শব্দকুঞ্জ স্মৃতিময় আষাঢ় সংখ্যা
পঞ্চব্যঞ্জনা: পাবলো নেরুদা’র পাঁচটি কবিতা
অনুবাদ: আলী সিদ্দিকী

পঞ্চব্যঞ্জনা: পাবলো নেরুদা’র পাঁচটি কবিতা
বঙ্গানুবাদ: আলী সিদ্দিকী
আমি তৃষ্ণার্ত তোমার মুখ, তোমার কণ্ঠ, তোমার চুলের জন্য
ইংরেজি অনুবাদ: Stephen Tapscott)
আমি তৃষ্ণার্ত—তোমার মুখ,
তোমার কণ্ঠস্বর, তোমার চুলের জন্য।
নীরব, অনাহারী আমি—
রাতভর হেঁটে বেড়াই নগরীর নির্জন পথে।
রুটি আমাকে তৃপ্তি দেয় না,
ভোর আমাকে করে ব্যথিত,
পুরো দিন আমি খুঁজি—
তোমার পায়ের চলার সেই তরল ছন্দ।
আমি ক্ষুধার্ত—তোমার মসৃণ হাসির জন্য,
তোমার হাতের জন্য—যা যেন এক বন্য ফসলের রং,
তোমার নখের সেই সাদা পাথরের জন্য,
আমি চাই তোমার ত্বক—একটা সম্পূর্ণ বাদামের মতো খেয়ে ফেলতে।
আমি খেতে চাই—
তোমার দেহের ভেতর জ্বলে ওঠা সেই রোদের কণা,
তোমার উদ্ধত মুখের রাজকীয় নাক,
তোমার চোখের পাপড়ির সেই ক্ষণিক ছায়া।
আমি হেঁটে বেড়াই একা, অনন্ত ক্ষুধার্ত,
গোধূলির গন্ধ শুঁকে শুঁকে খুঁজি তোমাকে,
তোমার উত্তপ্ত হৃদয়ের জন্য ব্যাকুল—
ঠিক যেমন কুইত্রাতুয়ে মরুভূমিতে
একটি পুমা খোঁজে তার শিকার।
(I Crave Your Mouth, Your Voice, Your Hair কবিতাটি নেরুদা’র ১৯৫২ সালে অনামে কবি হিসেবে প্রকাশিত গ্রন্থ The Captain’s Verses-এ সংকলিত হয়। ১৯৬৩ সালে নেরুদা নিজের নামসহ এটি পুনরায় প্রকাশ করেন। কবিতাটি তার তৃতীয় স্ত্রী ও চিরপ্রেমিকা Matilda Urrutia-কে উৎসর্গিত) ।
শব্দ
ইংরেজি অনুবাদ: Stephen Mitchell
শব্দের জন্ম রক্তে—
অন্ধ দেহে বেড়ে ওঠা, স্পন্দিত,
ওঠে জিহ্বায়, উড়ে যায় ঠোঁটে।
সে এসেছিলো—দূর থেকে, আবার কাছ থেকে,
মৃত পিতাদের কণ্ঠ হতে,
ভ্রাম্যমাণ জাতির হাঁটাপথ ধরে,
পাথরে রূপান্তরিত ভূমি থেকে,
যেখানে ক্লান্তি জমে উঠেছিলো গরিব গোষ্ঠীর প্রতি।
যখন বেদনা পাড়ি দেয় পথ,
মানুষ এগিয়ে যায়, এসে পড়ে,
নতুন মাটি আর জলে বুনে তাদের শব্দ।
এই আমাদের উত্তরাধিকার—
এই হাওয়াই আমাদের সংযোগ,
গভীরে শোয় যে মানুষ, আর যে সত্তা জেগে ওঠেনি এখনো,
তাদের মধ্যকার আলোচনায়।
এখনো কাঁপে বায়ুমণ্ডল—
প্রথম শব্দের যন্ত্রণায়, আতঙ্কে।
অন্ধকার থেকে উঠে আসে তা—
এখনো কোনো বজ্র সেই শব্দের মতো গর্জে না,
সেই প্রথম উচ্চারিত শব্দ—
হয়তো শুধু এক ফিসফিসানি, কিংবা এক ফোঁটা বৃষ্টি,
কিন্তু সেই ধারাপাত আজও পড়ে চলে।
