দন্ত-স সজীব এর একগুচ্ছ কবিতা

Spread the love

শব্দকুঞ্জ স্মৃতিময় আষাঢ় সংখ্যা

দন্ত-স সজীব এর একগুচ্ছ কবিতা

কিছু কবিতারা : দন্ত্য-স সজীব

 

দেহাতীত

যদি আর জেগে না উঠি

এই ভয়ে কেটে যায় বিনিদ্র রাত

বুকের পরে প্রেয়সীর নরম হাত

কী কোমল বিশ্বাস নিয়ে বলে—

“শুনছো? মৃত্যু মানে চিরতরে

চলে যাওয়া নয়

সে এক জরা-মৃত্যু-ভয় ভরা জীবনের

পরম পদোন্নতিধনে-জনে বেঁচে থাকা

অনন্তকাল।” বললাম—“জানি,

মৃত্যু কিশোরী ফাল্গুন, ঝাঁট দেয়া উঠোন,

নানুবাড়ির লাল মাটির ঘর, ভাঙা চৌকাঠ,

ঘুমচোখে সানকি ভরা জাউভাত,

চ্যাপা শুটকি, ভাজা মরিচের ঝাল,

গাগরম অজুহাতে মক্তবে না যাওয়া

সকাল। তারপর—

ছুটির পরে মৃত্যু! গড়াগড়ি হাইস্কুলের মাঠ

অনাহুত বেদনায় রূপবানের গান, কিংবা

তোমার লগে আলাবালার ঘর-সংসার

খেলায় ভুল বানান চিরকুট, দেহাতীত

প্রেমের প্রস্তাব। ভয় কী!

প্রেম ও পরম

তুমি তো আমি তো বাতাসে ডাঙর হবার

পাইনি সুযোগ তবুও বিকল ট্রেনের মতন

বুকের ভেতরে হৃদয়ের সব রোগশোক ভুলে

তোমার-আমার প্রেম টেনে নিয়ে যাই

বহু নির্জন বহু দূরে একলা যেখানে

প্ল্যাটফর্ম পাতালের দরজা খুলে

দাঁড়ায়ে রয়েছে নিরাশায়। তারপর—

তুমিও আমিও ডুবে যেতে চাই

পাতালের অতল তলে যেখানে

আমাদের প্রেম আর পরম ছাড়া

কেউ নাই আর কিছু নাই।

 

আমাদের আধমরা অনুভূতিগুলো

এখানে আকাশছোঁয়া স্বপ্নের নাকি চাষ হয় রোজ।

মৃত দৈনিকের বুক চিড়ে খোঁজ পাওয়া গেল—

নাগরিক উদ্বাস্তু পুরুষের পায়ের তলে

স্তন্যপায়ী যে অনুভূতি-শিশুর ছিল বাস;

সহস্র লোকের ভিড়ে বিবস্ত্র সে আজ

মুখ ধুবড়ে পড়ে আছে পথের ধুলোয়—

নিরাত্মা-নিথর।

কেবল কোমল হাতের দু একটি আঙুল,

দু-একটি আঙুল কেবল, কেঁপে ওঠে

তিরতিরপ্রাণ পেতে চায়পথের পরে

থেঁতলানো জীবন তবু নয়।

স্বপ্নের উচ্ছিষ্ট খেয়ে বেঁচে থাকা জীবন

সে চায়, দিবালোকে বিবস্ত্র জীবন তবু নয়।

স্তন্যপায়ী অনুভূতি-শিশু—

সম্ভ্রমই যে তার পরম বৈভব—বলা যায়

এই সব রাতের প্রতি

স্বৈরিনী রাত! অকালেই জাত যাবে বলে

অজুহাতে দ্বারে দিলে খিল। ভাঙা জানলায়

ঝোলে আঁধার-আঁচল। থীবেসের মহারাজা

বৃদ্ধ ওইদিপৌস একালের রাজপথে

ট্র্যাজেডির ভ্রুণ সঙ্গোপনে করে রোপ

যোকাস্টার পচনধরা জরায়ুতে

এককাল, দুইকাল; বহুকাল ধরে

শহুরে নর্দমায়শেওলায় মিশে স্বৈরিনী

তুমি বেঁচে থাকো, মরে থাকো ভরা বর্ষায়

পাথুরে শামুক হয়ে। নিশাচর পরভৃত

বড়ো উন্মাদ। তবু জাত যাবে বলে—

অজুহাতে দ্বারে দিলে খিল। অপমানে-

অভিমানে মথুরার শ্যাম ফিরে গেল

কোন এক রাইয়ের খোঁজে। বঁধুয়া তুমি—

রাধে হলে না-গো; হলে বেনামি সস্তা

রংচটা মলাটে ঘোলাটে প্রচ্ছদ, উদরে

অসংখ্য মৃত-বাড়ন্ত কবিতার ভ্রুণ—

অস্পষ্ট অক্ষরে আঁকা।

 

