শব্দকুঞ্জ স্মৃতিময় আষাঢ় সংখ্যা
গোলাম কিবরিয়া পিনু’র একগুচ্ছ কবিতা

শব্দকুঞ্জ স্মৃতিময় আষাঢ় সংখ্যা
গোলাম কিবরিয়া পিনু’র একগুচ্ছ কবিতা
বৃষ্টি
বৃষ্টি আসুক
জল ভরে যাক
উপচে পড়ুক নদী,
ও কল্লোলিনী–তোমার কল্লোলও
উথাল-পাথাল জাগুক!
ভিজিয়ে তুলুক
ধরণীতল!
ভিজিয়ে তুলুক–ভূত্বক!
চারণভূমিও ভিজে ভিজে
মৃত্তিকার কাটুক ধূলিধূসরিত শক!
অনাবৃষ্টিতে–
ভেতরে থাকা মৃগতৃষ্ণা পষ্ট,
অঝোররধারায় দূর হয়ে যাক
মরুময়তায় বৃক্ষহীনের কষ্ট!
প্রস্তরও ভিজে যাক–
ভিজুক গণ্ডশীলা!
আহা বারিপাতের লীলা!
বৃষ্টিস্নাত জলে
অঙ্কুরও পাক প্রাণ,
শেকড়ও পাক শিহরণের গান!
সবুজে সবুজে বনভূমি
ফিরে পাক তানপুরার তান।
পুষ্প ফুটুক–
ফলের ঘ্রাণ চারদিকে ছুটুক,
ফলভারে ফলের গাছ
খানিক নুয়ে পড়ুক!
জলজোয়ারে
এঁদোপুকুরেও জল আসুক,
খিড়কিপুকুরে–
শাপলা-শালুক ভাসুক,
শুকনো কূপে ভরুক জল
হাওড়-বাঁউড় হোক
জলে টলমল!
তা দেখে বৃষ্টিতে ভিজে
ঝুমুর নাচে উঠান কাঁপাক–
শিশু পরুক পায়ে নতুন মল!
বৃষ্টি পড়ুক মাঠে
বৃষ্টি পড়ুক নদীতে
পড়ুক বৃষ্টি হৃদয়েও,
গিঁঠ-বন্ধন খুলে পড়ুক–
বৃষ্টি-বাতাসে জানালা-দরোজা থাক খোলা!
সমুদ্রও হোক চনমনে,
বৃষ্টির জল নদী হয়ে
সমুদ্রকে দিক দোলা!
চঞ্চলতায় নদীমুখ,
রিনিঝিনি–আনন্দে হোক উন্মুখ!
ডুবে যাক জরাকাল–
ধুয়ে যাক অসুখ-বিসুখ!
বৃষ্টিভেজা মতিহার
মতিহার বৃষ্টিভেজা হলে
এখনো কী অপরূপ!
বরিষণমুখরিত হয়ে মনে হয় আজও আমাকে ডাকে–
বর্ষণমন্দ্রিত সন্ধ্যা নিয়ে নিজের দুকূল ভাঙি
মহুয়া গাছের নিচে গিয়ে বসি!
ঝিরঝিরে বৃষ্টি
গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি
ও উতলধারা–
ফুসফুসের প্রদাহ কমে যায়! দাঁতে লাগা–
অবস্থা থাকে না!
মনে হয় গায়ে জ্বর নিয়ে ভিজি!
অ্যান্টিবডি তৈরি হয়।
মতিহার বৃষ্টিস্নিগ্ধ সবুজের নাম
ধুলিধূসরিত নয়
খোলতাই হয়ে ধরা দেয়,
মনে হয় এক ছায়াগৃহ–নিরীহ বল্লরী
তার মধ্যে থেকে সেবন্তী এখনো ডাকে!
মতিহার থেকে দূরে নই
নিজের পর্ণমোচন হয়–এই বরষায়
অভিপ্লুত হই!
মুষলধারা
শ্রাবণে মুষলধারা কুঞ্জবনে যাই
ইটের বসত কত আর ?