এরপর অর্থে পূর্ণ হয় শব্দ,
জীবনে ভরে ওঠে,
জন্ম আর ধ্বনিতে ভরে ওঠে সব—
সুইকারোক্তি, স্পষ্টতা, শক্তি,
অস্বীকার, ধ্বংস আর মৃত্যু।
শব্দ—
সব শক্তি একত্র করে,
রূপ আর সারমর্মের এক বিদ্যুতময় মিলনে।
মানবিক শব্দ,
উজ্জ্বল রুপোর পাশে দীর্ঘ আলোর ধ্বনি,
রক্তের সংবাদদাতা এক ঐতিহ্যবাহী পাত্র।
এখানেই গড়ে ওঠে নীরবতা—
সামগ্রিক মানবিক শব্দে,
এবং না বলা মানে
অস্তিত্বের মাঝে নিঃশেষ হয়ে যাওয়া।
ভাষা ছড়িয়ে পড়ে চুলে, চোখে,
ঠোঁট না নেড়েও কথা বলে মুখ,
হঠাৎ, চোখও হয়ে ওঠে শব্দ।
আমি শব্দকে ধারণ করি,
চলাফেরা করি তার ভেতর দিয়ে—
এক মানব শরীরের মতো,
তার রেখা আমার মন ছুঁয়ে যায়,
প্রতিধ্বনির মাঝে আমি ভেসে যাই।
আমি উচ্চারণ করি, এবং আমি হই।
শব্দের সীমা পেরিয়ে
নীরবতার কাছে যাই—
কিছু না বলেই।
আমি শব্দকে তুলি,
জলকণার মতো এক স্বচ্ছ পাত্রে—
ভাষার রস পান করি তাতে,
বা এক অতল মাতৃত্বের জল।
এই পাত্র, এই জল, এই রক্তমদে
জন্ম নেয় আমার গান।
কারণ নামই তো উৎস—সবুজ জীবন,
রক্ত—যা তার স্বরূপ প্রকাশ করে,
আর তাই শব্দের প্রসারণ ঘটে।
শব্দ দেয়—
স্ফটিকে স্ফটিক,
রক্তে রক্ত,
আর প্রাণে প্রাণ।
(The Word কবিতাটি ১৯৯৭ সালে ইংরেজি ভাষায় প্রকাশিত নেরুদা’র Full Woman, Fleshly Apple, Hot Moon: Selected Poems of Pablo Neruda বইয়ে অন্তর্ভূক্ত) ।
আজ রাতে আমি লিখতে পারি বিষন্নতম পঙতিমালা
ইংরেজি অনুবাদ: W. S. Merwin/ Donald D. Walsh
আজ রাতে লিখতে পারি আমি
সবচেয়ে বিষণ্ণ পঙ্ক্তিগুলি।
লিখে ফেলতে পারি:
“তারারা ঝরে পড়ছে দূর আকাশে,
আর শীতল বাতাস হিম করে দেয় রাত।”
আজ রাতে আমি লিখতে পারি
সবচেয়ে একাকী বাক্যগুলি।
আমি তাকে ভালোবাসতাম—
আর কখনো কখনো সেও ভালোবেসেছে আমায়।
এমন এক রাতের কথা,
যখন আমি তাকে নিয়েছিলাম আলিঙ্গনে,
আমার চুম্বন ছুঁয়ে গিয়েছিল তার নীরব দেহ।
সে আমায় ভালোবেসেছিল।
আর আমি…
আমি কীভাবে না ভালোবাসতাম তার শান্ত দুটি চোখ?
আজ রাতে আমি লিখতে পারি
আমার একাকীত্বের গান—
সে আর আমার নয়,
আমার ভালোবাসা থেমে গেছে তার পাশে।
দূরে কোথাও গেয়ে ওঠে এক বিষাদসুর,
আর রাত—
রাতটি যেন আরও গভীর হয় তার অভাববোধে।
আমার চোখ আজ তাকে খোঁজে,
হৃদয় আর চায় না তাকে,
আমরা— যারা ছিলাম একদিন—
আজ আর সেই মানুষ নই।
আমি আর তাকে ভালোবাসি না,
এটাই ঠিক,
তবুও হয়তো ভালোবাসি,
ভালোবাসা কি সহজে মরে?
