শব্দকুঞ্জ স্মৃতিময় আষাঢ় সংখ্যা
গল্প
বৃষ্টিতে একদিন
মুহাম্মদ ফজলুল হক
বৃষ্টিতে একদিন
মুহাম্মদ ফজলুল হক
বর্ষা এলেই উদাস উদাস লাগে। মেঘবৃষ্টির খেলায় আলাদা অনুভূতি জেগে উঠে। চারপাশে পানি আর পানি। বাড়ীর সামনে উঠান অবধি এসেই থেমে থাকে না পিছনে শৌচাগার ছাপিয়ে রান্নাঘর পর্যন্ত পানিতে সায়লাভ হয়ে যায়। সকালে ঘুম থেকে উঠলেই অস্বস্তি বাড়ে। প্রকৃতির ডাকে সারা দেওয়া কঠিন হয়ে যায়। পানি সংলগ্ন খোলা জায়গায় কাজ সারতে হয়। রান্নাঘরের পিছনে নতুন শৌচাগার তৈরি হয়েছে। শৌচাগার বলতে দুটো করে বাঁশ আড়াআড়ি মাটিতে চাপিয়ে মাঝে আরেকটি বাঁশ রেখে চট দিয়ে কোনরকমে আব্র রক্ষার ব্যবস্থা।
ঘর থেকে বের হলেই নতুন নতুন অভিজ্ঞতা। স্বচ্ছ পানিতে নানান প্রজাতীর মাছ একইসাথে সিক্ত মাটিতে শামুক-ঝিনুকসহ অন্যান্য অচেনা প্রাণির
উপস্থিতি শায়লার মন ভালো করে দেয়। চারপাশে তাকিয়ে চট সরিয়ে পায়খানায় প্রবেশ করে ঝোলানো বাঁশ ধরে অন্য বাঁশের উপর বসে। নিচের স্বচ্ছ পানিতে নিজের ছায়া অবলোকন করে অবাক হয়। আরো অবাক হয় ছায়ার মাঝে ছোট ছোট রঙ্গিন মাছের আনাগোনা দেখে। আনমোনা হয়ে যায় সে। মাছের ছুটাছুটি বেড়ে যায়। কই, শিং ও মাগুর মাছের হল্লাতে পানি যেন উপচে উঠে। কিছুক্ষণ পর বড় মাছ পরিবর্তে আবার ছোট মাছের উপস্থিতি বাড়ে। পানির শব্দে টনক নড়ে। বের হয়ে আসে শায়লা।
ঘরে এসে মাছের জন্য খাবার নিয়ে যায়। রান্নাঘরের পিছনে পরিষ্কার জায়গায় দাড়িয়ে মাছেদের ডেকে খাবার দেয়। নানান মাছের খাবারের প্রতিযোগিতা দেখে আনন্দে অনুভব করে। হাঁস মুরগীর ঘর খুলে দেয়। নাচতে নাচতে হাঁস পানিতে ঝাপিয়ে পড়ে। মুরগীদল উঠানময় পায়চারি করে খাবার খুঁজতে থাকে। বৃষ্টির মাঝে হাঁস, মুরগী, মাছ ও পানির অন্তহীন সৌন্দর্য অবলোকন করতে করতে দুপুর হয়ে যায়।
গ্রামের সবাই মনে হয় দুপুরেই গোসল করে। ছোট থেকে বড় সবার যেন এই সময় পছন্দ। সবার বাড়ির সামনে পানি তবু গোসল করার জন্য আলাদা ঘাট আছে। শায়লাদের বাড়ি থেকে দুই বাড়ি এগিয়ে বাম দিকে এগুলে ঘাট দেখা যায়। ঘাটের পাশ দিয়ে নৌকা নিয়ে মানুষ চলাচল করে।
মাটি আর পানি প্রায় সমান সমান। ঢেউ এসে আছড়ে পড়ায় বাড়িঘর ভাঙ্গছে। কাঠ-বাঁশসহ নানা উপকরণ দিয়ে ভাঙ্গা রোধের কত প্রচেষ্টা চোখে পড়ে।
