শব্দকুঞ্জ স্মৃতিময় আষাঢ় সংখ্যা
বদরুজ্জামান আলমগীর এর
একগুচ্ছ কবিতা

বদরুজ্জামান আলমগীর এর একগুচ্ছ বর্ষার কবিতা
পুরাতনী বর্ষার দিক
যারা সবচেয়ে সুন্দর, সবার থেকে দয়াবান ও গুণশীল-
তারা আমাদের নজরের আওতায় আসে না,
তারা নীরবতায় মুখর, তাদের কথা আমাদের
কানে পশে না;
কোন প্রকল্প জারি করার প্রতিভা তাদের জিম্মায় নেই;
যারা অতুল বড় তারা আমাদের
দৃষ্টির পরিধি থেকে এভাবেই দূরবর্তী,
তারা গুমর- দৃশ্যমান ঢেউয়ের নিচে নেহায়েত লুকানো
পানিখাউরি পক্ষী, তাদের বেদনা কখনও সম্মানিত হয়নি,
তারা গাছের ভিতরে কালশিটে দাগ;
উইলিয়াম শেকসপিয়ার তারা নয়, কস্মিনকালেও নয়
কার্ল মার্কস বা মহাত্মা গান্ধী, নবী মোহাম্মদ নয়,
নয় যিশু খ্রিস্ট, মুসা পয়গম্বর, আকিরা কুরোসাওয়া,
কী গৌতম বুদ্ধ; তারা কেবলই আড়াল ও নিভৃত টিপসই ।
প্রকৃতি বড় চক্ষুষ্মান-
তার অন্তরে ন্যায়শাস্ত্র আছে- যারা অন্তরাল,
যারা একা ফুঁপিয়ে কাঁদে খানাখন্দ ও ফাটলের ভিতর-
তাদের কাছে নিসর্গ গুমোট, মেঘে সন্নিকটে ঘোর-
দয়ার আলিঙ্গনসমূহ বৃষ্টির নামে ঝরে-
মহাকবি কালিদাস তাকে মেঘের ডাকপিয়ন বলে ডাকে-
আমি তার নাম জানি না, কেবল বুঝি-
অনাগত পুরাণ ও প্লাবনের দিকে মুখ করে থাকা-
মেঘচূর্ণ হাওয়াই বাতি কেবলই নির্বাণ,
তারে চোখে যে দেখি না।
বৃষ্টি সংবিধান
বাবা আর আমি দুজন দুজনকে যে ভালোবাসি
তা হাতেকলমে বুঝি একসন্ধ্যার বৃষ্টির ভিতর।
হাট থেকে বাড়ি ফিরছি আমরা সন্ধ্যার মুখে,
বড় হাট উপচে পড়া এক আচানক, মনে ধরা জিনিস-
যতোক্ষণ কেউ বাজারের ভিতর লেপ্টে আছে
ততোক্ষণই বুঝবে- এ একদম চাক্ষুষ- এই ভিড়
গোছা গোছা গমের থোকা থোকায় হল্লা-
তার থেকে বড় সত্য বুঝি আর কিছুই হতে পারে না
বাস্তবিকই তা দরকষাকষি, অভিবাদন ও জটলা।
আবার একই হাট থেকে বেরিয়ে দূর থেকে সম্মিলিত
দোকানী আর বাজারীদের কথার ডালপালা খেয়াল করুন
এই শোরগোল ও প্রতিধ্বনির বিচ্ছুরণ মনে হবে বাস্তব নয়
এই আওয়াজ বুঝি হাশরের ময়দান থেকে আসে!
হাট থেকে বাড়ি ফেরার পথে হঠাৎ ঝমঝম বৃষ্টি পড়ে-
আমি টকাশ করে মাথার উপর ছাতা মেলে ধরি,
আর আমার বাবা দিব্যি ভিজতে ভিজতে নির্বিকার
বাড়ির দিকে পা ফেলে- সম্মুখে বাঁশবাগান হেলেদোলে।
বৃষ্টি আমাদের মাঝে ধুলো সম্ভ্রমের জ্যামিতি এনে দেয়-
বাবা এক বর্ষীয়ান পাকুড় গাছ- স্নেহ ও দুর্ভাবনার বালুভাত
আমি এক অসংহত শিমগাছের লতানো ডাল।
বাবা ভিজে জবজব, আমি ছাতার নিচে সংরক্ষিত আসন-
এভাবেই অসমতা আর অন্যায়ের ভিতর বাবা-ছেলে
তাদের ন্যায়বিচার ইতিহাসের সংবিধানে পাকাপোক্ত
বিজয়ের সুনামে চিহ্নিত করে বাড়ির দিকে হাঁটে।
বধ্যভূমি
ভেঙেচুরে বড় হয় আমার এক প্রাচীন পুরনো বন্ধু
বড় হয় মানে কী- বড় হবার, দূরের দিগন্তলীনে
পুচ্ছধারী ময়ূর হবার আকার আয়োজন করে সে;
আজ সিদ্দিক বকরের কল্যাণে তার খোঁজ আসে।
আমি সব ঠিকঠাক রাখি হিসেবী ও ভঙ্গুর
নিক্তি সুইসুতো পিছল পায়ের সাথেই জড়িয়ে থাকি
কিন্তু আমাদের দুজনার কপাল বদলায় না-
আমরা যেই কী সেই, দূরে দূরে বেঁচেবর্তে আছি;
সক্রেটিস, আলবেরুনি, মার্কসের কাছে শিখি-
জন্মদাগ ঘাটের মড়া- তারে ঘষে তোলা যায় না।
আমরা পায়ে হাঁটা যে জমানার মানুষ-
কোনকিছু পরিস্কার করার জন্য পানিতে ধুয়ে নিতাম,
দিনকাল বদলেছে- খুদ পানি পরিস্কার করার জন্য
পানি শুদ্ধিকরণ টেবলেট মিশাতে হয় এখন।
আমাদের অবিন্যস্ত কালে শরীর মন জুড়াবার দরকারে
ময়দানের খোলা হাওয়ায় হাত-পা ছড়িয়ে দাঁড়াতাম-
এখন বাসায় হাওয়া বিশুদ্ধকরণ মেশিন কিনে আনি।
আমি ও খসরুর পকেট ফাঁকা, ধুধু ও ধাঁধা
আমাদের কখনই পয়সা কোন ইস্যু ছিল না;
আর এখন জেন-জির কাল, তারা বলে-
হাওয়া, ইলেকট্রিক গাড়ি নিয়ে কিছুই বলবো না,
না বলবো দাবাখেলা আর এআই সম্পর্কে-
লেকচার দিয়ে লাভ কী- আগে তো পে করেন!
