শব্দকুঞ্জ স্মৃতিময় আষাঢ় সংখ্যা
শিকদার মুহাম্মদ কিব্রিয়াহ’র
একগুচ্ছ কবিতা

শিকদার মুহাম্মদ কিব্রিয়াহ’র একগুচ্ছ কবিতা
বৃষ্টি
সৌরলোকে লোডশেডিং! সূর্যের উঠানে মেঘের ঘেরাও!
সমুদ্রের উৎক্ষিপ্ত নিঃশ্বাসে ঢাকা প্রতিবেশী আকাশ।
আকস্মিক বিধবার ফুঁপান কান্নার মত ভেঙ্গে পড়ছে আকাশ।
বৃষ্টির ব্যারিকেড ভাঙ্গার কোন লক্ষণই নেই।
অবরুদ্ধ বেডরুমে ঈশ্বরের মত অবকাশ।
উপভোগ করছি আকাশ ও মৃত্তিকার দীর্ঘ সংগম।
দেহের ত্বক আলগা করে ভিজছে য়্যুকেলিপ্টাস বৃক্ষটি।
যেন দীঘল-ধবল উরুর ওপর দাঁড়িয়ে ঈভের বৃষ্টিস্নান।
বৃক্ষের বাহুতে ভেজা কাকটি যেন একটি পুঁচকে ফিঙে;
গড়িয়ে পড়ছে অস্তিত্বের সংগ্রাম কচুপাতার পানির মত।
বৃষ্টির ব্যারিকেড ভাঙছে গার্মেন্ট’স মেয়েরা,
ঢাকনাখোলা ম্যানহোলে ঢুকে যাচ্ছে নগরী
কলাপাতায় মাথা ঢেকে কানাডার দিকে
দৌড়াচ্ছে বাংলাদেশ!
বৃষ্টি হচ্ছে! বৃষ্টি ঝরছে!
প্রথম আকাশে ঈসার অখণ্ড অবকাশ
কিংবা ক্রুশবিদ্ধ যিশুর কষ্টের ফোঁটার মত।
এই শুদ্ধ মধুবনে
ভাবির বক্র টিপ্পনী যেন—বাঁকা বৃষ্টির চিমটি
উন্মত্ত বাতাসে কাঁপা আকস্মিক বৈশাখী বাদল,
উঠোন নিয়েছে ঢেকে শুভ্রতার বিস্তৃত রূপটি
যেন জ্যোৎস্নার টুকরো হয়ে ঝরে বৃষ্টির ছোবল।
আপার কোঁচড়ে গুটি গুটি আম উষ্ণতা গিলেছে
বৃষ্টির জলে ভিজেছে কম্পমান কবুতর দু’টি,
নম্র মাংশের ভূগোল জলছাপে অস্তিত্ব মেলেছে
যেন বেআব্রু বৃষ্টিতে মুখ তোলে উদ্ভিন্ন সে জুটি।
সূর্যের বেগুনি রশ্মি চেটে নেয়া নাজুক শরীর
নরম কাদার ক্ষীরে ভরে তোলে ত্বকের ফাটল,
বাদামী শরীর তাই সোদাগন্ধী মাটির নজির
যেন বৃষ্টির আদর খোলে বঙ্গে মৃত্তির আগল।
এই দেশ এই মাটি আটপৌরে বৃষ্টির জীবন,
এখানেই র’বো আমি চিরকাল শুদ্ধ মধুবন।
আষাঢ়স্য আয়াত
তুমুল বৃষ্টির চালে ঝমঝম তীর্যক রাগিনী
শুনে ভাবি, আজ সারা রাত নটী বৃষ্টির ধ্রুপদী-
নৃত্যুকলা মন ভরে দেখে নেবে আঁধার যামিনী
যদি কবিতার খাতা থাকে খোলা ফজর অবধি।
বৃষ্টির চাবুক পড়ে কৃষকের খড়চালা ঘরে
জলের করাত কেটে দিয়ে যায় শ্রমক্লান্ত ঘুম,
মেহনতি মানুষের আর্তস্বর বৃষ্টির অধরে
শুনে কবিতা ঘুমায় রাতভর নিঃশব্দ নিঝুম।
আহারে বৃষ্টির ফোঁটা মৃত্তিকার কামনার রস
গন্দুমে গন্দুমে ভরো বৃক্ষভূমি সাম্যের স্বভাবী,
লেপের আরামে খুঁজে উচ্চবিত্ত সুখের অলস
বিত্তের উল্লাস গিলে শ্রমজীবি মানুষের দাবি।
লিরিক বৃষ্টির শেষে সেতারের কান্না সারারাত,
শব্দের ক্লান্তিরা গড়ে কবিতার দুঃখের আয়াত।
বৃষ্টির ওঙ্কার
ভীষণ বর্ষায় কাঁপে ঘোলাজলে ধানের মিছিল
বৃষ্টির বুলেট ছোটে ঝাঁকে ঝাঁকে মৃত্তিকার পিঠে,
লাগাতার ধর্মঘটে স্তব্ধ যেন চরের নিখিল
কর্মহীন কিষাণের দিনরাত আহা কী যে মিঠে।
দেহলির ধানে জ্বালা—প্রতীক্ষার অঙ্কুর ছড়ায়
সিদ্ধধানের সুবাসে সহেলির গন্ধ নেয় খোঁজে,
আলস্যের আলপথে কৃষকের দিন কেটে যায়
যখন ধানের শীষ অথৈ জলে মুখ দেয় গোঁজে।
ঋণের ধকল চেপে বসে বোকা কৃষকের ঘাড়ে
বেলা অবেলায় সুখে খাবি খায় প্রতারক বাঁকে,
বজ্রের ঘোষণা তবু গর্জে সুপ্ত মেঘের পাহাড়ে
বলে, ওঠো হে মরদ অধিকার আদায়ের ডাকে।
আকালের মুখে ঠেলে দিও তুমি লাঙ্গলের ফলা,
তৃতীয় বিশ্বের পাতে যেন প’ড়ে আমিষের দলা।
মেঘলা দিনে
মোষের পালের মত ধায় মিশকালো মেঘ নিম্নগামী আকাশে ঝুলছে
আষাঢ়ে উৎসব,
কামনার ক্রুশবিদ্ধ প্রাগৈতিহাসিক জল
তবু তোমার ঋতুচক্রে
পোড়া গ্রীষ্মের উদ্ভব।
জলের জোয়ার জানে প্রাকৃত নান্দীপাঠ
শৃঙ্গারে শৃঙ্গারে করে জলবতী
মৃত্তিকার নাভিমূল,
তুমি নও কস্মিনকালে এরই ব্যতিক্রম
স্বরূপ-স্বভাবে মৃত্তিকার সহোদরা
চাষাবাদে ব্যাকুল।
বর্ষায় বিরাগ কেন! আসুক ভাদ্রের সুদিন,
আমৃত্যু বেঁধে নিক প্রকৃত বাদলঝরা ঋণ।