কলাগাছ ও বাঁশ দিয়ে ঘাট বানানো। নামেই ঘাট! আশপাশের সব জায়গায় মানুষ গোসল করছে। গরু-ছাগল গোসল করাচ্ছে। পোলাপান দল বেঁধে হৈ-হুল্লোড় করছে। তলিয়ে যাওয়া পুকুর পাড়ের হিজল গাছ থেকে লাফিয়ে পানিতে পড়ছে। পানি দেখে রাগ উঠে শায়লার। একটু শান্তিমত গোসল করবে সে ব্যবস্থা নেই। টিপটিপ বৃষ্টি, ঢেউয়ের যন্ত্রণা, কুচুরি পানার বাড়াবাড়ি তার উপর
পোলাপানের লুটোপুটিতে সব একাকার। শম্পা, ময়না, টুম্পা, রাশেদ, আলম ও কবিরকে চোখে পড়ে। গাছ উঠে বিভিন্ন ডাল থেকে মনের সুখে লাফিয়ে পানিতে পড়ছে। তর সয় না শায়লার। সব রাগ উবে যায়। হাতের কাপড় রেখে দৌড়ে পানিতে নামে। সাতার কেটে পুকুর পাড়ে যায়। তাকে দেখে খুশি হয় সবায়। হাত নেড়ে স্বাগত জানায়। গাছে উঠে শায়লা। সবচেয়ে উপরের ঢাল থেকে লাফ দেয়। আহা! শান্তি। এভাবে চলতেই থাকে। শরীরে শ্যাওলা জমছে। চোখ লাল হয়ে আসছে। ক্লান্তি নেই কারো।
টুম্পা কাছে এসে বলে, চল সাতার কেটে টিলায় যাই। অনেক মজা হবে। যেমন ভাবনা তেমন কাজ। সবাই সাতার শুরু করে। সবার আগে টুম্পা, রাশেদ ও শায়লা। ছোট ছোট ঢেউ ভেঙ্গে এগিয়ে চলছে। টিলা এখান থেকে নিকটে মনে হলেও বেশ দুর। নদী ও গ্রামের মাঝখানে টিলা। টিলা বলতে উচুঁ জমি৷ কয়েক বছর আগে শায়লার দাদা এই জমি ক্রয় করে পুকুর কেটেছে। পুকুর কাটা মাটি জমা করা রাখায় দুর থেকে টিলার মত দেখায়।
টিলা পানি থেকে সামান্য উপরে। পরিপূর্ণ বর্ষা না হলে ডুবে না।
একসাথে অনেকে সাতার শুরু করলে মাঝপথে থেমে যায় অনেকে। পুকুর পাড় দিয়ে ফিরে আসে। টিলার নিকটবর্তী দেখা যায় রাশেদ ও শায়লাকে। চারদিকের পানির বিশালতায় ভয় ঢুকে রাশেদের মনে। শায়লা অভয় দেয়। ভয় পাস না। আরেকটু। আমরা পৌঁছে যাবো। রাশেদের ভয় কাটে না। পাশাপাশি সাতার কাটে দুজন। শায়লা সহায়তা করে। হাত ধরে পৌঁছে যায় টিলাতে।
টিলায় পৌঁছে শান্ত হলেও গভীর ক্লান্তিবোধ করে। হাত-পা ছড়িয় আকাশ পানে তাকিয়ে শুয়ে থাকে দুজন। এভাবে কতক্ষণ ছিল টের পায় না কেউ। চোখ মেলে অবাক হয় রাশেদ। ভেজা শরীরে কি অপরূপ লাগছে শায়লাকে। তাকিয়ে থাকে পলকহীন। চোখ ফেরাতে পারে না। সতেজ হয়ে উঠে সে। শায়লার পায়ের দিকে চোখ যায়। গোড়ালির কাছে রক্ত ঝড়ছে। ভালো করে তাকিয়ে দেখে একটি জোক রক্ত চুষে নিচ্ছে। হাত দিয়ে
সরালে উঠে বসে শায়লা। তীর্যক দৃষ্টিতে রাশেদের দিকে তাকিয়ে বলে শালার জোক রক্ত খাওয়ার আর সময় পাওনি। হেসে উঠে রাশেদ। হেসে উঠে শায়লাও।
