শব্দকুঞ্জ ঈদসংখ্যা
জাফর সাদেক এর একগুচ্ছ কবিতা
জাফর সাদেকএর একগুচ্ছ কবিতা
মেহেদি দিবস
রাতের জানালার ওপারে কেউ আসে রোজ
বলে যায়, কেন জন্মাও আমার মতো নিরেট পাথর
জাগ্রত, অথচ শীতের নদীর মতো নীরব শীতল
জানালার ওপারে মৃত্যুর পাথর ছাড়াও
মাটির কষ্টকে মুছে দিতে জন্মেছে অনেক শিমুল
ফুল ফোটার মৌসুম এলে যে ডেকে যায় অবিরাম
সেই কোকিলের কাছে পৃথিবী রক্তহীন ফুলেল লাল
জানালার ওপারে মেঘেদেরও
ভেজা–অভ্র–কালো এমন সব এলোমেলো যাতায়াত
আছে, বিরহের পর সঙ্গমে আপ্লুত হবার অনুপ্রাস
জানালার ওপারে হাজার তরুণীর জন্য
জন্মেছে মেহেদি গাছ, ওদের
বুকের মৃত্তিকায় প্রতিদিনই মেহেদি দিবস
সবুজের আবরণের আড়ালে এক সাগর লাল ঢেউ
আমি বলবো, মৃত্যু না লাল না সবুজ
জানালার ওপাশে মৃত্যুর কাছে তবুও জন্মের লোভ
প্রথম সমুদ্র দেখা
যেন এক ফালি আকাশ হয়ে নির্জন সৈকতে নেচে যাচ্ছো
এই দৃশ্যে তুমি এখন আমার রাত ও স্বপ্ন
মুগ্ধ হয়ে তোমার নূপুর ছুঁয়ে যাচ্ছে দুখি ঢেউ
নাকি পায়ের সুন্দরে চুম্বন রেখে যায় জলের প্রেমিক
তোমার কাঁকনের সুরে মুগ্ধতায় প্রতীক্ষার মেঘ
নাকি কোথাও ভুল হচ্ছে আমার
কোথাও ভুল হচ্ছে বলে
তোমার কোমর ছন্দে ডাকছে ঝরনার বিভ্রম
ধরে নিই এখনও সময় আছে তোমায় অবগাহন
প্রসারিত হাতের ঢেউয়ে প্রসবী মেঘ, ভিজিয়ে
মুছে দিচ্ছে কতকিছু নীলাভ গোপনে
তোমার দেহের বাঁকে বাঁকে তখন সমুদ্রের দুয়ার
এসময় এক সাহারা বুকে নিয়ে
কেন ছুটে আসা উচিৎ তোমার সমর্পণে
সেই যে কবে মরুর ওষ্ঠে ছেড়েছি ঘর— সময় হয়েছে
জানতে চাই এখন, ঝিনুকের সঙ্গম রেখা কতটা অতল
তৃষিত জীবন দেখে ভেবো না, বলতে এসেছি— ভালোবাসি
জানাতে এসেছি সমুদ্র দর্শন এই প্রথম
চশমা
যে–মানুষ তুমি দেখছো সে এক বিভ্রম ডাকঘর
মায়ার আবরণে— ভুল চোখ, ভুল পত্রযোগ
কখনও ভুল অবগাহন
ওটা লবণের হ্রদ জেনেও স্নানে প্রতিদিন খোঁজো গোলাপ
কুহক দর্পণ— বেলা–অবেলায় ভুল অভ্যাস
মিলিয়ে নাও— ওই দূরের পথ হয়ে যে যায়
গভীর দৃষ্টি ফেলে দেখার আগেই সে হারায়
আরেক জন্মান্তরের মতো আলোছায়ার ঘোর
বনের হরিণীর চোখ যেমন এক পলকের আপন
ওখানে অনেক সহজ কবিতা না পাঠ করা
অবিশ্বাস্য সময়
আমরা কেবল সরল অক্ষর পাঠের ইচ্ছায়
সময় থেকে সময় জটিল জটিল লেন্সের
নানান ফ্রেমের চশমা পাল্টাই
ভুল–ডাকপিয়ন
তরুণী জানতো ভীষণ খেয়ালি হেমন্তের শিশির
শীতের আগে ফোটাবে মথুরাফুল
তার জানালায়, সন্ধে একঝাঁক তারায় আসবে
পথের ইশারা শেখাতে
কোথাও রাতের বন্দনা নিয়ে গাইবে প্রেমিক ডাহুক
তখন মেলে ধরবে সে বুকের ভেতরের শিউলিগাছ