আপনার গ্রামে, বা যে-শহরে বড় হয়েছেন আপনি
ওখানে হয়তো কোন বধ্যভূমি নাই,
কিন্তু আমার আপনার বুকের ভিতরে যে অঝোর বধ্যভূমি
নিভৃত বর্ষাকাল, বৈশাখের অনামী তাপদাহ
তাদের সাথে বৈঠক ছাড়াই বারবার আমাদের দেখা হোক।
হৃদয় নুড়ি
সারা দিনমান একটা একলা একা
ক্ষরণ হতে থাকে আমার :
কোন আকার আয়োজন ছাড়াই
বারবার মনে পড়ে আমাদের বন্ধু,
সংবেদের পাতা নিরাপোষ সহজ মানুষ
শতচূর্ণ পাঠশিল্পী শরফুজ্জামান মুকুলের কথা।
আহা, এমন কতো কবিতার আসর
শরফুজ্জামান মুকুলের কথা ও পাঠের গম্ভীরায়
তুমুলাভ ভরে উঠেছে-
আজ মুকুল কেবলই লীলুয়া বাতাসের ভাইফোঁটা
আর জীবনানন্দ দাশের, শামসুর রাহমানের
নামের রইয়া রইয়া ন্যাপথলিন!
দুনিয়া ভালোবাসার বলিরেখায় এভাবেই
আগুন ও জলের নিরিখ-
দূরে কোথাও ঝমঝম বৃষ্টি পড়ে,
আর ভিনপাড়ায় কে তার জলে ভেজা সাম্পান
তালাশ পাই না কভু হৃদয় নুড়ির অনুমান!
জলফকিরি
কে তুমি, কে হও তুমি আমার সুতার আবরণে
আমারই বর্ষার অচেনা চাকমা সরল পথখানি
কথা ছিল নদী বহিবে দূর প্রান্তরের কূলে
আকাশ সামিয়ানা হয়ে শঙ্কিত জেগেছিল
অসহায় আমার অন্তহীন পাখিদের নীড়ে
দেখি বোটানিতে আছো বুকের সফেদা ফলে
মেঘের নিচে আমার কৃষিজীবীনি মায়ের উদ্বেগে।
দুর্ভাবনা আর গুটিবসন্ত ছিন্ন আঁচলের জলে
কে তুমি নামহীনে, আমারই নাম ধরে ডাকো
বও একা আর একসাথে অনাহূত ভাঙা ভাঙা তীর
তুমি যে তুমি নও আর বদরুজ্জামান আলমগীর।
বদরুজ্জামান আলমগীর: কবি, নাট্যকার, অনুবাদক।
কবিতা : পিছুটানে টলটলায়মান হাওয়াগুলির ভিতর।
নদীও পাশ ফেরে যদিবা হংসী বলো। দূরত্বের সুফিয়ানা।
প্যারাবল : হৃদপেয়ারার সুবাস।
ভাষান্তরিত কবিতা : ঢেউগুলো যমজ বোন।
জালালউদ্দিন রুমির কবিতা, মসনবি : মোরাকাবা ও জলসংগ্রহ।
প্রকাশিতব্য সাম্প্রতিক আমেরিকান কবিতা : পানপাত্রে নক্ষত্র কুচি।
ছিন্নগদ্য : সঙ্গে প্রাণের খেলা।
নাটক : নননপুরের মেলায় একজন কমলাসুন্দরী ও একটি বাঘ আসে। পুণ্যাহ। আবের পাঙখা লৈয়া। জুজুবুড়ি। চন্দ্রপুরাণ। পানিবালা। বাঘ। পরীগাঁও। ইলেকশন বাজারজাতকরণ কোম্পানি লিমিটেড। এক যে আছেন দুই হুজুর। পিঁয়াজ কাটার ইতিহাস। ডুফি কীর্তন। ভাসিয়া যায় লাল গেন্দাফুল।।