উর্বরতা নাই,
বনবিদ্যা জানি আমি, তুমি জানো নাকি ?
এসো আজ জলে ভিজে পুষ্পরেণু মাখি।
বায়ুদূষণের মহামারী এ নগরে
খলনায়কের ক্ষেত্রসুধা এ নগরে
বৃষ্টি নেই, জলকষ্ট-খরা
ধুলোমাখা জরা,
বনফুল টেনে নিয়ে হই মাতোয়ারা।
গৃহনামে খুপরি ছেড়ে যাই
কম্পনে কম্পনে হই অরণ্যজাত
কীসের জাতপাত !
শ্রাবণের আগলভাঙা মুষলধারা চাই ।
জলকন্যা
১
জলকণা দিয়ে তৈরি হয়
টলটলে জল,
জলের উচ্ছ্বাস নিয়ে জলকন্যা
জলবিহারে এসেছে।
২
কাকচক্ষুর মত নির্মল জল
তৃষ্ণা মিটায়,
নাব্য ফিরে এসো
নদীমাতৃক এ দেশে অববাহিকা আছে।
৩
মেঘ নিয়ে এলো বাদল বাতাস
চারণভূমিতে তৈরি হয় জলকাদা
বীজকোষ দোষহীন
মূল হোক বিকশিত।
৪
শুকিয়ে যাওয়া কূলে জলতরঙ্গ
উপকূলও নাচে
এ আষাঢ়ে মরা নদী বাঁচে
সমুদ্র টের পায় শিহরণ।
৫
মরুদ্বীপে পাথর–সেখানে মুষলধারা
আলো ভিজে গিয়ে ঝিলিমিলি
মরুর অনমনীয়তা-ঠেঁটাপনা-স্নায়ুবিকার কাটে
সুষমা ছড়ায়।
৬
ঠাঠাপড়া রোদ্দুর
ছায়াশুন্য–রোদেপোড়া
বহুদিন পর
মেঘরস-বারিবিন্দু-ধারাসম্পাত
বর্ষণমুখর।
৭
বৃক্ষরোপণের এইতো সময়
বর্ষাকাল এসেছে
বিরহপীড়িত খরা নেই মাটিতে
জলের অনুরাগে প্রবহমান নদী।
৮
পুনরায় জলনালী থেকে আসা জলে
ভরেছে এ ডোবা
মৌসুমী মেঘের আনাগোনা
ভারী বৃষ্টিপাত।
৯
নির্জন বনেও বৃষ্টিপাত ব্যাকুলতা সৃষ্টি করে
মালিন্য থাকেনা–জল ধুয়ে নেয়
ঈষৎ মেঘের চমকানো আলোয় দেখা যায়
সমুদ্রের জল।
১০
জলের ছোঁয়ায় জেগে ওঠ
জলের শীতলতায় দাহ থাকে না
আগুনের তাপ কমে যায়
এটাই জলের অহঙ্কার।
গোলাম কিবরিয়া পিনু , মূলত কবি। প্রবন্ধ, ছড়া ও অন্যান্য লেখাও লিখে থাকেন। গবেষণামূলক কাজেও যুক্ত। গোলাম কিবরিয়া পিনু-এর জন্ম ১৬ চৈত্র ১৩৬২ : ৩০মার্চ ১৯৫৬ গাইবান্ধায়। গাইবান্ধা শহরে মূলত শৈশব-কৈশোর কেটেছে। পড়েছেন গাইবান্ধা শহরের মধ্যপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে, এর পর মাধ্যমিকÑগাইবান্ধা সরকারি উচ্চ বালক বিদ্যালয়ে, এর পর গাইবান্ধা সরকারি কলেজ হয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাগত যোগ্যতা : স্নাতক সম্মান (বাংলা ভাষা ও সাহিত্য) এবং স্নাতকোত্তর; পিএইচ.ডি. । ১৯৮৩ থেকে ধারাবাহিকভাবে ঢাকায় বসবাস করেন। লিখছেন তিন দশকের অধিককাল। এর মধ্যে কবিতা-ছড়া-প্রবন্ধ ও গবেষণা মিলে ২৬টি গ্রন্থ বের হয়েছে–বাংলা একাডেমি, বাংলাদেশ শিশু একাডেমিসহ বিভিন্ন প্রকাশনী থেকে। বিশ্ববাংলা কবিতা, উত্তম দাশ, মহাদিগন্ত, কলকাতা, ২০১৩, পৃষ্ঠা-১৪৩ কবিতার বই ছাড়াও তাঁর ছড়ার কটি বই আছে। আছে বাংলা নারীলেখকদের নিয়ে গবেষণা গ্রন্থ, যা বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত হয়েছে। এই গ্রন্থে নারীর আত্মপ্রতিষ্ঠা থেকে নারী লেখকদের সৃজনশীলতা ও বাংলা সাহিত্যে তাঁদের অবদান বিশেষভাবে এসেছে। নারী লেখকদের সাহিত্য-ভূমিকা, সৃজনশীলতা, জীবনচেতনা, আত্মপ্রতিষ্ঠার সংগ্রাম ও ভূমিকার বিবর্তন তাৎপর্যপূর্ণভাবে এই গ্রন্থে ধরা পড়েছে । এছাড়া অন্যান্য বিষয়ে প্রবন্ধের বইও রয়েছে। শিশু-কিশোর সংগঠন খেলাঘর-সহ ছাত্র ও রাজনৈতিক সংগঠনের সাথে যুক্ত ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধেও তাঁর রয়েছে ভূমিকা। পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পরবর্তী প্রতিবাদ-কর্মকাণ্ডে যুক্ত ছিলেন, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে গাইবান্ধায় অনুষ্ঠিত প্রথম ছাত্র মিছিলে নেতৃত্ব দান, ১৯৭৫-৭৭ পর্যন্ত হুলিয়া ও গ্রেফতারি পরোয়ানা নিয়ে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত ছিলেন। সে-সময়ে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে কবিতা লেখা ও তা ‘সাপ্তাহিক মুক্তিবাণীসহ অন্যান্য সংকলনে ছাপা। নব্বইয়ের স্বৈরাচার বিরোধী ও ধর্মান্ধ-মৌলবাদ বিরোধী আন্দোলনে ধারাবাহিক ভূমিকা পালন করেছেন। বর্তমানে বাংলা একাডেমির জীবনসদস্য ও এশিয়াটিক সোসাইটি অফ বাংলাদেশ-এর সদস্য। এখনো কটি সংগঠনের সাথে যুক্ত আছেন। জাতীয় কবিতা পরিষদের সাবেক সাধারণ সম্পাদক। বর্তমানে বাংলাদেশ প্রগতি লেখক সংঘের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। দেশ ও দেশের বাইরের বিভিন্ন সংগঠন থেকে পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়েছেন। পেশাগত প্রশিক্ষণ ও অন্যান্য প্রয়োজনে ভারত, নেপাল, শ্রীলংকা, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, আমেরিকা, বলিভিয়া, নেদারল্যান্ডসসহ কয়েকটি দেশ ভ্রমণ করেছেন। ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ পর্যন্ত একটি আর্ন্তজাতিক মিডিয়া বিষয়ক সংস্থা ‘ফ্রি প্রেস আনলিমিটেড’-এর সাথে যুক্ত হয়ে কাজ করেছেন। এর আগে এফপিএবিতে উপপরিচালক (এডভোকেসি), ফোকাল পয়েন্ট ও বিভাগীয় প্রধান হিসেবে কর্মরত ছিলেন। এছাড়া এফপিএবি থেকে প্রকাশিত মাসিক ‘সুখী পরিবার’-এর সম্পাদক হিসেবে ১৯৮৩ থেকে ২০১৪ পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। বিসিসিপি ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানেও যুক্ত ছিলেন। পেশাগতভাবে বিভিন্ন সময়ে সাংবাদিকতা, কলামলেখা, সম্পাদনা ও এডভোকেসি বিষয়ক কর্মকাণ্ডে যুক্ত থেকেছেন।

