শব্দকুঞ্জ ঈদসংখ্যা
রম্যগল্প
কথোপকথনে নাসিরুদ্দিন হোজ্জা
শফিক হাসান
রম্যগল্প
কথোপকথনে নাসিরুদ্দিন হোজ্জা
শফিক হাসান
নাসিরউদ্দিন হোজ্জাও এসেছেন বাংলাদেশে। টাইম মেশিনটা তিনি কোত্থেকে সংগ্রহ করেছে তা জানা যায়নি অবশ্য! স্বপ্নে ভেসে, কল্পনার ডানায় উড়ে তার সাক্ষাৎকার গ্রহণ করা হয়েছে। শোনা যাক প্রিয়–অপ্রিয় বচন–
কেমন আছেন– এমন প্রশ্ন করে বিব্রত করতে চাই না। কেমন চলছে আপনার?
চালিয়ে নিলে সবই চলে যায়। আমার আর কী। দুদিনের অতিথি। তোমাদের একটি বিষয়ে আমার ভারি আশ্চর্য লাগছে। এ ধরনের প্রায় সবাই এক বাক্যে বলে দাও, ভালো আছি। আজ পর্যন্ত কাউকে বলতে শুনিনি ‘খারাপ আছি’। তোমাদের সাংবাদিকরাও কেমন–মৃত্যুপথযাত্রী ব্যক্তিকে প্রশ্ন করে– এ মুহূর্তে আপনার অনুভূতি কী! তবে আমার অনুভূতি খুব একটা সুবিধার নয়। দেমাগও ঠিক নেই!
বাংলা মুলুকে এসেছিলেন ইবনে বতুতা। তিনি এ দেশের পুকুরভরা মাছ, গোয়ালভরা গরুর প্রশংসা করেছিলেন। এ ক্ষেত্রে আপনার মন্তব্য কী? কেমন লাগছে এই সময়ের বাংলাদেশ?
কীসের সঙ্গে কী পান্তাভাতে ডালডা ঘি। এখন তো তোমাদের উন্নয়নের গতিপথ পাল্টে গেছে। শত কোটি টাকার মালিক সৃষ্টি হয়েছে হাজারে হাজারে। কালো টাকার ঝনঝনানিতে চেহারার চেকনাই বেড়েছে অনেকের। ভুঁড়ি উপচে তেল গড়াচ্ছে। পুকুরভরা মাছের গল্প এখন রূপ নিয়েছে কাতলা, রাঘববোয়ালে। প্রায়ই শোনা যায়, অসার তর্জন–গর্জনÑ রুই–কাতলারাও জালে আটকাচ্ছে, রাঘববোয়ালদেরও ছাড় নয়। এসব হুঁশিয়ারির ফলে কাগজে তাদের ছবি ছাপা হয়, টেলিভিশনের পর্দায় জানানো হয় ঠিকুজিÑ তারা হয়ে ওঠে আরও ‘জনপ্রিয়’। এই যদি হয় অবস্থা, তাহলে বলিÑ মেষ রে মেষ, তুই আছিস বেশ!
জনশ্রুতি আছে– আপনার জন্ম তুরস্কে। জন্মদিন উপলক্ষে আন্তর্জাতিক উৎসব হয়। এদিকে আজারবাইজান, আফগানিস্তান, ইরান, উজবেকিস্তানের নাগরিকরা আপনাকে নিজেদের দেশের নাগরিক হিসেবে ধরে নিয়েছে। এমনকি চীনও বলছে– আপনি নাকি উইঘুরের বাসিন্দা ছিলেন! বিভ্রান্তি কেন?
তারিখ নিয়ে কত ক্যাচাল! একজনের মৃত্যুদিুনে অন্যজন জন্মোৎসব পালন করেন! আমাকে যদি বিভিন্ন দেশ নাগরিকত্ব দিয়ে দেয়– সেটা তো ভালোই। রোহিঙ্গাদের অবস্থান নিয়ে এখন বাংলাদেশে যে জটিলতা চলছে– তাতে নিশ্চয়ই সংশ্লিষ্টরা বুঝতে পারছে একটি দেশের ঠিকানা থাকা কত জরুরি। এদিক দিয়ে আমি সৌভাগ্যবান– না চাইতেই পাচ্ছি বিশ্ব নাগরিকের মর্যাদা। প্রয়োজনে যদি মিয়ানমারে যাই, তারাও হয়তো আমাকে ফেরাবে না!
পাগড়ি পরে আপনি গাধার পিঠে চড়তেন। এখন পাগড়ি বা গাধা কোনোটাই দেখছি না যে?
চারপাশে মানুষের নির্বুদ্ধিতা দেখে পাগড়ি পরা বাদ দিয়েছি। মাথাই যদি না থাকে তবে পাগড়ি পরে সুরক্ষা দেব কেন! বর্তমানে চারপাশে যে পরিমাণ গাধা গিজগিজ করছে, তাতে নতুন করে আরেকটা গাধা আমদানি করতে মন সায় দেয় না! হেঁটে হেঁটে রঙ্গ দেখি।
আপনি ছিলেন বিচারক বা কাজী। অন্যদিকে আপনার নামে প্রচলিত গল্পগুলোর কোনোটিতে আপনাকে দেখা যায় চালাক হিসেবে। কোনোটিতে বোকা। কথা হচ্ছে, সত্যিকার অর্থে আপনি কী?