তার মতো কোনো কণ্ঠ খুঁজি আমি,
তার মতো এক চুমুতে
জেগে ওঠে তার ছায়া।
সে আর আমার নয়,
এটাই বাস্তবতা,
কিন্তু কবিতার ভাষায় আজও—
আমি তাকে হারানোর ব্যথা লিখি।
এটাই শেষ কষ্ট,
যা আমি তাকে দিই—
আজ রাতে লিখে ফেলি
সবচেয়ে বিষণ্ণ পঙ্ক্তিগুলি।
(Tonight, I Can Write the Saddest Lines কবিতাটি ১৯২৪ সালে প্রকাশিত নেরুদা’র Twenty Love Poems and a Song of Despair সংকলনে প্রকাশিত হয়। ইংরেজি অনুবাদ: W. S. Merwin / Donald D. Walsh) ।
যদি তুমি আমায় ভুলে যাও
ইংরেজি অনুবাদ: Donald D. Walsh
আমি চাই না তুমি ভাবো—
যদি আমি দূরে থাকি,
তবে ভালোবাসার উড়ন্ত শব্দগুলো চলে যাবে তোমার হৃদয় থেকে।
তোমার মনে রাখা উচিত—
আমার হৃদয়ের অতল গহ্বরেও
কখনো কখনো, যখন আমার চোখগুলো চায় না দেখতে পৃথিবী,
তবুও—
তোমার হৃদয় সেখানে থাকে।
যদি হঠাৎ তুমি আমাকে ভুলে যাও,
খুব ধীরে ধীরে,
ধরে নাও, আমি তোমায় ভুলে যাব—
একটু একটু করে।
যদি প্রতিদিন, প্রতিটি মুহূর্ত
তুমি আমার ভালোবাসাকে উপেক্ষা করো,
যদি তুমি আমার পাশে থাকা বন্ধ করো,
আমি আমার ভালোবাসা ফিরিয়ে নেব—
চুপিসারে, নিরবে—
যেন তা কখনো ছিল না।
কিন্তু যদি হঠাৎ
তুমি আমাকে মনে রাখো,
আর কেউ জানে না এমন কোনো গভীর জায়গা থেকে—
যদি আমার দিকে ফিরে তাকাও হঠাৎ,
আর তোমার ঠোঁটে উঠে আসে এই নাম—
আমার নাম—
তবে আমি ফিরে আসব,
ফিরে আসব তোমার কাছে—
যেন
একটা আগুন কখনো নিভেনি,
যেন একটা পালক উড়ছিল শুধু
তোমার আত্মার হাওয়ায়।
(If you forget me কবিতাটি কবির রাজনৈতিক নির্বাসনের সময় লিখিত এবং ১৯৬১ সালে প্রকাশিত Selected poems গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত) ।
কবির দায়িত্ব
ইংরেজি অনুবাদ: Alastair Reid
যে কেউ শুনছে না সাগরের ডাক
এই শুক্রবার সকালের একঘেয়ে ব্যস্ততায়—
যে কেউ বন্দি হয়ে আছে
বাড়ি, অফিস, কারখানা, কিংবা কোনো নারীর কোলে,
রাস্তা, খনি বা কঠোর কারাগারের কুঠুরিতে—
তার জন্য আমি আসি।
আমি কথা না বলে, না তাকিয়ে
চুপিসারে পৌঁছে যাই তার বন্দিদ্বারে।
একটা অস্পষ্ট কিন্তু দৃঢ় কাঁপন শুরু হয়—
একটি বজ্রের টুকরো নড়ে ওঠে যেন,
পৃথিবীর গুঞ্জন ও সাগরের ফেনা শুরু করে নৃত্য,
সমুদ্রের নদীগুলো গর্জে ওঠে হঠাৎ,
নক্ষত্র কাঁপে তার আলোকমালায়—
আর সমুদ্র ধাক্কা খায়, মরে আবার বাঁচে।
আমার নিয়তি আমায় টেনে আনে এভাবে—
আমি নিরন্তর শুনে চলি সাগরের করুণ গান,
মনে রাখি তার জল-ধ্বংসের গর্জন,
তুলে রাখি এক শাশ্বত পাত্রে,
যাতে—
যেখানেই কেউ বন্দি হয়ে থাকে,
যেখানে কেউ ভোগে শরতের নিঃশব্দ প্রহার—
আমি সেখানে পৌঁছাতে পারি এক বিপথগামী ঢেউ হয়ে,
আমি জানালার ভেতর দিয়ে ঢুকে পড়ি,
আর কেউ শুনলে, তাকিয়ে ওঠে চোখ
আর বলে—
“কীভাবে আমি পৌঁছাবো সাগরে?”
আর আমি কিছু না বলেও পৌঁছে দিই
তার কাছে তরঙ্গের তারকাময় প্রতিধ্বনি,
ভাঙা ফেনা, বালুর ক্ষয়,
নুনের সরে যাওয়া গুঞ্জন,
আর উপকূলে গাঙচিলের ধূসর কান্না।
এইভাবে—
আমার ভেতর দিয়ে,
স্বাধীনতা আর সাগর
দেয় উত্তর—
এক বন্ধ দরজার ভেতরকার হৃদয়কে।
(Poet’s Obligation কবিতাটি ১৯৫৪ সালে প্রকাশিত নেরুদা’র The Grapes and the Wind গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত) ।


অনুবাদ কবিতা। পঞ্চব্যঞ্জনা- পাবলো নেরুদার ৫টি কবিতা-আলী সিদ্দিকী