বিকেলের সূর্য সরিয়ে হৃদয়ে লালিত পুকুরে ভাসবে
লজ্জার পূর্বরাগ
তরুণীর একবার বন্দনার পরিবর্তে
উড়াল ওড়নায় চাইলো বেদনা নির্ভর সুখ
তার দুয়ারে এবার এক আকাশ মেঘ
সব প্রসবী মেঘে হয়না বৃষ্টির বৈশালি কূজন
বজ্রের ঘরে রেখে আসতে হয় শরীরের রক্তাক্ত অলিগলি পথ
জানি, তরুণী খণ্ড খণ্ড হতে রোজ চিঠি দেয় বজ্রের কাছে
আমি কিন্তু বৃষ্টির জন্য অপেক্ষা করি— ভুল–ডাকপিয়ন
জাফর সাদেক
১৯৬২ সালের ২৮ নভেম্বর পাবনা জেলার পাকশী শহরে জন্মগ্রহণ করেন কবি জাফর সাদেক। নদীর পাড়ের শহরে বেড়ে ওঠা বিধায় পদ্মা তার কবিমনকে কল্লোলিত করতে পেরেছিলো দারুণভাবে। ছেলেবেলা থেকেই কবিতার প্রতি তার তীব্র আকর্ষণ। কিন্তু কবি নিজেই তার কাব্যময় জীবনকে দুটো পর্বে ভাগ করতে ইচ্ছুক। প্রথম পর্ব তার ছেলেবেলার কাঁচা হাতের খসড়া। তবে সেসময়টা তিনি কবিতা লিখার চেয়ে কবিতাকে খুঁজে বেড়ানোয় বেশি মনোযোগী ছিলেন। এমনকি মাঝে কাব্য খুঁজে পাওয়ার এ অন্বেষণে ভাটাও পড়েছিলো। কেননা পেশা হিসেবে তিনি বেছে নিয়েছিলেন চাকরিকে। ১৯৮৯ সালে জার্মান ভিত্তিক একটি বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান ‘বেয়ার ক্রপ সায়েন্স লিমিটেড’ এ সিনিয়র ম্যানেজার পদে নিয়োজিত ছিলেন। নিজের পেশার প্রতি পূর্ণ সম্মান থেকেই হয়তো বা কবিতাকে ছুটি দিয়েছিলেন। তবে তার পোস্টিং হয়েছিলো মেঘনা পাড়ের আরেক অঞ্চল বরিশালে। তাই ঐ আগুনমুখা কিংবা কালমেঘার কাছেই কবি আশ্রয় চাইতেন। কিন্তু কবিতাকে পূর্ণরূপে পেয়েছিলেন ১৯৯৯ সালের কিছু পরে, এখান থেকেই দ্বিতীয় পর্ব শুরু। ১৯৯৯ সালের ১৩ জুলাই এক রোড অ্যাকসিডেন্টে কবির ডান পায়ে ফ্রাকচার হয়। এই ক্ষণিকের অবসরই মূলত তাকে কবিতার আরো কাছে নিয়ে যায়। জাফর সাদেক এর বই সমূহ বলতে আমরা পাঠকেরা বুঝে থাকি কিছু অমলীন কবিতার বই। তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ পায় ২০০৬ সালে যার নাম ছিলো ‘তাঁকে ছোঁয়া যেন ঈশ্বর ছুঁয়ে থাকা’। এছাড়াও তাঁর শিল্পকর্মে স্থান পেয়েছে আরো চারটি কবিতার বই ও একটি প্রবন্ধগ্রন্থ। জাফর সাদেক এর বই সমগ্র এর মাঝে উল্লেখযোগ্য হলো ‘হাজং যুবতীর চুরুট’, ‘মন্ত্র নই তৃষার আঙুল’, ‘দম–যোগিনীর তাল’, ‘তিমির নীরে অবগাহন’, ‘আমার সোনার বাংলা ক্রান্তিকালের সংকট’। বই আকারে বের হওয়ার পাশাপাশি তাঁর কাব্যগ্রন্থে স্থান পাওয়া প্রায় সব কবিতাই পূর্বে নানা জাতীয় দৈনিকের সাময়িকী ও সাহিত্য ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়েছিলো।