জায়গা নেই।
 

অন্য ক্যাবে বসে সুরজিৎকে কল করে জানিয়ে দিলো সব। এক্সিডেন্টের কথা,
ফ্লাইট মিস হয়ে যাচ্ছে, সেই কথা এবং পরশু রাতের আগে পৌছতে পারছে না।
 

এয়ারপোর্ট পৌছল ফ্লাইট ছাড়ার ঠিক দশ মিনিট আগে। ততক্ষণে কাউন্টার

বন্ধ হয়ে গেছে। সৃজিতা এখন কি করবে, ফিরে যাবে! এদিকে চিন্তায় মাথাটা ধরে আছে সৃজিতার। 

দুই – শুভ যাত্রা

মরিয়া হয়ে ম্যানেজারের সাথে দেখা করে সব খুলে বলতে, তিনি এক রাস্তার
হদিশ দিলেন। ঘন্টা দেড়েক পর হায়দ্রাবাদের এক ফ্লাইট আছে, রাত সাড়ে বারোটা নাগাদ পৌছবে।
পরদিন ভোর সাড়ে চারটেতে ব্যাঙ্গালোর যাবার ফ্লাইট পাওয়া যাবে ওখান থেকে।

সৃজিতা রাজি হতেই সব ব্যাবস্থা হয়ে গেল কয়েক মিনিটে। সিকিউরিটি চেক

করিয়ে, বসে তবে স্বস্তির নিঃশ্বাস। 

সুরজিৎ কে কল করতে গিয়েও করলো না সৃজিতা। সুরজিৎ তো সর্বদাই সারপ্রাইজ
দেবার বাহানা খোঁজে, কাল সকালে পৌছে নাহয় সৃজিতা একটু চমকে দিল সুরজিৎকে!
 

মাস ছয়েক আগে খানিকটা ভুল বোঝাবুঝির জেরেই প্রোমোশন ও ট্রান্সফার নিয়ে

ব্যাঙ্গালোর চলে যায় সুরজিৎ। অফিসের এক সুপুরুষ সহকর্মীকে নিয়ে ভুল বোঝাবুঝি। 

সৃজিতা চেষ্টা করেও ওকে বুঝিয়ে উঠতে পারেনি, অধস্তন সহকর্মীর সাথে
প্রেম করার
  মতো রুচিহীন নয় সৃজিতা। 

হায়দ্রাবাদ পৌছে মনটা খারাপ হয়ে গেল শঙ্খের কথা ভেবে। শঙ্খ সুরজিৎ
সৃজিতার একমাত্র পুত্র। বছর খানেক হলো ইঞ্জিনিয়ারিং এর পাঠ শেষ করে, চাকরিতে ঢুকেছে,
একটা বিদেশি সফ্টওয়্যার কোম্পানিতে। পোস্টিং এই হায়দ্রাবাদেই।
 

আপাতত ওয়ার্ক ফ্রম হোম চললেও সপ্তাহে একদিন রিপোর্ট করতে হয়, সব জুনিয়র
ইঞ্জিনিয়ারদের। ফলে হায়দ্রাবাদেই পড়ে থাকতে হচ্ছে ছেলেটাকে।
 

শঙ্খটা হয়েছে একদম ওর বাবার কার্বন কপি। হুজুগে, ছটফটে এবং খামখেয়ালি। 

ঘুণাক্ষরেও যদি জানতে পারতো, মা এসে এয়ারপোর্টে বসে থাকবে, তাহলে ঠিক
পঞ্চাশ কিলোমিটার ড্রাইভ করে পৌছে নিয়ে যেতো মাকে নিজের ঘর দেখাতে। যেতে আসতেই যদি
দু ঘন্টা চলে যায়, তাহলে ছেলের ঘর দেখেই আবার রওয়ানা হতে হতো। মাঝখান থেকে ছেলেটার
ঘুমের বারোটা!
 

তাছাড়া শঙ্খটা বাইক চালায় পাগলের মতো বেগে, সৃজিতা রীতিমতো ভয় পায়
ওর পিছনে বসতে।
 

সিকিউরিটি চেক করিয়ে দেখে বেশ কিছু যাত্রী ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে আছে।
দেখে তবে স্বস্তি, হাতে রাখা স্যানিটাইজার ছিটিয়ে আরাম করে বসে পরলো সৃজিতা।

সুরজিৎ অবশ্য রাগ করে বেশিদিন থাকতে পারে না। ব্যাঙ্গালোরে ওর কাজে
ওর অফিস খুব খুশি। তাই কোলকাতা ট্র্যান্সফারের কথা ভুলে যেতে বলেছে কোম্পানি। একটা
মস্ত বড়ো ইনক্রিমেন্ট দিয়ে খুশি করতে চেয়েছে ওকে।
 

কি আর করবে! দুজনকেই মানিয়ে নিতে হয়েছে পরিস্থিতি। চিন্তায় মশগুল
সৃজিতা হঠাৎ খেয়াল করে, বোর্ডিংয়ের জন্য লাস্ট কল ঘোষনা করছে।
 

তড়িঘড়ি সিট ছেড়ে উঠে পড়ে সৃজিতা, এগিয়ে যায় বোর্ডিং গেটের দিকে….. 

 


তিন – রহস্যময় উপহার

ভোর রাতের ফ্লাইট একদম সঠিক সময়ে ব্যাঙ্গালোর পৌছে দিল সৃজিতাকে। একটা
ক্যাব ধরে, সুরজিতের ঠিকানা খুঁজে, যখন কলিং বেল টিপতে যাবে, তখনো সূর্যদেব মুখ দেখান
নি।
 

দরজা খুলেই সুরজিৎ জড়িয়ে ধরে সৃজিতাকে। – আমি জানতাম তুমি ঠিক ম্যানেজ
করে এসে হাজির হবে।
 

– ছাড়ো, তুমি না করোণা পজিটিভ! 