কবিকাক এবং যা কিছু তবুও ভালো

পথের ধারে ভর্তা-ডালে উনিশ টাকার ভাত,

ভরদুপুরে আয়েশ করে বটতলাতে কাৎ।

ব্যস্ত শহর—নিরালা নিঝ্ঝুম

দুইটি চোখে এক শতাব্দী ঘুম;

নিঘুম চোখে দিনের শেষে শেষ না-হওয়া রাত,

তবুও ভালো ভরদুপুরে ভর্তা-ডাল আর ভাত।

অন্ধকারের চাদর গায়ে ভদ্রলোকীর ছল!

মধ্যরাতে চায়ের কাপে নোনতা গরম জল।

ক্লান্ত শহর—মৌনতায় মুখর,

জোছনা-রোদে ঝলসানো এক ঘর;

কাকের সঙ্গে কাব্যসভায় শব্দেরা নিশ্চল,

তবুও ভালো চায়ের কাপে কেবল গরম জল।

ভরদুপুরে কবির ছায়া আঁধারে চুপচাপ।

মধ্যরাতে কাকের চোখে বিষণ্নর ছাপ।

কাক আর কবি কাছের মানুষ বড়ো

মানুষ-পাখি এক খাঁচাতে জড়ো;

সকাল ভরে পূণ্যেতে আর সন্ধ্যে ভরা পাপ,

তবুও ভালো এক খাঁচাতে দুজনে চুপচাপ।

 

শূন্য শহর

এ শহর—

এক মূর্ছিত নর্তকীর

ধূসর কঙ্কাল জনতার মুখে মুখে

রক্তহীন পচা মাংসের স্তূ

পদকপ্রাপ্ত মানবতা

রণোত্তর।

ষোড়শীর আবাদি জমিন

জুড়ে মৃত্যুর প্রকোপ প্রবল

ঊষর ধুলোয় কে ফসল ফলাতে চায়?

বিদগ্ধ সময় কাৎ হয়ে শোয়;

খোঁজে—শূন্য শহর, মানুষ কোথায়?

ভালো নেই কবিতারা

ঠোঁট ভেঙে কেঁদে ওঠা শিশুটির মতো

কবিতারা অভিমানে কেঁদে ওঠে আজ।

ভেজা স্যাঁতস্যাঁতে আবেগের উঠোন জুড়ে বসে

রক্তশূন্য কবিতার বৈঠক।

বিবস্ত্র অন্ধকারে কুৎসিত নেউলের সুরালো চিৎকার,

ভাঙা কুলো, ছাই, মাছের আঁশ আর ডিমের খোসায়

মেলে কবিতার নতুন পোশাক

অথর্ব চিত্তজুড়ে ভয়ানক নেশা লাগে আর নবোঢ়ার

দেহে ভাসে মরা বকুলের গন্ধ; অমৃতের স্বাদ।

কবিতারা ভালো নেই।

শহরের পথে-ঘাটে কবি-কাক

চোখ বুজে হাঁটে। ওড়ে। শতচ্ছিন্ন পাখনা জুড়ে

বিষাক্ত নেউলের চিহ্ন—নখের, দাঁতের আর নিঃশ্বাসের।

কী বীভৎস ভালো লাগা! কালের গায়ে লেপ্টে থাকা

আধুনিক গঞ্জিকা-শৈলীর মোহনীয় টান।

কবিতারা ভালো নেই।

ঠোঁট ভেঙে কেঁদে ওঠা শিশুটির মতো

কবিতারা অভিমানে কেঁদে ওঠে আজ।

ভেজা রোদ্দুরে স্নান করে কবি-কাক

ভাঙা ডানা থেকে মুছে ফেলে রক্তের দাগ।

কবিতারা ভালো নেই। ভালো নেই।

দন্ত্য-স সজীব
কবি

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top