হাসালে হে। বোকা মানুষ কি অপরাধীর বিচার করতে পারে? আর আমার গল্প বলতে বর্তমানে নির্জলা কিছু নেই। এখানে তোমরা গোপাল ভাঁড়, বীরবল প্রমুখের গল্প মিশিয়ে আমার নামে চালিয়ে দিচ্ছ। ভেজালে তোমরাই বিশ্বসেরা। অনেক ব্যবসায়ী আসল পণ্যে ভেজাল মিশিয়ে বাড়তি মুনাফার পথ খুলেছে। তা খেয়ে যে মানুষ মারা যাচ্ছে, দুরারোগ্য ব্যাধিতে ভুগছে– ঠুলি পরা বিবেকে তোমরা এসব দেখেও দেখ না, বুঝেও বোঝ না!
রসরচনা বলা না গেলেও রসসাহিত্যে আপনি বড় একটি স্থান দখল করে আছেন। আপনার পূর্বপুরুষদের কেউ কি দখলদার ছিল? যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের মতো প্রভাবশালী কেউ…?
রসের কথা মনে করিয়ে দিয়ে তো আবার বিপদ বাড়ালে! বাংলাদেশে নিপা ভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকি দেখা নাকি দেখা যায় মাঝে–মধ্যে! এতে চিকিৎসাসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো খুশিতে বাকবাকুম করছে– মোটা টাকা উপার্জনের আশায়। এদিকে আজ সকালে আমি লোভ সামলাতে না পেরে এক গ্লাস তাজা রস খেয়ে ফেলেছি। তাতে বাদুড়ের লালা মিশে ছিল কিনা ভাবতেই বমি আসার উপক্রম হচ্ছে। ওয়াক…. ওয়াক…
গোপাল ভাঁড়, বীরবলের গল্পের সঙ্গে আপনার গল্পের মৌলিক পার্থক্য কী?
এত মিল–অমিল খুঁজে ব্যতিব্যস্ত হওয়ার কী দরকার! তোমাদের দেশে এখন নাকি একজনের গল্প আরেকজনের নামে চালিয়ে দেওয়ার কুসংস্কৃতি চালু হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শ্রেণির শিক্ষকও নাকি নামের আগে ডিগ্রির সঙ্গে বিন্দু বসানোর লোভে অন্যের লেখাকে নিজের গবেষণা কম্ম বলে চালিয়ে দিচ্ছেন! ফেসবুকেও একজনের কবিতা আরেকজন চুরি করে নিজের নামে ‘ছাপিয়ে’ দিচ্ছে! তোমাদের লজ্জা করে না? চুরি–চামারি করে আর কতদিন চালাবে?
আপনার আমলে তো গাধা–ঘোড়ার পিঠে চড়ে যাতায়াত করতে হতো। এখন ঢাকা শহরে দোতলা বাস, এসি বাসও চলছে। এ অগ্রগতিকে কীভাবে দেখছেন?
যেখানে কোনো গতিই নেই– তার নাম অগ্রগতি? হাসালে ছোকরা, ফাঁসালে! সড়ক আইনের কয়টা ধারা বাস্তবায়ন করতে পেরেছ! একদিকে জš§নিয়ন্ত্রণের কথা বলা হচ্ছে– অন্যদিকে সড়কে আকছার মানুষ মরছে। রাস্তাঘাটেই যদি এত মানুষ মারা যাবে তাহলে জন্মনিয়ন্ত্রণ করে কী লাভ! পরিবহন মালিক–শ্রমিকদের হাতেই তো জন্মনিয়ন্ত্রণের ভার ছেড়ে দিয়ে বসে আছ! তারা কমাতে কমাতে জিরো টলারেন্সে নিয়ে আসবে!
আপনার জন্মস্থান তুরস্কের পেঁয়াজ বাংলাদেশেও আমদানি হয়। পেঁয়াজগুলো স্বাদ–গন্ধ–বর্ণহীন কেন?
নিজেদের লাজ–লজ্জা, বিবেকবোধ যদি নরকের গুহায় রপ্তানি করে দাও, উচ্চমূল্যে আমদানি করা পেঁয়াজই কিনে খেতে হবে। পেঁয়াজকে তোমরা বিমানে চড়াতে পার ঠিকই; কিন্তু সিন্ডিকেট চক্র–কারসাজিকারীদের শূলে চড়াতে পার না! পতিত জমিতে নিজেরা চাষ বাড়াতে পার না? পেঁয়াজ না খেয়ে অক্ষমতার বড়ি খাও– কাজে দেবে।
ঈশপের গল্পের মতো নীতিকথা, খনার বচনের মতো শিক্ষণীয় ‘কবিতা’ আপনার কাছে পাইনি কেন?
তার আগে চাওয়াটাকে পরিশুদ্ধ কর। তোমরা জানো না– কী চাইতে হয় আর কী চাইতে হয় না! রাজনীতিকে আটকে রেখেছ মিথ্যাচারের মধ্যে। অপঘাতে কেউ মারা গেলেও তিনটি রাজনৈতিক দল লাশকে নিজেদের দলের কর্মী দাবি করে টানাটানি শুরু করে দেয়। যাই বাপু এবার, তোমাদের বিশ্বাস নেই। কখন কী বিপদে ফেলে দাও ঠিক নেই। হোজ্জা কারও বোঝা হতে চায় না!
কিছু খেয়ে গেলে ভালো হতো না?
পাগল নাকি! তোমাদের সব খাবারেই তো শুনি ভেজাল। আমাকে ভেজাল খাবার দিয়ে মারতে চাও নাকি! আমি বরং যাই; খুঁজি গিয়ে টাইম মেশিনের চালক কোন দিকে গেছে!