পুরো টিলা ফাঁকা হলেও বিভিন্ন ময়লা আবর্জনা, পোকামাকড় ও শামুক ঝিনুকে ভরপুর। উল্টাদিকে কিছু হাঁস দেখা যায়। হাঁস দেখে শায়লার মনে হয় একটু খোঁজলে নিশ্চয়ই ডিম পাওয়া যাবে। দুজনে মিলে ডিম খুঁজতে যায়। হাঁসের মৈথুন চোখে পড়ে।না দেখান ভান করে রাশেদ। ইতোমধ্যে ডিমও খুঁজে পায় কয়েকটি। ফিরে আসার প্রস্তুতি নেয়। আকাশ মেঘলা হয়ে উঠে। কিছু বুঝার আগেই মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হয়। বৃষ্টির আনন্দে রাশেদের হাত ধরে নেচে উঠে শায়লা। বৃষ্টি বাড়তে থাকে।
বৃষ্টির ফোঁটা ঘন হয়ে আসে। আকাশ নিজেই যেন ভেঙ্গে পড়েছে। দিগন্তজোড়া পানিপ্রবাহে কেবল ঢেউয়ের খেলা। বৃষ্টির সাথে ঢেউয়ের মিলনে অপূর্ব সংগীত সৃষ্টি হয়। শায়লা সেই সংগীতে নিজকে উজার করে দেয়। মাথা উপরের দিকে তুলে চোখ
বন্ধ করে হাত ছড়িয়ে নাচতে থাকে। রাশেদ হতচকিত হয়ে তাকিয়ে থাকে। তার জীবনে এমন মুহূর্ত আগে কখনো আসেনি। পৃথিবী থেমে গেছে বলে মনে হয়।
তুই পাগল, বলে রাশেদ। শায়লা চোখ মেলে তাকায়। এই তো বৃষ্টি। ইস, সময় যদি থেমে যেত। এই বৃষ্টি, এই পানি সব এমনই থাকুক চিরকাল। রাশেদ অপ্রস্তুত হয়। মাথা ঘুরিয়ে দেখে চারপাশে কেউ নেই। অস্পষ্টভাবে দূরে কিছু মানুষ দেখা যায়। ডিম আঁচলে জড়িয়ে নেয় শায়লা।
রাশেদ বলে, মাথায় কিছু আছে? না রে, শুধু বৃষ্টি আছে। তুই বুঝবি না। যারা বৃষ্টিতে ভিজে না তারা কখনো বুঝবে না এই আনন্দ।
হঠাৎ বজ্রপাত হয়। আকাশ গর্জে উঠে। রাশেদ বলে, চল এবার বাড়ি যাই। শায়লা চুপ থাকে। তারপর বলে, একটু দাঁড়া। ওইদিকে যাই। তোকে একটা জিনিস দেখাবো। সে আবার কী? শায়লা জামা খুলে শেমিজ তুলে বুকের মাঝখানে একজোড়া তিল দেখায়। ভালো করে দেখে রাখ।
প্রথমটির নাম শায়লা, দ্বিতীয়টির নাম রাশেদ। তারা জীবনভর পাশাপাশি থাকবে। বৃষ্টির ছোঁয়ায় শায়লার মুখ, ভেজা চুল, চোখ ও ঠোঁটসহ সমগ্র শরীর অপূর্ব দীপ্তি ছড়ায়। চুপচাপ তাকিয়ে থেকে স্তব্দ হয়ে যায় রাশেদ। তার চোখে আগুন লাগে।পুড়ে যাওযার সুখে চোখ বন্ধ হয়ে আসে। রাশেদের উত্তাপের সুখে পুড়তে থাকে শায়লাও। উত্তাপ ক্রমান্বয়ে সারা দেহে ছড়িয়ে পড়ে। জ্বলেপুড়ে অঙ্গার হতে হতে বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে শান্ত হয় দুজন।