– মিথ্যে, মিথ্যে, মিথ্যে। না বললে কি তুমি ছুটে আসতে এই ভাবে? 

– এই এক মুখ দাড়ি নিয়ে অফিস যাচ্ছো কি করে? 

– চকচকে গাল দেখিয়ে ভিডিও কল করলে তুমি কি আসতে ছুটে! এই যে ম্যাডাম,

এই হলো আমার অফিস যাবার মুখোশ। কে বলবে বোস সাহেবের মুখে একগাল দাড়ি! 

মূহুর্তে একটা সুদৃশ্য মাস্ক মুখে গলিয়ে দেখায় সুরজিৎ। এক লহমায় ওর

অসুস্থ চেহারাটা চিরপরিচিত স্মার্ট সুরজিৎ-এ পরিনত হয়। 

– টায়ার্ড ? রাতভর ঘুমাওনি তো! একটু বিশ্রাম নিয়ে নাও। 

– একদম টায়ার্ড না। 

– তাহলে শোন, দুধ এনে রেখেছি, জম্পেশ করে পায়েস রান্না করো, তোমার
সেই স্পেশাল রেসিপি। আর শোনো, তোমার জন্য একটা গিফ্ট বুক করা আছে। ঘন্টা খানেকের মধ্যে
ডেলিভারি দিয়ে যাবে। নিয়ে নিও। আমি একটু না শুয়ে পারছি না।
 

– তুমি কি গো? ছেলেটার না আজ জন্মদিন! বেচারা শঙ্খ ওখানে বসে হোম ডেলিভারির
বিস্বাদ খাবার খাবে, আর তোমার আজকেই খাওয়া চাই পায়েস?
 

– করো না গো, কতদিন খাইনি তোমার হাতের রান্না। আজ পায়েসটাই খুব খেতে

মন চাইছে। 

এর পর আর কি বলবে সৃজিতা? মুখ হাত ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে নিয়ে, কাজে লেগে
পড়লো। পায়েস রাঁধছে, আর শঙ্খের মুখটা ভেসে উঠছে ওর মানসপটে।

কি যে ভালবাসে ছেলেটা ওর হাতের রান্না পায়েস খেতে! কতদিন দেখা নেই
ছেলেটার। হোয়াটসঅ্যাপ ভিডিও কলে মুখ দেখে কি আর মায়ের মন ভরে!

হায়দ্রাবাদে রাতভর বসে থেকেও ছেলেটাকে একটুখানি দেখতে পেলো না, খুব
আফসোস হচ্ছে। এখন মনে হচ্ছে এয়ারপোর্টে শঙ্খকে ডেকে নিলেই হতো!
 অনেক দিন পর পায়েস রাঁধছে, কিন্তু মনটা পড়ে আছে হায়দ্রাবাদে। রান্না

শেষ করে গ্যাস বন্ধ করতে যাবে, ঠিক সেই মুহুর্তে কলিং বেল বেঁজে ওঠে। 

নিশ্চয়ই কুরিয়ারের লোক হবে, কি গিফ্ট বুক করে রেখেছে কে জানে! এদিকে
সাহেবের তো নাক ডাকছে। কি যে ছেলেমানুষ না লোকটা!
 

দরজা খুলতেই দেখে ছ’ফুট লম্বা এক চির-পরিচিত নবযুবক ! দারুণ এক চমক
!! শঙ্খ !!!
 

– মা তুমি এসে গেছো? 

এক ঝটকায় মাকে শুন্যে তুলে নিয়ে এক চক্কর ঘুরে নিল শঙ্খ !!

 

শ্রী দীপঙ্কর সাহা একজন অবসরপ্রাপ্ত ইন্সট্রুমেন্টেশন ইঞ্জিনিয়ার। জন্ম তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের যশোর শহরে। ছোটবেলা থেকেই লেখালেখির সাথে জড়িত। স্কুলে পড়াকালীন তিন বৎসর যাবৎ এক মাসিক দেওয়াল পত্রিকা সম্পাদনা করার অভিজ্ঞতা আছে।  সত্তরের দশকে নিজ নামে ও “শঙ্খদীপ সেন” ছদ্মনামে প্রচুর রহস্য, রোমাঞ্চ, ভৌতিক ও কল্পবিজ্ঞান শ্রেণীর লেখার অভিজ্ঞতা আছে, যার সবই বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত। কিছু অনুবাদ কাজেরও অভিজ্ঞতা আছে। দুটি বই প্রকাশিত।  তারপর কর্মসুত্রে সুদূর রাজস্থানে চলে যাওয়ায় যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় ও লেখালেখিতে ছেদ পড়ে যায়। সুদীর্ঘ এগারো বৎসর ইন্সট্রুমেন্টেশন লিমিটেড এবং তেইশ বৎসর স্টিল অথরিটি অব ইন্ডিয়ায় চাকরি শেষে অবসর গ্রহণের পর এল এন্ড টি, কোলকাতায় এডভাইজার হিসাবে দুই বৎসর কাজ করে পুরোপুরি ভাবে অবসর প্রাপ্ত। 

বছর তিন চার পূর্বে করোণার আবহে যখন জীবন ব্যতিব্যস্ত, তখন লেখালেখির কাজ নতুন করে শুরু হয় এবং ইতিমধ্যে চারটি গল্পগ্রন্থ এবং দুটি অনুবাদ গ্রন্থ প্রকাশিত হয়ে

Leave a Reply