তুই সত্যি আলাদা শায়লা। অন্যরকম। রাশেদ নিরবতা ভাঙ্গে। শায়লা হেসে বলে, তা জানি। তোকে একটা কথা বলি রাশেদ। কেউ জানে না আমি মাঝে মাঝে এখানে আসি। শুধু বৃষ্টির দিনে। জায়গাটা আমার খুব পছন্দের। চাইলে কাঁদতে পারি। আনন্দে আবার নাচতেও পারি। তুই সত্যি অনন্য সুন্দর। আজ প্রথম দেখলাম তোর অনন্যনতা। তুই কবি হলি কবে? এই বৃষ্টিতেই বোধহয়। তোর সঙ্গে ভিজতে ভিজতে নাকি
জ্বলতে জ্বলতে। হাসিতে ফেটে পড়ে দুজন। বৃষ্টির শব্দে তাদের হাসি চাপা পড়ে যায়।
টিলার পেছন একটু উঁচু জায়গায় বসে আছে তারা।এবার নামি, বলে রাশেদ। না রে, বৃষ্টি কমুক। শায়লা বলে। যদি বৃষ্টি এত ভালো লাগে বিয়ে করে নে, বৃষ্টিকে? বৃষ্টি তো চিরকাল থাকে না রে বোকা। আমি যে চিরকাল কারো হতে চাই। রাশেদের বুক কেঁপে ওঠে। সে বুঝে উঠতে পারে না কী বলবে। শায়লা ঘেঁষে বসে। তার ভেজা শরীর লেপ্টে যায় রাশেদের শরীরের সাথে। নীরবতা ভেদ করে শায়লা বলে, আমরা কি বন্ধু থাকবো সারাজীবন? বন্ধু মানে কি জানিস? যার সাথে পুড়তে কিংবা ভিজতে খারাপ লাগে না। কথা শেষ হয় না। সেই তো বন্ধু।
হঠাৎ ঝড়ো বাতাস শুরু হয়। চল এবার বাড়ি ফিরি। বলে শায়লাকে হাত ধরে পানিতে নামায় রাশেদ। কিছু না বলে অভিমানী ভঙ্গিতে রাশেদকে অনুসরণ করে শায়লা। খুব কাছাকাছি থেকে সাতার শুরু করে। রাশেদ আত্মবিশ্বাসে ভরপুর।
কোন ভয় পা না এবার। মনে হয় পানিতে ভয়ের কিছু নেই। শায়লা পাশে আছে। পানি তাদের বহন করছে। ঠিক যেভাবে বৃষ্টি তাদের ভালোবাসার গান গেয়ে চলছে। মনের সুখে নিয়ে ফিরে আসে তারা।
সন্ধ্যা নামে ধীরে ধীরে। রান্নাঘর থেকে ভেসে আসে মাছ ভাজার গন্ধ। উঠানে হাঁস-মুরগীর কলরব। বৃষ্টির ফোঁটা কমেছে। আকাশে হালকা নীলাভ আলো। শায়লা আর রাশেদ উঠানে দাঁড়িয়ে। শায়লা বলে, আবার আসবি টিলায়? রাশেদ চুপ থাকে। তারপর ধীরে ধীরে মাথা নাড়ে। তুই ডাকলে আসব। বর্ষা শেষ হলে দেখা হবে আমাদের? হবে। এমন বর্ষা আর আসবে না। এই বৃষ্টি, এই দিন আজকের মতো হবে না কখনো।
শায়লা মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকে আকাশের দিকে। রাশেদ পাশে দাঁড়িয়ে নীরবে। নীরবতায় সম্পর্ক শক্তিশালী হয়ে উঠে। বৃষ্টি নিজের ভাষায় মনের কথা বুঝিয়ে দিয়ে যায়। এভাবেই শেষ হয় এক বৃষ্টির দিন। জলরঙে আঁকা স্মৃতির মত এক
টুকরো ভেজা গল্প। শুধু শায়লা আর রাশেদ জানে। টিলায় বৃষ্টিকে সাক্ষী রেখে চিরকালীন যে সুখ উপলব্ধি করেছে তা কখনো রোদেও শুকোবে না।
মুহাম্মদ ফজলুল হক
গল্পকার ও প্রাবন্ধিক
শিক্ষক, সরকারি জিল্লুর রহমান মহিলা কলেজ
ভৈরব, কিশোরগঞ্জ, বাংলাদেশ।